❏ প্রশ্ন-১২৬ঃ কোন মজলিসে সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে সমাবেশে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে হযরাত ওলামায়ে কিরামের মতামত কী? যা বর্তমানে প্রচলিত আছে। শরীয়তের বিধান মতে তা জায়েয কিনা? এটির ওপর কিয়াস করে মিলাদুন্নবী -এর মাহফিলে দাঁড়িয়ে কিয়াম করার হুকুম কি?
প্রথমতঃ মিলাদুন্নবী -এর যিকির করার পর দাঁড়ানো। আর
দ্বিতীয়তঃ সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে দাঁড়ানো।
উভয়টি কিন্তু এক নয়। কোন প্রকারের পার্থক্য ছাড়া একই হুকুম আরোপ করা কী? বিস্তারিত বর্ণনা কর।
✍ উত্তরঃ عليه التكلان وهو المستعان কিয়াম শব্দের অর্থ দাঁড়ানো। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য সে কিয়াম যা কোন সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তির আগমনে করা হয়। যা বর্তমানে সুপরিচিত ও প্রচলিত আছে যে, কোন সম্মানিত ব্যক্তি মজলিসে প্রবেশ করলে সমাবেশে উপস্থিত সকলেই তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যায়।
এ সম্পর্কে ‘আশি‘আতুল লুম‘আত’ ৪র্থ খন্ডর ৮ম পৃষ্ঠায় শায়খ মুহাক্কিক হযরত মুহাদ্দিস আবদুল হক দেহলভী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন যে, উক্ত মাসআলার ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে, মাহফিলে প্রবেশকারীর সম্মানার্থে দাঁড়ানো সুন্নাত। তারা দলিল হিসেবে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদীসটি উপস্থাপন করেন। হুযূর মোস্তফা(ﷺ) হযরত সা‘দ বিন মু‘আজ (رضى الله تعالي عنه)-এর আগমনে সাহাবা-ই কিরামদেরকে হুকুম দিয়েছিলেন-
قوموا الى سيدكم الخ
অর্থাৎ-‘তোমরা তোমাদের সরদার সা‘দের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাও।’
কতেক আলেম বলেন, এটা মাকরূহ, বিদ‘আত ও নিষিদ্ধ। তারা দলিল হিসেবে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদীস পেশ করেন যে, হুযূর সৈয়্যদুল কাউনাইন (ﷺ) সাহাবা-ই কিরামদেরকে দন্ডায়মান হতে নিষেধ করেছেন এবং একথাও বলেছেন যে, তোমরা অনারব লোকদের মতো অন্যের সম্মানার্থে দাঁড়াইও না।
অবশ্য অত্র অধ্যায়ে উভয় প্রকারের হাদীস বিদ্যমান আছে। বর্ণিত আছে যে, কখনো হুযূর মোস্তফা(ﷺ) হুকুম করেছেন এবং কখনো অবস্থার প্রেক্ষাপটে নিষেধও করেছেন। সুমহান উত্তম চরিত্রের অধিকারী হুযূর মোস্তফা(ﷺ) -এর সাহাবা-ই কিরামগণও কখনো কারো সম্মানার্থে দাঁড়িয়েছেন আবার কখনো দাঁড়ান নি।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম উভয় হাদীসের মধ্যে বৈপরীত্ব ও দ্বন্দ্ব এভাবে নিরসন করেছেন। কোন কোন ওলামা বলেছেন, এ সমাধান সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আসল কথা হলো, উভয় হাদীসের সমন্বয় এভাবে করা যায় যে, রাসূলে পাক উম্মতকে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছেন। হাদীস শরীফে এসেছে- بعثت لاتمم مكارم الاخلاق ‘আমি উত্তম চরিত্র পূর্ণতাদানের নিমিত্তে প্রেরিত হয়েছি।’ মানুষের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকৃতির লোক। কেউ রয়েছেন উত্তম ও উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ তা‘আলা সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর অন্যরা তাদের মোকাবিলায় নিকৃষ্ট ও অধম। যাদেরকে এ সম্মান দেয়া হয়নি। স্বাভাবিকতঃ একথা স্পষ্ট যে, এ জাতীয় অবস্থার তারতম্যের কারণে স্বভাব-চরিত্রেও তারতম্য ও তফাত হওয়া আবশ্যক। যেমন- মুকীম বা স্থায়ী বসবাসকারীর হুকুম মুসাফিরের জন্য সমীচীন নয়। অনুরূপভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ফকির আর স্বাস্থ্যবান ও রোগীর জন্য একই বিধান কখনো প্রযোজ্য নয়। অনুরূপভাবে সম্মানিত ও উৎকৃষ্ট ব্যক্তি; তাদের উৎকৃষ্টতা তাদেরকে নিম্নস্তরের লোকদের থেকে সম্মান প্রদর্শন কামনা করে। এমনকি তাদেরকে অহংকারী, দাম্ভিক ও আত্ম-পূজারী করে তোলে। তাই উৎকৃষ্টদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, অন্যদের থেকে সম্মান তালাশ করো না এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর অহংকার করো না। আর অন্যদেরকে শিক্ষা দিলেন যে, এ প্রকৃতির লোকদের তোমরা সম্মান করো না। যাতে মুসলমানদের মাঝে অধঃস্তনদের পক্ষ হতে সম্মান পাওয়ার মতো মহামারি ব্যাধি বিস্তার লাভ করতে না পারে। তাই হুযূর মোস্তফা (ﷺ) প্রভূর পক্ষ হতে শিক্ষার ওপর ক্ষান্ত না হয়ে স্বয়ং নিজেই বাস্তব নমুনা প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহর মহান রাসূল (ﷺ) হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় তা‘যিমের জন্য মানুষজন দন্ডায়মান হওয়াকে জায়েয রাখেন নি। এটা ছিল আল্লাহর প্রিয় হাবীব (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠতম পর্যায়ের বিনয়-নম্রতা ও মিনতির সুস্পষ্ট প্রমাণ
الله اكبر وصلّى الله على سيدنا محمد وعلى اٰله واصحابه اجمعين-اللهم صل على سيدنا محمد صلّى الله عليه وسلّم ابدًا ابدًا.
হযরাত সাহাবা-ই কিরামগণ (رضى الله تعالي عنه) সৈয়্যদুল মুরসালীন মোস্তফা(ﷺ) -এর তা‘যিম ও সম্মানার্থে এ কারণে দাঁড়াতেন না যে, হুযূর তা পছন্দ করতেন না। অথচ তাঁদের চেয়ে অধিক সম্মান হুযূর -এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মতো আর কে আছে? কারণ তাঁরা ভয় ও আদব রক্ষার্থে হুযূর (ﷺ)-এর সামনে উচ্চস্বরে কথাও বলতেন না।
অবশ্য আমাদের একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিয়ামের অনুমতি এবং তা নিষিদ্ধকরণের হুকুম দুই শ্রেণীর লোককে সম্বোধন করে দেয়া হয়েছে। আর কিয়াম হচ্ছে সম্মান প্রদর্শনের একটি নিয়ম ও রীতি মাত্র। কিয়াম ছাড়াও আরো অনেক নিয়ম ও মাধ্যম রয়েছে যা অবলম্বনে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা যায়। ভদ্র, উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাবান লোকদের ক্ষেত্রে এটি অবলম্বন করা আমলযোগ্য ও অপরিহার্য বিষয়।
কিয়ামে তা‘যিমী তথা সম্মানার্থে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমাদের কিয়ামের কথাও স্মরণে এসেছে যে, যা মওলুদ শরীফের মাহফিলে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর বিলাদত শরীফের যিকিরের পর করা হয়। উক্ত কিয়ামের ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের মাঝে মতানৈক্য ও মতভেদ বৃদ্ধি পেয়ে রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে উপনীত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে কম-বেশি, হ্রাস-বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত প্রত্যেক পক্ষেই আছে।
নিষ্পত্তি ও সমাধানমূলক কথা এই যে, হুযূর পাক (ﷺ) -এর বিলাদত শরীফের আলোচনা এটা যিকিরে মাহফিলের অন্তভুর্ক্ত। তবে শর্ত হলো জাল হাদীস এবং বানোয়াট ঘটনা যেন না হয়। যাতে বিশুদ্ধ হাদীসের রেওয়ায়েত ও সঠিক ঘটনার পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ প্রমাণিত হয় এবং হুযূর পাক -এর বরকতময় জীবনের ঐ সকল দিকসমূহ বর্ণনা করা হয়, যার প্রেক্ষিতে মুসলমানদের স্বীয় জীবনের বিভ্রান্ত দিকগুলো সংশোধনের দিকে উৎসাহিত ও দৃষ্টি দিতে পারে। মহান আল্লাহর বাণী,
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ .
আয়াতের বাস্তবতা প্রকাশ
167. সূরা তাওবা, আয়াতঃ ১২৮।