প্রথম অধ্যায়ঃ

‘হাযির-নাযির’ সম্পর্কিত বিষয়ের প্রামাণ্য বিবরণ

এ অধ্যায়টি পাঁচটি পরিচ্ছেদে সুবিন্যস্ত।


প্রথম পরিচ্ছেদঃ

কুরআনের আয়াত সমূহ দ্বারা প্রমাণ


আল্লাহ তা’আলা প্রিয় নবী (ﷺ) কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন,



(১)يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرً وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا


-“ওহে অদৃশ্য বিষয়াদির সংবাদদাতা! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি ‘হাযির-নাযির’, সুসংবাদদাতা, ভয় প্রদর্শনকারী, আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁর দিকে আহবানকারী এবং উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে।’’

{সূরাঃ আযাব, আয়াতঃ ৪৫-৪৬, পারাঃ ২২}


আয়াতে উল্লেখিত شاهد (শাহিদ) শব্দের অর্থ সাক্ষীও হতে পারে এবং ‘হাযির-নাযির’ ও হতে পারে। সাক্ষী অর্থে ‘শাহিদ’ শব্দটি এজন্য ব্যবহৃত হয় যে, সে ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিল। রাসূল (ﷺ)কে ‘শাহিদ’ হয়তো এ জন্যই বলা হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) দুনিয়াতে এসে অদৃশ্য জগতের সাক্ষ্য দিচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শীরূপে। প্রত্যক্ষদর্শী যদি না হন, তাহলে প্রিয়নবী (ﷺ) কে সাক্ষীরূপে প্রেরণের কোন অর্থই হয় না, কেননা সমস্ত নবীগণ (عليه السلام) তো সাক্ষী ছিলেন। অথবা, তাঁকে এ জন্যই ‘শাহিদ’ বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন রাসূল (ﷺ) সমস্ত নবীগণের অনুকূলে প্রত্যক্ষদর্শীরূপে সাক্ষ্য প্রদান করবেন। এ সাক্ষ্য না দেখে প্রদান করা যায় না। তাঁর শুভ সংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শনকারী ও আল্লাহর পথে আহ্বানকারী হওয়ার বিষয়টিও তথৈবচক অন্যান্য নবীগণও এ সমস্ত কাজ সম্পন্ন করেছেন, কিন্তু শুধু শুনেই; আর রাসূল (ﷺ) করেছেন স্বচক্ষে দেখেই। এজন্যই মিরাজ একমাত্র রাসূল (ﷺ)-এরই হয়েছিল। উপরোক্ত আয়াতে প্রিয় নবী (ﷺ) কে سِرَاجًا مُّنِيْرًا সিরাজাম-মুনীরা’ ও বলা হয়েছে। ‘সিরাজাম-মুনীরা’ সূর্যকেই বলা হয়। সূর্য যেমন পৃথিবীর সর্বত্র, ঘরে ঘরে বিদ্যমান, রাসূল (ﷺ)ও প্রত্যেক জায়গায় বিরাজমান। এ আয়াতের প্রতিটি শব্দ থেকে রাসূল (ﷺ)-এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত।



(২)وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا


-‘‘এবং কথা হলো এই যে আমি (আল্লাহ তা’আলা) তোমাদেরকে (উম্মতে মুহাম্মদী) সমস্ত উম্মতগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করেছি, যাতে তোমরা অন্যান্য লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করতে পার এবং এ রাসূল (ﷺ) তোমাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী ও সাক্ষীরূপে প্রতিভাত হন।’’

{সূরাঃ বাক্বারাঃ আয়াতঃ ১৪৩, পারাঃ ২}



(৩)فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا


-‘‘তখন কি অবস্থা হবে, যখন আমি (আল্লাহ তা’আলা) প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন করে সাক্ষী উপস্থিত করব, এবং হে মাহবুব! আপনাকে সে সমস্ত সাক্ষীদের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরূপে আনয়ন করবো।’’

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৪১, পারাঃ ৫}


এ আয়াতসমূহ নিম্নোক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন অন্যান্য নবীগণের উম্মতগণ আরজ করবে; ‘আপনার নবীগণ আপনার নির্ধারিত বিধি-বিধান আমাদের নিকট পৌঁছাননি। পক্ষান্তরে নবীগণ আরজ করবে; ‘আমরা অনুশাসনসমূহ পৌঁছিয়েছি’। নবীগণ নিজেদের দাবীর সমর্থনে সাক্ষী হিসেব উম্মতে মুস্তাফা আলাইহিস সালামকে পেশ করবেন। উনাদের সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আপত্তি উত্থাপন করে বলা হবেঃ আপনারা সে সব নবীদের যুগে ছিলেন না। আপনারা না দেখে কিভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন? তাঁরা তখন বলবেন; আমাদেরকে রাসূল (ﷺ) এ ব্যাপারে বলেছিলেন। তখন রাসূল (ﷺ)-এর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। রাসূল (ﷺ) দুটো বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেনঃ এক, নবীগণ (عليه السلام) শরীয়তের বিধানাবালী প্রচার করেছেন দুই, আমার উম্মতগণ সাক্ষ্য প্রদানের উপযুক্ত। সুতরাং, মুকাদ্দমা এখানেই শেষ। সম্মানিত নবীগণের পক্ষে রায় দেওয়া হবে। লক্ষ্যণীয় যে, যদি রাসূল (ﷺ) পূর্ববর্তী নবীগণের তাবলীগ ও স্বীয় উম্মতগণের ভবিষ্যতের অবস্থা সচক্ষে অবলোকন না করতেন, তা’হলে তাঁর সাক্ষ্যের ব্যাপারে কোন আপত্তি উত্থাপিত হল? বোঝা গেল, রাসূল (ﷺ) সাক্ষ্য হবে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য আর আগেরটা হবে শ্রুত বিষয়ে সাক্ষ্য। এ থেকে তাঁর ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলো। এ আয়াতের তাৎপর্য ইতিপূর্বে ইলমে গায়ব এর আলোচনায়ও বিশে­ষণ করেছি।


(৪)لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ


-‘‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে সে রাসূলই এসেছেন, যাঁর কাছে তোমাদের কষ্টে নিপতিত হওয়ার ব্যাপারটি বেদনাদায়ক।’’

{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১২৮, পারাঃ ১১}


এ আয়াত থেকে তিন রকমে রাসূল (ﷺ) এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়-


প্রথমতঃ جَاءَكُمْ আয়াতাংশে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের মুসলমানদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, তোমাদের সকলের কাছে রাসূল (ﷺ) তশরীফ এনেছেন। এতে বোঝা যায় যে নবী করীম (ﷺ) প্রত্যেক মুসলমানের কাছেই আছেন। মুসলমানতো পৃথিবীর সব জায়গায় আছে; তাই রাসূল (ﷺ)ও প্রত্যেক জায়গায় বিদ্যমান আছেন।


দ্বিতীয়তঃ আয়াতে বলা হয়েছে- مِنْ اَنْفُسِكُمْ

অর্থাৎ- তোমাদের আত্মসমূহের মধ্য থেকে অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে তাঁর (ﷺ) আগমন যেন শরীরের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হওয়া যায় শরীরের শিরা-উপশিরায়, এমনকি প্রতিটি কেশাগ্রেও বিদ্যমান; যা প্রত্যেক কিছুর ব্যাপারে সজাগ ও সংবেদনশীল। তদ্রুপ রাসূল (ﷺ) প্রত্যেক মুসলমানের প্রতিটি কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত।


آنكهوں ميں ہيں ليكن مثل نظر يوںدل ميں ہيں جيسے جسم ميں جاں

ہيں مجه ميں وليكن مجه سے نهاں اس شان كى جلوه نمائ ہے


অর্থাৎ চোখ সমূহের মধ্যে তিনি বিরাজমান, তবে দৃষ্টির মত অদৃশ্য। দিলের মধ্যে এমনভাবেই বিদ্যমান আছেন, যেমনিভাবে শরীরের মধ্যে প্রাণ বিচরণ করে। তিনি অপূর্ব এক শানে বিকশিত। আমার মধ্যে রয়েছেন অথচ আমার দৃষ্টির আড়ালে।"


যদি আয়াতের অর্থ কেবল এটাই হতো- তিনি তোমাদের মধ্যে কার একজন মানুষ, তা‘হলে مِنْكُمْ বলাই যথেষ্ট ছিল, مِنْ اَنْفُسِكُمْ কেন বলা হল, তৃতীয়তঃ আয়াতে আরও বলা হয়েছে


عَزِيْزُ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ


অর্থাৎ- যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে, তা তাঁর কাছে পীড়াদায়ক।


এতে বোঝা গেল যে, আমাদের সুখ-দুংখ সম্পর্কেও হুযুর পুরনুর (ﷺ) প্রতি নিয়ত অবগত। এ জন্যই তো আমাদের দুঃখ-কষ্টের ফলশ্রুতিতে তাঁর পবিত্র হৃদয়ে কষ্ট অনুবব হয়। যদি আমাদের খবরও না থাকে, তবে তার কষ্ট অনুভব হয় কিভাবে? শেষের এ আয়াতাংশটিও আসলে পূর্বোলি­খিত مِنْ اَنْفُسِكُمْ এরই তাৎপর্য বিশে­ষণ করে। শরীরের কোন অঙ্গে ব্যথা বেদনা হলে রূহই কষ্ট অনুবব করে। তদ্রূপ তোমরা কোন দুঃখ-কষ্টে পতিত হলে, তা ’ আকা মওলা (ﷺ) এর কাছে পীড়াদায়ক ঠেকে।


(৫)وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا


-‘‘এবং যখন ওরা নিজেদের অত্মার প্রতি অবিচার করে, তখন তারা যদি আপনার সমীপে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আর আপনিও তাদের জন্য সুপারিশ করেন, তা’হলে নিশ্চয়ই আল্লাহকে তওবা কবুলকারী, করুণাময় হিসেবে পাবে।’’

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৬৪, পারাঃ ৫}


এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, পাপীদের মাগফিরাত বা ক্ষমাপ্রাপ্তির একমাত্র পথ হচ্ছে রাসূল (ﷺ)-এর মহান দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁর শাফা’আত প্রার্থনা করা এবং হুযুর মেহেরবাণী করে তাদের জন্য শাফা’আত করা। এর অর্থ এ নয় যে, আমাদেরকে মাগফিরাতের জন্য পবিত্র মদীনাতে উপস্থিত হতে হবে; কেননা তাহলে আমাদের মত দরিদ্র বিদেশী পাপীদের ক্ষমাপ্রাপ্তির কি উপায় হবে? ধনাঢ্য ব্যক্তিগণও তো জীবনে একবার কি দু’বার সে মহান দরবারে যাবার সামর্থ, রাখেন; অথচ দিনরাত পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত রয়েছেন। তাই, এতে মানুষের সাধ্যাতীত কষ্ট হবে। কাজেই আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে- রাসূল (ﷺ) তোমাদের কাছেই বিদ্যমান আছেন। তোমরাই বরং তাঁর নিকট থেকে দূরে অবস্থান করছো। তোমরা হাযির হয়ে যাও, তিনি তোমাদের প্রতি সুপ্রসন্ন হবেন।


يار نزديك ترازمن بمن است ، ويں عجب هين كه من ازوے دورم


অর্থাৎ, "পরম বন্ধু আমার নিজের চেয়েও কাছে বিদ্যমান। এটাই বিস্ময়কর যে আমি তার নিকট থেকে দূরে রয়েছি।"


এতে বোঝা যায় যে, রাসূল (ﷺ) সর্বত্র বিদ্যমান।



(৬)وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ


-‘‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’’

{সূরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ১০৭}


অন্যত্র বলা হয়েছে-


وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ


-‘‘আমার রহমত প্রত্যেক কিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছে।’’

{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ১৫৬, পারাঃ ৯}


বোঝা গেল যে, রাসূল (ﷺ) বিশ্ব চরাচরের জন্য রহমত স্বরূপ এবং ‘রহমত সমগ্র বিশ্বকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। সুতরাং, সমগ্র বিশ্বকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন রাসূল (ﷺ)। স্মরণ রাখা দরকার যে, মহাপ্রভু আল্লাহর শান হচ্ছে- তিনি ‘রাব্বুল আলামীন’ (বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রতিপালক), আর প্রিয় হাবীবের শান হচ্ছে- তিনি ‘রাহমাতুলি­ল আলামীন’ )বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রতি রহমত স্বরূপ)। স্পষ্টই প্রতীয়মান হল যে, আল্লাহর যা’র প্রতিপালক, রাসূল (ﷺ) হচ্ছেন তার প্রতি রহমত স্বরূপ।



(৭)وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ


-‘‘হে মাহবুব! এটা আল্লাহর অভিপ্রেত নয় যে আপনি তাদের মধ্যে থাকাকালে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন।’

{সূরাঃ আনফাল, আয়াতঃ ৩৩, পারাঃ ৯}


অর্থাৎ খোদার মর্মন্তুদ শাস্তি তারা পাচ্ছে না এজন্য যে, আপনি তাদের মধ্যে রয়েছেন। আর, সাধারণ ও সর্বব্যাপী আযাব তো কিয়ামত পর্যন্ত কোন জায়গায় হবে না।


এ থেকে জানা যায় যে, হুজুর (ﷺ) কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জায়গায় বিদ্যমান থাকবেন।


❏ এ সম্পর্কে সুপ্রসিদ্ধ ‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ বলা হয়েছে, হুজুর (ﷺ) প্রত্যেক পুণ্যাত্মা ও প্রত্যেক পাপীর সাথে বিদ্যমান আছেন। এর বিশদ বিবরণ এ অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে দেয়া হবে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন,


وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ


‘‘তোমরা জেনে রেখ, তোমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিরাজমান।’’

{সূরাঃ হুজরাত, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ২৬}


এখানে সমস্ত সাহাবায়ে কিরামকে সম্বোধন করা হয়েছে, অথচ তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করতেন। সুতরাং, স্পষ্টই বোঝা যায় যে, হুজুর (ﷺ) সে সব জায়গায়ও তাঁদের কাছে আছেন।



(৮)وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ


-‘‘এবং এভাবেই হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে সমস্ত আসমান ও যমীনে পরিব্যাপ্ত আমার বাদশাহী অবকলোন করাই।’’

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৭৫, পারাঃ ৭}


এ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে তাঁর চর্মচক্ষে সমগ্র জগত দেখার বন্দোবস্ত করেছিলেন। হুজুর (ﷺ) এর মরতবা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম থেকেও অনেক ঊর্ধ্বে। অতএব, একথা স্বীকার করতেই হয় যে, রাসূল (ﷺ) ও সমগ্র জগত অবলোকন করেছেন। এ আয়াতের তাৎপর্য ‘ইলমে গায়ব’ শীর্ষক আলোচনায় পূর্ণ বিশে­ষণ করা হয়েছে।




(৯)أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ


-‘‘হে মাহবুব আপনি কি দেখেন নি, আপনার প্রভু হস্তীবাহিনীদের সাথে কি অবস্থা করেছেন?

{সূরাঃ ফীল, আয়াতঃ ১, পারাঃ ৩০}



(১০)أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ


-‘‘হে মাহবুব আপনি কি দেখেননি, আপনার প্রতিপালক ‘আদ’ নামক জাতির সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন।’’

{সূরাঃ ফাজর, আয়াতঃ ৬, পারাঃ ৩০}


‘আদ’ জাতি ও হস্তীবাহিনীর ঘটনাবলী হুজুর (ﷺ) এর আবির্ভাবের আগেই সংঘটিত হয়েছিল, অথচ বলা হচ্ছে اَلَمْ تَرَ (আপনি কি দেখেন নি? অর্থাৎ আপনি দেখেছেন। এতে কেউ আপত্তি উত্থাপন করে বলতে পারে যে,


❏ কুরআন করীমে কাফিরদের প্রসঙ্গেও তো বলা হয়েছে


أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ قَرْنٍ


-‘‘তারা কি দেখেনি, আমি তাদের আগে কত জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি।’’

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৬, পারাঃ ৭}


এখানে লক্ষ্যণীয় যে, কাফিরগণ তাদের আগেকার কাফিরদরে ধ্বংস হতে দেখেনি; তবু আয়াতে বলা হয়েছে ‘তারা কি দেখেনি’? সুতরাং, আপনি কি দেখেন নি?” এ উক্তি থেকে সচক্ষে দেখার ব্যাপারটির প্রমাণিত হয় না। এর উত্তর হচ্ছে এখানে আয়াতে আগেকার কাফিরদের ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ, বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ী ও ধ্বংসাবশেষ দেখার কথাই বলা হয়েছে। মক্কার কাফিরগণ যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করার সময় সে সব স্থান সমূহের পার্শ্ব দিয়া যাতায়াত করতো, সেজন্য বলা হয়েছে, ‘এসব লোক ওসব ধ্বংসাবশেষ দেখে কেন শিক্ষা গ্রহণ করে না?’ হুজুর (ﷺ) তো দৃশ্যতঃ না পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছেন, না ‘আদ’ জাতি ও অন্যান্যদের বিধ্বস্ত দেশ সমূহ বাহ্যিকভাবে দেখেছেন। তাই, তাঁর ক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হবে যে, এখানে তাঁর নূরে নবুয়াতের মাধ্যমে দেখার কথাই বলা হয়েছে।


(১১) কুরআন শরীফের অনেক জায়গায় اِذً উক্ত হয়েছে, যেমন


وَاِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَئِكَةِ.


-‘‘যখন আপনার প্রতিপালক ফিরিশতাদের উদ্দেশ্যে বললেন।’’

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ৩০, পারাঃ ১}


وَاِذْقَالَ مُوْسَي لِقَوْمِهِ


-‘‘যখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম স্বজাতির উদ্দেশ্যে বললেন।’’  

{সূরাঃ বাক্বারাঃ আয়াতঃ ৬৭, পারাঃ ১}

 

ইত্যাদি। তাফসীরকারকগণ এসব জায়গায় اُذْكُرْ (ঐ ঘটনাটি স্মরণ করুন।) শব্দটি উহ্য আছে বলে মত পোষণ করেন। লক্ষ্যণীয় যে “স্মরণ করুন” এ কথা দ্বারা সে সব বিষয় বা ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, যা’ সংঘটিত হতে দেখা গিয়েছে, কিন্তু কালক্রমে সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ নেই। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ওই সমস্ত বিগত ঘটনাবলী হুজুর (ﷺ) অবলোকন করেছেন। ‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ উলে­খিত আছে যে, হযরত আদম আলাইহিস সালামের সমস্ত ঘটনাবলী হুজুর (ﷺ) প্রত্যক্ষ করেছেন। সামনে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে। কেউ আরও একটি আপত্তি উত্থাপন পূর্বক বলতে পারে যে,


❏ কুরআন করীমে বনী ইসরাইলকেও তো -


وَإِذْ نَجَّيْنَاكُمْ مِنْ آلِ فِرْعَوْنَ


-‘‘সে সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন তোমাদেরকে ফিরাউনের বংশধরদের অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করেছিলাম।’’  

{সূরাঃ বাক্বারাঃ আয়াতঃ ৪৯, পারাঃ ১}

 

আয়াতের মধ্যে সম্বোধন করা হয়েছে। হুজুর (ﷺ) এর যুগের ইহুদীগণ কি উক্ত আয়াতের বর্ণিত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় বিদ্যমান ছিল? কিন্তু তাফসীরকারকগণ এখানেও اَذْكُرْ স্মরণ কর) শব্দ উহ্য আছে বলে স্বীকার করেন। এর উত্তর হবে যে, সমস্ত বনী ইসরাইলের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী জানা ছিল, তারা ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেছিল। সেজন্য তাদের জানা ঘটনাবলীর দিকেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে হুজুর (ﷺ) না কারো কাছ থেকে লেখাপড়া শিখেছেন, না ইতিহাসের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেছেন, না কোন ইতিহাসবেত্তার সান্নিধ্যে ছিলেন, না শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত কোন গোত্রের মধ্যে লালিত-পালিত হয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁর পক্ষে একমাত্র নূরে নবুওয়াতের মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনভাবে জ্ঞানার্জনের কোন উপায় ছিল কি?



(১২)وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ


-‘‘নবী মুসলমানদের কাছে তাদের প্রাণের চেয়েও নিকটতর।’’

{সূরাঃ আহযাব, আয়াতঃ ৬, পারাঃ ২১}


দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলবী কাসেম সাহেব তাঁর রচিত ‘তাহযীরুন নাস গ্রন্থে ১০ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ এ আয়াতের اَوْلَى শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘নিকটতর’।


তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় ‘নবী মুসলমানদের কাছে তাঁদের প্রাণের চেয়েও ‘নিকটতর’। আমাদের নিকটতম হচ্ছে আমাদের প্রাণ; এ প্রাণ থেকেও নিকটতর হচ্ছেন নবী আলাইহিস সালাম। বলা বাহুল্য যে, অতি নিকটে অবস্থিত বস্তু দৃষ্টিগোচর হয় না। অত্যধিক নৈকট্যের কারণে আমরা তাঁকে [প্রিয়নবী (ﷺ)] চোখে দেখতে পাই না।


বিঃ দ্রঃ- এখানে কিছু সংখ্যক লোক এ আপত্তিটা উত্থাপন করে থাকেন যে, আপনারা যেহেতু মুক্কালি­দ, আপনাদের জন্য কুরআনের আয়াত ও হাদীছ সমূহ থেকে দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করাতো জায়েয নয়। একজন মুকালি­দের উচিত তার বক্তব্যের সমর্থনে স্বীয় ইমাম (মুজতাহিদ ইমাম) এর উক্তি পেশ করা। সুতরাং, আপনারা কেবল আবু হানীফা (رحمة الله) এর উক্তিই পেশ করতে পারেন।

এর উত্তর কয়েকভাবে দেয়া যায়ঃ


(ক) আপনারা নিজেরাই যেহেতু ‘হাযির-নাযির’ না হওয়ার আকীদা পোষণ করেন, সেহেতু আপনাদেরই উচিত ছিল আপন আকীদা এর সমর্থনে ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর উক্তি উপস্থাপন করা।


(খ) আমি তাকলীদের’ আলোচনায় পূর্বেই উলে­খ করেছি যে, আকীদা সম্পর্কিত কোন মাসআলায় তাকলীদ হয় না; কেবলমাত্র ফকীহগণের গবেষণালবদ্ধ মাসায়েলের ক্ষেত্রেই ‘তকলীদ’ প্রযোজ্য হয়। আলোচ্য বিষয়টি হচ্ছে ‘আকীদা’ এর একটি মাসআলা।


(গ) মুকালি­দ সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীছ সমূহ থেকে দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে। তবে হ্যাঁ এসব দলীলের ভিত্তিতে নিজে মাসায়েল বের করতে পারে না।


❏ এ প্রসঙ্গে ‘তাহাবী’ শরীফে উলে­খিত আছেঃ


وَمَافُهِمَ اَلاَحْكَامُ مِنْ نَحْوِ الظَّاهِرِ وَالنَّصِّ اَلْمُفَسَّرِ فَلَيْسَ مُخْتَصًّا بِهِ (اَىْ بِالْمُجْتَهِدِ) بَلْ يَقْدِرُ عَلَيْهِ الْعُلَمَآءُ الْاَعَمُّ


-‘‘যে সমস্ত আহকাম বা শরীয়ত বিধি কুরআনের ‘যাহির’ ‘নাস’ ও ‘মুফাসসার’ ইত্যাদি প্রকৃতির আয়াত থেকে সরাসরি সুস্পষ্টভাবে বোধগম্য হয় সে সকল মাসায়েলও মুজতাহিদের গবেষণা প্রসূত হতে হবে, এমন কথা বলা যায় না। এসব মাসায়েলও বরং সাধারণ আলিমগণও বের করার সামর্থ রাখেন।’’


❏ সুবিখ্যাত ‘মুসাল্লামুছ ছবুত’ নামক ‘উসুলে ফিক্হ’ এর গ্রন্থ উলে­খিত আছে


وَاَيْضًا شَاعَ اِحْتِجَاجُهُمْ سَلْفًا وَخَلْفًا بِالْعُمُوْمَاتِ مِنَ غَيْرٍ نكير


-‘‘অধিকন্তু, ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করার রীতি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ধর্মীয় মনীষীদের মধ্যে কোনরূপ ওজর আপত্তি ছাড়াই প্রচলিত হয়ে আসছে।


❏ কুরআন করীমও ইরশাদ করছেঃ


فَاسْئَلُوْا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ


-‘‘যদি তোমরা না জান, তবে জ্ঞানীদের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করো।’’  

{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৪৩, পারাঃ ১৪}


ইজতিহাদী মাসায়েল যেহেতু আমরা জানি না, সে জন্য আমরা ইমামদের অনুসরণ করি। আর সুস্পষ্ট অর্থবোধক আয়াতসমূহের অর্থ আমরা বুঝি, সেজন্য এসব ব্যাপারে তকলীদ নিষ্প্রয়োজন।


(ঘ) ‘হাযির-নাযির’ এর মাসআলা সম্পর্কে সুবিখ্যাত ফকীহ, মুহাদ্দিছ ও তাফসীরকারকদের উক্তিসমূহের বিশদ বর্ণনা পরবর্তী পরিচ্ছেদ সমূহেও করা হবে। গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন যে, ‘হাযির-নাযির’ এর এ আকীদা সমস্ত মুসলমানই পোষণ করে।

━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah 
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।
Top