দ্বিতীয় অধ্যায়
উরস প্রসঙ্গে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব
১নং আপত্তি- মৃত্যুর পর যাতে আপনারা ওলী মনে করেন এবং যার উরস করেন, সে যে ওলী তা আপনারা কিভাবে বুঝলেন? কারো মৃত্যুর বেলায় নিশ্চিত হওয়া যায় না, সে কি ঈমান নিয়ে মরলো, নাকি বেঈমান হয়ে মরলো। তাই কোন মৃত ব্যক্তির বেলায়ত প্রাপ্তি কিভাবে জানা যেতে পারে? উচ্চস্তরের অনেক নেকবান্দাও কাফির হয়ে মারা যায়।
উত্তর- যিন্দেগীর প্রকাশ্য আহকাম মৃত্যুর পর চালু হয়। যে যিন্দেগী অবস্থায় মুসলমান ছিল, মৃত্যুর পর চালু হয়। যে যিন্দেগী অবস্থায় মুসলমান ছিল, মৃত্যুর পরও তাকে মুসলমান মনে করে তার নামায, কাফন দাফন এবং তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তি বন্টন ইত্যাদি করা হবে এবং যে যিন্দেগীতে কাফির ছিল, মৃত্যু পর না তার জানাযা, না হবে তার দাফন কাফন বা সম্পত্তি বন্টন। শরীয়তের হুকুম বাহ্যিক আচরণের উপরই হয়ে থাকে। কেবল সম্ভাবনাম কোন বিষয় গ্রহণযোগ্য নয়। তাই যিনি যিন্দেগীতে ওলী ছিলেন, তিনি মৃত্যুর পরও ওলী হিসেবে গণ্য হবেন। যদি কেবল সম্ভাবনাময় বিষয়ের উপর আহকাম চালু হয়, তাহলে কাফিরদের জানাযাও পড়ে নিন সম্ভবতঃ মুসলমান হয়ে মরতে পারে এবং মুসলমানের জানাযা না পড়ে আগুনে জ্বালিয়ে ফেলুন, কারণ সম্ভবতঃ কাফির হয়ে মরতে পারে। অধিকন্তু মিশকাত শরীফের কিতাবুল জানায়েয المشئ بالجنازة শীর্ষক অধ্যায় মুসলিম ও বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে বর্ণিত আছে যে, হুযুর ﷺ সামনে দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে গেল এবং লোকেরা এর প্রশংসা করলেন। তিনি ফরমালেন وَجَبَتْ (অবধারিত হয়ে গেছে) এরপর অন্য আর একটি জানাযা নিয়ে গেল এবং লোকেরা এর সমালোচনা করলেন। তিনি (ﷺ) বললেন وَجَبَتْ (অবধারিত হয়ে গেছে) হযরত উমর (رضي الله عنه) আরয করলেন- কি অবধারিত হয়ে গেল? তিনি (ﷺ) ফরমালেন প্রথমটার জন্য বেহেশত এবং দ্বিতীয়টার জন্য দোযখ। এরপর বললেন-
أَنْتُمْ شُهَدَاءُ اللَّهِ فِي الأَرْضِ.
-‘‘তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।’’ ২৭৬
{সহীহ বুখারী, কিতাবুুল জানাইয, ২/৯৭পৃঃ হা/১৩২৭}
এর তেকে বোঝা গেল, সাধারণ মুসলমান যাকে ওলী মনে করেন, সে আল্লাহর কাছেও ওলী বলে গণ্য। মুসলমানের মুখ থেকে ওই কথাটিই বের হয়, যা আল্লাহর দরবারে আলোচিত হয়। অনুরূপ যেটা মুসলমানগণ হালাল ও ছওয়াবের কাজ মনে করে, আল্লাহর কাছেও সেটা হালাল ও ছওয়ারের কাজ হিসাবে গণ্য। কারণ মুসলমানগণ হলেন আল্লাহর সাক্ষী। হাদীছই এর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন-
مَا رَآهُ الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ.
-‘‘যেটাকে মুমিনগণ ভাল জানে, ওটা আল্লাহর কাছেও ভাল বলে গণ্য।’’ ২৭৭
{ইমাম হাকেম, আল-মুুস্তাদরাক, হা/৪৪৬৫}
❏ কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান-
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ.
-‘‘আমি তোমাদেরকে ন্যায় পরায়ণ উম্মত হিসেবে গঠন করেছি, যাতে তোমরা জনগণের সাক্ষী হতে পারে।’’ ২৭৮
{সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১৪৩।}
মুসলমানগণ কিয়ামতেও সাক্ষী, দুনিয়াতেও সাক্ষী। আল্লাহ তা’আলা কুরআন করীমের সঠিকতা ও রসুলুল্লাহ ﷺের সত্যতা প্রমাণে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ও অন্যান্য বুযুর্গানে কিরামের সাক্ষ্য পেশ করেছেন এবং বলেছেন-
وَشَهِدَ شاهِدٌ مِنْ بَنِي إِسْرائِيلَ عَلى مِثْلِهِ.
-‘‘যখন নেককার মুমিনদের সাক্ষ্য দ্বারা নবুয়ত প্রমাণ করা যায়, তখন অনায়াসে বেলায়তও প্রমাণিত হতে পারে।’’ ২৭৯
{সূরা আল-আহহাফ, আয়াত নং-১০।}
এবং ওই সাক্ষ্য দ্বারা যখন কুরআনের সঠিকতা প্রমাণিত হতে পারে, তখন শরয়ী মাসায়েল কেন প্রমাণিত হতে পারবে না?
বিঃদ্রঃ এ প্রশ্নটা মক্কা মুকাররমায় হেরম শরীফের নজদী ইমাম করেছিল। এক সমাবেশে আমি এ জবাবটা দিয়েছিলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেচিলেন যে এ কথাটা সাহাবায়ে কিরামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; ওনারা যার সম্পর্কে যে রকম সাক্ষ্য দিবেন, সে রকম হয়ে যাবে আর ওখানে أَنْتُمْ (তোমরা) বলেছেন। আমরা ওই সম্বোধনের অন্তর্ভূক্ত নই। কারণ ওই সময় আমরা মওজুদ ছিলাম না। এর উত্তরে আমি বলেছি যে, মিশকাত শরীফেই সে একই জায়গায় বর্ণিত আছে-
وَفِي رِوَايَةٍ: الْمُؤْمِنُونَ شُهَدَاءُ اللَّهِ فِي الْأَرْضِ.
-‘‘অন্য এক রেওয়াতে বর্ণিত আছে যে, পৃথিবীতে মুসলমানগণ আল্লাহর সাক্ষী।’’ ২৮০
{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, কিতাবুল জানাইয, ১/৫২৪পৃঃ , হা/১৬৬২, ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৩/১৬৯ পৃঃ হা/২৬৪২}
এখানে أَنْتُمْ শব্দ নেই। অধিকন্তু কুরআন শরীফে সমস্ত আহকাম সম্বোধন শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন-
اقيموا الصلوة واتو الزكوة وغيره.
-‘‘নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর ইত্যাদি।’’
তাহলে কুরআন নাযিল হওয়ার সময় আমরা যেহেতু ছিলাম না, তাই আমরা এসব আহকাম থেকে মুক্ত, এসব আহকাম কেবল সাহাবায়ে কিরামের জন্যই ছিল। এটা নিছক ভুল ধারণা। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমস্ত মুসলমান কুরআন হাদীছের সম্বোধন শব্দসমূহের আওতার অন্তর্ভূক্ত। খোদার শুকর, এ বক্তব্যের ফলে ইমাম ছাহেবের রাগ এসেছে কিন্তু জবাব আসেনি।
২নং আপত্তি- হাদীছ শরীফে আছে-
وَلَا تَجْعَلُوا قَبْرِي عِيدًا.
-‘‘আমার কবরকে ঈদে পরিণত কর না।’’ ২৮১
{ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ২/২১৮ পৃঃ হা/২০৪২, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/২৯১ পৃঃ হা/৯২৬}
এর থেকে বুঝা গেল কবরের কাছে গণজমায়েত করা, মেলা বসানো নিষেধ। কেননা ঈদের ভাবার্থ হচ্ছে মেলা এবং উরসে গণজমায়েত হয় ও মেলাও বসে। তাই এটা হারাম।
উত্তরঃ ঈদ মানে গণজমায়েত আর হাদীছের অর্থ- “আমার কবরে জমায়েত হইও না, একলা আসিও” এ আজগুবী অর্থ কোত্থেকে আবিষ্কার করলো? ঈদের দিন আনন্দ প্রকাশ করা হয়, ঘরবাড়ী সাজানো হয় এবং খেলাধুলাও হয়ে থাকে। এখানে তা-ই বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ আমার পবিত্র কবরে আসলে চাইলে, আদব সহকারে এসো। এখানে এসে হৈ-হল্লা, খেল তামাসা কর না। যদি কবরে জমায়েত হওয়া নিষেধ হয়, তাহলে আজকাল মদীনা মনোয়ারার প্রতি দলে দলে লোক ধাবিতক কেন? اللهم ارزقناه পাঁচটি ওয়াক্ত নামাযের পর জনগণ একত্রিত হয়ে সালাম কেন পেশ করে? হাজী এমদাদুল্লাহ ছাহেব “ফয়ছালা এ হাপ্ত মাসায়ালা” গ্রন্থে উরস শীর্ষক আলোচনায় বলেছেন। وَلَا تَجْعَلُوا قَبْرِي عِيدًاএর সঠিক অর্থ হচ্ছে কবরে মেলা বসানো, আনন্দ উল্লাস করা ও সাজসজ্জা ও ধুমধামের আয়োজন করা নিষেধ। কিন্তু (উক্ত হাদীছের) অর্থ এ নয় যে কবরে জমায়েত হওয়া নিষেধ। অন্যথায় মদীনা শরীফে রওযা পাক যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে দলে দলে লোক যাওয়া নিষেধ হতো। এটা ভুল ধারণা। সুতরাং হক কথা হলো একাকী হোক বা দলবদ্ধভাবে হোক, উভয় ভাবে কবর যিয়ারত জায়েয। অথবা হাদীছের ভাবার্থ হচ্ছে তোমরা আমার কবরে ঘন ঘন আসা যাওয়া কর, ঈদের মত পূর্ণ বছর অতিবাহিত করে এসো না।
৩নং আপত্তি- প্রায় উরসসমূহে নারী পুরুষের অবাধ সমাগম,নাজ গান কাওয়ালী হয়ে থাকে। মোট কথা বুযুর্গানে উরস হচ্ছে নান হারামে কার্যের সমাহার এজন্য এটা হারাম।
উত্তরঃ এর মোটামুটি উত্তর হচ্ছে কোন সুন্নাত বা জায়েয কাজে হারাম বিষয়ের সংমিশ্রণের ফলে মূল হালাল কাজটা হারাম হয়ে যায় না। বরং হালাল হালালই থাকে আর হারাম হারামই।
❏ ফতওয়ায়ে শামীর ‘যিয়ারতে কুবুর’ শীর্ষক আলোচনায় উলেখিত আছে-
قَالَ ابْنُ حَجَرٍ فِي فَتَاوِيهِ: وَلَا تُتْرَكُ لِمَا يَحْصُلُ عِنْدَهَا مِنْ مُنْكَرَاتٍ وَمَفَاسِدَ كَاخْتِلَاطِ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَغَيْرِ ذَلِكَ لِأَنَّ الْقُرُبَاتِ لَا تُتْرَكُ لِمِثْلِ ذَلِكَ، بَلْ عَلَى الْإِنْسَانِ فِعْلُهَا وَإِنْكَارُ الْبِدَعِ، .... قُلْت: وَيُؤَيِّدُ مَا مَرَّ مِنْ عَدَمِ تَرْكِ اتِّبَاعِ الْجِنَازَةِ، وَإِنْ كَانَ مَعَهَا نِسَاءٌ وَنَائِحَاتٌ.
-‘‘ইমাম ইবনে হাজার (رحمة الله) বলেন, এজন্য কবর যিয়ারত ছেড়ে দিবেন না যে, ওখানে নাজায়েয কাজ হয়। যেমন নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, কারণ ওই রকম নাজায়েয কাজের দরুণ মুস্তাহাব ত্যাগ করতে হয় না। বরং যিয়ারত করা এবং বিদআত প্রতিরোধ করা জনগণের কর্তব্য।’’ ২৮২
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, কিতাবুল জানাইয, যিয়ারাতুল কুবুুর, ২/২৪২ পৃষ্ঠা}
ইতিপূর্বে উলেখিত সেই মাসআলাটি “জানাযার সাথে যাওয়াটা ছেড়ে দিও না যদিওবা এর সাথে বিলাপকারী থাকে” এর সমর্থন করে।
মক্কা বিজয়ের আগে কাবা শরীফে ও সাফা মারওয়া পাহাড়ে মূর্তি ছিল। কিন্তু মূর্তির কারণে মুসলমানেরাতো তওয়াফ ছেড়ে দেননি আর উমরাহও বাদ দেননি। তবে যখন আল্লাহ ক্ষমতা দিয়েছেন, তখন মূর্তিগুলোকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছেন। আজকাল বাজারে, ট্রেনে, বিভিন্ন দুনিয়াবী জনসভায় নারী পুরুষের সংমিশ্রণ হয়ে থাকে। এমনকি হাজীদের জাহাজে, অনেক সময় তওয়াফ করতে মিনা-মুযদালাফায় নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ হয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে কেউ মূল বিষয়কে নিষেধ করে না। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহেও অনেক সময় হারাম কাজ ঘটে যায়। কিন্তু এ কারণে মাদ্রাসা হারাম হয় না। অনুরূপ উরসে মহিলাদের যাওয়া এবং নাচ গান করা হারাম। কিন্তু এর কারণে মূল উরস হারাম হবে কেন? বরং ওখানে গিয়ে ওই সমস্ত নাজায়েয কাজ প্রতিরোধ কর এবং জনগণকে বোঝাও। দেখুন, জুদ ইবনে কায়েস নামক এক মুনাফিক আরয করেছিল- আমাকে তবুক যুদ্ধে শরীক করবেন না, কারণ রোম ও সিরিয়ার মহিলারা খুবই সুন্দর আর আমি হলাম নারীদের পাগল। তাই আমাকে ফিতনায় ফেলবেন না। কিন্তু কুরআন করীম এ অজুহাতকে খণ্ডন করেছেন-
أَلَا فِي الْفِتْنَةِ سَقَطُوا وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةٌ بِالْكَافِرِينَ.
-সাবধান! ওরাই ফিতনাতে পড়ে আছে। জাহান্নামতো কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করে আছে। ২৮৩
{সূরা তাওবাহ, আয়াত নং-৪৯।}
এ অজুহাতেও আল্লাহ তা’আলা কুফরী এবং জাহান্নামের সহায়ক বলেছেন। (তফসীরে রূহুল বয়ান ও তফসীর কবীর দ্রষ্টব্য) একই ধরনের আপত্তি কেবল বাধা দিবার জন্য আজকাল দেওবন্দীরা করে থাকে।
আজকাল বিবাহ শাদীতে হারাম কাজ হচ্ছে, যার ফলে মুসলমানেরা অধপতনে যাচ্ছে এবং গুনাহের ভাগীও হচ্ছে। কিন্তু এ সমস্ত হারাম কাজের কারণে বিবাহকে হারাম বলে কেউ বন্ধ করে দেয়নি।
আজকাল যে কাওয়ালী সাধারণভাবে প্রচলিত, যেখানে অশ্লীল বিষয়ের গান পরিবেশন করা হয় এবং ঙেখানে পাপীতাপাী, বড় ছোট সবাই জমাযেত হয় আর গানের তালে তালে নৃত্য করা হয়, এটা নিশ্চয়ই হারাম। কিন্তু যদি কোন জায়গায় এ ব্যাপারে পালনীয় সমস্ত শর্তাদি পালন পূর্বক কাওয়ালী হয় এবং কাওয়ালী পরিবেশনকারী আর শ্রোতাগণ যদি উপযোগী হয়, তাহলে একে হারাম বলতে পারেন না। বড় বড় অনেক সুফিয়ানে কিরাম উপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য সঠিক কাওয়ালী হালাল এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য হারাম বলেছেন। এর উৎস হলো সেই হাদীছটি, যেটা মিশকাত শরীফের কিতাবুল মনাকেব مناقب عمر (মনাকেবে উমর) শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে হুযুর আলাইহিস সালামের সামনে জনৈকা বাঁদী দপ বাজাচ্ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) তশরীফ আনলেন, সে কিন্তু দপ বাজাতে ছিল; হযরত উছমান (رضي الله عنه) তশরীফ আনলেন, তখনও সে দপ বাজাচ্ছিল। কিন্তু যখন হযরত ফারুকে আযম (رضي الله عنه) তাশরীফ আনলেন, তখন দপকে নিজের গায়ের নীচে দিয়ে বসে গেল। তখন হুযুর ﷺ ইরশাদ ফরমান- হে উমর! তোমাকে শয়তানও ভয় করে। এখন প্রশ্ন হলে দপ বাজানো শয়তানী কাজ ছিল কিনা। যদি শয়তানী কাজই ছিল, তাহলে কি শয়তান হুযুর আলাইহিস সালাম, হযরত সিদ্দিক আকবর (رضي الله عنه) ও হযরত উছান গণী (رضي الله عنه) কে ভয় করলো না? আর এতে স্বয়ং হুযুর ﷺ এবং ওই সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম কেন অংশ গ্রহণ করলেন? আর যদি শয়তানী কাজ না হতো, তাহলে হুযুর আলাইহিস সালামের এ ধরনের বলার কি অর্থ হতে পারে? এর উত্তর সেটাই হবে যে, হযরত ফারুকে আযম আসার আগে এ কাজটা শয়তানী ছিল না। তাই হচ্ছিল এবং হযরত ফারুকে আযম (رضي الله عنه) আসার সাথে সাথেই এটা শয়তানী হয়ে গেছে এবং সাথে সাথে বন্ধও হয়ে গেছে। এজন্য সুফিয়ানে কিরাম কাওয়ালীর জন্য ছয়টি শর্তারোপ করেছেন। এগুলোর একটি হচ্ছে মসলিসে যেন কোন অনুপযুক্ত ব্যক্তি না থাকে। অন্যথায় শয়তানের অনুপ্রবেশ ঘটবে। যেমন খাবার মজলিসে যদি কোন ব্যক্তি বিসমিল্লাহ না পড়ে খাওয়া শুরু করে, তাহলে শয়তানও এতে শরীক হয়ে যায়। এর দ্বারা এটা বোঝা যায় না যে হযরত ফারুকে আযম (رضي الله عنه) এর মর্যাদা কিছু কম। বরং সাহাবারে কিরামের এক এক জন এক এক দিকে মর্যাদাবান। কারো কাছে আনুগত্যের প্রাধান্য এবং কারো কাছে ভালবাসার প্রাধান্য রয়েছে। এজন্য তাদের প্রভাবও ভিন্নতর ছিল। যদি কোন গাউছ বা কুতুর বিসমিল্লাহ না বলে খেতে আরম্ভ করে, এতে শয়তান শরীক হয়ে যায়। এর জন্য গাউছের দোষারোপ করা হয় না।
❏ ফতওয়ায়ে শামীর পঞ্চম খন্ড কিতাবুল কারাহিয়াতের اللبس পরিচ্ছেদের একটু আগে বর্ণিত আছে ২৮৪-
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ৬/৩৫০ পৃঃ }
أَنَّ آلَةَ اللَّهْوِ لَيْسَتْ مُحَرَّمَةً لِعَيْنِهَا، بَلْ لِقَصْدِ اللَّهْوِ مِنْهَا..... أَلَا تَرَى أَنَّ ضَرْبَ تِلْكَ الْآلَةِ بِعَيْنِهَا حَلَّ تَارَةً وَحَرُمَ أُخْرَى بِاخْتِلَافِ النِّيَّةِ بِسَمَاعِهَا وَالْأُمُورُ بِمَقَاصِدِهَا وَفِيهِ دَلِيلٌ لِسَادَاتِنَا الصُّوفِيَّةِ الَّذِينَ يَقْصِدُونَ أُمُورًا هُمْ أَعْلَمُ بِهَا، فَلَا يُبَادِرُ الْمُعْتَرِضُ بِالْإِنْكَارِ كَيْ لَا يُحَرِّمَ بَرَكَتَهُمْ، فَإِنَّهُمْ السَّادَةُ الْأَخْيَارُ.
❏ তাফসীরাতে আহমদীয়ায় ২১ পারার সূরা লুকমানের আয়াতে -
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ
কাউয়ালীর অনেক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পরিশেষে এটাই বলেছেন যে উপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যই কাওয়ালী হালাল আর অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য এটা হারাম। এরপর বলেছেন - ২৮৫
{আল্লাল্লামা মোল্লা জিওন, তাফসিরে আহমদিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৬০৪।}
وبه ناخذ لانا شاهدنا انه نشاء من قوم كانوا عارفين و محبين لرسول الله وكانوا معذورين لغلبة الحال ويستكثرون السماع للغناء وكانوا يحسبون ذالك عبادة اعظم وجهادا اكبر فيحل لهم خاصة انتهى ملخصا.
হাজী এমদাদুল্লাহ ছাহেব ফয়সালা এ হাপ্ত মাসায়েলা গ্রন্থে উরসের আলোচনায় কাউয়ালী প্রসংগে বলেছেন- মুহাককিকদের অভিমত হচ্ছে যদি জায়েযের শর্তসমূহ কাউয়ালী প্রসংগে বলেছেন- মুহাককিকদের অভিমত হচ্ছে যদি জায়েযের শর্তসমূহ পাওয়া যায় এবং নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ দূরীভূত করা হয় তাহলে জায়েয, অন্যথায় জায়েয নয়।
❏ মৌলভী রশীদ আহমদ ফতওয়ায়ে রশিদীয়ার كتاب الخطر والاباحت এর ৬১ পৃষ্ঠায় উলেখ করেছেন যে বাদ্যযন্ত্রবিহীন রাগ (গান) শুনা জায়েয। যদি গায়ক উচ্ছৃঙ্খল না হয় এবং রাগের বিষয়বস্তু শরীয়ত বিরোধী না হয়, তাহলে সংগীতের মত হলেও কোন ক্ষতি নাই। সারকথা হলো কাউয়ালী উপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য শর্তসাপেক্ষ জায়েয এবং শর্তহীন ভাবে অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য হারাম।
আল্লামা শামী (رحمة الله عليه) ফতওয়ায়ে শামীর কিতাবুল কিরাহিয়ায় কাউয়ালীর জন্য ছয়টি শর্তের কথা উলেখ করেছেন। এ শর্তগুলো হচ্ছে-
(১) মজলিসে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দাঁড়ী বিহীন কোন ছেলে না থাকা
(২) সমবেত সবাই উপযুক্ত হওয়া এবং অনুপযুক্ত কেউ না থাকা
(৩) কাউয়ালের নিয়ত খাঁটি হওয়া এবং উপার্জানের উদ্দেশ্য না থাকা।
(৪) শ্রোতাগণ খাবার ও স্বাদ গ্রহণের নিয়তে জমায়েত না হওয়া।
(৫) বিনা আত্মহারায় না দাঁড়ানো এবং
(৬) গানগুলো শরিয়ত বিরোধী না হওয়া।
কাউয়ালী শুনার উপযুক্ত হলো সেই, যাকে আত্মহারা অবস্থায় তলোয়ারের আঘাত করলেও কিছু বলতে পারে না। কতেক সুফিয়ানে কিরাম বলেন, যাকে সাত দিন পর্যন্ত খাবার দেয়া হলো না। এরপর একদিকে গান অন্যদিকে খাবার রাখা হলে, সে যদি খাবারের দিকে খেয়াল না করে গানের প্রতিই আকৃষ্ট থাকে, সেই কাউয়ালী শুনার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। আমার এ আলোচনার উদ্দেশ্য এ নয় যে, আজকাল প্রচলিত সাধারণ কাউয়ালীকে হালাল বলা বা সাধারণ লোকদেরকে কাউয়ালী শুনার প্রতি আকৃষ্ট করা। আমি বিরুদ্ধবাদীদের অনেককে কেবল কাউয়ালীর কারণে সুফিয়ানে কিরামকে গালি দিতে শুনেছি। তারা কাউয়ালীকে যেনার মত হারাম বলেছে। এ জন্য আরয করতে বাধ্য হলাম যে, ইচ্ছা না হলে কাউয়ালী না শুনুন, কিন্তু ওই সমস্ত ওলীউল্লাহ যাদের দ্বারা সেমা প্রমাণিত তাদের দোষারোপ কর না। কাউয়ালী হচ্ছে এক প্রকার ব্যথার অষুধ। তাই যার ব্যথা আছে, সে সেবন করবে এবং যার ব্যথা নাই সে সেবন করবে না।
❏ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (رحمة الله عليه) বলেন -
كه نه ايں كار مى كنم ونه انكار مى كنم.
(আমি এ কাজ করিও না এবং অস্বীকারও করি না)
আমি অনেক লোককে বলতে শুনেছি- হাদীছ শরীফে যেহেতু গানের কুফল বর্ণনা করা হয়েছে, সেহেতু এর বিপরীত খাজা আজমীরী ও ইমাম গাযযালীর কথার কোন মূল্য নেই; এরা সব ফাসিক ছিল” মায়াজ্জাল্লাহ এসমস্ত কথায় আমি খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। তাই এ সংক্ষিপ্ত মাসআলাটা বর্ণনা করলাম।
৪নং আপত্তি- যদি এ কায়দাটা সঠিক হয় যে হালাল কাজে হারামের সংমিশ্রণের ফলে হালাল কাজ হারাম হয় না, তাহলে তাযিয়া (হাসান হুসাইনের কৃত্রিম কবর নিয়ে শোভাযাত্রা) মূর্তি পূজারীদের মেলা, খেল তামাশা, সিনেমা- থিয়েটার ইত্যাদি সব জায়েয হবে, কারণ ওসবের মধ্যে কিছু না কিছু জায়েয কাজও হয়ে থাকে। ওসবের বেলায়ও তাহলে বলুন, এসব জামায়েত হারাম নয় বরং এগুলোতে যা মন্দ কাজ আছে এগুলো হারাম এবং যে সব জায়েয কাজ আছে ওগুলো হালাল। কিন্তু ফকীহগণ বলেন- যে বৌ ভাতের অনুষ্ঠানে নাচ-গান হয়, সেখানে যাওয়া নিষেধ। অথচ দাওয়াত গ্রহণ করা সুন্নাত কিন্তু হারাম কাজের সংমিশ্রণের ফলে হারাম হয়ে গেছে। উরসের বেলায়ও তাই হয়েছে। বিরোধিতাকারীদের এটাই হচ্ছে সর্ব শেষ আপত্তি।
উত্তরঃ একটি হচ্ছে হালালের সাথে হারাম কাজ মিলিত হওয়া আর একটি হচ্ছে হালালের সাথে হারাম সংমিশ্রিত হওয়া যেখানে হারাম কাজ হালালের অংশ হয়ে যায় এবং একে বাদ দিয়ে সে কাজটা হয় না এবং হলেও ওই নামে হয় না। এমতাবস্থায় হারাম কাজ হালালকেও হারামে পরিণত করে। আর যদি হারাম কাজ ওই রকম অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিণত না হয়, বরং কোন কোন সময় মিলিত হয় আবার কোন সময় হয় না, তাহলে এ ধরনের হারাম কাজ মূল হালাল কাজকে হারাম করতে পারেনা। যেমন, পেশাব কাপড়ে লাগলে এবং পানিতে পড়লো। কাপড়েরর অংশে পরিণত হলোনা কিন্তু পানির অংশে পরিণত হয়ে গেল আর শরীয়তের হুকুমও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো। বিবাহ শাদীতে, ভ্রমণে, বাজারে ও অন্যান্য ব্যাপারে হারাম কাজের অনুপ্রবেশ ঘটে কিন্তু ওসবের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয় না অর্থ্যাৎ ওগুলোকে বাদ দিলে কোন কিছু আসে যায় না। তাযিয়া মিছিলে নাজায়েয কাজের সংমিশ্রণ এমনভাবে হয়েছে যেগুলোকে বাদ দিয়ে তাযিয়া মিছিল হতেই পারে না। আর হলেও ওটাকে তাযিয়া মিছিল বলা হবে না। অবশ্য যদি কেউ মহান কারবালার নকশা এঁকে ঘরে রেখে দিল, এবং একে মাটিতে দাফনও করলো না আর কোন হারাম কাজের সংমিশ্রণও হতে দিল না, তাহলে জায়েয আছে। কেননা নিষ্প্রাণ বস্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করা মুবাহ। খোদার শুকর, নাকর, নাচ-গান ইত্যাদি উরসের অংশে পরিণত হয়নি। এসব হারাম কাজ থেকে মুক্ত অনেক অনেক উরস হয়ে থাকে এবং ওগুলোকে উরসই বলা হয়।
যেমন সেরহিন্দ শরীফে সম্পূর্ণ হারাম কাজ থেকে মুক্ত অবস্থায় হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (رحمة الله عليه) এর উরস হয়ে থাকে। লোকেরা সাধারণভাবে হযরত আমিনা খাতুন (رضي الله عنه), সৈয়্যদেনা আবদুল্লাহ ও ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه) এর উরস করে থাকে এবং ওখানে কেবল ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয় এবং খাবার, শিরনী ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়। আর প্রত্যেক দাওয়াত কবুল করা সুন্নাত নয়।
যেমন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদের দাওয়াত, কুপ্রথা অনুসারে ধনীদেরকে মইয়তের উত্তরসূরীর দাওযাত, যার কাছে কেবল হারাম সম্পদই আছে, তার দাওয়াত কবুল করা নাজায়েয। অনুরূপ বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে যদি ঠিক খাবার ঘরে নাচ-গান হয়, সেই দাওয়াত কবুল করা নিষেধ। কিন্তু কবর যিয়ারতের ক্ষেত্রে এ ফতওয়া প্রযোজ্য নয়। কারণ দাওয়াতটা হারাম কাজের সংমিশণের ফলে সুন্নাত হতে পারে নি। কিন্তু কবর যিয়ারত যেহেতু যে কোন অবস্থায় সুন্নাত, তাই এটা হারাম হতে পারে না। যেমন যে কোন অবস্থান দাফন কার্যে শরীক হওয়া সুন্নাত। ওখানে হারাম কার্যাদি হলে এর দ্বারা সুন্নাত হারাম হবে না। এটা খুবই সূক্ষ্ম পার্থক্য, স্মরণ রাখা উচিত।