দ্বিতীয় অধ্যায়
(‘ইয়া রাসূলাল্লাহু’ বলা প্রসঙ্গে উত্থাপিত আপত্তি সমূহের বিবরণ)
১। কুরআন করীম ইরশাদ করছেঃ
وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ
-‘‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুকে ডেকো না, যা’ তোমার লাভ বা ক্ষতি কিছুই করতে পারে না।’’
{সূরাঃ ইউনূছ, আয়াতঃ ১০৬, পারাঃ ১১}
এ থেকে জানা গেল যে, খোদা ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা নিষেধ। অন্যত্র বলা হয়েছে-
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُهُمْ وَلَا يَضُرُّهُمْ
-‘‘এরা খোদা ছাড়া অন্য কিছুকে ডাকে, যা’ তাদের উপকারও করে না, ক্ষতিও করে না।’’
{সূরাঃ ফুরকান, আয়াতঃ ৫৫, পারাঃ ১৯}
সুতরাং, প্রমাণিত হল, খোদা ভিন্ন অন্যকে ডাকা মূর্তি পূজারীদের কাজ।
উত্তরঃ এ ধরনের আয়াতসমূহ যেখানে دُعَا দু’আ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এ দু’আ শব্দ দ্বারা ডাকার কথা বোঝানো হয়নি, বরং শব্দটির লক্ষ্যার্থ হচ্ছে পূজা করা (তাফসীরে জালালাইন ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থ সমূহ দ্রষ্টব্য।) এখানে একথাই বোঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পূজা করো না। দ্বিতীয় আয়াতটি এ লক্ষ্যার্থের প্রতি সমর্থন যোগাচ্ছে।
❏প্রতিপালক আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেছেনঃ
وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ
-‘‘যে বা যারা খোদার সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে (পূজা করে) ।’’
{সূরাঃ মু’মিন, আয়াতঃ ১১৭, পারাঃ ১৮}
এ থেকে বোঝা গেল, খোদা ভিন্ন অন্য কাউকে খোদা মনে করে ডাকাটা ‘শির্ক’। কেননা এতে খোদা ভিন্ন অন্যের ইবাদত বোঝা যায়। যদি এসব আয়াতের লক্ষ্যার্থ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সে সব আয়াত, হাদীছ ও উলামায়ে দ্বীনের উক্তিসমূহ, যা ইতিপূর্বে পেশ করেছি, যেখানে খোদা ভিন্ন অন্যকে ডাকা হয়েছে, সবই শির্কে পর্যবসিত হবে। জীবিতকে ডাকা হোক, বা মৃতকে ডাকা হোক, সর্বাবস্থায় ‘শির্ক্’ বলে গণ্য হবে। প্রত্যহ আমরা ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত ব্যক্তিদেরকে ডাকাডাকি করি। তাই, পৃথিবীতে কেউ শির্ক থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অধিকন্তু, ‘শির্ক্ বলা হয় খোদা ছাড়া অন্য কাউকে খোদার সত্ত্বা ও গুণাবলীতে অংশীদার গণ্য করাকে। কাউকে ডাকলে বা আহবান করলে খোদার গুণে অংশীদার করা হচ্ছে? এবং তা শির্ক হবে কেন?
২। কুরআন ইরশাদ করছেঃ
فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِكُمْ
-‘‘দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায় ‘আল্লাহকে স্মরণ কর।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১০৩, পারাঃ ৫}
এ থেকে জানা গেল যে, উঠতে বসতে খোদা ভিন্ন অন্য কারো নাম জপ করা শির্ক; এক মাত্র আল্লাহরই যিকির করা চাই।
উত্তরঃ এ আয়াত থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জিকরকে হারাম বা শির্ক জ্ঞান করা অজ্ঞানতা মাত্র। উক্ত আয়াত একথাই বলা হয়েছে যে, নামায আদায় করার পর তোমরা যে কোন অবস্থায়, যে কোনভাবে খোদার যিকির করতে পারবে। অর্থাৎ নামাযে নির্ধারিত নিয়মাবলী পালনের প্রয়োজনীয়তা ছিল- ওযু ছাড়া নামায হবে না, সিজদা, রুকু ও বসা অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা যাবে না এবং বিনা কারণে বসে শোয়ে আদায় করা যাবে না। কিন্তু নামাজের কাজ যখন সমাধান হয়ে যাবে, তখন এত সব নিয়মাবলী পালনের প্রয়োজন আর থাকছে না। এখন দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় খোদাকে স্মরণ করতে পারবে।
আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য- প্রথমতঃ এ আদেশাত্মক আয়াতে فَاذْكُرُو اللهَ (আল্লাহকে স্মরণ কর) যে আদেশটি দেয়া হয়েছে, তা কাজটির আবশ্যিকতা জ্ঞাপনের নিমিত্তে প্রয়োগ করা হয়নি, কেবল কাজটির বৈধতা জ্ঞাপনার্থে আদেশ দেয় হয়েছে। অর্থাৎ নামায ব্যতীত অন্য সময় খোদাকে স্মরণ করা, বা খোদা ভিন্ন অন্য কাউকে স্মরণ করা কিংবা একদম নিশ্চুপ থাকা সব কিছুর অনুমতি দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ আয়াতের এ আদেশটিকে আবশ্যিকতা জ্ঞাপনার্থে ধরে নিলেও খোদা ছাড়া অন্য কারো জিক্র নিষিদ্ধ প্রমাণিত হচ্ছে না। কেননা, খোদা ছাড়া অন্য কারো যিকরের সাতে খোদার যিকরের ‘বিরুদ্ধে বিরোধিতামূলক সম্পর্ক নেই; বরং আল্লাহর যিকরের সাথে বিরুদ্ধ বিরোধিতামূলক সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহর যিকির না করার (দু’টি বিরুদ্ধে বিরোধিতামূলক বিষয়ের প্রথমটি সত্য হলে, দ্বিতীয়টির মিথ্যা হবেই। আবার দ্বিতীয়টি মিথ্যা হলে প্রথমটি সত্য হবে অনিবার্যরূপেই।)
তৃতীয়তঃ আল্লাহর যিকির ও আল্লাহ ছাড়া অন্যের যিকির এ বিষয় দু’টিতে তর্কের খাতিরে যদি বিরুদ্ধে বিরোধিতামূলক সম্পর্ক আছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তা’হলেও বিষয় দু’টির একটি ওয়াজিব হবার কারণে অপরটি বেশীর পক্ষে হারাম হবে, শির্ক্ হবে না। স্মর্তব্য যে হারাম বা ফরয হওয়া এগুলো ‘কর্মেরই’ বৈশিষ্ট্য, কর্মের না বাচক সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য নয়।
চতুর্থতঃ হুযুর (আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লাম) এর যিকির পরোক্ষভাবে খোদার যিকির হিসেবে গণ্য। কুরআন ঘোষণা করছেঃ
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ
-‘‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৮০, পারাঃ ৫}
কালেমা, নামায, হজ্ব, দরূদ, খুতবা ও আযান মোট কথা সমস্ত ইবাদতে হুজুর (ﷺ) এর যিকর অন্তভুর্ক্ত ও জরুরী। এমতাবস্থায় নামাযের পরে অন্য যে কোন সময়ে উঠতে বসতে তাঁর যিকির হারাম হবে কেন? যে ব্যক্তি উঠতে বসতে সদা সর্বদা দরূদ শরীফ বা কলেমা পাঠ করে, সে হুযুরেরই যিকির করছে এবং সেজন্য ছওয়াবের ভাগী হচ্ছে।
পঞ্চমতঃ تَبَّتْ يَدَا اَبِيْ لَهَبٍ (তাব্বাত য়াদা আবি-লাহাব)
{সূরাঃ লাহাব, আয়াতঃ ১, পারাঃ ৩০}
সুরায়ে মুনাফিকুন ও অন্যান্য আয়াত যেখানে কাফিরদের বা তাদের প্রতিমা সমূহের উলেখ আছে, সে সব সূরা ও আয়াতের তিলাওয়াত আল্লাহর যিকির কিনা? নির্দ্বিধায় বলা যাবে, তা আল্লাহর যিকির। কারণ সেগুলো কুরআনের আয়াত। কুরআনী আয়াতের প্রতিটি অক্ষরের জন্য ছওয়াব নির্ধারিত, যদিও বা সেসব আয়াতে উলেখিত বিষয়বস্তু হচ্ছে কাফিরগণ বা তাদের প্রতিমা। কারণ, তা আল্লাহরই বাণী। কিন্তু এ কোন্ ধরনের ইনসাফ্, আল্লাহর কালামের যিকির আল্লাহর যিকর হিসেবে গণ্য হবে, আর রহমতে এলাহী বা নূরে এলাহী মুহাম্মদ রাসূলাল্লাহর যিকির আল্লাহর যিকিরে গণ্য হবে না? কুরআনে আছেঃ قَالَ فِرْعَوْنُ (কালা ফিরআওনু) অর্থাৎ ‘ফিরাউন বলল’। এখানে ‘কালা’ শব্দটি পাঠ করলে ৩০টি ছওয়াব এবং ‘ফিরআউন’ শব্দটি পাঠ করলে ৫০টি ছওয়াব পাওয়া যাবে। কারণ প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে ১০টি ছওয়াব নির্ধারিত। এখন লক্ষ্য করুন, কুরআনে ফেরাউনের নাম পাঠ করা হলে ছওয়াব পাওয়া যায় ৫০, আর মুহাম্মদ রাসূলাল্লাহর নাম নিলে ‘মুশরিক’ হতে হয়- এ কোন ধরনের যুক্তি?
সপ্তমতঃ হযরত ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) পুত্র হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর বিচ্ছেদ বেদনায় শোকাহত হয়ে উঠতে বসতে সদা হযরত ইউসুফের নাম উচ্চারণ করতেন এবং তাঁরই শোকে এত অধিক কান্নাকাটি করেছেন যে, তার চোখ দু’টি সাদা হয়ে গিয়েছিল। এরূপ হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) হযরত হাওয়ার বিচ্ছেদ ব্যথার বিবি হাওয়ার নাম জপ করতেন, হযরত যয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) স্নেহময় পিতা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শোকে উঠতে-বসতে পিতার নাম জপ করতেই থাকতেন। আর তাঁর শোকাহত অবস্থা যেন ব্যথাতুর হয়ে ফুটে উঠতঃ
حال من در هجر والد كمتر از يعقوب نيست
اوپسر گم كرده بود دومن پدر گم كرده ايم
অর্থাৎ পিতৃশোকে আমার অবস্থা হযরত ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) এর শোকাহত অবস্থার চেয়ে কম নয়। অবশ্যি তিনি হারিয়েছিলেন পুত্র, আর আমি হারিয়েছি পিতাকে।
এখন বলুন, তাঁদের উপর শিরক্ এর হুকুম প্রযোজ্য হবে কিনা? যদি প্রযোজ্য না হয়, তা’হলে যে আশেকে নবী নিজের নবীর নাম স্মরণ করেন, তিনি মুশরিক হবেন কেন? একজন ব্যবসায়ী দিনরাত তার ব্যবসার কথাই উলেখ করে। আর জ্ঞানান্বেষী ছাত্র দিন রাত সর্বদা নিজের পাঠের কথা স্মরণ করে। তারাও তো খোদা ছাড়া অন্য কিছুর নাম জপন্য করছে, তারা মুশরিক নয় কেন?
বিঃদ্রঃ- এ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলে ডাকার বৈধতা-অবৈধতা প্রসঙ্গে আমি এক তর্ক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম পাঞ্জাবের দীনা নগরে মৌলভি ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর সাথে। তিনি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে আলোচ্য আয়াতটিই (২নং প্রশ্নে উলেখিত আয়াত) পেশ করেছিলেন। আমি কেবল তিনটি প্রশ্ন রেখেছিলাম তাঁর কাছে। এক, কুরআনে আজ্ঞাবাচক শব্দসমূহ কয়টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এবং এখানে আয়াতে উলেখিত আজ্ঞাবাচক শব্দটি কোন্ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? দুই, এমন দুটি’ বিষয়ের, যা’দের মধ্যে ‘বিরুদ্ধ বিরোধিতামূলক’ সম্পর্ক রয়েছে, একটি ‘ওয়াজিব’ হলে অপরটি হারাম হবে কিনা? তিন, আল্লাহর যিকিরের সাথে যে বিষয়টির বিরুদ্ধ বিরোধিতা সম্পর্কে আছে, সে বিষয়টি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো যিকির করা, না আল্লাহর যিকির না করা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি এসব ব্যাপারে ‘উসুলে ফিকাহ’ ও যুক্তিবিদ্যাকে স্থান করে দিয়েছেন, অথচ এ উভয় বিদ্যাই ‘বিদআত’। অর্থাৎ অজ্ঞ থাকাই ‘সুন্নাত’। ‘তাহলে ‘বিদআতের’ এমন এক শুদ্ধ সংজ্ঞা দিন, যাতে মাহফিলে মীলাদ হারাম সাব্যস্ত হয়, আর ‘আহলে হাদীছ’ এর সংবাদপত্র প্রকাশ সুন্নাত হিসেবে গণ্য হয়- প্রশ্নাকারে বলেছিলাম আমি। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনও দেয়া হল না। আর জীবিতবস্থায় কেউ তাঁকে দিয়ে উক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদান করালে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাম। আফসোস! ছানাউল্লাহ সাহেব উত্তর না দিয়েই এ ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। আহা! তাঁর অনুরক্ত ও গুণগ্রাহীদের কেউ যদি উত্তর প্রদান করে তার আত্মাকে সন্তুষ্ট করত!
৩। বুখারী শরীফ ২য় খন্ডে এর كتاب الاستيذان بحث مصافحه باب الاخذباليدين শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত ইবনে মসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, হুযুর (ﷺ) আমাদেরকে ‘আত্তাহিয়াত’ তাশাহুদ’ পাঠে শিখিয়েছেনঃ
اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ اَيُّهَا النَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرْكَاتُهُ
হে নবী আপনার প্রতি সালাম, আপনার উপর আল্লাহর রহমত ও বরকত সমূহ বর্ষিত হোক। এরপরে আছেঃ
فَلَمَّا قُبِضَ قُلْنَا اَلسَّلاَمُ عَلَيْهِ يَعْنِىْ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
-‘‘ হুজুর (ﷺ) এর ওফাতের পরে আমরা ‘আততাহিয়াত’ পড়ার সময় বলেছিঃ নবীর উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’’
{বুখারীঃ আস-সহিহঃ ২/৯২৬ পৃ. হাদিসঃ ৬২৬৫}
❏উক্ত বুখারী শরীফের সুপ্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আইনী’তে এ হাদীছের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
وظاهرها أَنهم كَانُوا يَقُولُونَ: السَّلَام عَلَيْك أَيهَا النَّبِي، بكاف الْخطاب فِي حَيَاة النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم، فَلَمَّا مَاتَ تركُوا الْخطاب وذكروه بِلَفْظ الْغَيْبَة، فصاروا يَقُولُونَ: السَّلَام على النَّبِي
-‘‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে এ হাদিসের অর্থ দাঁড়ায়, সাহাবায়ে কেরাম হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র ইহকালীন জীবনে সম্বোধন করেই বলতেন ‘আসসালামু আলাইকা’ অর্থাৎ আপনার প্রতি সালাম। আরও পরিষ্কাররূপে বলতে গেলে, তাঁরা আরবী কর্মবাচক মধ্য পুরুষের শব্দ ব্যবহার করতেন। কিন্তু যখন নবীর ওফাত হয়ে গেল, তখন তারা মধ্যম পুরুষের কর্মবাচক শব্দটি ব্যবহারের রীতি পরিহার করে তদস্থানে নাম পুরুষের ব্যবহার আরম্ভ করলেন, আর বলতে লাগলেন ‘আস্সালামু আলান নবীয়ে’ অর্থাৎ- নবীর প্রতি সালাম।’’
{আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীঃ উমদাদুল ক্বারীঃ ২২/২৫৪পৃ. হাদিসঃ ৬২৬৫}
উক্ত হাদীছ ও তার ব্যাখ্যা গ্রন্থের ইবারত থেকে জানা গেল যে, তাশাহুদ পাঠে ‘আস্সালামু আলাইকা’ বলা হত হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র জীবদ্দশায়। তাঁর ওফাতের পর তাশাহুদ পাঠে তাঁকে সম্বোধনের রীতি বর্জিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম যেহেতু তাশাহুদ পাঠে নবীকে সম্বোধন করে ডাকার রীতি পরিহার করেছিল, সেহেতু কেউ নামাযের বাইরে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ ইত্যাদি বলে নীকে সম্বোধন করলে সে পুরোপুরি ‘মুশরিকরূপে গণ্য হবে।
উত্তরঃ বুখারী শরীফ ও ‘আইনীর উক্ত ইবারত আপনাদের মতেরও পরিপন্থী। কেননা, আজ পর্যন্ত কোন মুজতাহিদ ইমাম ‘তাশাহুদ (আত্তাহিয়াত) পরিবর্তন করার নির্দেশ দেন নি। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) গ্রহণ করেছেন হযরত ইবন মসউদ (رضي الله عنه) এর বর্ণিত তাশাহুদ, আর ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) গ্রহণ করেছেন হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) এর বর্ণিত তাশাহুদ। উভয় তাশাহুদে “আসসালামু আলাইকুম আইয়ুহান নবীইয়ু” ইবারতটুকু উলেখিত আছে। লা-মাযহাবীরাও ছনায়ী দলভুক্ত হোক বা গজনবী দলভুক্ত এ সম্বোধন পদ সম্বলিত তাশাহুদ পাঠ করে থাকে। সুতরাং, বুখারী ও আইনীর ইবারত থেকে জানা যাচ্ছে যে, কোন কোন সাহাবী স্বীয় ইজতিহাদ (গবেষণা) অনুযায়ী ‘তাশাহুদ পরিবর্তন করেছিলেন, কিন্তু ‘হাদীছে মরফু’র মুকাবিলায় সাহাবীর নিজস্ব গবেষণালব্ধ বিষয় গ্রহণযোগ্য নয়। (যে হাদীছের বর্ণনাকারীদের সূত্র অব্যাহতভাবে হুজুর (ﷺ) পর্যন্ত বিস্তৃত, সে হাদীছকে হাদীছে মরফু বলা হয়।) আর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা পরিবর্তন করেছিলেন, তারা এজন্য পরিবর্তন করেন নি যে অদৃশ্য বা অনুপস্থিত সত্ত্বাকে সম্বোধন করা হারাম। তা না হলে হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র জীবদ্দশায় দূর বসবাসকারী সাহাবায়ে কেরাম এ সস্মোবধন পদ (হে নবী) সম্বলিত তাশাহুদ পাঠ করতেন না। সুদূর ইয়ামন, খাইবার, মক্কা মুকাররমা, নজদ ও ইরাকের সব জায়গায় নামায পড়া হত। সব জায়গায় সে একই তাশাহুদ পাঠ করা হত। অদৃশ্য বা অনুপস্থিত সত্ত্বাকে সম্বোধন করার প্রচলণ সমানভাবে বিদ্যমান ছিল। কারণ, হুজুর (ﷺ) হেজাযে বসবাস করছিলেন এবং হেজাযসহ অন্যান্য সব জায়গায় সম্বোধন পদ সম্বলিত তাশাহহুদ পাঠ করা হচ্ছিল। সে ব্যাপারে না হুজুর (ﷺ) নিষেধ করেছিলেন, না সাহাবায়ে কেরাম কোন সংশয় প্রকাশ করেছেন। আর হুযুর (ﷺ) ও তাশাহুদের ইবারত শিখানোর সময় একথা বলেন নি যে, ‘এ তাশাহুদ কেবল আমার পবিত্র ইহকালীন সময়ের জন্য প্রযোজ্য; আমার ওফাত শরীফের পর অন্যভাবে তা পাঠ করিও।
❏ফতোয়ায়ে রশীদিয়াহ’ গ্রন্থ প্রথম খন্ডের কিতাবুল আকায়েদ’ এর ১৭ পৃষ্ঠায় আছে- “সুতরাং, সম্বোধন পদ সম্বলিত তাশাহুদের সম্বোধন পদ পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই এবং এ ব্যাপারে কয়েকজন সাহাবীর অনুসরণও জরুরী নয়। অন্যথায় হুযুর (ﷺ) বলতেন- “আমার ওফাতের পর আমাকে সম্বোধন করো না।’ যে কোন অবস্থায় উক্ত সম্বোধন পদের প্রচলন রাখাই উত্তম। মূলতঃ সেভাবেই শিক্ষা দেয়া হয়েছিল।”
উত্তরের সারমর্ম হলো, কয়েকজন সাহাবীর এ পরিবর্তনের কাজ দলীল হতে পারে না। অন্যথায় অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতীয়মান হবে যে, হুযুর (আলাইহিস সালাত ওয়াস সালাম) এর পবিত্র যামানায় শির্ক হচ্ছিল, কিন্তু তা নিষেধ করা হয়নি। আর পরবর্তীকালে সাহাবীদের কেউ কেউ পরিবর্তন করেছিলেন, সবাই করেন নি এ প্রসঙ্গে
❏‘মিরকাত’ গ্রন্থের ‘তাশাহুদ’ শীর্ষক অধ্যায়ের সংশিষ্ট পরিচ্ছেদের শেষে বলা হয়েছে-
وَأَمَّا قَوْلُ ابْنِ مَسْعُودٍ: كُنَّا نَقُولُ فِي حَيَاةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ فَلَمَّا قُبِضَ عَلَيْهِ السَّلَامُ قُلْنَا: السَّلَامُ عَلَى النَّبِيِّ، فَهُوَ رِوَايَةُ أَبِي عِوَانَةَ، وَرِوَايَةُ الْبُخَارِيِّ الْأَصَحُّ مِنْهَا بَيَّنَتْ أَنَّ ذَلِكَ لَيْسَ مِنْ قَوْلِ ابْنِ مَسْعُودٍ، بَلْ مِنْ فَهْمِ الرَّاوِي عَنْهُ، وَلَفْظُهَا: فَلَمَّا قُبِضَ قُلْنَا: سَلَامٌ يَعْنِي عَلَى النَّبِيِّ، فَقَوْلُهُ قُلْنَا: سَلَامٌ يَحْتَمِلُ أَنَّهُ أَرَادَ بِهِ اسْتَمْرَرْنَا بِهِ عَلَى مَا كُنَّا عَلَيْهِ فِي حَيَاتِهِ
-‘‘ইবন মসউদ (رضي الله عنه) যে বলেছেন ‘আমরা বলতাম ..... সেটি হচ্ছে আবু আওয়ানার রিওয়ায়ত। এ প্রসঙ্গে বুখারীর রিওয়ায়ত অধিকতর বিশুদ্ধ। সেখানে বলা হয়েছে যে কথাটি ইবন মসউদ (رضي الله عنه) এর উক্তির অন্তভুর্ক্ত নয়। বরং তা হচ্ছে বর্ণনাকারীদের ব্যক্তিগত উপলব্ধি। ইবন মসউদ (رضي الله عنه) এর বর্ণিত উক্তিটি ছিল এরূপঃ ‘যখন হুজুর (ﷺ) এর ওফাত হয়ে গেল, তখন বলেছিলাম ‘সালামুন’ অর্থাৎ নবীর প্রতি।’ তাঁর এ যে উক্তি ‘আমলা বলেছিলাম, সালাম, এ উক্তির অন্য অর্থ হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তঃ তিনি একথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, আমরা নবীর জীবদ্দশায় যেভাবে পাঠ করতাম। সেভাবে পড়ার রীতি চিরকালের জন্য জারী রাখলাম।’’
{মোল্লা আলী ক্বারীঃ মেরকাতঃ ২/২৮ পৃ.}
এ বর্ণনা থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরাম ‘তাশাহুদের’ ইবারত মোটেই পরিবর্তন করেন নি। পরিবর্তনের যে কথাটি বলা হয়েছিল, তা’ ছিল হাদীছ বর্ণনাকারীর নিছক ব্যক্তিগত বোধোদয়, আসল ব্যাপার কিন্তু তা’ নয়।
━━━━━━━━
৪। ওহাবী মতাদর্শের কেউ কেউ বলেন যে, নবী কিংবা ওলীকে দূর থেকে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে ডাকা যে, তিনি আমার আওয়াজ শুনছেন, “শিরক”। কেননা, দূরের আওয়াজ শ্রবণ খোদারই একমাত্র বৈশিষ্ট্য, খোদা ভিন্ন অন্য কারো মধ্যে এ ক্ষমতা আছে বলে স্বীকার করা শিরক। তবে হ্যাঁ, যদি এরূপ ধরণা বা বিশ্বাস পোষন করা না হয়, তাহলে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ ‘ইয়া গাউছ’ ইত্যাদি বলা বৈধ, যেমন বায়ুকে সম্বোধন করে বলা হয়ে থাকে “ওহে প্রভাত সমীরণ শুন”।
এখানে এরূপ কোন ধারণা করা হয় না যে, বাতাস শুনছে। আজকাল সাধারণ ওহাবী মতাবলম্বীগণ এ অজুহাত খাঁড়া করে থাকেন। ফতোয়ায়ে রশীদিয়াহ’ ইত্যাদি গ্রন্থেও এ কথার জোরালো সমর্থন পাওয়া যায়।
উত্তরঃ দূরের আওয়াজ শ্রবণ মোটেই খোদার গুণ নয়। দূর থেকে তো তিনিই শুনেন, যিনি আহবানকারী থেকে দূরে অবস্থান করেন। কিন্তু মহা প্রতিপালক শাহরগের চেয়েও নিকটতর।
❏তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেনঃ
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ
-‘‘আমি তার শাহরগের চেয়েও নিকটতর।’’
{সূরাঃ ক্বফ, আয়াতঃ ১৬, পারাঃ ২৬}
❏আরও বলেছেনঃ
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ
-‘‘যখন আমার বান্দাগণ আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তখন তাদেরকে বলে দিবেন যে, আমি নিকটে বিরাজমান।’’
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ১৮৬, পারাঃ ২}
❏অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لَا تُبْصِرُونَ
-‘‘আমি এ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কাছে তোমাদের চেয়েও অধিকতর নিকটবর্তী, কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ না।’’
{সূরাঃ ওয়াকিয়া, আয়াতঃ ৮৫, পারাঃ ২৭}
স্পষ্টই বোঝা গেল যে, মহাপ্রতিপালক আল্লাহ নিকটের আওয়াজই শুনেন, তার জন্য প্রতিটি আওয়াজই নিকটের, কারণ তিনি স্বয়ং নিকটেই বিদ্যমান। আর যদি একথা মেনে নেওয়া হয় যে, দূরের আওয়াজ শ্রবণ তাঁর বৈশিষ্ট্য, তাহলেও স্বীকার করতে হয়, যে কাছের আওয়াজ শ্রবণও তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই কাছের কাউকে শ্রোতা মনে করে আহবান করা যাবে না, কেননা এতে মুশরিক হয়ে যবে। তাই সবাইকে বধির মনে করতে হয়।
অধিকন্তু দূরের আওয়াজ শ্রবণ যেমন খাদ্যের গুণ, তেমনি দূরের বস্তু দেখা ও দূরের ঘ্রাণ পাওয়া খোদার অন্যতম গুণ। ‘ইলম গায়ব’ ও ‘হাযির-নাযিরের’ আলোচনায় প্রমাণ করেছি যে, আওলিয়ায়ে কেরামের দৃষ্টিতে দূর ও নিকট এক সমান। তাদের দর্শনেন্দ্রিয় যদি দূরের ও কাছের বস্তুকে একইভাবে দেখতে পায়, তা’হলে তাদের শ্রবন্দ্রিয়ও দূরের ও কাছের আওয়াজ শুনলে ‘শিরক’ হবে কেন? খোদা প্রদত্ত এ গুণ। তাঁরা লাভ করেছেন। এখন আমি প্রমাণ করছি যে, নবী ও গুণীগণ দূরের আওয়াজ শুনেন।
❏হযরত ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) সুদূর কানআনে (লেবানন) বসে হযরত ইউসুফের (আলাইহিস সালাম) জামার খুশবু পেয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেনঃ إِنِّي لَأَجِدُ رِيحَ يُوسُفَ -‘‘আমি হযরত ইউছুফের (আলাইহিস সালাম) ঘ্রাণ পাচ্ছি।’’
{সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ৯৪, পারাঃ ১৩}
এখন বলুন, এ শিরক হল কিনা/ হযরত উমর (رضي الله عنه) মদীনা পাক থেকে হযরত সারিয়া (رضي الله عنه) কে, যিনি সুদূর নেহাওয়ান্দ নামক স্থানে যুদ্ধরত ছিলেন, ডাক দিয়েছিলেন, আর হযরত সারিয়া (رضي الله عنه) সে আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন (এ ব্যাপারে ৪৪৬নং তাখরীজ দেখুন- বাহাদুর) লক্ষ্য করুন, হযরত ফারুক (رضي الله عنه) এর চোখ দূর থেকে দেখেছে আর হযরত সারিয়া (رضي الله عنه) এর কান দূর থেকে শুনেছে। তাফসীরে রূহুল বয়ান, জালালাইন, মাদারেক ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থ সমূহেঃ وَاُذِّنَ فِى النَّاسِ بِالْحَجَ
{সূরাঃ হজ্জ, আয়াতঃ ২৭, পারাঃ ১৭}
আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহিম(আলাইহিস সালাম) পবিত্র কাবা ঘর নির্মান করে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সমস্ত রূহের উদ্দেশ্যে ডাক দিয়েছিলেন হে আল্লাহর বান্দাগণ, চলুন। কিয়ামত পর্যন্ত যেসব রূহ মর্ত্যে আগমন করবে সকলেই সে আওয়াজ শুনেছিল। যেসব রূহ তাঁর ডাকে লম্বাইক (আমি উপস্থিত আছি) বলেছেন, সে সব রূহ অবশ্যই হজ্ব করার গৌরব লাভ করবেন। আর যে সব রূহ সে সময় নিশ্চুপ ছিল, তারা কখনও হজ্ব করতে পারবে না। লক্ষ্য করুন, এখানে শুধু দূর থেকে নয়, বরং ভূমিষ্ঠ হবার আগেই সবাই হযরত খলীল (আলাইহিস সালাম) এর আওয়াজ শুনেছে। এখন ইহা শিরক হল কিনা? অনুরূপ, হযরত ইবরাহিমখলীল (আলাইহিস সালাম) এর আওয়াজ শুনেছে। এখন ইহা শিরক হল কিনা? অনুরূপ, হযরত ইবরাহিমখলীল (আলাইহিস সালাম) মহান প্রতিপালকের দরবারে আরজ করছিলেন- হে মওলা, তুমি মৃত্যুকে কিরূপে জীবন দান করবে, তা’আমাকে দেখিয়ে দাও’। তখন আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশ আসলো-চারটি পাখীকে যবাই করে এদের মাংসগুলো চারটি পাহাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাও ثُمَّ اَدْعُهُنَّ يَاتِيْنَك سَعْيًا এরপর পাখীগুলোকে ডাক, ডাকের সাথেই সেগুলো দৌড়ে এসে যাবে।
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৬০, পারাঃ ৩}
লক্ষ্য করুন, মৃত পাখীগুলোকে ডাকা হল, পাখীগুলো ডাকে সাড়া দিয়ে দৌড়ে এসে গেল, আল্লাহর ওলীগণ কি ওসব প্রাণীর চেয়েও অধম? মৃত প্রাণীগুলো শুনতে পায়, আর আল্লাহর ওলীগণ দূরের আওয়াজ শুনেন না। আজকাল এাকজন লোক লন্ডনে বসে টেলিফোনের মাধ্যমে ভারতে অবস্থানরত লোকের সাথে কথা বলতে পারে। সে ভারতীয় লোককে এ বিশ্বাস রেখেই ডাকে যে, ভারতীয় লোকটি উক্ত যন্ত্রের সাহায্যে তার কথা শুনতে পায়। এর ডাকাটা শির্ক কিনা? যদি কোন মুসলমান এ কথা দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করে যে, নবুয়তের শক্তি টেলিফোনের শক্তির চেয়ে অনেক বেশী এবং তাই আম্বিয়ায়ে কিরাম খোদা প্রদত্ত শক্তি বলে প্রত্যেকের আওয়াজ শুনেন, আর এ বিশ্বাসের বলে আল্লাহর রাসূলকে এ বলে আহবান করে- ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল গিয়াছ’ (হে আল্লাহর রাসূল, ফরিয়াদীর ফরিয়াদ শুনুন ও সাহায্য করুন।) তা’হলে এভাবে ডাকা শির্ক হবে কেন? হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) একবার এক সফরে যাবার সময় দূর থেকে জঙ্গলস্থিত একটি পিঁপড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন।
❏পিঁপড়াদের রানী অন্যান্য পিঁপড়াদের উদ্দেশ্যে বলছিলঃ
يَا أَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوا مَسَاكِنَكُمْ لَا يَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَانُ وَجُنُودُهُ وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ
-‘‘ওহে পিঁপড়া সব, তোমরা নিজ নিজ ঘরে ঢুকে পড়, যাতে হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) ও তার লোকজন তাদের অজান্তে অবলীলাক্রমে তোমাদেরকে পদদলিত না করেন।’’
{সূরাঃ নামল, আয়াতঃ ১৮, পারাঃ ১৯}
তাফসীরে রূহুল বয়ান ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থ সমূহে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে লিখা হয়েছে যে, হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) তিন মাইল দূর থেকে পিঁপড়ার এ আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন। এখন চিন্তা করুন, এক পিঁপড়ার আওয়াজ, তাও আবার তিন মাইল দূর থেকে। বলুন, এটা শির্ক হল কিনা? মিশকাত শরীপের ‘ইছবাতু আযাবিল কবর’ শীর্ষক অধ্যায়ে আছে- মৃত ব্যক্তি দাফনের পর কবর থেকে বাহিরের লোকের পদ ধ্বনি শুনতে পায়, যিয়ারত ব্যক্তি দাফনের পর কবর থেকে বাহিরের লোকের পদ ধ্বনি শুনতে পায়, যিয়ারত কারীদেরকে দেখে ও চিনতে পারে। এজন্য কবরস্থানে গিয়ে কবরবাসীদেরকে সালাম দেয়া চাই। লক্ষ্য করুন, এতটুকু মাটির নিচে থেকে এত ক্ষীণ আওয়াজ শ্রবণ কত দূরের আওয়াজ শুনার সমতুল্য? বলুন, ইহা শির্ক হল কিনা? ইলমে গায়ব শীর্ষক আলোচনায় ওলীদের ‘ইলম গায়ব’ বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘মিশকাত শরীফের’ কিতাবুত দাওয়াত এর একটি হাদীছ আগে উলেখ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহর ওলীগণ খোদায়ী শক্তিতে দেখেন, শুনেন ও স্পর্শ করেন। যাঁকে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমতা দান করেন, তিনি যদি দূর থেকে শুনতে পান, তা’ শিরক হবে কেন?
ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিশ্বস্ত, উলেখযোগ্য আলেম মৌলভি আবদুল হাই সাহেব লক্ষেন্ডৗবী তার ফতোয়ায়ে আবদুল হাই’ গ্রন্থের ‘কিতাবুল আকায়িদ’ এর ৪৩ পৃষ্ঠায় জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কি বলেছেন, তা শুনুন। প্রশ্নটি ছিল এরূপঃ কোন এক ব্যক্তি বরে যেঃ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ (তিনি না জন্ম গ্রহণ করেছে, না কাউকে জন্ম দিয়েছেন) হচ্ছে হুযুরের (ﷺ) শান, আর قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌُ (বলুন, তিনিই আল্লাহর যিনি এক) হচ্ছে হুযুরের (ﷺ) একটি গুণ। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মৌলভি আবদুল হাই সাহেব একটি হাদীছের অবতারণা করেছেন।
❏হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) একদা জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ, চাঁদ আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করত, যখন আপনার বয়স ছিল মাত্র ৪০ দিন? রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান- স্নেহময়ী জননী আমার হাত দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে রাখছিলেন, এর কষ্টে ফুঁকিয়ে উঠতাম, আর চাঁদ বারণ করত। হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) আরয করলেন আপনি তখন ছিলেন ৪০ দিনের শিশু, তাই এ অবস্থা কিরূপে উপলব্ধি করলেন? ইরশাদ করেন- লওহে মাহফুজে কলম চলত, আমি কলম চালনার আওয়াজ শুনতাম অথচ সে সময় আমি ছিলাম মাতৃগর্ভে। আর ফিরিশতাগণ আরশের নিচে তসবীহ পাঠ করতেন, আমি শুনতাম তাঁদের তসবীহের আওয়াজ মাতৃগর্ভ থেকে। রিওয়ায়ত থেকে প্রমাণিত হল, হুযুর (ﷺ) শ্রদ্ধেয়া মাতার মাতৃগর্ভ থেকে আরশ-ফরশের সমস্ত আওয়াজ শুনতেন। হাদীছ শরীফে আছে- যখন কোন স্ত্রী তার স্বামীর সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়, তখন বেহেশত থেকে হুর স্ত্রীকে ডাক দিয়ে তিরস্কার করে। সুতরাং, জানা গেল যে, ঘরের কুঠরীর অভ্যন্তরে যে বাক বিতন্ডা চলছে, তা এত দূর থেকেও হুর দেখতে পাচ্ছে ও শুনছে; আর বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, হুরের এ অদৃশ্য জ্ঞানও আছে যে, সে লোকটির পরিণাম ভাল হবে।
দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আমরা দূরের বস্তু দেখতে পাই, রেডিও টেলিফোন দ্বারা দূরের আওয়াজ শুনতে পাই। নূরে নাবুওয়াত ও বেলায়তের শক্তি কি বিদ্যুত শক্তির চেয়েও দুর্বল? মিরাজের সময় হুযুর (ﷺ) বেহেশতে হযরত বেলাল (رضي الله عنه) এর পদচারণার আওয়াজ শুনেছিলেন, অথচ সে সময় তো হযরত বেলাল (رضي الله عنه) এর মেরাজ হয়নি, তিনি নিজ ঘরেই ছিলেন। সম্ভবতঃ তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য তিনি চলাফেরা করছিলেন। আর ওদিকে তার পদচারণার আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল। আর যদি হযরত বেলাল (رضي الله عنه) জিসমে মিছালী সহকারে (দুনিয়াবী শরীরের অনুরূপ আকৃতিসম্পন্ন শরীর) বেহেশতে পদার্পণ করে থাকেন, তা’হলে হাযির নাযিরের বিষয়টিও প্রমানিত হয়।
এসব ব্যাপারে ভিন্নমতবলম্বীগণ একথাই বলবেন যে, আল্লাহ তাদেরকে শুনিয়ে দেন বিধায় তারা শুনেছিলেন। আমরাও তো তাই বলছি- নবী ও ওলীগণকে খোদা দূরের আওয়াজ শুনান, তাই তাঁরা শুনতে পান। খোদা তা’আলার এ শ্রবণ ক্ষমতা সত্ত্বাগত, আর তাদের এ গুণ খোদা প্রদত্ত। খোদার এ গুণ হচ্ছে চিরন্তন, আর তাঁদের এ গুণ অচিরন্তন। খোদার এ গুণ কারো নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, আর ওনাদের এ গুণ খোদার নিয়ন্ত্রণাধীন। খোদা শ্রবণ করেন কান ও অন্য কোন অঙ্গের সাহায্য ব্যতিরেকে আর ওনারা শুনে কান দ্বারা। এ শ্রবণ ক্ষমতার প্রকৃতিতে এতটুকু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ‘শিরক’ হয় কিরূপে? নবীকে সম্বোধন করা প্রসঙ্গে আরও অনেক বিষয়ের অবতারণা করা যেতে পারে। কিন্তু এতটুকুই যথেষ্ট বিধেয় এখানেই সমাপ্ত করা হল।
(এ ব্যাপারে আমার লিখিত “জাল হাদীসের নামে প্রতারণার জবাব” বইয়ে রাসূল (দঃ) আমাদের দরূদ শুনতে পান এ ব্যাপারে আমি অনেক দলীল উপস্থাপন করেছি দেখে নিবেন- শহীদুল্লাহ বাহাদুর।)