দ্বিতীয় অধ্যায়

উরস উপলক্ষে সফর প্রসংগে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ ও এর জবাব


১নং আপত্তিঃ মিশকাত শরীফের المَسَاجِدْ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-


وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ: مَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَمَسْجِدِي هَذَا.


-‘‘তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোন দিকে সফর করা যাবে না। এ তিন মসজিদগুলো হলো বায়তুল্লাহ, বায়তুল মুকাদ্দিস ও আমার এ মসজিদ।’’ ২৯২

 {বুখারী, হা/১১৮৯, মুসলিম, হা/১৩৯৭}


এ হাদীছ থেকে বোঝা গেল যে এ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন দিকে সফর করা জায়েয নাই এবং কবর যিয়ারতের সফর এ তিনটির বাইরে বিধায় নাজায়েয।


উত্তরঃ এ হাদীছের ভাবার্থ হচ্ছে এ তিন মসজিদে নামাযের ছওয়াব বেশী পাওয়া যায়। যেমন মসজিদ বায়তুল্লাহ এক নেকীর ছওয়াব অন্যান্য জায়গায় এক লাখের সমান এবং বায়তুল মুকাদ্দিস ও মদীনা পাকের মসজেিদ এক নেকীর ছওয়াব পঞ্চাশ হাজারের সমান। সুতরাং এসব মসজিদসমূহে এ নিয়েতে দূর থেকে সফর করে আসা কল্যাণকর ও জায়েয। কিন্তু অন্য কোন মসজিদের দিকে একই নিয়তে সফর করা অনর্থক ও নাজায়েয। কারণ উপরোক্ত তিন মসজিদ ব্যতীত বাকী সব মসজিদে ছওয়াব একই বরাবর। কারণ উপরোক্ত তিন মসজিদ ব্যতীত সব মসজিদ ছওয়াব একই বরাবর। দিল­ীর জামে মসজিদ জুমায়াতুল বেদা (রমজানের শেষ জুমা) পড়ার জন্য অনেক লোক দূর দূরান্তর থেকে সফর করে আসে এবং মনে করে যে ওখানে ছওয়াব বেশী হয়। আসলে এটা না জায়েয, কারণ উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা অন্য কোন মসজিদের দিকে সফর করা এবং বেশী ছওয়াবের প্রত্যাশা করা নিষেধ প্রমাণিত হয়েছে। যদি হাদীসের বিশ্লেষণ এরকম করা না হয়, তাহলে আমি প্রথম অধ্যায়ে যে সব সফর কুরআন থেকে প্রমাণ করেছি, সবই হারাম পণ্য হবে এবং আজকাল ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য ও দুনিয়াবী অনেক কাজের জন্য যত রকম সফর করা হয়, সবই হারাম বিবেচিত হবে।


❏ মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “আশআতুল লুমআতে” এ হাদীছ প্রসংগে লিখেছেন-


وبعضے از علماء گفته اند كه سخن در مساجد است يعنى در مسجدے ديگر جزايں مساجد سفر جائز نه باشد واما مواضع ديگر جز مساجد خارج از مفهوم اين كلام است.


-‘‘কতেক আলিম বলেন যে, এখানে মসজিদসমূহের বেলায় কথা হয়েছে অর্থাৎ ওই মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের দিকে সফর করা জায়েয নাই। মসজিদ ভিন্ন অন্যান্য জায়গা এ বক্তব্যের অর্ন্তভূক্ত নয়।’’


❏ মিশ্কাত শরীফের অপর ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাতে এ হাদীছ প্রসংগে বর্ণিত আছে-


وَفِي شَرْحِ مُسْلِمٍ لِلنَّوَوِيِّ قَالَ أَبُو مُحَمَّدٍ: يَحْرُمُ شَدُّ الرَّحْلِ إِلَى غَيْرِ الثَّلَاثَةِ وَهُوَ غَلَطٌ، وَفِي الْإِحْيَاءِ: ذَهَبَ بَعْضُ الْعُلَمَاءِ إِلَى الِاسْتِدْلَالِ بِهِ عَلَى الْمَنْعِ مِنَ الرِّحْلَةِ لِزِيَارَةِ الْمَشَاهِدِ وَقُبُورِ الْعُلَمَاءِ وَالصَّالِحِينَ، وَمَا تَبَيَّنَ فِي أَنَّ الْأَمْرَ كَذَلِكَ، بَلِ الزِّيَارَةُ مَأْمُورٌ بِهَا لِخَبَرِ: كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ أَلَا فَزُورُوهَا . وَالْحَدِيثُ إِنَّمَا وَرَدَ نَهْيًا عَنِ الشَّدِّ لِغَيْرِ الثَّلَاثَةِ مِنَ الْمَسَاجِدِ لِتَمَاثُلِهَا، بَلْ لَا بَلَدَ إِلَّا وَفِيهَا مَسْجِدٌ، فَلَا مَعْنَى لِلرِّحْلَةِ إِلَى مَسْجِدٍ آخَرَ، وَأَمَّا الْمَشَاهِدُ فَلَا تُسَاوِي بَلْ بَرَكَةُ زِيَارَتِهَا عَلَى قَدْرِ دَرَجَاتِهِمْ عِنْدَ اللَّهِ، ثُمَّ لَيْتَ شِعْرِي هَلْ يَمْنَعُ هَذَا الْقَائِلُ مِنْ شَدِّ الرَّحْلِ لِقُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ كَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَيَحْيَى، وَالْمَنْعُ مِنْ ذَلِكَ فِي غَايَةِ الْإِحَالَةِ، وَإِذَا جُوِّزَ ذَلِكَ لِقُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ وَالْأَوْلِيَاءُ فِي مَعْنَاهُمْ، فَلَا يَبْعُدُ أَنْ يَكُونَ ذَلِكَ مِنْ أَغْرَاضِ الرِّحْلَةِ، كَمَا أَنَّ زِيَارَةَ الْعُلَمَاءِ فِي الْحَيَاةِ.


-‘‘ইমাম নববী (رحمة الله) এর শরহে মুসলিমে বর্ণিত আছে-ইমাম আবু মুহাম্মদ বলেছেন যে, ওই তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য দিকে সফর করা হারাম। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ইহয়ায়ে উলমে উলে­খিত আছে “কতেক আলিম বরকতময় স্থানসমূহ ও উলামায়ে কিরামের মাযারে যিয়ারত উপলক্ষে সফর করাকে নিষেধ বলে। কিন্তু আমি যা বিশ্লেষণ করে পেয়েছি, তা এরকম নয় বরং কবর যিয়ারতের নির্দেশ আছে যেমন হাদীছে আছে أَلَا فَزُورُوهَا  (এখন থেকে যিয়ারত কর) ওই তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের দিকে সফর করার থেকে নিষেধ এজন্য করা হয়েছে যে বাকী সব মসজিদ ফযীলতের দিক দিয়ে একই বরাবর। কিন্তু বরকতময় স্থানসমূহ একই বরাবর নয় বরং মর্তবা অনুযায়ী ওগুলোর বরকত ভিন্ন ভিন্ন। এসব নিষেধকারীরা কি নবীদের মাযার, যেমন হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) হযরত মুসা (عليه السلام) হযরত ইয়াহিয়া (عليه السلام) প্রমুখের মাযার যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করতে পারবে কি? নিশ্চয়ই না, কারণ এটা অসম্ভব। আর আল্লাহর ওলীগণের বেলায়ও একই হুকুম প্রযোজ্য। সুতরাং বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে যদি ওনাদের সেখানে সফর করে যাওয়া হয়, যেমনি উলামায়ে কিরামের জীবদ্দশায় তাঁদের কাছে যাওয়া যায়, কি অসুবিধে আছে?।’’  ২৯৪

{মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ২/৫৮৯পৃ: হাদিস নং.৬৯৩}


❏ মিশকাত শরীফের কিতাবুল জিহাদে জিহাদের ফযীলত প্রসংগে বর্ণিত আছে-


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَرْكَبُ الْبَحْرَ إِلَّا حَاجٌّ، أَوْ مُعْتَمِرٌ، أَوْ غَازٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، فَإِنَّ تَحْتَ الْبَحْرِ نَارًا، وَتَحْتَ النَّارِ بَحْرًا.


-‘‘হাজী গাযী ও উমরাকারী ব্যতীত অন্য কেউ সমুদ্র পথে সফর করিও না। কারণ সমুদ্রের নিচে আগুন বা আগুনের নিচে সমুদ্র আছে।’’  ২৯৫

{ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ৩/৬ পৃ: হা/২৪৮৯, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, কিতাবুল জিহাদ, ২/১১২৭, (ভারতীয় পৃষ্ঠা-৩৩৩) হাদিস/৩৮৩৮,

☞এ হাদিসটি ‘হাসান’ পর্যায়ের; কেননা ইমাম আবু দাউদ এ হাদিসের বিষয়ে নীরব ছিলেন। আলবানী এটিকে যঈফ বলেছেন। তবে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন-

وَرَوَاهُ الْبَزَّارُ مِنْ حَدِيثِ نَافِعٍ عَنْ ابْنِ عُمَرَ مَرْفُوعًا

-‘‘ইমাম বায্যার (رحمة الله) এই হাদিসটি নাফে হতে তিনি ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে মারফু সূত্রে সংকলন করেছেন।’’ (ইবনে হাজার, তালখিসুল হবীর, ২/৪৮৫ পৃ: হা/৯৫৫, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, হা/৯৩৩৩) তাই দুটি সূত্রে এটি ‘হাসান’ বলে প্রমাণিত।}


তাহলে কি এ তিন ধরনের লোক ব্যতীত অন্যদের জন্য সমুদ্র পথে সফর করা হারাম? মোট কথা হলো হাদীছের ভাবার্থ হচ্ছে তা-ই, যা আমি বর্ণনা করেছি। অন্যথায় পার্থিব জীবনযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়বে।


২নং আপত্তি- আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, তার রহমতও সব জায়গায় রয়েছে। দাতা হচ্ছেন আল্লাহ যিনি সর্বত্র মওজুদ। তা সত্বেও কোন জিনিসটা তালাশ করার জন্য আওলিয়া কিরামের মাযারে সফর করে যাওয়া হয়?


উত্তর- আওলিয়া কিরাম হচ্ছেন আল্লাহর রহমতের দরজাসমূহ। এ দরজাসমূহ দিয়েই রহমত প্রবাহিত হয়। রেলগাড়ী এর সারা লাইন দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু একে ধরতে হলে স্টেশনে যেতে হয়। যদি অন্যত্র লাইনের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকেন, রেল নিশ্চয়ই আপনার পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করবে সত্য, কিন্তু আপনি ধরতে পারবেন না। আজকাল দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে, চাকুরী, ব্যবসা ও অন্যান্য উপলক্ষে সফর কেন করেন? আল্লাহ তো রিযিকদাতা এবং তিনি সব জায়গায় রিযিক দেন। ডাক্তারের কাছে রোগী কেন সফর করে আসে? আল্লাহই তো আরোগ্যদানকারী এবং তিনি তো সর্বত্র আছেন। আবহাওয়া পরিবর্তন করার জন্য দার্জিলিং ও কাশ্মীর ভ্রমণ করা হয় কেন জানেন, ওখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর। আর আওলিয়া কিরামের স্থানসমূহের আবহাওয়া ঈমানের জন্য কল্যাণকর। আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে হযরত খিজির (عليه السلام) এর কাছে কেন পাঠিয়েছিলেন? ওগুলো সব কিছুতো এখান থেকেই দিতে পারতেন।


❏ কুরআন করীমে আছে-


هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّهُ.


-‘‘তথায় হযরত যাকারিয়া (عليه السلام) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।’’  ২৯৬

{সূূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-৩৮।}


বোঝা গেল যে, হযরত যাকারিয়া ﷺ হযরত মরিয়মের কাছে দাঁড়িয়ে সন্তানের জন্য দুআ করেছেন অর্থাৎ ওলীর কাছে গিয়ে দুআ করা মানে দুআ কবুল হওয়া। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, আওলিয়া কিরামের মাযার সমূহের কাছে দুআ বেশী কবুল হয়।


৩নং আপত্তি- যেই গাছের নিচে বায়তুর রিজওয়ান (আনুগত্যের শপথ) হয়েছিল লোকেরা ওই জায়গাটাকে যিয়ারতগাহ পরিণত করেছিল। হযরত উমর (رضي الله عنه) এ জন্যে ওই গাছটাকে কাটায়ে ফেললেন। তাই আওলিয়া কিরামের কবর সমূহকে যিয়ারতগাহে পরিণত করাটা হযরত উমর (رضي الله عنه) এর আমলের বিপরীত।


উত্তর- এটা নিছক ভুল ধারণা। হযরত উমর (رضي الله عنه) ওই গাছটা কখনো কাটেন নি। বরং সেই মূল বৃক্ষটা অলৌকিকভাবে মানুষের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এবং লোকেরা ধোঁকায় পড়ে অন্য আর একটি বৃক্ষের যিয়ারত শুরু করে দিয়েছিল। এ ধোঁকা থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি সেই গাছটাকে কাটায়ে ফেলেন। হযরত ফারুকে আযম (رضي الله عنه) যদি পবিত্র বস্তুর যিয়ারতবিরোধী হতেন, তাহলে হুযুর আলাইহিস সালামের চুল মুবারক, তোহবন্দ শরীফ, রওযা পাক সবইতো তাঁর সামনে যিয়ারতগাহে পরিণত হয়েছিল। এগুলোকে কেন রেহাই দিলেন?


❏ মুসলিম শরীফের দ্বিতীয় খণ্ড কিতাবুল ইমারত وَبَيَانِ بَيْعَةِ الرِّضْوَانِ تَحْتَ الشَّجَرَةِ অধ্যায়ে এবং বুখারী শরীফের দ্বিতীয় খণ্ড غزوه الحديبيه অধ্যায়ে হযরত ইবনে মুসাইয়ব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে-


عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، قَالَ: كَانَ أَبِي مِمَّنْ بَايَعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَ الشَّجَرَةِ، قَالَ: فَانْطَلَقْنَا فِي قَابِلٍ حَاجِّينَ، فَخَفِيَ عَلَيْنَا مَكَانُهَا.

-‘‘আমার পিতাও ওনাদের সাথে ছিলেন, যাঁরা বৃক্ষের নিচে হুযুর আলাইহিস সালামের কাছে বায়আত করেছিলেন। তিনি বলেছেন পরবর্তী বছরে যখন আমরা হজ্বে গিয়েছিলাম, তখন ওই জায়গাটা আমাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।’’  ২৯৭

{ইমাম মুুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবিল ইমারাত, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৪৮৫, হাদিস/১৮৫৯}


❏ বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে-


فَلَمَّا خَرَجْنَا مِنَ العَامِ المُقْبِلِ نَسِينَاهَا، فَلَمْ نَقْدِرْ عَلَيْهَا.


-‘‘অতপর যখন আমরা পরবর্তী বছর গেলাম, তখন জায়গাটা ভুলে গিয়েছিলাম এবং খুঁজে পাইনি।’’  ২৯৮

{ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুল মাগাজী, ৫/১২৪, হাদিস/৪১৬৩, পরিচ্ছেদ: بَابُ غَزْوَةِ الحُدَيْبِيَةِ}


এরপর এটা কিতাবে বলতে পারে যে, হযরত ফারুকে আযম (عليه السلام) আসল গাছটি কাটায়ে ফেলেছেন।


Top