দ্বিতীয় অধ্যায়

উচ্চস্বরে যিকর করা প্রসঙ্গে আপত্তি সমূহের জবাব

        

ভিন্নমতাবলম্বীগণ এ বিষয়ে প্রমাণিক ও যৌক্তিক-এ দু’ধরনের আপত্তি উত্থাপন করে থাকে। আমি প্রথমে তাদের প্রমাণিক আপত্তিসমূহের জবাব দিচ্ছি।


১নং আপত্তি- কালামে পাকে বর্ণিত আছে-


وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ.


-‘‘তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশংকচিত্তে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় নীরবে স্মরণ কর।’’  ৩৪০

{সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-২০৫।}


এ আয়াত থেকে বোঝা গেল খোদার যিকর মনে মনে হওয়া উচিৎ, উচ্চস্বরে নিষেধ।


উত্তর: এর কয়েকটি জবাব আছে। প্রথমতঃ এ আয়াতে নামাযরত অবস্থায় যিকরের কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ অনুচ্চস্বরে পঠিত নামায সমূহে কির’আত বা মুক্তাদীদের তাশাহুদ ইত্যাদি মনে মনে পড়া অথবা ইমাম ছাহেব কর্তৃক প্রয়োজনের অতিরিক্ত আওয়াজ বের না করা। যেমন


❏ তফসীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে উলি­খিত আছে-


فمن أم فى صلاة الجهر ينبغى له ان لا يجهر جهرا شديدا بل يقتصر على قدر ما يسمعه من خلفه قال فى الكشف لا يجهر فوق حاجة الناس والا فهو مسيىء.


যে ব্যক্তি উচ্চস্বরে পঠিত নামাযে ইমামতি করে, সে যেন অতি উচ্চস্বরে কিরআত (সূরা) না পড়ে। বরং পিছনের লোকেরা শুনতে পারে মত পড়লেই যথেষ্ট। কাশ্ফ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেন চীৎকার না করে, অন্যথায়, গুনাহগার হবে।  ৩৪১

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩০৬।}



❏ তফসীরে কবীরে এ আয়াত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-


وَالْمُرَادُ مِنْهُ أَنْ يَقَعَ ذَلِكَ الذِّكْرُ بِحَيْثُ يَكُونُ مُتَوَسِّطًا بَيْنَ الْجَهْرِ وَالْمُخَافَتَةِ كَمَا قَالَ تَعَالَى: وَلا تَجْهَرْ.


অর্থাৎ এর ভাবার্থ হলো সরব ও নীরবের মাঝামাঝি আল্লাহর যিকর করা উচিৎ।  ৩৪২

{ইমাম রাজী, তাফসিরে কাবীর, ১৫/৪৪৪ পৃষ্ঠা}


❏ তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত আছে-


قال ابن عباس: يعني بالذكر القرآن في الصلاة يريد اقرأ سرا في نفسك.


-হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে, এ আয়াতে যিকর বলতে নামাযে কুরআন তিলাওয়াতকে বোঝানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মনে মনে কিরআত পড়েন।  ৩৪৩

{ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৮৭, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}


স্বয়ং কুরআন করীম অন্যত্র এ আয়াতের ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন-


وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا.


-নামায অতি উচ্চেস্বরেও পড়ো না, আবার অতিশয় নিম্নস্বরেও পড়ো না। এ দু'য়ের মধ্যপথ অবলম্বন কর।  ৩৪৪

{সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত নং-১১০।}


আমি এ গ্রন্থের পেশ কালামে উলে­খ করেছি, কুরআনের সাহায্যে কুরআনের তাফ্সীরের স্থান সর্বঊর্ধ্বে। দ্বিতীয়তঃ এ আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে যিকর যেন কেবল মৌখিক না হয় বরং কথার সাথে কলবও যেন জড়িত থাকে। তা না হ'লে যিকর নিস্ফল।


❏ তফ্সীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উলে­খিত আছে-


وقيل المراد بالذكر في النفس أن يستحضر في قلبه عظمة المذكور جل جلاله.


-বলা হয়েছে যে, মনে মনে যিকর করার অর্থ হচ্ছে অন্তরে খোদায়ে কুদ্দুসের মহত্ব বিরাজমান থাকা।  ৩৪৫

{ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৫০।}


❏ একই তফসীরে আরও উলে­খিত আছে-


وإذا كان الذكر باللسان عاريا عن ذكر القلب كان عديم الفائدة لأن فائدة الذكر حضور القلب واستشعاره عظمة المذكور عز وجل.


অর্থাৎ যদি মৌখিক যিকর আত্মিক য্কির থেকে উদাসীন হয়, তাহলে এর কোন মূল্য নেই। কেননা য্কিরের ফযীলত হচ্ছে আত্মাকে হাযির করা ও খোদার মহত্বকে অন্তরে স্থান দেয়া।   ৩৪৬

{ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৮৭, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}


অথবা এ আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে কোন কোন সময় আত্মিক যিকর উচ্চেস্বরের যিকর থেকে উত্তম। অর্থাৎ আয়াতের আদেশটা হচ্ছে امر استحبابى পছন্দমূলক আদেশ আর পছন্দটাও সব সময় এবং সব দিক দিয়ে নয় বরং কেবল কতেক অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ জন্য এ আয়াতটা সেই আয়াত


وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا.


যখন কুরআন তিলাওয়াত হয়, তখন মনোযোগ সহকারে শোন  ৩৪৭

{➥347. সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-২০৪।}


এর পরে বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াত দু’টা একত্রিত করলে বোঝা যায় যে, যিকরে ইলাহী কোন সময় উচ্চস্বরে এবং কোন সময় নিম্নস্বরে করা চাই। যখন উচ্চস্বরে যিকর হয় তখন নিশ্চুপভাবে শুনুন আর যখন নীরবে হয়, তখন এতে মনোনিবেশ করুন। উচ্চস্বরে যিকরে যদি লৌকিকতার ভয় থাকে, তাহলে নীরবে করা উত্তম। আর যদি এ উদ্দেশ্যে হয় যে শয়তান দমন হবে, কলব সজাগ হবে, ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হবে এবং সমস্ত বস্তু কিয়ামতের দিন যিকর কারীর ঈমানের সাক্ষ্য দিবে, তখন উচ্চস্বরে যিকর করা উত্তম।        


❏ তফসীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে আরও উলে­খ আছে-


وَاذْكُرْ يا محمد رَبَّكَ..... فِي نَفْسِكَ وهو الذكر بالكلام الخفي فان الإخفاء ادخل فى الإخلاص واقرب من الاجابة وهذا الذكر يعم الاذكار كلها من القراءة والدعاء وغيرها.


অর্থাৎ এর দ্বারা নীরবে যিকর করাকে বোঝানো হয়েছে। কেননা নীরবের মধ্যে আন্তরিকতা এবং কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। এবং এ যিকর সবরকমের যিকর তিলাওয়াত, ও দুআকে অর্ন্তভুক্ত করে।  ৩৪৮

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩০৫।}


❏ এ আয়াত প্রসঙ্গে রূহুল বয়ানে আরও উলে­খিত আছে-


بان الإخفاء أفضل حيث خاف الرياء او تأذى المصلون او النائمون والجهر أفضل فى غير ذلك لان العمل فيه اكثر ولان فائدته تتعدى الى السامعين ولانه يوقظ قلب الذاكر ويجمع همه الى الفكر ويصرف سمعه اليه.


-যেখানে লৌকিকতার ভয় থাকে বা নামাযীদের ও বিশ্রামকারীদের অসুবিধা হয়, সেক্ষেত্রে নীরবে যিকর করা শ্রেয়। এ গুলো ব্যতীত অন্যান্য অবস্থায় উচ্চস্বরে যিকর করা উত্তম। কেননা এতে আমল বেশী এবং এর উপকার শ্রোতারাও ভোগ করে। আর এ জন্য যে উচ্চস্বরে যিকর, যিকরকারীর কলব জাগ্রত করে, চিন্তাধারাকে কেন্দ্রীভূত করে এবং অন্যান্যদেরকে সজাগ করে। ৩৪৯

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩০৬।}


২নং আপত্তি- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-


ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ.


-বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক; তিনি সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না।  ৩৫০

{সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-৫৫।}


এর থেকেও প্রমাণিত হলো যে উচ্চেস্বরে যিকর আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।


উত্তরঃ এ আয়াতেরও কয়েক রকম ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথমতঃ এ আয়াত খোদার প্রত্যেক যিকরের কথা নয়, কেবল দুআর কথা উলে­খিত আছে এবং বাস্তবিকই দুআ গোপনে করাই উত্তম, যাতে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা প্রকাশ পায়।


❏ তাফ্সীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে উলে­খিত আছে-


اى متضرعين متذللين مخفين الدعاء ليكون اقرب الى الاجابة لكون الإخفاء دليل الإخلاص والاحتراز على الرياء.


অর্থাৎ কান্নাকাটি ও বিনীত সহকারে গোপনে প্রার্থনা কর, যাতে কবুল হয়। কেননা গোপনে দুআ করাটা হচ্ছে আন্তরিকতা ও কপটতাহীনতার প্রমাণ।  ৩৫১

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৭৭।}


❏ একই আয়াতের প্রেক্ষাপটে তফ্সীরে খাযেনে বর্ণিত আছে-


وقيل: المراد به حقيقة الدعاء هو الصحيح لأن الدعاء هو السؤال والطلب وهو نوع من أنواع العبادة.


-কারো কারো মতে এর দ্বারা মূলতঃ দুআকেই বোঝানো হয়েছে। এবং এটাই সঠিক, কেননা প্রার্থনা ও কামনা হচ্ছে দুআ এবং এটা এক প্রকার ইবাদত।  ৩৫২

{ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২১০।}


❏ এ আয়াত প্রসঙ্গে তফসীরে খাযেনে আরও উলে­খিত আছে-


والأدب في الدعاء أن يكون خفيا لهذه الآية قال الحسن بين دعوة السر ودعوة العلانية سبعون ضعفا.


দুআর নিয়ম হচ্ছে গোপনে করা। এ আয়াতের আলোকের হযরত হাসন (رضي الله عنه) বলেন, গোপনে একটি দুআ প্রকাশ্যে সম্ভব দুআর সমতুল্য।৩৫৩  

{ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২১০।}


অথবা এ আয়াতের ব্যাখ্যা এটাও হতে পারে যে কোন কোন অবস্থায় গোপনে যিকর করা ভাল। অর্থাৎ উপরোক্ত আয়াতে ادعوا শব্দ দ্বারা যিকরে ইলাহীর নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এ নির্দেশটা হচ্ছে পছন্দমাফিক, তাও আবার কতেক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।


❏ এ প্রসঙ্গে তফ্সীরে খাযেনে আরও বর্ণিত আছে-


فذهب بعضهم إلى أن إخفاء الطاعات والعبادات أفضل من إظهارها لهذه الآية ولكونها أبعد عن الرياء وذهب بعضهم إلى أن إظهارها أفضل ليقتدي به الغير فيعمل مثل عمله وتوسط الشيخ محمد بن عبد الحكيم الترمذي فقال: إن كان خائفا على نفسه من الرياء، فالأولى إخفاء العبادات صونا لعمله عن البطلان وإن كان قد بلغ في الصفاء وقوة اليقين إلى التمكين بحيث صار مباينا شائبة الرياء كأن الأولى في حقه الإظهار لتحصل فائدة الاقتداء به وذهب بعضهم إلى أن إظهار العبادات المفروضات أفضل من إخفائها.

-এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে কতেক তফসীরকারক ইবাদত সমূহ প্রকাশ্যে করার চেয়ে গোপনে করাকে ভাল বলেছেন। কেননা এতে রিয়ার সম্ভাবনা নেই। এবং কেউ কেউ বলেন প্রকাশ্যে করাটা উত্তম যাতে একে অনুসরণ করে অন্যান্যরা ইবাদত করে। আবার কেউ কেউ বলেন ফরয ইবাদতসমূহ গোপনে করার চেয়ে প্রকাশ্যে করাটা ভাল।  ৩৫৪

{ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২১১।}


৩ নং আপত্তিঃ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-


وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ.


-হে মাহবুব, আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি তো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে, আমি তার আহবানে সাড়া নেই।  ৩৫৫

{সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১৮৬।}


এ আয়াতে করীমা থেকে বোঝা গেল, আল্লাহ তাআলা আমাদের নিকটেই আছেন, আমাদের মনের চিন্তাধারা ও অনুচ্চ কথাবার্তা শোনেন। তাই উচ্চস্বরে আহবান করাটা অনর্থক।    

               

উত্তর- এ আয়াতে করীমায় ওসব লোকদের ধারণাকে বাতিল বলা হয়েছে, যারা মনে করে যে আল্লাহ আমাদের থেকে অনেক দূরে এবং উচ্চেস্বরে যিকর না করলে তিনি শুনতে পান না। এটা নিছক অজ্ঞতা মাত্র। উচ্চস্বরে যিকর করা হয় অমনোযোগী আত্মাকে মনোযোগী করার জন্য।


❏ তফসীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে উলে­খিত আছে-


وسبب النزول ما روى ان أعرابيا قال لرسول الله صلى الله تعالى عليه وسلم أقريب ربنا فنناجيه أم بعيد فنناديه فقال تعالى.


-এ আয়াতের শানে নুযুল হচ্ছে জনৈক বেদুঈন হুযুর আলাইহিস সালামের সমীপে আরয করলেন, আল্লাহ তা’আলা কি নিকটে যেন তাঁর কাছে মুনাজাত করা যায়, নাকি দূরে যে তাঁকে ডাকতে হবে? এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা উপরোক্ত আয়াতটি ইরশাদ ফরমান  ৩৫৬

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৯৬।}


এর থেকে বোঝা গেল যে আল্লাহকে দূরে মনে করে ডাকা পাপ। আর এক রিওয়ায়েত মতে এ আয়াতটি খাইবর যুদ্ধের সময় নাযিল হয়েছে যখন সাহাবায়ে কিরাম নারায়ে তকবীর দিতে চেয়েছিলেন। হুযুর আলাইহিস সালামের ইচ্ছা ছিল যে ওখানে গোপনে প্রবেশ করা, যাতে কাফিরগণ টের না পায়। যেমন


❏ তফসীরে রুহুল বয়ানে উলে­খিত আছে-


قال ابو موسى الأشعري لما توجه رسول الله صلى الله تعالى عليه وسلم الى خيبر اشرف الناس على واد فرفعوا أصواتهم بالتكبير لا اله الا الله والله اكبر فقال صلى الله عليه وسلم (اربعوا على أنفسكم انكم لا تدعون أصم ولا غائبا.


-যখন হুযুর ﷺ খাইবরের পথে ধাবিত হলেন, সাথীরা একটি উঁচু পাহাড়ে আরোহণ করে উচ্চেস্বরে নারায়ে তাকবীর দিলেন, তখন হুযুর ﷺ ইরশাদ ফরমান-নিজেদের প্রতি একটু সহানুভূতি কর। তোমরা তো কোন বধির বা দূরের কাউকে ডাকছ না।  ৩৫৭

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৯৬।}


❏ রূহুল বয়ানে আরও বর্ণিত আছে-


وهذا باعتبار المشارب والمقامات واللائق بحال اهل الغفلات الجهر لقلع الخواطر.


-এটা অবস্থা ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে। খারাপ চিন্তাধারাকে দূরীভূত করার জন্য অমনোযোগী লোকেদের অবস্থানুযায়ী উচ্চস্বরে যিকর করা যায়। ৩৫৮

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৯৬।}


৪ নং আপত্তি- মিশকাত শরীফের কিতাবুল আসমা بَاب ثَوَابُ التَّسْبِيحِ وَالتَّحْمِيدِ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-


فَجَعَلَ النَّاسُ يَجْهَرُونَ بِالتَّكْبِيرِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ إِنَّكُمْ لَا تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلَا غَائِبًا إِنَّكُمْ تَدْعُونَ سَمِيعًا بَصِيرًا وَهُوَ مَعَكُمْ وَالَّذِي تَدْعُونَهُ أَقْرَبُ إِلَى أَحَدِكُمْ مِنْ عُنُقِ رَاحِلَتِهِ.


-যখন উচ্চস্বরে তকবীর দিতে লাগলেন, তখন হুযুর ﷺ ইরশাদ ফরমান- হে লোক সকল, নিজেদের জানের প্রতি সহানুভূতি কর। তোমরা তো কোন বধির বা দূরবর্তী কাউকে ডাকছ না তোমরা তো শ্রবণকারী ও অবলোকনকারীকে ডাকছ, আর তিনি তো তোমাদের নিকটেই আছেন এবং যাকে তোমরা ডাকছ, তিনি তো তোমাদের সওযারীর ঘাড়ের থেকেও নিকটতর  ৩৫৯

{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ২/৭১৩ পৃ: হা/২৩০৩, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ৪/২০৭৬ পৃ: হা/২৭০৪}


বোঝা গেল, উচ্চস্বরে যিকর নিষেধ এবং এ ব্যাপারে হুযুর ﷺ অসন্তুষ্ট।


উত্তরঃ এর জবাব ২ নং আপত্তির উত্তরে দেয়া হয়েছে। এ হাদীছটি এক যুদ্ধ যাত্রার প্রাক্কালে বর্ণিত হয়েছে। ওই সময় মুসলিম সৈনিকদের প্রয়োজন ছিল সংগোপনে খাইবরে প্রবেশ করা, যাতে খাইবরের কাফিরেরা যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে না পারে। কিন্তু কতেক লোকের উচ্চস্বরে তকবীর বলাটা অবস্থানুক‚ল্যে ছিল না, তাই বারণ করা হয়েছে। এ হাদীছের শুরু এভাবে ছিল-


وَعَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ قَالَ: كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ فَجَعَلَ النَّاسُ يَجْهَرُونَ.


আমরা হুযুর আলাইহিস সালামের সাথে সফরে ছিলাম। তখন লোকেরা উচ্চস্বরে তকবীর বলছিল ৩৬০

{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ২/৭১৩ পৃ: হা/২৩০৩, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ৪/২০৭৬ পৃ: হা/২৭০৪}


অর্থ বা মুসলমানদের আসানীর জন্য পরামর্শ স্বরূপ এ রকম বলা হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা সফরের কষ্ট ভোগ করছ; এর উপর আবার শ্লোগান দেয়ার কষ্টটাও করছ। এর কী প্রয়োজন আছে?


❏ লুমআত গ্রন্থে এ হাদীছের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে-


فيه اشارة الى ان المنع من الجهر للتيسير والارفاق لا لكون الجهر غير مشروع.


এ হাদীছে ওই দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে উচ্চেস্বরের এ নিষেধাজ্ঞা কেবল আসানীর জন্য করা হয়েছে। উচ্চস্বর নিষিদ্ধ বলে নয়। ৩৬১

{শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, লুম’আত, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২০১।}


❏ আশআতুল লুমআতে এ হাদীছ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-


دريں اشارت است كه منع از جهر برائے آسانى ونرمى است نه از جهت نا مشروعيت ذكر جهر وحق آنست ذكر جهر مشروع است بے شبه مگر بعارض ايں رادر رساله اور او اثبات نموديم.


-এ হাদীছে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে উচ্চস্বরের বেলায় নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন সহজ ও আসানীর জন্য করা হয়েছে; উচ্চেস্বরে যিকর নিষিদ্ধ বলে নয়। এবং হক কথা হলো যে উচ্চস্বরে যিকন নিঃসন্দেহে বৈধ, যদি অন্য কোন কারণ না থাকে। আমি এর প্রমাণ ‘রিসালায়ে আওরায়ে’ দিয়েছি। ৩৬২

{শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, আশিয়াতুল লুম’আত (ফারসী), খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪৩।}



৫ নং আপত্তিঃ হিদায়া শরীফের প্রথম খণ্ড تكبيرات التشريق শীর্ষক পরিচ্ছেদে উলে­খিত আছে-


وأخذ بقول ابن مسعود أخذا بالأقل؛ لأن الجهر بالتكبير بدعة.


-কুরবানীর ঈদে তকবীর বলার ক্ষেত্রে) ইমাম আবু হানীফা (رضي الله عنه) সৈয়্যদুনা হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর উক্তিকে গ্রহণ করেছেন কম সময় হওয়ার কারণে। কেননা উচ্চেস্বরে তকবীর বলা বিদআত আর বিদআত কম হওয়াই ভাল।  ৩৬৩

{মীরগীনানী, হেদায়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৭৫, আইনী, বেনায়া শারহুল হেদায়া, ৩/১২৭ পৃ:, দারুল কুতব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}


ইমাম আবু হানীফা (رضي الله عنه) এর মতে যিলহজ্ব মাসের নয় তারিখের ফজর থেকে দশ তারিখের আসর পযর্ন্ত প্রত্যেক ফরয নামাজের পর তকবীরে তশরীক বলা চাই। সাহেবাইনের (ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ) মতে নয় তারিখের ফজর থেকে তের তারিখের আসর পযর্ন্ত তকবীর বলা চাই। ইমাম আবু হানীফা সাহবের বক্তব্য হলো উচ্চেস্বরে যিকর করা বিদআত।


❏ হিদায়ার সেই পরিচ্ছেদে আরও উলে­খিত আছে-


ولأن الجهر بالتكبير خلاف السنة، والشرع ورد به عند استجماع هذه الشرائط.


-এ জন্যে যে, উচ্চস্বরে তকবীর বলা সুন্নাতের খেলাপ এবং এ সমস্ত শর্তাবলী একত্রিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই এ হুকুম দেয়া হয়েছে। ৩৬৪

{মীরগীনানী, হেদায়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৭৫, আইনী, বেনায়া শারহুল হেদায়া, ৩/১৩৩ পৃ:, দারুল কুতব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}


উত্তরঃ ইমাম আবু হানীফা (رضي الله عنه) ও সাহেবাইনের মধ্যে মতভেদের কারণ হচ্ছে তকবীরে তশরীক ওয়াজিব হওয়া নিয়ে, বৈধতা নিয়ে নয়। অর্থাৎ ইমাম সাহেব (رضي الله عنه) বলেন কেবল দু’দিন আর সাহেবাইন বলেন পাঁচ দিন। ইমাম সাহেব একে বিদআত বা সুন্নাতের খেলাফ বলে ওয়াজিব হওয়াটাকে অস্বীকার করেছেন। আমি এ আলোচ্য বিষয়ের প্রথম অধ্যায়ে ফাতওয়ায়ে শামীর উদ্বৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছি যে স্বয়ং ইমাম সাহেব (رضي الله عنه) কুফাবাসীদেরকে বাজারসমূহ নারায়ে তকবীর বলার অনুমতি দিয়েছেন। বলুন, এ বিদআতের অনুমতি কেন দিলেন?


❏ ফাতওয়ায়ে শামীর صلوة العيدين অধ্যায়ে عيد الفطر শীর্ষক আলোচনায় উলে­খিত আছে-


وَالْخِلَافُ فِي الْأَفْضَلِيَّةِ أَمَّا الْكَرَاهَةُ فَمُنْتَفِيَةٌ عَنْ الطَّرَفَيْنِ.


অর্থাৎ মত পার্থক্যটা হচ্ছে কেবল আফযল হওয়া নিয়ে; কেউ মাকরূহ বলার পক্ষপাতি নন।  ৩৬৫

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭০, সলাতুল ঈদাইন।}


❏ একই জায়গায় শামীতে আরও বর্ণিত আছে-


التَّكْبِيرُ جَهْرًا فِي غَيْرِ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ لَا يُسَنُّ إلَّا بِإِزَاءِ الْعَدُوِّ أَوْ اللُّصُوصِ وَقَاسَ عَلَيْهِ بَعْضُهُمْ الْحَرِيقَ وَالْمَخَاوِفَ كُلَّهَا اهـ زَادَ الْقُهُسْتَانِيُّ أَوْ عَلَا شَرَفًا.


-আইয়ামে তশরীক ব্যতীত অন্যান্য সময় উচ্চস্বরে তকবীর বলা সুন্নাত নয়। অবশ্য দুশমন, বা চোরের মুকাবিলায় এবং এর উপর কিয়াস করে কতেক লোক অগ্নিকাণ্ডে ও অপরাপর সমস্ত ভয়াবহ অবস্থায় তকবীর বলতে বলেছেন। ইমাম কুহসেতানী (رحمة الله) উচ্চ জায়গায় আরোহণ করার সময়ও তকবীর বলতে বলেছেন। ৩৬৬

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭০, সলাতুল ঈদাইন।}


❏ দুররুল মুখতারে العيدين শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-


وَهَذَا لِلْخَوَاصِّ أَمَّا الْعَوَامُّ فَلَا يُمْنَعُونَ مِنْ تَكْبِيرٍ وَلَا تَنَفُّلٍ أَصْلًا.


-এ হুকুমটা হচ্ছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য। সাধারণ লোকদেরকে তকবীর ও নফল থেকে বাধা দিও না। ৩৬৭

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭১, সলাতুল ঈদাইন।}


❏ একই অধ্যায়ে শামীতে বর্ণিত আছে-


(قَوْلُهُ: لَا فِي الْبَيْتِ) أَيْ لَا يُسَنُّ وَإِلَّا فَهُوَ ذِكْرٌ مَشْرُوعٌ.


-‘‘এটা প্রমাণিত হলো যে হিদায়া গ্রন্থের এ সমস্ত আলোচনা সুন্নাত হওয়া নিয়ে, জায়েয হওয়া নিয়ে নয়।’’  ৩৬৮

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭৬, সলাতুল ঈদাইন।}


অধিকন্তু তকবীর তশরীকের ক্ষেত্রে সাহেবাইনের উক্তি অনুযায়ী ফতওয়া দেয়া হয়েছে। আমি প্রথম অধ্যায়ে উলে­খ করেছি যে মওলবী রশীদ আহমদ সাহেবের ফাতওয়া হচ্চে উচ্চস্বরে যিকর জায়েয। আর যদি উলে­খিত আয়াত ও হাদীছসমূহের এরূপ ব্যাখ্যা করা না হয়, তাহলে এগুলো তাদেরও বিপরীত হবে। কেননা তারাও কতেক যিকর উচ্চেস্বরে করে থাকে। যেমন আযান, কুরবানী ঈদের সময় তকবীরে তশরীক, হজ্বের সময় তলবিয়া (লাব্বাইক), সভার সময় নারায়ে তকবীর ও অমুখ সাহেব জিন্দাবাদ ইত্যাদি বলা। কারণ উপরোক্ত দলীল সমূহ তো উচ্চস্বরে যিকরকে সাধারণভাবে নিষেধ করে, আর একক হাদীছ দ্বারা কুরআনের আয়াতে শর্তারোপ করা জায়েয নেই। সুতরাং এটা বলার কোন অবকাশ নেই যে এ সমস্ত জায়গায় উচ্চস্বরে যিকর করার কথা যেহেতু হাদীছ শরীফে উলে­খিত আছে, তাই জায়েয। হাদীছের দ্বারা কুরআনের আয়াতের মধ্যে বাধা সৃষ্টি করা জায়েয নেই।


৬ নং আপত্তিঃ ফাত্ওয়ায়ে বযাযিয়ার ৩৭৮ পৃষ্ঠায় উলে­খিত আছে-


عَنْ فَتَاوَى الْقَاضِي أَنَّهُ حَرَامٌ لِمَا صَحَّ عَنْ ابْنِ مَسْعُودٍ أَنَّهُ أَخْرَجَ جَمَاعَةً مِنْ الْمَسْجِدِ يُهَلِّلُونَ وَيُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - جَهْرًا وَقَالَ لَهُمْ " مَا أَرَاكُمْ إلَّا مُبْتَدِعِينَ.


-‘‘ফাতওয়ায়ে কাযী খাঁ থেকে উদ্বৃত করা হয়েছে যে উচ্চস্বরে যিকর করা হারাম। কেননা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ থেকে বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি একদল লোককে মসজিদ থেকে কেবল এজন্যই বের করে দিয়েছেন, তারা উচ্চস্বরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও হুযুর (ﷺ) এর প্রতি দরূদ পাঠ করছিল এবং বলেছেন আমি তোমাদেরকে বিদআতী মনে করি।’’  ৩৬৯

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৯৮।}


দেখুন, সদলবলে উচ্চস্বরে যিকর করা ও দরূদ শরীফ পড়া হারাম এবং হযরত ইবনে মসউদ (رضي الله عنه) ওই সমস্ত যিকরকারী ও দরূদ পাঠকারীগণকে বিদআতী বলেছেন বরং তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিয়েছেন। কিন্তু আফসোস! আজকাল উচ্চস্বরে যিকর করতে অনিচ্ছুকদেরকে ওহাবী বলা হয়। এটা কালের বিবর্তনের ফল ঈমান কুফরী হয়ে গেছে আর কুফরী ঈমান (রাহে সুন্নাত)


উত্তরঃ এর দু’টি উত্তর আছে-ইলযামী ও হাকীকী। ইলযামী উত্তর হলো তাহলে আপনারাও বিদআতী ও হারামের অনুসারী হয়ে গেছেন। কেননা আপনাদের দ্বীনি ও রাজনৈতিক সভা হয়ে থাকে এবং বক্তৃতার সময় নারায়ে তকবীর ও অমুক সাহেব জিন্দাবাদ বলে থাকেন আর এ সব সভা রাতদিন মসজিদসমূহে হয়ে থাকে। কৈ আপনারা তো উচ্চস্বরে যিকরের বেলায় না ফাতওয়া দেন, না ওদেরকে বাধা দেন?


শুধু উচ্চস্বরে দরূদ শরীফ পড়াটা হারাম, অথচ আপনাদের সভা সমিতির শ্লোগান ইত্যাদি জায়েয।


হাকীকী উত্তরটা হলো বিরোধিতাকারীরা ফতওয়ায়ে বযাযিয়া ও শামীর যেই অংশটুকু তাদের সমর্থনে উদ্ধৃত করেছে, আর যেই অংশটুকু বাদ দিয়েছে, যদি তা না করে সম্পূর্ণ ইবারতটা উদ্ধৃত করতো, তাহলে এর উত্তর ওই কিতাবদ্বয়েই পাওয়া যেত। দেখুন


❏ একই জায়গায় শামীতে উলে­খিত আছে-


وَأَمَّا رَفْعُ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ فَجَائِزٌ كَمَا فِي الْأَذَانِ وَالْخُطْبَةِ وَالْجُمُعَةِ وَالْحَجِّ اهـ وَقَدْ حَرَّرَ الْمَسْأَلَةَ فِي الْخَيْرِيَّةِ وَحَمَلَ مَا فِي فَتَاوَى الْقَاضِي عَلَى الْجَهْرِ الْمُضِرِّ.


-‘‘উচ্চস্বরে যিকর করা জায়েয, যেমন আযান, জুমার খুতবা ও হজ্বে হয়ে থাকে। এবং  এ মাসআলাটা ফাত্ওয়ায়ে খাইরিয়াতে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর ফাতওয়ায়ে কাজী খাঁয় যেটা বলা হয়েছে, সেটার দ্বারা ক্ষতিকর উচ্চস্বরকে বোঝানো হয়েছে।’’৩৭০

{➥370. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৯৮।}


প্রমাণিত হলো যে, হযরত ইবনে মসউদ (رضي الله عنه) ওই সমস্ত লোকদেরকে বিদআতী বলেছেন, যারা অন্যান্য লোকদের প্রথম জামাতের নামায পড়ার সময় উচ্চেস্বরে যিকর করতো। যার ফলে নামাযের ব্যাঘাত সৃষ্টি হতো বা অন্য কোন ধর্মীয় ক্ষতি ছিল। মোট কথা হলো, ক্ষতিকর যিকর নিষিদ্ধ। এবার ফাতওয়ায়ে বযাযিয়াটাও একটু দেখুন। এখানে হযরত ইবনে মসউদের হাদীছটা উদ্ধৃত করে উত্থাপিত একটি আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে-যদি আপনারা বলেন যে, ফাতওয়ায়েতো আছে উচ্চেস্বরে যিকর থেকে কাউকে বাধা দিও না, যদিও বা তা মসজিদে করা হয়, যাতে কুরআনের সেই আয়াতের বিপরীত হয়ে না যায়-


وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللَّهِ أَنْ يُذْكَرَ.


যে কেউ আল্লাহর মসজিদ সমূহে তাঁর যিকর করতে বাধা প্রদান করে ও ওদের বিনাশ সাধনে প্রয়াসী হয়, তার অপেক্ষা বড় জালিম কে হতে পারে?   ৩৭১

{➥371. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১১৪।}


❏ অথচ হযরত ইবনে মসউদের আমল আপনাদের এ ফাতওয়ার বিপরীত। এর উত্তরে যা বলা হয়েছে, তাতে এও রয়েছে-


الاخراج عن المسجد يجوز ان يكون لاعتقادهم العبادة فيه وليعلم الناس بانه بدعة والفعل جائز والجائز يجوز ان يكون غير جائز لغرض يلحقه.


-তাঁর পক্ষে ওদেরকে মসজিদ থেকে বের করা ন্যায়সঙ্গতঃ ছিল। এজন্য যে ওসব লোকের আকীদা হলো-এ উচ্চস্বরটাও ইবাদত এবং লোকদেরকে এটা জানানো যে এ আকীদাটা বিদআত। জায়েয কাজ কোন কোন সময় বৈপত্তিক কারণে নাজায়েয হয়ে যায়।  ৩৭২
✧ এই ফতওয়ার সেই একই জায়গায় সুস্পষ্ট উল্লে­খিত আছে-

واما رفع الصوت بالذكر فجائز كما فى الاذان والخطبة والحج

-উচ্চস্বরে যিকর জায়েয আছে যেমন আযান, খুতবা ও হজ্জে করা হয়ে থাকে।’’

যুক্তি গত আপত্তিসমূহঃ


বিরোধিতাকারীগণ কেবল তিনটি যুক্তিগত আপত্তি উত্থাপন করে থাকেন। প্রথমটা হচ্ছে খোদা আমাদের সন্নিকটেই আছেন। তাহলে জোরে চিৎকার করার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? এর উত্তর ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে যে, উচ্চেস্বরে করাটা আল্লাহকে শোনানোর জন্য নয় বরং অন্যান্য উপকারের জন্য করা হয়, যেমন আযান ইত্যাদি উচ্চস্বরে দেয়া হয়। দ্বিতীয়টা হচ্ছে এ দরুদ শরীফটা হাদীছ থেকে প্রমাণিত নেই তাই নাজায়েয। এর উত্তরও এ কিতাবের অন্যত্র দেয়া হয়েছে যে ওষুধ, খাদ্য ও দুআর ক্ষেত্রে অবিকল অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই বরং যেটা নাজায়েযের পর্যায়ে পড়বে না, সেটা জায়েয।

        

এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে বিশেষ করে কোন দরুদ শরীফ আফযল, তা জানতে চাইলে, আমার কিতাব ‘শানে হাবীবুর রহমান’ দেখুন। তৃতীয়টা হচ্ছে নামাযের পর উচ্চস্বরে যে দরুদ শরীফ পাঠ করা হয়, তাতে নামাযীদের অসুবিধা হয়, নামায ভুলে যায়। তাই উচ্চেস্বরে দরুদ পড়া নাজায়েয।


        উত্তরঃ এর কয়েকটি উত্তর দেখা যায়। প্রথমতঃ এ আপত্তিটা বক্তব্য অনুযায়ী হয়নি। কেননা আপনারা বলেন যে, উচ্চস্বরে যিকর করা একেবারে নিষেধ। কিন্তু আপনাদের এ আপত্তি থেকে প্রতিভাত হয় যে এর দ্বারা যদি কোন নামাযীর অসুবিধা হয় তাহলে নাজায়েয, অন্যথায় জায়েয। তাহলে যখন নামাযরত কেউ না থাকে, তখন জায়েয হওয়া চাই।


        দ্বিতীয়তঃ পাঞ্জাবে দেখা যায় যে, ফজর নামাযের পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এবং ইশার নামাযের সময় সুন্নাত ও বিতর পড়ার পরে দরূদ শরীফ পাঠ করা হয় এবং ওই সময় সব লোক নামায থেকে ফারেগ হয়ে যায়। তৃতীয়তঃ আমি এ আলোচনার প্রথম অধ্যায়ে এ ধরনের হাদীছসমূহ উপস্থাপন করেছি যে হুযুর আলাইহিস সালাম ও সাহাবায়ে কিরাম নামাযের পর উচ্চস্বরে যিকর করতেন। অধিকন্তু এখনও অনেক মসজিদকে হিফজখানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেখানে ছাত্ররা জোহর ও ইশার নামাযের পর জোরগলায় কুরআন মুখস্থ করে। কোন কোন সময় ইশার নামাযের পর মসজিদে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, যেখানে নারায়ে তকবীর দেয়া হয় ও বক্তৃতা করা হয়। কুরবানী ঈদের সময় ফরয নামাযের জামাত শেষ হবার সাথে সাথে উপস্থিত সকলে উচ্চেস্বরে তিনবার তকবীরে তশরীক বলে। বলুন, এ সব যিকরের ফলে নামাযীর ধ্যান ভঙ্গ হয় কিনা? এবং এটা জায়েয কি নিষেধ? ফকীহগণ যে বলেন উচ্চস্বরে যিকর দ্বারা নামাযীদের অসুবিধা হেতু নিষেধ এর উদ্দেশ্যে সুস্পষ্ট। যখন জামাতের সময় লোকেরা নামাযে মশগুল, তখন যদি উচ্চস্বরে যিকর করা হয়, তা নিশ্চয়  নিষেধ হবে। কিন্তু নামায হয়ে গেলে পর যিকর বা তিলাওয়াত করা জায়েয। কিন্তু কোন ব্যক্তি জামাত শেষ হবার পরে এসে নামায পড়ার বাহানায় সবাইকে যদি নিশ্চুপ করানোর উদ্দেশ্যে বলে-হে নামাযী ভাইসব, হে কুরআন তিলাওয়াত কারীগণ, হে যিকরকারীগণ, হে বক্তাগণ আপনারা সবাই নীরব হোন, আমাকে নামায পড়তে হবে; এ ধরনের কথার প্রতি কর্ণপাত করার কোন প্রয়োজন নেই।


        জেনে রাখা দরকার যে মসজিদ সমূহে প্রথম জামাতের প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করা হয়। এ প্রসঙ্গে শরীয়তের অনেক মাসায়েল রয়েছে। মক্কা শরীফে কেবল প্রথম জামাতের সময় তওয়াফ বন্ধ থাকে। জামাত শেষ হবার সাথে সাথে তওয়াফ শুরু হয়ে যায়। তওয়াফের সময় দুআর শোরগোল এ রকম হয়ে থাকে যে কানফাটা আওয়াজও শোনা যায় না। বলুন ওখানে এ উচ্চস্বরে যিকরের কি হুকুম হতে পারে? নামাযীদের অসুবিধার কারণে কি তওয়াফ বন্ধ করাবে?


Top