উচ্চস্বরে যিকরের বর্ণনা


পাঞ্জাব ও অন্যান্য জায়গায় ফজর ও ইশার নামাজের পর উচ্চেস্বরে দরূদ শরীফ পড়ার রেওয়াজ আছে। বিরোধিতাকারীগণ একে হারাম বলে এবং নানা রকম ফন্দি ফিকিরের মাধ্যমে একে প্রতিরোধ করতে চায়। যেমন তারা বলে উচ্চ স্বরে যিকর করা বিদআত, হানাফী নীতির বরখেলাপ এবং এর ফলে নামাযরত মুসল­ী নামাযে ভুল করে; তাই এটা হারাম। কিন্তু আমাদের অভিমত হলো উচ্চেস্বরে যিকর করা জায়েয বরং কতেক জায়গায় আবশ্যক। অতএব অন্যান্য আলোচনার মত এটাকেও দু’দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে এর প্রমাণ এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দেয়া হয়েছে।

প্রথম অধ্যায়

উচ্চস্বরে যিকর করার প্রমাণঃ

      

উচ্চস্বরে যিকর করা জায়েয। কুরআন, হাদীছ ও উলামায়ে কিরামের উক্তি দ্বারা এটা প্রমাণিত।


❏ কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান-


فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا.


আল্লাহর যিকর এমনভাবে কর, যেমনভাবে তোমাদের বাপদাদাদের যিকর কর বরং তদপেক্ষা বেশী।  ৩১৬

{সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-২০০।}


মক্কার কাফিরগণ হজ্ব সমাপণান্তে একত্রিত হয়ে নিজ নিজ বংশের গুণকীর্তন ও পূর্বপুরুষদের শৌর্য-বীর্য বর্ণনা করতো। আল্লাহ তা’য়ালা একে নিষেধ করেছেন এবং এরস্থলে তাঁর যিকর করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে এটা উচ্চ স্বরেই হয়ে থাকবে। এ জন্যে উচ্চস্বরে তালবিয়া অর্থাৎ লাব্বাইকা পাঠ সুন্নাত, বিশেষ করে বিভিন্ন কাফেলা একত্রিত হবার সময়।


❏ আল্লাহ তা’আলা আরও ইরশাদ ফরমান-


وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ.


-যখন কুরআন শরীফ পাঠ করা হবে, তখন মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং নিশ্চুপ থাকুন। ৩১৭

{সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-২০৪।}


বোঝা গেল যে, উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত জায়েয। নীরবের যিকর নয়, উচ্চস্বরের যিকরই শোনা যায় (তাফসীরে কবীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।


❏ মিশকাত শরীফের الذكر بعد الصلوة অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-


وَعَن عبد الله بن الزبير قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا سَلَّمَ مِنْ صَلَاتِهِ يَقُولُ بِصَوْتِهِ الْأَعْلَى: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ.

হুযুর ﷺ যখন নামায থেকে সালাম ফিরাতেন, তখন উচ্চেস্বরে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ বলতেন।  ৩১৮

{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৩০৪, পৃষ্ঠা-৮৮, হাদিস/৯৬৩, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ১/৪১৫ পৃ,. হা/৫৯৪}



❏ মিশকাত শরীফে সেই জায়গায় আরও উলে­খিত আছে-


عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: كُنْتُ أَعْرِفُ انْقِضَاءَ صَلاَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالتَّكْبِيرِ.


-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে-আমি তকবীরের আওয়াজ থেকে হুযুর আলাইহিস সালামের নামায সমাপ্তি বুঝতে পারতাম।  ৩১৯

{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৩০৩, (ভারতীয় পৃষ্ঠা-৮৮), হাদিস/৯৬৩, ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১/১৬৮ পৃ,. হা/৮৪২}


অর্থাৎ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস কম বয়সের কারণে মাঝে মাঝে মধ্যে জামাতে হাজির হতেন না। এ জন্য তিনি বলেন নামাযের পর মুসল­ীরা এত উচ্চস্বরে তকবীর বলতেন যে, আমরা ঘরের লোকেরা বুঝতে পারতাম যে নামায শেষ হয়েছে।


❏ প্রসিদ্ধ ‘লুমআত’ গ্রন্থে এ হাদীছের প্রেক্ষাপটে উলে­খিত আছে-


ان ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا كان لم يحضر الجماعة لانه كان صغيرا ممن لا يواظب على ذالك.


-হযরত ইবনে আব্বাস ছোট ছিলেন। এজন্যে নিয়মিতভাবে জামাতে হাজির হতেন না।  ৩২০

{শায়খ আব্দুল হক মুুহাদ্দিসে দেহলভী, লুমআত, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২১১।}


❏ মুসলিম শরীফের প্রথম খণ্ড الذكر بعد الصلوة শীর্ষক অধ্যায়ে সেই ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে-


أَنَّ رَفْعَ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ حِينَ يَنْصَرِفُ النَّاسُ مِنَ الْمَكْتُوبَةِ، كَانَ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.


অর্থাৎ ফরযসমূহ থেকে ফারেগ হওয়ার পর উচ্চস্বরে যিকর করা হুযুর আলাইহিস সালামের যুগে প্রচলিত ছিল।  ৩২১

{ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ১/৪০১ পৃ,. হা/৫৮৩}


❏ মিশকাত শরীফে ذكر الله عز وجل শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: ......إِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ، ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلَإٍ، ذَكَرْتُهُ فِي مَلَإٍ هُمْ خَيْرٌ مِنْهُمْ.


-যে ব্যক্তি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি আর যে ব্যক্তি সমাবেশে আমাকে যিকর করে, আমিও তাকে এর থেকে ভাল সমাবেশে (অর্থাৎ ফিরিশতাদের সমাবেশে) স্মরণ করি। ৩২২

{ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ৪/২০৬১ পৃ,. হা/২৬৭৫, ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৯/১২১ পৃ,. হা/৭৪০৫, ইমাম ইবনে মাযাহ, আস-সুনান, হা/৩৮২২, সুনানে তিরমিযি, হা/৩৬০৩, ইমাম নাসাঈ, আস-সুনানুল কোবরা, হা/৭৬৮৩, ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪১২, হাদিস-৯৩৪০।}


❏ জামে সগীরে উলে­খিত আছে হযরত আনাস থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুর ﷺ ইরশাদ ফরমান-


أكْثِرُوا فِي الجَنَازَةِ قَوْلَ لَا إِلَه إلاّ اللَّهُ.


-‘‘জানাযায় لَا إِلَه إلاّ اللَّهُ বেশী করে বলুন। ৩২৩

{ইমাম সুয়ূূতি, জামেউস-সগীর, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৮৭, হাদিস-১৪০৮, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন এবং জামিউল আহাদিস, ৫/৩৭৪ পৃ: হা/৪৩১৬, ইমাম ইবনে আদি, আল-কামিল, শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ১/২১২ পৃ: হা/২৩১৬, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১৫/৬৫০ পৃ, হা/৪২৫৭৮, আজলূনী, কাশফুল খাফা, ১/১৬৫ পৃ:, হা/৪৯৯, আলবানী এই হাদিসটিকে শুধু শুধু যঈফ বলেছেন। (আলবানী, সিলসিলাতুল....যঈফাহ, ৬/৪১৪ পৃ: হা/২৮৮১) আমি এটির জবাব দিয়েছি আমার লিখিত ‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’ গ্রন্থের ৩য় খন্ডে।}


এর থেকে বোঝা যায় যে, জানাযা নিয়ে যাবার সময় কলেমা তৈয়্যবা বা অন্য কোন যিকর উচ্চস্বরে হোক বা নিম্নস্বরে সব রকমের জায়েয আছে।


❏ মৌলভী রশীদ আহমদের হাদীছের উস্তাদ শেখ মুহাম্মদ থানবী রচিত ‘দলায়েলুল আযকার’ (দিল­ী থেকে প্রকাশিত) পুস্তিকার ৭৯ পৃষ্ঠায় উলে­খিত আছে-


ان النبى ﷺ كان يجهر مع الصحابة بالاذكار والتهليل والتسبيح بعد الصلوة.


হুযুর ﷺ নামাযের পর সাহাবায়ে কিরামের সাথে উচ্চস্বরে তসবীহ তাহলীল পড়তেন। তাফসীর রূহুল বয়ানে চতুর্থ পারার আয়াত  ৩২৪

{সূূরা আলে-ইমরান, আয়াত নং-১৯১।}


رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ এর ব্যাখ্যায় উলে­খিত আছে-


الذِّكْر بِرفع الصوت جائز بل مستحب إذا لم يكن عن رياء ليغتنم الناس بإظهار الدين ووصول بركة الذكر الى السامعين فى الدور والبيوت والحوانيت ويوافق الذاكر من سمع صوته ويشهد له يوم القيامة كل رطب ويابس سمع صوته.


-‘‘উচ্চস্বরে যিকর করা জায়েয। বরং মুস্তাহাব, যদি কপটতা না থাকে এবং দ্বীনের প্রচারই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। যিকরের বরকত ঘরে অবস্থানরত শ্রোতাদের কাছেও পৌঁছবে এবং যিনি আওয়াজ শুনে মশগুল হবেন, (তিনিও বরকতের ভাগী হবেন) এবং কিয়ামতের দিন আর্দ্র-শুষ্ক সব কিছু যিকরকারীর ঈমানের সাক্ষ্য দিবে।’’ ৩২৫

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৪৭।}


এর থেকে বুঝা গেল উচ্চস্বরে যিকরে দ্বীনের অনেক ফায়দা আছে।


❏ তাফসীরে খাযেন ও রূহুল বয়ানে ষষ্ঠ পারার আয়াত ৩২৬

{সূূরা বানি ইসরাঈল, আয়াত, ৫৫}


 وَآتَيْنا داوُدَ زَبُوراً এর ব্যাখ্যা প্রসংগে একটি রিওয়ায়েত উদ্বৃত করা হয়েছে। রিওয়ায়েতটা হচ্ছে হুযুর ﷺ সৈয়্যদুনা আবু মুসা আশআরী (رضي الله عنه) কে বললেন আজকের রাত্রে আমি তোমার কোরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনেছি। তোমাকে তো সুমধুর দাউদী কণ্ঠ দান করা হয়েছে। তখন হযরত আবু মুসা আশ’আরী বলেন-


فقلت اما والله لَوْ عَلِمْتُ أَنَّكَ تسمع لخبرته خبيرا- التحبير حَسَنُ الصَّوْتِ.


-‘‘খোদার কসম, যদি আমি জানতাম যে আমার কুরআন তিলাওয়াত সাহেবে কুরআন (ﷺ) শুনেছেন, তাহলে আমি আরও আওয়াজ সুন্দর করে তিলাওয়াত করতাম।’’ ৩২৭

{খতিব তিবরিযি, মিশকাত}


এ হাদীছ থেকে দু’টি বিষয় জানা গেল। একটি হচ্ছে সাহাবায়ে কিরাম উচ্চেস্বরে যিকর করতেন যার আওয়াজ বাহিরে শোনা যেত। অপরটি হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত আল্লারই এবাদত এবং ইবাদতরত অবস্থায় হুযুর আলাইহিস সালামকে সন্তুষ্ট করা সাহাবায়ে কিরামের একান্ত আকাঙ্খা ছিল।


আরব্য কবি কি সুন্দর বলেছেন-


حمامة جرعى خومة الجندل اسجع

فانت بمراى من سواد و مسمعى


(বিয়াবনের কবুতর মনের আনন্দে উচ্চস্বরে গান করছে আর তুমি সোয়ান পাহাড়ের চূড়া থেকে ওকে দেখছ আর তার গান শুনছ।)


❏ মিশকাত শরীফের কিতাবুস সালাত শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে- এক রাত্রে হুযুর ﷺ তাঁর প্রাণপ্রিয় সাহাবায়ে কিরাম রাত্রে কে কি করছেন দেখার জন্য বের হলেন। হযরত সিদ্দীকে আকবর (رضي الله عنه) কে খুব নিম্নস্বরে এবং হযরত উমর (رضي الله عنه) কে খুবই উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখলেন। সকালে তাঁদের কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে হযরত সিদ্দীকে আকবর আরয করলেন-


أَسْمَعْتُ مَنْ نَاجَيْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ.


‘হে আল্লাহর হাবীব (ﷺ), যাকে শোনানো আমার অভিপ্রায় ছিল, তাকে অর্থাৎ আল্লাহকে শুনিয়েছি।’


❏ হযরত উমর ফারুক (رضي الله عنه) আরয করলেন-


أُوقِظُ الْوَسْنَانَ وَأَطْرُدُ الشَّيْطَانَ.


ঘুমন্তদেরকে জাগাতে ছিলাম এবং শয়তানকে তাড়াতে ছিলাম।’


সুবহানুল্লাহ! উভয়ের উত্তর মনঃপুত হলো, কারো প্রতি তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি বরং হযরত সিদ্দীক আকবরকে বললেন, ‘তুমি আওয়াজ আরও একটু বড় করবে’ এবং হযরত উমর ফারুককে বললেন ‘তুমি আওয়াজ’ একটু ছোট করবে’। ৩২৮

{সুনানে আবি দাউদ, ২/৩৭ পৃ: হা/১৩২৯, সুনানে তিরমিযি, ১/৫৬৯ পৃ: হা/৪৪৭, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৩৭৭ পৃ: পরিচ্ছেদ: بَاب صَلَاة اللَّيْل , হাদিস/১২০৪}


মিশকাত শরীফে কিতাবুল আসমায়ে তা’আলায় ‘হযরত বরিয়া (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে-একবার আমি হুযুর আলাইহিস সালামের সাথে ইশার নামাযের সময় মসজিদে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম এক ব্যক্তি খুবই উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। আমি হুযুর আলাইহিস সালামের কাছে আরয করলাম ‘হে আল্লাহর হাবীব, এটা ভণ্ডামি মাত্র’।


❏ হুযুর ইরশাদ ফরমালেন


لَا، بَلْ مُؤْمِنٌ مُنِيبٌ


-‘‘না, সে তওবাকারী মুমিন।’’  ৩২৯

{ইমাম নাসাঈ, আস-সুনানিল কোবরা, ১০/১২৯ পৃ: হা/১১১৮০, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ২/৭০৯, কিতাবু আসমাউল্লাহি তায়ালা, হাদিস/২২৯৩}


❏ ফত্ওয়ায়ে আলমগীরী কিতাবুল কারাহিয়ার চতুর্থ অধ্যায়ে -


الْبَاب الرَّابِع فِي الصَّلَاة وَالتَّسْبِيح وَرَفَعَ الصوت عِنْد قِرَاءَة الْقُرْآن

শীর্ষক আলোচনায় উলে­খিত আছে-


قَاضٍ عِنْدَهُ جَمْعٌ عَظِيمٌ يَرْفَعُونَ أَصْوَاتَهُمْ بِالتَّسْبِيحِ وَالتَّهْلِيلِ جُمْلَةً لَا بَأْسَ بِهِ.


-‘‘কোন কাযীর দরবারে যদি বড় জমায়েত হয় এবং সবাই মিলে যদি দরূদ পড়ে, তাতে কোন ক্ষতি নেই।’’  ৩৩০

{নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩১৫।}


❏ একই জায়গায় আলমগীরীতে আরও উলে­খিত আছে-


الْأَفْضَلُ فِي قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ خَارِجَ الصَّلَاةِ الْجَهْرُ.


-নামায ছাড়া অন্যান্য সময় উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করা ভাল।৩৩১  

{নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩১৬।}


❏ উক্ত ফাত্ওয়ার কিতাবে একই জায়গায় আরও বর্ণিত আছে-


وَأَمَّا التَّسْبِيحِ وَالتَّهْلِيلِ لَا بَأْسَ بِذَلِكَ، وَإِنْ رَفَعَ صَوْتَهُ، كَذَا فِي الْفَتَاوَى الْكُبْرَى.


অর্থাৎ ‘সুবহানাল্লা’ বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই, যদিওবা উচ্চস্বরে বলা হয়। ৩৩২

{নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩১৬।}


❏ ফাতওয়ায়ে শামীর প্রথম খণ্ডে ------------------ এর বর্ণনার সাথে বর্ণিত আছে-


وَفِي حَاشِيَةِ الْحَمَوِيِّ عَنْ الْإِمَامِ الشَّعْرَانِيِّ: أَجْمَعَ الْعُلَمَاءُ سَلَفًا وَخَلَفًا عَلَى اسْتِحْبَابِ ذِكْرِ الْجَمَاعَةِ فِي الْمَسَاجِدِ وَغَيْرِهَا إلَّا أَنْ يُشَوِّشَ جَهْرُهُمْ عَلَى نَائِمٍ أَوْ مُصَلٍّ أَوْ قَارِئٍ.


-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উলামায়ে কিরাম এ বিষয়ে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন যে, মসজিদ সমূহে সমবেতভাবে উচ্চস্বরের জন্য যেন কোন বিশ্রামকারী বা নামাযী বা তিলাওয়াতকারীর অসুবিধা না হয়।৩৩৩  

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রদ্দুল মুহতার, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৬০।}


❏ শামীতে একই জায়গায় আরও উলে­খিত আছে-


فَقَالَ بَعْضُ أَهْلِ الْعِلْمِ: إنَّ الْجَهْرَ أَفْضَلُ لِأَنَّهُ أَكْثَرُ عَمَلًا وَلِتَعَدِّي فَائِدَتِهِ إلَى السَّامِعِينَ، وَيُوقِظُ قَلْبَ الذَّاكِرِ فَيَجْمَعُ هَمَّهُ إلَى الْفِكْرِ، وَيَصْرِفُ سَمْعَهُ إلَيْهِ، وَيَطْرُدُ النَّوْمَ، وَيَزِيدُ النَّشَاطَ.


-কতেক উলামা বলেন- উচ্চস্বরে যিকর করা আফযল। কেননা এতে শ্রম বেশী এবং যারা শুনেন, তাদের কাছেও এর ফায়দা পৌঁছে থাকে। এটা অমনোযোগীদের আত্মাকে জাগ্রত করে, তাদের ধ্যান ধারণা ও শ্রবণ শক্তিকে খোদার যিকরের দিকে আকর্ষণ করে, তন্দ্রা দূরীভূত হয় এবং আনন্দ বৃদ্ধি পায়। ৩৩৪

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রদ্দুল মুহতার, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৬০।}


❏ দুররুল মুখতারে সালাতুল ঈদাইন অধ্যায়ে تكبير  تشريق শীর্ষক আলোচনায় উলে­খিত আছে-



وَلَا يُمْنَعُ الْعَامَّةُ مِنْ التَّكْبِيرِ فِي الْأَسْوَاقِ فِي الْأَيَّامِ الْعَشْرِ وَبِهِ نَأْخُذُ


ঈদুল আযহা এর প্রথম দশ দিন সাধারণ মুসলমানদেরকে বাজারে নারায়ে তকবীর দেওয়া থেকে বাধা দিও না। আমরা তা পছন্দ করি। সম্ভবতঃ তখনকার যুগে সাধারণ লোকেরা ঈদের সময় বাজারে নারায়ে তকবীর দিতেন। যদিও বা এটা বিদআত কিন্তু বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে বাধা দিও না।’  ৩৩৫

{হাসকাফী, দুররুল মুখতার, ১/১১৭ পৃষ্ঠা, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রদ্দুল মুহতার, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৮০}


❏ এ ইবারতের প্রেক্ষাপটে শামীতে উলে­খিত আছে-


فِي الْمُجْتَبَى قِيلَ لِأَبِي حَنِيفَةَ يَنْبَغِي لِأَهْلِ الْكُوفَةِ وَغَيْرِهَا أَنْ يُكَبِّرُوا أَيَّامَ الْعَشْرِ فِي الْأَسْوَاقِ وَالْمَسَاجِدِ قَالَ نَعَمْ وَذَكَرَ الْفَقِيهُ أَبُو اللَّيْثِ أَنَّ إبْرَاهِيمَ بْنَ يُوسُفَ كَانَ يُفْتِي بِالتَّكْبِيرِ فِيهَا قَالَ الْفَقِيهُ أَبُو جَعْفَرٍ: وَاَلَّذِي عِنْدِي أَنَّهُ لَا يَنْبَغِي أَنْ تُمْنَعَ الْعَامَّةُ عَنْهُ لِقِلَّةِ رَغْبَتِهِمْ فِي الْخَيْرِ وَبِهِ نَأْخُذُ اهـ فَأَفَادَ أَنَّ فِعْلَهُ أَوْلَى.


-ইমাম আবু হানীফা (رضي الله عنه) থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে কুফাবাসী ও অন্যান্য এলাকার লোকেরা যিলহজ্ব মাসের দশ দিন পযর্ন্ত বাজার ও মসজিদ সমূহে যে তকবীর বলে, তা মুস্তাহাব কি না। তিনি বলেছেন, হ্যাঁ। ইমাম আবু জাফর (কুঃ সিঃ) তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে সাধারণ লোকদেরকে এ তকবীর বলা থেকে বাধা দেয়া উচিত নয়। কেননা ওরা এমনিতে ভাল কাজের প্রতি কম আগ্রহী। এ অভিমতটা আমরা গ্রহণ করি। এর থেকে বোঝা গেল বাজারের তকবীর মুস্তাহাব। ৩৩৬

{➥336. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রদ্দুল মুহতার, ➥খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৮০}


❏ ইমাম নববী (رحمة الله) রচিত ‘কিতাবুল আযকার’ গ্রন্থে في رَفْعِ الصَّوْتِ بالصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم শীর্ষক আলোচনায় উলে­খিত আছে-


يُستحب لقارئ الحديث وغيره ممّن في معناهُ، إذا ذُكر رسولَ الله صلى الله عليه وسلم، أن يرفَعَ صوتهُ بالصلاة عليه والتسليم......وقد نصَّ العلماء من أصحابنا وغيرهم أنه يُستحبّ أن يرفع صوته بالصلاة على رسول الله صلى الله عليه وسلم في التلبية.


-‘‘হাদীছ শরীফ ইত্যাদি অধ্যয়নকারীদের উচিত যে যখন হুযুর আলাইহিস সালামের আলোচনা হয়, তখন যেন উচ্চস্বরে সালাত ও সালাম পাঠ করে। আমাদের উলামায়ে কিরাম তলবিয়া অর্থাৎ লাববাইকা বলার সময় উচ্চেস্বরে দরুদ শরীফ পড়ার কথা বলেছেন।’’  ৩৩৭

{➥337. ইমাম নববী, কিতাবুল আযকার, ২২৫ পৃ:}


এগুলো ছাড়া আরও অনেক হাদীছ ও ফকীহগণের উক্তি উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু বক্তব্য সংক্ষেপ করার জন্য এতটুকু যথেষ্ট মনে করলাম। খোদার শুকরিয়া যে বিরুদ্ধ বাদীদের অগ্রদূত মৌলভী রশীদ আহমদ ছাহেবও এ ব্যাপারে আমাদের সাথে একমত। যেমন ফাত্ওয়ায়ে রশিদিয়ার তৃতীয় খণ্ড كتاب الخطر والاباحة এর ১০৪ পৃষ্ঠায় একটি প্রশ্ন উত্তর আছে। প্রশ্নটা হচ্ছে “যিকর দুআ ও দরূদ উচ্চস্বরে বেশী বা কম উচ্চস্বরে হোক, পাঠ করা জায়েয আছে কিনা? উত্তর- যে সমস্ত জায়গায় উচ্চস্বরে যিকর করার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে, যে সব ব্যতীত উচ্চস্বরে যিকর করা ইমাম আবু হানীফার মতে মাকরূহ। কিন্তু সাহেবাইন (ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ) ও অন্যান্য ফকীহ ও মুহাদ্দিছগণের মত জায়েয। আমাদের গুরুজনদের কাছে সাহেবাইনের মতামতই গ্রহণীয়।”


مدعى لاكهپه بهارى هے گواهى تيرى.


অর্থাৎ লক্ষ প্রমাণাদির থেকে তোমার সাক্ষ্যই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।


এখন আর কোন দেওবন্দী ওহাবীর অধিকার নেই যে কোন সুন্নী মুসলমানকে উচ্চস্বরে যিকর করা থেকে বাধা দেয়। কেননা বিনা মাকরূহে এর জায়েয হওয়া সম্পর্কে চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। বিবেকও বলে যে কয়েকটি কারণে উচ্চস্বরে যিকর করা জায়েয।

প্রথমতঃ শরীয়তে আছে যে শ্রম অনুপাতে ছওয়াব পাওয়া যায়। এ জন্য ঠাণ্ডায় ওযু করা, অন্ধকার রাতে মসজিদে জামাত পড়ার জন্য আসা এবং দূর থেকে মসজিদে আসার জন্য অতিরিক্ত ছওয়াব রয়েছে। (মিশকাত শরীফ ও অন্যান্য গ্রন্থ দেখুন) মনে মনে যিকরের থেকে উচ্চেস্বরে যিকরের মধ্যে কষ্ট বেশী। তাই এটা আফযাল। মিশকাত শরীফের কিতাবুল আযানে বর্ণিত আছে যে যতদূর মুয়াযযিনের আওয়াজ পৌঁছবে, ওই পযর্ন্ত সমস্ত গাছ-পালা, ঘাস, জ্বীন ও ইনসান কিয়ামতের দিন ওনার ঈমানের সাক্ষ্য দিবে। তাই উচ্চস্বরে যিকরের দ্বারা এ ফায়দাটা পাবার আশা করা যায়।

তৃতীয়তঃ মনে মনে যিকরের নিজেও পেয়ে থাকে যেমন শব্দ ইত্যাদির ধাক্কায় আত্মা জাগ্রত হয় এবং শ্রোতারাও উপকৃত হয়, যেমন যিকরের আওয়াজ শুনে ওরাও যিকর করতে পারে। আর যিকর না করলেও শোনার ছওয়াব তো পাবে। নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল।

চতুর্থতঃ মিশকাত শরীফের الاذان অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে আযানের আওয়াজের দ্বারা শয়তান পালিয়ে যায়। একটু আগে উলে­খিত হয়েছে যে হযরত ফারুকে আযম (رضي الله عنه) হুযুর আলাইহিস সালামের প্রশ্নের উত্তরে আরয করেছিলেন-


وَأَطْرُدُ الشَّيْطَانَ.


-‘‘শয়তানকে তাড়াচ্ছিলাম।’’  ৩৩৮

{ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, ২/৩০৯ পৃ:, হা/৪৪৭, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৩৭৭ পৃ:, হা/১২০৪, ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ২/৩৭ পৃ:, হা/১৩২৯}


এতে বোঝা যায়, আযান ছাড়া অন্যান্য যিকরেও শয়তান পালিয়ে যায়। তাই উচ্চস্বরে যিকরের দ্বারা শয়তান থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।

পঞ্চমতঃ উচ্চেস্বরে যিকরের ফলে ঘুম, তন্দ্রা ও অলসতা দূরীভূত হয়। আর মনে মনে যিকরের ফলে অনেক সময় ঘুম এসে যায়। কিন্তু আমার এ সমস্ত বক্তব্য কেবল ওই অবস্থায় ফলপ্রসু হবে, যদি লোক দেখানো অভিপ্রায়ে না হয়। আর যদি লোক দেখানোর নিয়ত হয়, তাহলে যিকর কেন, এ রকম মুরাকাবা করা ও নামায পড়াও গুনাহ হবে।


❏ নক্সবন্দীয়া তরীকার মশায়েখে কিরাম নীরবে যিকর করার প্রতি আগ্রহী। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে-


دل مي هو ياد تيرى گوشئه تنهائى هو

پهر تو خلوت ميں عجب انجمن آرائى هو


অর্থাৎ মনে মনে তোমার স্মরণে এক কিনারায় একাকী বসে আছি। কিন্তু তুমি এ একাকীত্বের মধ্যেও অদ্ভূত মাহফিলের আয়োজন করেছ।


অন্যান্য সিলসিয়ার বুযুর্গানে কিরাম উচ্চস্বরে যিকরের সমর্থক। তাঁদের বক্তব্য হচেছ-


سارا عالم هو مگر ديده دل ديكهے تمهين

انجمن گرم هو اور لذت تنهائى هو.


অর্থাৎ সারা বিশ্বে আমরা ছড়িয়ে আছি কিন্তু অন্তরের চোখে তোমাকে দেখছি। জমায়েতের মধ্যে আছি কিন্তু একাকীত্বের স্বাদ পাচিছ। উভয় পক্ষ খোদার প্রিয়।


নকশবন্দীগণ নির্জনতায় সমাবেশ করেন আর অন্যান্যগণ সমাবেশের মধ্যে একাকীত্ব প্রকাশ করেন।


وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى.


-‘‘আল্লাহ তাআলা সবাইর কাছে বেহেশতের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন।’’  ৩৩৯

{সূরা আন-নিসা, আয়াত নং-৯৫}


কিন্তু তাঁদের এ পার্থক্য হালাল-হারাম নিয়ে নয়, নিজ নিজ তরীকাগত। কেউ কারো দোষারোপ করেন না। আমার এ পূর্ণ আলোচনাটা ওই সমস্ত দেওবন্দী ও অন্যান্য বাতিল পন্থীদের জন্য নিয়ে করা হয়েছে, যারা উচ্চস্বরে যিকর করাকে হারাম বলে ফাতওয়া দেয়। আফসোস মুজাদ্দিদে আলফে ছানীর (رحمة الله) সেই বাণী-‘আমি একাজটা নিজে করি না, আবার অস্বীকারও করি না’ বিসর্জিত।

Top