কা’বা নির্মাণের বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৫৩ঃ কা’বা ঘর কখন স্থাপিত হয়? এটির নির্মাণ কবে থেকে শুরু হয়েছে?
✍ উত্তরঃ হজ্ব ও ওমরায় যে ঘরটির চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা হয় সেটিই কা’বা ঘর। এটি সেই পবিত্র গৃহ, মুসলমানরা প্রতি বছর, প্রতি মাস, প্রতিক্ষণে যার প্রদক্ষিণ করে। ফেরেশতারাও অবতীর্ণ হয়ে যার তাওয়াফ করে থাকে।
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এ-পর্যন্ত দশবারের মত কা’বা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
১. সর্বপ্রথম আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা কা‘বা ঘর নির্মাণ করেছিল।
২. এরপর নিমার্ণ করেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম পাঁচটি পাহাড়ের পাথরের সাহায্যে। পাহাড় পাঁচটি হলো, লেবানন পাহাড়, সীনার তুর পাহাড়, যাইতার তুর পাহাড়, জুদি পাহাড় এবং খোরাসান পাহাড়। পাঁচ পর্বতসমূহের পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয়। কিন্তু হেরা পর্বতের পাথর দ্বারা এর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল।
80. মক্কার ইতিহাস, আল্লামা ফাসী, বর্ণনাকারী আল্লামা কুতুবুদ্দিন (رحمة الله)।
৩. হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর তিরোধানের পর তাঁর পুত্র হযরত শীস আলাইহিস সালাম নিমার্ণ করেন।
৪. এরপর নিমার্ণ কাজ সম্পাদন করেন হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)। তিনি প্রথম ভিত্তির ওপর এটি নিমার্ণ করেন। এই নিমার্ণের বর্ণনা হলো, কা’বা-মুখ তথা হাজরে আসওয়াদ থেকে রুকনে ইরাকী পর্যন্ত বিস্তৃত, এই স্থানটির দৈঘর্য ৩২ গজ, যাকে কা’বার মুখমন্ডল বলা হয়। রুকনে ইয়ামানী থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত স্থানের প্রস্থ ২০ গজ। অন্যদিকে কা’বার পশ্চাদ ভাগ তথা রুকনে শামী থেকে রুকনে ইয়ামানী পর্যন্ত স্থানের দৈঘর্য ৩১ গজ। রুকনে ইরাকী থেকে রুকনে শামী পর্যন্ত যেখানে হাতীমও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে এই স্থানের প্রস্থ ২২ গজ। অন্যান্য প্রতিটি রুকনের উচ্চতা ৯ গজ।
এছাড়া হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কা’বা ঘরের দু’টি দরজা নিমার্ণ করেছিলেন। একটি পূর্বে, অপরটি পশ্চিমে। কিন্তু হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার ছাদ বানাননি। ইতিহাসগ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, সে-যুগে শুধু দেওয়ালই নির্মিত হত, ছাদ থাকত না। আর দরজা ভূমির সাথে মিলিত থাকত। অবশ্য দরজার পার্ট লাগানো থাকত না, খিলও থাকত না। সে যুগের অবস্থা এমন ছিল যে, এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না, যদিও তা আল্লাহর ঘর ছিল।
এই ঘরের এক পাশে বাইরের দিকে তাওয়াফ গণনার সুবিধার জন্য একটি লম্বা পাথর লাগানো হয়েছে, এটি ‘হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর’ নামে প্রসিদ্ধ। চিন্তা-ভাবনা করলে ধারণা করা যায় যে, এটি সেই ধরনের পাথর যা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর ইবাদতের জন্য দাঁড় করেছিলেন। যেটিকে আবার ‘মাযবাহ বা কুরবানির স্থান’ অথবা আয়েরও বলা হয়।
এই দেয়ালের ভেতর একটি খননকৃত গর্ত ছিল। একে বলা হত কা’বার খনি। কা’বার জন্য যা হাদিয়া-তুহফা আসত তা চুরি থেকে রক্ষার জন্য এখানে রাখা হত।
নোটঃ এই রীতি সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজও মানুষেরা মসজিদ, খানকা, মাযার ও পবিত্র স্থানগুলোতে হাদিয়া-তোহফা দিয়ে থাকে। সেগুলোও একটি নিরাপদ স্থানে রাখা দরকার। প্রয়োজনের সময় তা থেকে হতদরিদ্র, ফকির, মিসকিনদের প্রয়োজনসহ অন্যান্য যেকোন ধর্মীয় কল্যাণমূলক কর্মে খরচ করা যেতে পারে। সদস্যদের প্রস্তাবিত কর্মেও তা খরচ করা যেতে পারে।
৫. এরপর কা’বা ঘর নির্মাণ করে ‘আমালেকা গোত্র। এরা হলো ‘আমলীক বিন লিওয়ায বিন ইরাম বিন সাম বিন নূহ আলাইহিস সালাম এর বংশধর। এরাই মক্কার সর্বপ্রথম বাসিন্দা।
৬. জুরহুম এর পুত্ররা ষষ্ঠবারের নিমার্ণে শরীক হন। জুরহুম হলো কাহতান বিন আ’বির বিন শামিখ আরক্বাহশাদ বিন সাম বিন নূহ আলাইহিস সালাম এর পুত্র। অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, প্রথমে বনি জুরহুম এবং পরে আ’মালেকা নিমার্ণ করেছিল।
৭. কুসাই বিন কেলাব নিমার্ণ করেন। এর প্রেক্ষাপট ছিল, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর কা’বার স্থাপনায় কিছুটা জীর্ণতা দৃশ্যমান হয়। এটি বন্যার কারণে সংঘটিত হয়েছিল। এখনও অনেক সময় এ-ধরনের বন্যা হয়ে থাকে। এ-ছাড়া অন্য কোন কারণ খোঁজে পাওয়া যায় নি। সে-সময় কুসাই বিন কেলাব খেজুরের ঢাল-পালা ও গোগল কাঠ দিয়ে কা’বার ছাদ নিমার্ণ করেছিলেন। এই পুনঃনির্মাণ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর ভিত্তি মুতাবেক হয়েছিল। যদিও নিমার্ণের নির্দিষ্ট সময় জানা নেই, কিন্তু এতে সন্দেহ নেই যে, কুসাই বিন কেলাব নবী কারীম (ﷺ) -এর ছয় প্রজন্ম পূর্ব পুরুষ ছিলেন। তাই অনুমানের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, এই নিমার্ণকর্মটি নবীজি (ﷺ)-এর জন্মের দুইশ’ বছর আগে হয়েছিল।
৮. কুরাইশরা নিমার্ণ করেছিল। এ সময় নবী কারীম (ﷺ) -এর বয়স মুবারক মাত্র ৩৫ বছর। সে-সময় ইবরাহীম (عليه السلام)-এর নিমার্ণে কিছুটা বেশ-কম করা হয়। কা’বা উচ্চতা যা পূর্বে ৯ গজ ছিল তা বৃদ্ধি করা হয়। দৈর্ঘ্য ৭ গজের কম করে ফেলা হয়। হাতিমের দিকে কিছু জায়গা রেখে দেয়া হয়। পশ্চিমের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং পূর্বের দরজা ভূমি থেকে ৪ গজ এক বিঘত উঁচু করে দেয়া হয়। হাতিম ছাড়া অন্যান্য দিকে একেক হাত করে ছেড়ে দেয়া হয়।
কা’বা ঘর নিমার্ণকালে যখন হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের বিষয়টি আসে, ঠিক তখনই লেগে যায় ঝগড়া-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব। প্রত্যেক গোত্রই হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করতে চাচ্ছিল। এমন সংকটময় মুহূর্তে আবু উমাইয়া বিন মুগিরার পরামর্শে সবাই একমত হয়। তার পরামর্শ ছিল- আগামীকাল সর্বপ্রথম যেই এই রাস্তা দিয়ে আসবে, তাকেই আমাদের বিষয়ে বিচারক বানানো হবে। তাদের সবার সৌভাগ্য যে, নবী কারীম (ﷺ) সর্বপ্রথম সেই নির্ধারিত পথে প্রথমে এসেছিলেন, যদিও সে-সময় নবী কারীম (ﷺ)-এর বয়স কম ছিল। কিন্তু সবাই ‘আল-আমীন’ বলে খুশিতে চিৎকার করে উঠে। আমরা সবাই তাঁর ফয়সালার ওপর রাজি, একথা বলে সবাই দাঁড়িয়ে উঠে।
পরে নবী কারীম (ﷺ) তাঁর চাদর মুবারক বিছিয়ে আল্লাহর আদেশ মতে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে দেন। সকল গোত্রপতিদের উদ্দেশ্য বলা হলো, সবাই যেন চাদর ধরে হাজরে আসওয়াদ যেখানে স্থাপন করা হবে সে-পর্যন্ত নিয়ে যায়। সকলই তা করল। চাদর ধরে নিধার্রিত স্থানে চলে যায়। এরপর হাজরে আসওয়াদটি নবী কারীম(ﷺ) নিজ হাতে নিয়ে স্ব-স্থানে স্থাপন করে দেন। এতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা আর হয়নি।
৯. হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রাদিআল্লাহু আনহু নির্মাণ করেন। এর ঘটনা ছিল, হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) হেজাজের গভর্ণর হলে পুরো হেজাজ তাঁর অধীনে চলে আসে। ইয়াজিদের পক্ষ থেকে তাঁকে হত্যা করার জন্য মসজিদে হেরমের দিকে লক্ষ্য করে হোছাইন বিন নুমাইর প্রাচীন কামান দ্বারা আগুন নিক্ষেপ করে। এই আঘাতে কা’বা ঘরের দেয়ালের কিছু অংশ পুড়ে যায় এবং ছাদের কিছু কাঠও জ্বলে যায়। এমন সময় ইয়াজিদ মারা যায়। ফলে তাঁর সৈন্যরা ফিরে যায়। সে-সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) ইচ্ছা করলেন, অবশিষ্ট দেয়ালগুলো ভেঙ্গে পুনরায় নতুনভাবে মজবুত করে দেয়াল নিমার্ণ করতে। অতপর সকল দেয়াল ভাঙ্গার পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর ভিত্তি প্রকাশ পায়। ফলে তার ওপরই কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণ করা হয়। যে ভূমি বাইরে রয়ে গিয়েছিল তা আবার কা’বা ঘরের অন্তভর্ূক্ত করা হয়। পূর্বের মত দরজা ভূমির সাথে সমতল করা হয়। দ্বিতীয় দরজাও আগের মত পুনঃনিমার্ণ করা হয়। উচ্চতায় এর আগের তুলনায় ৯ গজ উঁচু করা হয়। এই নিমার্ণ কাজ ১৫ জুমাদাস সানী হিজরী ৬৪ সনে শুরু হয়ে ২৭ রজব ৬৪ হিজরীতে শেষ হয়।
১০. আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের আদেশে ৭২ হিজরী সনে হাজ্জাজ বিন ইউসূফ নির্মাণ করেন। মৌলিকভাবে এইবার হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রাদিআল্লাহু আনহু এর নিমার্ণ ঠিক রাখা হয়। কিন্তু হাতিমের দিকে ৬ গজ এক বিঘত ভূমি বের করে দিয়ে কুরাইশের ভিত্তি মোতাবেক দেয়াল নিমার্ণ করে দেয়া হয়। পশ্চিমের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। পূর্বের দরজা ৪ গজ এক বিঘত উঁচু করা হয়। যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে হাজ্জাজের নিমার্ণের ওপর। কা’বা ঘরের ভেতরে প্রথম দুই সারিতে ৬টি স্তম্ভ ছিল। হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) তাঁর সময়ে ৩টি স্তম্ভ কমিয়ে দিয়েছিলেন এবং একই সারিতে ৩টি স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সুতরাং এখনো ৩টি স্তম্ভ বিদ্যমান আছে। যার এক কোণে হাজরে আসওয়াদ রাখা হয়।
কা’বার মূল নাম হলো বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর যুগ থেকে একটি নিয়ম প্রচলিত ছিল আল্লাহর ইবাদতের জন্য যেখানেই কোন চিহ্ন স্থাপন করা হত তাকে ‘বায়তে ইল’ বা আল্লাহর ঘর বলা হত। কিন্তু যেহেতু এই ঘরটি হযরত ইসমাইল (عليه السلام) মুকা’আব বা ঘন ক্ষেত্রফলের আকৃতিতে নির্মাণ করেছিলেন, তাই এটি ‘কা’বা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কা’বার নাম বায়তুল আতীক, মক্কা, বক্কা এবং উম্মুল ক্বোরাও এসেছে। বিভিন্ন কিতাবে কা’বার আরও অনেক নাম লেখা রয়েছে। প্রায় ১৮টি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সব নামের মধ্যে মক্কা ও কা’বা নামে বেশি প্রসিদ্ধ। কা’বা ঘরে অসংখ্য মূর্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) মক্কা বিজয়ের দিন মূর্তিগুলো ভেঙ্গে আল্লাহর ঘর খানায়ে কা’বাকে একমাত্র আল্লাহ'র উপাসনালয়ে পরিণত করেছিলেন। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর যুগ ও তাঁর পরবর্তী যুগগুলোতে দেয়াল পূর্বের মতই ছিল। কয়েকবার আগুন ধরে কা’বা জ্বলে গিয়েছিল।
অনুমান করা হচ্ছে আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রাদিআল্লাহু আনহু এর যুগ পর্যন্ত পুরাতন গিলাফের ওপর নতুন গিলাফ পরিয়ে দেয়ার প্রচলন ছিল। এ-কারণেই তাঁর যুগে কা’বা ঘরে আগুন লেগেছিল। এর পরেও এই রীতি চালু ছিল। ইসলামী যুগেও কা’বার ওপর চাদর পরানোর রীতি ছিল এবং অদ্যবধিও প্রতি বছর হজ্বের দিন নতুন গিলাফ পরানোর প্রথা চালু রয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই।