ওহাবী ফেরকার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১২৮ঃ সংক্ষিপ্তাকারে ওহাবী সম্প্রদায়ের পরিপূর্ণ অবস্থা এবং তারা কতভাগে বিভক্ত হয়েছে তা যথাযথভাবে বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ عليه التكلان وهو المستعان ওহাবী একটি দল বা সম্প্রদায়ের নাম। যার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব। যিনি নজদের উআইনিয়া এলাকায় ১৬৯১ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অনেক কষ্ট করে তাকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। তারপর তিনি মক্কা মুয়ায্যমা ও বসরা শহরে গিয়ে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। সিহাহ সিত্তাসহ বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর তাঁর পিতার সঙ্গে মক্কা শরীফে হজ্বব্রত পালন করেন এবং মদীনা তাইয়্যেবা যিয়ারত শেষে শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীমের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং এক বছর পর্যন্ত তার থেকে ফিক্বহ্ শাস্ত্র শিক্ষা করেন। অতঃপর নিজ দেশে ফিরে যান এবং সেখানকার মুজতাহিদ হন। তিনি প্রকাশ্যভাবে ইসলামী শরীয়তের অনুসরণ এবং এর মূলনীতিতে কোন ধরনের প্রার্থক্য করেন নি। কিন্তু যে সকল লোক ফাল (গণনা করে ভবিষ্যতের কথা বলা) দেখতেন, শগুন (শুভাশুভের নিদর্শন) মানতেন, মাযারসমূহকে সুসজ্জিত ও সম্মান করতেন, তামাক ব্যবহার করতেন এবং রেশমি কাপড় পরিধান করতেন তাদেরকে খারাপ বলতেন। কেননা এগুলো রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর শরীয়তের পরিপন্থী। কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ পাঠ করে তিনি ধারণা করেন যে, শরীয়তের মূলনীতিতে বিভিন্ন অবস্থার সংমিশ্রণের কারণে বিশাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। তখন তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন যে, মানুষদেরকে বিশেষ নিয়ম এবং ইসলামী শরীয়তের বিধান ও নীতিমালা এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিক্ষা দিয়েছেন এবং আমল করেছেন। তার মতে, দুনিয়ার সকল মুসলমান পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। যে সকল পীর আউলিয়া-ই কিরামের কথা ও কাজের অনুসরণ করছে, তারা এ প্রথা নিজেদের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই প্রচলন করতেছে।
তিনি ইমাম চতুষ্টয়ের আনীত নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছেন। কেবল পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফকে নিজের রাহনুমা বা পথপ্রদর্শক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। লোকেরা তার কথা মেনে তার অনুসৃত নীতি অনুসরণ করতে লাগলো। যখন তার সঙ্গে আরো অন্যান্য দল একত্রিত হলো, তখনকার গভর্ণরের সঙ্গে মতবিরোধ হয়। অবস্থা জটিল ও বেগতিক দেখে তিনি তখনকার দরিনার প্রভাবশালী নেতা মুহাম্মদ বিন সউদ-এর নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইবনে সউদের সহযোগিতায় ওহাবী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। দরিনার শাসক নতুন মাযহাবের উদ্ভাবকের সঙ্গে বংশীয় আত্মীয়তার বন্ধন স্থাপন করে তাকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন। দরিনার এই নেতার পুত্র আবদুল আজিজ একজন প্রসিদ্ধ ওহাবী হন। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে যখন ইবনে আবদুল ওহাব ও দরিনার নেতার ইন্তিকাল হয়, তখন আবদুল আজিজ তাদের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ওহাবী জামাআতকে আরো শক্তিশালী ও অগ্রগামী করলেন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ জয় করেন। আবদুল আজীজ বীর সাহসী যোদ্ধা ছিলেন না। ১৮০৩ খ্রীস্টাব্দে এক ইরানী তাকে হত্যা করেন। তারপর আবদুল আজীজের বড় সন্তান সউদ তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তুমুল যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। তিনি সমস্ত তুর্কী সম্রাজ্য জয় করার সংকল্প করেন এবং যুদ্ধ কৌশল অবলম্বনে কোন আপোষ করতেন না। তিনি বাল্যকাল থেকেই তরবারী হাতে নেন। সে বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ‘কারবালায়ে মুআল্লা’তে আক্রমণ করেন এবং সেখানকার কাফির ও মুশরিকদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। ইমামে হুম্মাম সৈয়্যদুশ শুহাদা আমীর হামযা আলাইহিস সালামের পবিত্র রওজা মুবারকের প্রতিও কোন ধরনের আদব ও সম্মান প্রদর্শন করেনি। নগদ টাকা, মণি-মুক্তা ও খনিজ সম্পদ সহ যা কিছু রওজা শরীফে সংরক্ষিত ছিল সব ওহাবীরা নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী বৎসর মক্কা অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ওহাবী মতবাদ ও রীতি-নীতি চালু করে দেয়। হুক্কা, তাসবিহ, তাবিজ এবং রেশমী কাপড়ের টুকরোগুলো জোরপূর্বক সকল থেকে কেড়ে নিতেন এবং সকলের সামনে এগুলো জ্বালিয়ে দিতেন। নামাযের সময় হলে শরয়ী লোকেরা চাবুক ও বেত নিয়ে বের হতেন, ফলে লোকজন মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন।
মক্কা মুয়াযযামায় যখন তার মিশন পূর্ণতা লাভ করল এবং একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জিত হল, তখন রোম সম্রাটের নিকট তার বিজয়ী সংবাদের চিঠি এভাবেই লিখে পাঠান যে,
‘সউদের পক্ষ হতে কন্স্টানটিনোপল সরকারের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি ৪ঠা মুহাররম ১২১৮ হিজরী মোতাবেক পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করি এবং সেখানকার অধিবাসীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। আমি এই বরকতময় স্থান হতে ঐ সকল বস্তু অপসারণ করেছি যেগুলোকে মানুষ মূর্তির ন্যায় পূজা করতো। আমি যাবতীয় শুল্ক ও টেক্স মাফ করে দিয়েছি। আমি নবী করীম কর্তৃক প্রবর্তিত সকল নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছি, যা আপনি করেছিলেন। আমার ঐকান্তিক ইচ্ছে যে, আপনি সিরিয়া ও মিশরের গভর্ণরদের নির্দেশ দিবেন যে, সেখানকার লোকেরা যেন ঢোল-তবলা ও বাদ্য-যন্ত্র নিয়ে এখানে না আসে।’
দ্বিতীয় বছর মদিনা মুনাওয়ারায় বিজয়ী লাভ করে। তার মিশন এমন ভাবে পরিপূর্ণতার সাথে পরিচালনা করে যে, এমন কোন সেক্টর বা বিষয় ছিল না- যেখানে তার শাসন ক্ষমতা একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করেনি। এমন কি রাসূলে পাক -এর রওজা মুবারক ও বিশ্রাম স্থল থেকে চাঁদর মুবারক ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নযোগে সুসংবাদ পেল যে, হুযূর রহমতে ‘আলম বলেছেন, সাবধান! এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাক। তাই সে উক্ত মত পরিবর্তন করেন। এখানে দীর্ঘ নয় বছর ইবনে সাউদ শাসন পরিচালনা করেন। ওহাবী দল সংখ্যায় এতো বেশী পৌঁছে গিয়েছিল যে, তুরস্ক সরকারের স্বীয় রাজত্ব হারানোর ভয় হয়। তাই সরকার আলী পাশাকে নির্দেশ দিলেন যে, বাতিল ওহাবী সম্প্রদায়কে পবিত্র স্থান থেকে জোরপূর্বক সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে আক্রমণ করা হোক। আলী পাশা হুকুম মোতাবেক সৈন্য বাহিনী জমায়েত করে তাদের হারামাইন শরীফাইন থেকে বের করে দিলেন। ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দে ইবনে সাউদ মারা গেলে ছেলে আবদুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হন। যদিও সে কুচক্রী ও অসৎ প্রকৃতির ছিলেন কিন্তু যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী ছিলেন না। সব কিছুতেই সন্দেহ পোষণ করতেন। পরিশেষে ইবরাহীম পাশা তাকে গ্রেফতার করে কনস্টানটিনোপলে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। অতঃপর তার পুত্র ফয়সল তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দে মারা যান। তারপর পুত্র আবদুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হয়। অতঃপর ওহাবী দলের সামরিক শক্তি একেবারে হারিয়ে যায়। পরিশেষে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব মনগড়া যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল, তা কিছু সংখ্যক মাযহাবের নেতা অনুসরণ করেছিল।
ওহাবীরা নিজেদেরকে- আহলে হাদীস, আহলে সুন্নাত, মুহাদ্দিস, হাদীস চর্চাকারী ও গবেষক এবং মওয়াহ্হিদ বা একত্ববাদী বলে থাকে এবং তাদের পরিপন্থী ও বিরোধীতাকারীদেরকে বিদ‘আতী বলে। আর আজকাল ওহাবী গাইরে মুকালিদরা, হানাফী মুকালিদ নামে প্রসিদ্ধ।
বর্তমানে এই দলটি বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্বঘোষিত নবী দাবীদার মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারী। কেউ কেউ গোলাম নবী ছকরালভীর মাযহাবের অনুসারী, যারা নিজেদেরকে আহলে কোরআন বলে। তাদের নিকট হাদীস শরীফের কোন মূল্য নেই। তারা প্রত্যেক মাসআলা কোরআন মজিদ থেকে দলিল পেশ করতে চায়। এ সকল অপকর্ম ও ভ্রষ্টতার কারণে তারা তাকলীদ বা মাযহাব ছেড়ে দিয়েছে। ওহাবী ফেরকা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আমার লিখিত ‘সংক্ষিপ্ত নজদি ওহাবীদের ইতিহাস’ গ্রন্থখানা অধ্যয়ন করার অনুরোধ করছি।