✧ পরিশিষ্টঃ


‘কিয়াস’ সম্পর্কিত বিষয়ের আলোচনা-

শরীয়তের দলীল চারটি- 

(১) কুরআন,

(২) হাদীছ,

(৩) ইজমা’য়ে উম্মত ও

(৪) কিয়াস।

ইজমা’র দলীল সমূহ আমি আগেই বর্ণনা করেছি যে,


❏ কুরআন হাদীছের হুকুম হলো, “সাধারণ মুসলমানদের দলের অন্তভুর্ক্ত থাকো। যে এদের দল থেকে পৃথক হয়েছে, সে জাহান্নামী।”


❏ কিয়াসের আভিধানিক অর্থ হলো, অনুমান করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় কিয়াস হলো মৌলিক মাসআলার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করে ওটার সহিত কোন অমৌলিক মাসআলার কারণ ও বিধির দিক থেকে সমন্বয় সাধন করা। অর্থাৎ, (মনে করুন) এমন একটি মাসআলা বা সমস্যার সমাধান বের করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হল, যার সম্পর্কে কুরআন-হাদীছে সুস্পষ্টভাবে উল্লে­খ নেই। তখন কুরআন বা হাদীছে বর্ণিত আলোচ্য মাসআলার সহিত সাদৃশ্যপূর্ণ কোন ‘আমল খুঁজ করে বের করা হল এবং এর কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় পূর্বক বলা হল যে, যেহেতু একই কারণ আলোচ্য মাসআলায় বিদ্যমান আছে, সেহেতু এ মাসআলায় অনুরূপ সিদ্ধান্ত স্থিরিকৃত হবে।


দৃষ্টান্ত স্বরূপঃ


(১) কেউ জিজ্ঞাসা করলো, স্ত্রীর সঙ্গে পায়ুকামের মাধ্যমে যৌনমিলন উপভোগ সম্পর্কে শরীয়তের বিধান কি? আমি উত্তর দিলাম যে, ঋতুস্রাবের সময় অপবিত্রতার কারণে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করা হারাম। তদ্রূপ আলোচ্য মাসআলায়ও ঐ একই কারণে উক্ত কর্ম হারাম হবে।


(২) কেউ জিজ্ঞাসা করলোঃ পিতা যদি কোন নারীর সহিত অবৈধভাবে ব্যভিচার করে তাহলে তার ছেলের সহিত উক্ত নারীর বিবাহ বৈধ হবে কিনা? উত্তরে আমি বললাম যে, সঙ্গম ও পিতা-পুত্রের মধ্যে বিদ্যমান অবিচ্ছেদ্য শারীরিক সম্পর্কের কারণে বাপের বিবাহিত স্ত্রী ছেলের জন্য হারাম। সুতরাং, এখানেও যেহেতু একই কারণ বিদ্যমান সেহেতু উক্ত মেয়েটি ছেলের জন্য হারাম হবে। এটাকেই ‘কিয়াস’ বলা হয়। কিন্তু শর্ত হলো যিনি কিয়াস করবেন, তাকে মুজতাহিদ হতে হবে। যার তার কিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়। কিয়াস আসলে শরীয়তের হুকুমকে প্রকাশ করে থাকে। ইহা স্বতন্ত্র বা স্বয়ং সম্পূর্ণ কোন বিধি প্রকাশ করে না। ইহা কুরআন, হাদীছ ও সাহাবীগণের কার্যাবলীতে বিদ্যমান রয়েছে।



❏ কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে,


فَاعْتَبِرُوْا يَااُوْلِى الْاَبْصَارِ.


অর্থাৎ- হে দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, শিক্ষা গ্রহণ করো।  

{সূরাঃ হাশর, আয়াতঃ ২, পারাঃ ২৮}

     

অর্থাৎ কাফিরদের অবস্থার সঙ্গে তোমাদের নিজেদের অবস্থা যাচাই করো। তোমরাও যদি তাদের মত আচরণ কর, তাহলে তোমাদেরও একই পরণতি হবে। এছাড়াও কুরআনে মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়ার ঘটনাকে নিদ্রার সঙ্গে ও ক্ষেত শুকায়ে পুনরায় সবুজ শ্যামল রূপ ধারণ করার সঙ্গে তুলনা করেই ব্যক্তি করা হয়েছে।

কুরআন শরীফে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাফিরদের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এটাও কিয়াস।


❏ বুখারী শরীফের কিতাবুল ইতিসামে একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করা হয়েছে এবং নাম দেয়া হয়েছে,


بَابُ مَنْ سُئِلَ عِلْمًا وَهُوَ مُشْتَغِلٌ فِي حَدِيثِهِ، فَأَتَمَّ الحَدِيثَ ثُمَّ أَجَابَ السَّائِلَ


-‘‘যে কোন নির্দিষ্ট সুবিদিত নীতিকে এমন একটি রীতির সঙ্গে তুলনা করা, যার হুকুম আল্লাহ তা’আলা ব্যক্ত করেছেন, যাতে প্রশ্নকারী বুঝতে পারে, এর বিবরণ সম্পর্কিত অধ্যায়।’’

{ক) বুখারীঃ আস-সহীহঃ কিতাবুল ই’তিসামঃ ২/১০৮৮

 খ) বুখারীঃ আস-সহীহঃ ৬/২৬৬৭ হাদিসঃ ৬৮৮৪}


❏ উক্ত অধ্যায়ে একটি হাদীছ বর্ণিত আছে, যেখানে হুজুর (ﷺ) কর্তৃক একটি মেয়ে লোককে কিয়াসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা উল্লেখিত আছে। হাদীছটি হলো,


اِنَّ اِمْرِأة جَاءَتْ اِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ اِنَّ اُمِّىْ نَذَرَتْ اَنْ تَحُجَّ اَفَا حُخُّ عَنْهَا قَاَل نَعَمْ حُجِّىْ عَنْهَا اَرَئِيْتِ لَوْكَانُ عَلَى اُمِّكِ دَيْنُ اَكُنْتُ قَاضِيَةً قَالَتْ نَعَمْ قَالَ اِقْضُو الَّذِىْ لَهُ فَاِنَّ اللهَ اَحَقُّ بِالْقَضًاءِّ


-‘‘একজন মেয়ে লোক হুজুর (ﷺ) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, আমার মা হজ্বের মান্নত করেছিলেন, এখন আমি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্ব সমাপন করবো? ইরশাদ ফরমালেন- হ্যাঁ, হজ্ব করো, (এরপর বললেন) তোমার মায়ের কর্য থাকলে, তুমি তা পরিশোধ করতে কিনা? মেয়েটি আরয করলো, জী হ্যাঁ। নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ ফরমালেন, আল্লাহর কর্যও আদায় কর। কেননা আল্লাহ তা’আলার কর্য আদায়ের ব্যাপারটি সর্বাগ্রেই বিবেচ্য হবে।’’

{বুখারীঃ আস-সহীহঃ ১/২৫০ পৃ. কাদীমী কুতুবখানা, করাচী}

     

❏ মিশকাত শরীফের কিতাবুল ইমারাত ماعلى الولاة অধ্যায়ে তিরমিযী শরীফের ১ম খন্ডের ابواب الاحكام এর শুরুতে ও দারমী শরীফে উল্লেখিত আছে যে, যখন হুজুর (ﷺ) হযরত মু’আয ইবন জাবাল (رضي الله عنه) কে ইয়ামনের বিচারক নিয়োগ করে পাঠালেন, তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ তুমি কিভাবে ফায়সালা করবে? আরয করলেন, আল্লাহর কালাম দ্বারা। নবী (ﷺ) ফরমালেনঃ যদি আল্লাহর কালামে না পাও? আরয করলেন, তাঁর রাসূলের সুন্নাত দ্বারা। নবী (ﷺ) ফরমালেনঃ যদি সেখানেও না পাও? আরয করলেনঃ


اَجْتَهِدُ بِزَائِىْ وَلاَ الُوْقَالَ فَضَرَبَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ عَلَىْ صَّدْرِهِ وَقَالَ اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِىْ وَفَّقَ رَسُوْلَ رَسُوْلُ اللهِ لِمَا يَرْضَىْ بِهِ رَسُوْلُ اللهِ


-‘‘নিজের রায়কে সম্বল করে ইজতিহাদ প্রয়োগ করবো। (বর্ণনাকারী বলেন) তখন হুজুর (ﷺ) তার বুকে হাত মারলেন এবং ফরমালেন খোদার শুকরিয়া যে, তিনি তাঁর রাসূলের (ﷺ) দূতকে এমন কাজের উপযুক্ততা দিয়েছেন, যে কাজে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সন্তুষ্ট হন।’’

{ক) তিরমিজীঃ আল-জামেঃ ৩/৬০৮ পৃ. হাদীসঃ ১৩২৭

খ) খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ পৃ. ৩২৪ হাদিসঃ

গ) আবু দাউদঃ আস-সুনানঃ ৩/৩০৩ হাদিসঃ ৩৫৯২

ঘ) দারেমীঃ আস-সুনানঃ ১/৭২ হাদিসঃ ১৭০

ঙ) ইমাম বগভীঃ শরহে সুন্নাহঃ ৫/৩৫২

চ) আবু হুমায়দীঃ আল-মুসনাদঃ ১/৭২ হাদিসঃ ১২৪

ছ) ইমাম তাহাভীঃ আল-মুসনাদঃ ৭/২৭৮ হাদিসঃ ৬৭৬০

জ) ইমাম যাহাবীঃ সিয়ারু-আলামিন আন্-নুবালাঃ ১/৪৪৮

ঝ) ইমাম আহমদঃ আল-মুসনাদঃ ৩৬/৩৩৩ পৃ. হাদিসঃ ২২০০৭}


এ থেকে কিয়াসের সমর্থনে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেল। যেহেতু হুজুর (ﷺ) এর ইহকালীন জীবনে ‘ইজমা’ হতে পারে না, সেহেতু মু’য়াজ (رضي الله عنه) ইজমার উল্লে­খ করেন নি। এরূপ সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের কিয়াসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।


❏ হযরত ইবনে মসউদ (رضي الله عنه) কিয়াস করে এমন একটি মেয়েকে, যে মহর ধার্যকরণ ব্যতিরেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল, ও পরে স্বামী মারা গিয়েছিল, মহরে মিছল (উক্ত মেয়ের নিকট আত্মীয়ার ক্ষেত্রে ধার্যকৃত মহরের সমপরিমাণ মহর) প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। (নাসায়ী শরীফ ২য় খন্ড, ৮৮ পৃষ্ঠা দেখুন)


❏ লা-মাযহাবীরা কুরআনের আয়াত,


 اَجْتَنِبُوْا كَثِيْرًامِنَ الْظَنِّ


"অধিকাংশ ধারণার বশবর্তী হওয়ার থেকে বিরত থাকো।"

{সূরাঃ হুজরাত, আয়াতঃ ১২, পারাঃ ২৬}

     

এর ভিত্তিতে যে আপত্তিটা উত্থাপন করে থাকে, এর উত্তর হলো আয়াতে উল্লেখিত ধারণা বলতে খারাপ বা বিরূপ ধারণা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে মুসলমানদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করো না। এজন্যই তো উক্ত আয়াতের পরে গীবত (পরনিন্দা) ইত্যাদির নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে। তা না হলে কিয়াস ও গীবতের মধ্যে কি সম্পর্ক থাকতে পারে? যেমনঃ


❏ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমানঃ


اِنَّمَا النَّجْوَى مِنَ الشَّيْطَنِ.


-‘‘‘পরামর্শ করাটা শয়তানের পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়।’’  

{সূরাঃ মুযদালাহ, আয়াতঃ ১০, পারাঃ ২৮}

     

তাহলে কি প্রত্যেক পরামর্শই শয়তানী কাজ? কখনও নয়। বরং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক যে পরামর্শ, সেটাই হলো শয়তানী কাজ। তদ্রূপ যে সকল ক্ষেত্রে কিয়াসের নিন্দা করা হয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে ওই কিয়াসের কথাই বলা হয়েছে, যা খোদার হুকুমের মুকাবিলায় প্রয়োগ করা হয়। যেমন শয়তান সিজদার নির্দেশ পাবার পর ‘কিয়াস’ করে, আল্লাহর হুকুমকে অগ্রাহ্য করল। এ ধরনের কাজ কুফর বৈ আর কি!

লা মাযহাবীরা আরও বলে যে আল্লাহ তা’আলা ফরমান,

اِنَّمَا اَتَّبِعُ مَايُوْحَىاِلَىَّ

(আমার কাছে ওহী আসে আমি সেটারই অনুসরণ করি)।

{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ২০৩, পারাঃ ৯}


 اِنَّمَا (ইন্নামা) শব্দটি حصر অর্থাৎ একট বিশেষ দিককেই সীমাবদ্ধ করণের জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ اِنَّمَا শব্দটি দ্বারা এ কথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে ওহী ছাড়া যেন আর কোন কিছু, যথা- ইজমা, কিয়াস ইত্যাদির অনুসরণ করা না হয়। শুধু কুরআন-হাদীছেরই যেন অনুসরণ করা হয়। কিন্তু তাদের জানা দরকার যে ইজমা-কিয়াসের উপর ‘আমল করা মানে কুরআন-হাদীছের উপরই আমল করা। কিয়াসের কাজ হলো কেবল পরিষ্ফুট করে ব্যক্ত করা।


পরিশেষে কিয়াস অস্বীকারকারীদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, যেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বিবরণ কুরআন হাদীছে পাওয়া না যায়, কিংবা বাহ্যিক দৃষ্টিতে হাদীছ সমূহের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বিবৃত হয়, তখন কি করবেন? যেমন বিমানে নামায পড়ার কি নিয়ম? অনুরূপ জুমার নামাযে প্রথম রাকআতে জামাআতের মুসল্লীগণ মওজুদ ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় রাকআতে জামাআতের মুসাল্লীগণ পেছন থেকে চলে যান। তখন কি জুমা’র নামায আদায় করবেন, না জুহরের নামায? এর রকম অন্যান্য কিয়াস নির্ভর মাসাইলের বেলায় আপনাদের কি উত্তর হবে? এ জন্যই বলছি, কোন ধর্মতাত্ত্বিক ইমামের দামান দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরুন, এটাই সর্বোত্তম পন্থা। আল্লাহ তাওফীক দান করুন।

━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah 
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।
Top