❏ প্রশ্ন-৬ঃ তাওহীদের ভিত্তি কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত?
✍ উত্তরঃ রিসালতের বিশুদ্ধ ও সঠিক ভিত্তির ওপর তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং যার তাওহীদের ভিত্তি রিসালতের বিশুদ্ধ আক্বীদার ওপর প্রতিষ্ঠিত না হবে, তা প্রকৃত তাওহীদ নয়। তাই যার রিসালত সম্পর্কে চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা ভুল হবে, তার তাওহীদও প্রকৃত ইসলামী তাওহীদ নয়। বরং উহা ঐ সকল লোকের তাওহীদ হবে যারা রাসূলে কারীম (ﷺ) -এর আসল পরিচয় সম্পর্কে অবগত না হয়ে কেবল তাকে মাটির মানুষই মনে করে এবং যারা মুস্তফা (ﷺ) কে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হিসেবে অস্বীকার করেছে, তারা অবশ্যই গোমরাহ, পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত ফেরকা, প্রকৃত তৌহিদপন্থি নহে।
তাই لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ হলো মহান আল্লাহ'র একত্ববাদের দাবী, আর مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ হলেন এ দাবীর প্রকাশ্য ও প্রকৃষ্ট দলিল। অতএব দলিল উপস্থাপনে যদি কোন রকম ভুল-ত্রুটি হয়, তার দাবি উপস্থাপন গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং একথা প্রমাণিত হলো যে, রিসালতের সঠিক ও বিশুদ্ধ আকীদার ভিত্তির ওপর প্রকৃত তাওহীদের ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা তাওহীদের বাহক হিসেবে বিশ্ব জগতের জন্য রহমতরূপে পাঠিয়েছেন তাঁর জ্যোর্তিময় নূরানী অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করছে এবং পবিত্র কোরআন মাজীদের পরিপন্থী এ ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করছে যে, হুযূর মুস্তফা (ﷺ) মাটির তৈরী আমাদের মতো সাধারণ মানুষ। কিন্তু এসব ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি নিবন্ধ করলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ সকল মুসিবত, গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতা এবং রাসূল কারীম (ﷺ) এর শারীরিক, দৈহিক ও আত্মার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অনবগত ও অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
এ সম্পর্কে চার অন্ধের হাতী সম্পর্কে একটি ঘটনা উদাহরণ স্বরূপ উপস্থাপন করা যায়। কথিত আছে যে, চার অন্ধের একজনের হাত হাতীর লম্বা দাঁতের ওপর পড়ল, দ্বিতীয় জনের হাত কানের ওপর, তৃতীয় জনের হাত পায়ের ওপর এবং চতুর্থ জনের হাত তার লেজের ওপর পড়ল। এ চারজনই ভাগ্যের নিমর্মতায় নিজ নিজ জ্ঞানানুসারে তাদের দাবীতে সত্য ছিল। কিন্তু অন্ধত্বের কারণে তারা হাতীর দেহের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারেনি। তাই তাদের প্রত্যেকের দাবী ভুল ও অবাস্তব প্রমাণিত হলো, যা তাদের মতভেদ ও মত পার্থক্যের মূল রহস্য ও কারণ ছিল। অন্ধ লোক সম্পর্কে হাতীর উদাহরণ তো সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলিত আছে।
বেশ কিছু দিন পূর্বে একটি আশ্চার্যজনক ঘটনার অবতারণা হয়েছে যে, লাউড স্পীকার আবিষ্কারের সূচনা থেকেই সাধারণ ওলামায়ে কিরাম ছাড়াও প্রখ্যাত শীর্ষ ও বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামরাও এ ফতোয়া প্রদান করেন যে, লাউডস্পীকার শুধু বাদ্যযন্ত্র ও খেলা-ধুলার যন্ত্রের নাম। সুতরাং ওয়াজ-নসিহত ও দ্বীন-ধর্মের প্রচারের মতো ভালো কাজে এর ব্যবহার মাকরূহ ও নিষিদ্ধ। অথচ লাউডস্পীকার শুধু আওয়াজ বর্ধক যন্ত্র বৈ আর কিছুই নয়। এটাকে ভাল-মন্দ সব কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতএব, পরবর্তীতে আওয়াজ বর্ধক যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধকারী সকল শীর্ষ ওলামায়ে কিরামের ফতোয়া ভুল প্রমাণিত হলো। যার মূল কারণ এটাই ছিল যে, মাইক তৈরীর মূল উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি দেয়া ছাড়াই ফতোয়া দেয়া হয়েছিল। তাই একথা প্রমাণিত হলো যে, মূল উদ্দেশ্য ও বাস্তব বিষয় সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা ছাড়া গতানুগতিক রায় প্রদান করলে, তা যত বড় জ্ঞানী-গুণীর পক্ষ থেকে হোক বা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে হোক- তা ভুলই প্রমাণিত হবে।
ঠিক একই অবস্থা তাদের যারা রাসূলে কারীম(ﷺ) -এর আসমানী জ্যোর্তিময় আত্মা এবং তাঁর মাটির দেহের বাস্তবিক অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত; তারা অনবগতি ও মূর্খতার দরুন বরাবরই অজ্ঞতায় শামিল। তারা সর্বসাধারণ হোক বা সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে আলেম-ওলামা হোক। সুতরাং তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার সুস্পষ্ট দলিল এটাই যথেষ্ট যে, উপরিউক্ত বিষয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে, রাসূল সম্পূর্ণরূপে মাটির মানুষ। আবার কারো মতে, তিনি তো আমাদের মতো সাধারণ মানব কিংবা আমাদের মতো মাটির তৈরী মানুষ। অনুরূপভাবে তারা তাঁর আসমানী নূরানী আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। যা আসমান থেকে নাযিল করা হয় এবং জমিনে মাটির দেহে মানবরূপে গোপন থেকে আল্লাহর ঐশি বাণী প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়। ওহীর প্রত্যাদেশ এবং মাটির দেহের সমন্বয়ে অলৌকিক ও অতীব আশ্চার্যজনক মু‘জিযা তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়।
অতএব তাদের এ সকল মতামত ও প্রোপাগান্ডা শুধু কিয়াস ও আন্দায নির্ভর কথা-বার্তা। যা মূলতঃ বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। ফলে তারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। কেননা যে সকল কথা কিয়াস ও আন্দায নির্ভর বলা হয়ে থাকে, তা সত্য ও হক্বের মোকাবিলায় অকার্যকর।
যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِيْ مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ بِمَا يَفْعَلُوْنَ .
‘ওদের অধিকাংশ অনুমানেরই ভিত্তিতে অনুসরণ করে। সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না। ওরা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা সে বিষয়ে সবিশেষ অবগত।’
3. সূরা ইউনুস, আয়াতঃ ৩৬।
এখন দেখার বিষয় হলো, রাসূল এর হাকিকত এবং তাঁর জাত বা সত্তার আসল ও বাস্তবতা কী? হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ আল্লাহ'র রাসূল। তাঁর পবিত্র দেহ কখনো মানবীয় নয়, বরং আসমানী নূরানী পবিত্র সত্তা। এটাই মূলতঃ তাঁর রূহের বাস্তব রূপ এবং সত্তাগতভাবে নূরানী অস্তিত্ব। যা মানবীয় আসমানী নূরানী অস্তিত্বের চেয়ে অধিক পূতঃপবিত্র। অতএব রাসূলে পাক এর আসমানী নূরানী আত্মা দ্বারা তাঁর আসমানী নূরানী অস্তিত্ব উদ্দেশ্য; আর এটাই হলো রাসূল সত্তার মূল হাকিকত। কেননা মানবীয় মাটি-পানি পঞ্চইন্দ্রীয় দ্বারা সৃষ্ট দেহের হাকিকত মাটিই হয়ে থাকে। যেহেতু রাসূলে পাক এর রূহ মুবারক ঊর্ধ্বজগতের- মাটি ও পানি থেকে নয়; ফলে তা সৌন্দর্যের বিষয়ও হতে পারে না। তাঁর আত্মা হলো আসমানি যাকে মানবীয় আত্মাও বলা যায়। বাস্তবিক পক্ষে ওটাই মানবজাতির মূল হাকিকত। অনুরূপভাবে রাসূলে পাক-এর প্রকৃত সত্তা কখনো মানবীয় দেহ নয়।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন, وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ ‘মুহাম্মদ ইলাহ বা মাবুদ নন বরং মানব আকৃতিতে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল। এভাবেও বলা যায় যে, মুহাম্মদ আল্লাহ'র বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যকার আড়াল বা আবরণের নাম রাসূল। যাকে برزخ كبرىٰ ‘বরযখে কুবরাও’ বলা যায়। আল্লাহ্ তা‘আলার পরিচিতি লাভ এবং তাঁর তাওহীদ বা একত্ববাদের কেন্দ্রবিন্দুর নাম রিসালত বা বরযখে কুবরা, বা তাঁর গোপন রহস্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং এটাকে قصر اضافىও বলা যায়।
قصر اضافى অর্থাৎ- قصر الموصوف على الصفة-এর ব্যাখ্যা হলো- তিনি মাবুদ, ইলাহ বা রাব্বুল আলামীন নন, বরং তিনি হলেন- রাহমাতুলিল আলামিন (বিশ্বজগতের জন্য রহমত), শফিউল মুয্নিবীন (পাপীদের সুপারিশকারী) এবং খাতামুন নাবীয়্যীন (সর্বশেষ নবী)।