প্রথম নিবন্ধ : দুটি বক্তব্য


  প্রথম বক্তব্য বি'ছাত'(বিছাত-নবী, রাসূলের প্রেরণ ও আগমন) ও নবূওতের হাকীকত সম্পর্কে, গোটা মাখলুকাত যে তাদের মুহতাজ-(মুহতাজ-মুখাপেক্ষী) তা এখানে বর্ণিত হয়েছে। জেনে রাখ! সৃষ্টিগতভাবে মানুষের স্বভাব জ্ঞানশূন্য, খালি; তাই সে আল্লাহ তা'আলার সৃষ্ট বিভিন্ন জগৎ সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না। আর সৃষ্টি জগতের সংখ্যা অসংখ্য, অনির্ণনীয়, যার জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা ছাড়া আর কারো নেই। যেমন আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:


وَمَا يَعۡلَمُ جُنُوۡدَ رَبِّكَ اِلَّا هُوَ


  অর্থাৎ তোমার রবের লশকরের খবর-তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।(আল কোরআন ৭৪ : ৩১)।


 বস্তুতঃ তাঁর সৃষ্ট সৃষ্টি জগতের ইলম বা জ্ঞান ‘ইদরাক’ বা অনুভূতির মাধ্যমে হাসিল হয়ে থাকে। আর অনুভূতি জাত ইন্দ্রিয়রাজীর সৃষ্টি কেবল এজন্যে হয়েছে যে, তার মাধ্যমে মানুষ সৃষ্ট জগত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে। আর সৃষ্ট জগতের দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য হলাে-সব ধরনের সৃষ্টি রাজীর জগতকে বুঝানাে। 

উল্লেখ্য যে, মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘স্পর্শ-অনুভূতির' সৃষ্টি হয়, যদ্বারা সে সর্দি-গর্মি, শুনাে-ভিজা, নরম-শক্ত ইত্যাদি অনুভব করতে পারে।কিন্তু স্পর্শজনিত

-অনুভূতির দ্বারা রং ও শব্দকে অনুধাবন করা যায় না। বরং বলা যায়  স্পর্শজনিত অনুভূতির রাজ্যে এর কোন প্রবেশাধিকার নেই। অতঃপর এর মাঝে ‘দর্শন-অনুভূতি' সৃষ্টি করা হয়। যদ্বারা সে রং ও আকার আকৃতি অনুমান করতে পারে। অনুভূতির-জগতে এর প্রশস্ততা অনেক ব্যাপক ও সীমাহীন। অতঃপর মানব স্বভাবের মধ্যে শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি করা হয়, যদ্বারা সে আওয়াজ ও গান-বাদ্য শুনে। পরে তার মাঝে 'চাখার’ বা স্বাদ-গ্রহণের শক্তি সৃষ্টি করা হয়; এমনকি তা অনুভূত-জগৎকে অতিক্রম করে যায়। এ সময় তাদের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়।

 

যখন মানব-শিশু সাত-বছর বয়সে পৌছে এবং এ হলাে তার জীবনের ক্রম পরিবর্তনের ধারার একটি স্তর, যদ্বারা সে ঐসব কাজ-কর্মকে বুঝতে পারে, যা অনুভূতি স্তরের বাইরে এবং 'অনুভূতির-জগতে’ এর কিছুই পাওয়া যায় না। তার বয়স যখন আরাে বাড়তে থাকে, তখন তার মাঝে আকল বা জ্ঞান সৃষ্টি করা হয়, যদ্বারা সে শরীয়তের বিভিন্ন স্তরের আমল যথা-ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল ও মুস্তাহাব ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে, যা ইতিপূর্বে কোন স্তরে হাসিল হয় না। 


প্রকাশ থাকে যে, ‘আকল' বা জ্ঞানের উপর আরাে একটি স্তর আছে, যার মধ্যে তার মাঝের আরাে একটি চোখ খুলে যায়, যা দিয়ে সে অতীত ও ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত ব্যাপারাদি ও অন্যান্য কার্যাবলী অবলােকন করে-যা জ্ঞান দ্বারা হাসিল করা সম্ভব নয়। যেমন, অনুভূতি-ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ‘ভাল-মন্দের' পার্থক্য নির্ণয় করা আদৌ সম্ভব নয়। একইভাবে, ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়কারী ইন্দ্রিয়ের সামনে যদি 'জ্ঞান-জাত' বিষয়কে পেশ করা হয়, তবে তাে সে তা অস্বীকার করে বসবে। 


বস্ততঃ এভাবেই কিছু সংখ্যক জ্ঞানী-লােকেরা মুদরিকাতে-নুবূওত’ বা নুবুওত প্রাপ্তির-জ্ঞানকে অস্বীকার করেছে এবং তা অবাস্তব বলে ধারণা করেছে। আর এরূপ করা চরম মূর্খতা বই আর কিছুই নয়। এরূপ করার কারণ হলাে এই যে, তারা এ স্তরের সর্বোচ্চ মর্তবায় পৌছতে পারিনি। ফলে তারা ধারণা 

করেছে যে, এর আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। যেমন কোন জন্মান্ধ ব্যক্তি, যদি সে আদৌ রং ও আকৃতির খবর না জানে, আর তার সামনে এগুলাের গুণাগুণ যদি বর্ণনা করা হয়, তবে সে তা জানতে পারবে না এবং স্বীকারও করবে না। 

পক্ষান্তরে, আল্লাহ পাক তাঁর নবীদের স্বীয় বান্দাদের নিকটবর্তী করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নুবুওতের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে-বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন; আর তা হলাে নিদ্রা। কেননা, নিদ্রিত ব্যক্তি স্বপ্নে গায়েবের এ জ্ঞান লাভ করতে পারে, যা অচিরেই ঘটবে; চাই তা স্পষ্টভাবে বা অস্পষ্টভাবে তা’বীরের মাধ্যমে প্রকাশিত হােক। যদি অনভিজ্ঞ কোন লােককে এরূপ বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি বেহুশ হয়ে মৃতবৎ পড়ে যায় এবং তার দেখা, শােনা ও অনুভূতির ইন্দ্রিয় অকেজো হয়ে যায়; এমতাবস্থায়ও সে 'গায়েব' বা অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জানে; তখন সে ব্যক্তি তাকে অস্বীকার করবে এবং তা অসম্ভব ও অবাস্তব বলে এরূপ দলীল পেশ করবে যে, 'স্পর্শ-শক্তি’ অনুভূতির একটা অন্যতম মাধ্যম; তাই যে ব্যক্তি জীবিত থাকাবস্থায় তা অনুভব করতে পারে না, সে নিদ্রিত (বা মৃত) অবস্থায় তা কিরূপে অনুধাবন করবে? কিন্তু এটি এ ধরনের “কিয়াস" বা ধারণা যাকে অস্তিত্ব ও দর্শন মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। 


উল্লেখ্য যে,'আকল’ বা জ্ঞান মানুষের জন্য এমন এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জিনিস, যদ্বারা সে জ্ঞান সম্পর্কীয় বিভিন্ন জিনিস আয়ত্বে আনতে পারে, যা অনুভূতির মাধ্যমে হাসিল করা সম্ভব নয়। এমনিভাবে, নুবুওত হলাে এমন এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্তর, যাতে এমন দৃষ্টি শক্তি হাসিল হয়, যার আলােকে অদৃশ্য জগতের এমন সব খবর এবং অন্যান্য বিষয়াদি প্রকাশ পায়, যা 'আকল’ বা জ্ঞান বুঝতে সক্ষম নয়।


 আর নুবুওতের ব্যাপারে যে ধরনের সন্দেহ হতে পারে, তাহলাে : ১. তার ‘ইমকান' বা সম্ভাব্যতার ব্যাপারে; ২. তার অজুদ' বা অস্তিত্বের ব্যাপারে এবং ৩, একজন বিশেষ ব্যক্তির তা হাসিল হওয়ার ব্যাপারে। অথচ তার অস্তিত্বই দলীল হলাে-'ইমকান' বা সম্ভাব্যের এবং এর ‘অজুদ' বা অস্তিত্বের দলীল হলাে ঐ সমস্ত গােপন তথ্য ও তত্ত্ব যা জ্ঞানের দ্বারা হাসিল করার চিন্তাও করা যায় না। যেমন-চিকিৎসা শাস্ত্র ও জ্যোতিষ শাস্ত্র; যদি কেউ এ দুটি জ্ঞান সম্পর্কে কিছু বলতে চায়, তবে প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে এ জ্ঞান অর্জন করতে হবে যে, এ দু'টি বিষয়ের জ্ঞান লাভ আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ হতে, ওহী বা ইলহাম ব্যতীত সম্ভব নয়। কেননা, কেবল অভিজ্ঞতার দ্বারাই এ দুটি বিষয়ের জ্ঞান লাভ আদৌ সম্ভব নয়। বস্তুত, কোন কোন নক্ষত্রের পরিক্রমা হাজার হাজার বছরে মাত্র একবার হয়ে থাকে। কাজেই, অভিজ্ঞতার দ্বারা এ জ্ঞান কিরূপে হাসিল হতে পারে? 


উপরোক্ত আলােচনায় জানা গেল যে, যে সমস্ত বিষয়ের ধারণা ‘আকল' বা জ্ঞান দ্বারা করা যায় না, তা জানার পদ্ধতির অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে। আর নুবুওতের জ্ঞান এরূপেই হাসিল হয়ে থাকে। এছাড়া নুবুওতের আরও কিছু খাস বৈশিষ্ট্য আছে। আর আমি যে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করলাম, তা মহাসমুদ্রের ক্ষুদ্র বারি বিন্দুর মত। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী-রাসূলগণের যে মু'জিযা বা অলৌকিক শক্তি প্রদান করেছেন, জ্ঞানীরা তাদের জ্ঞান দ্বারা কখনাে ঐ স্তরে পৌছাতে পারে।  মু'জিযা ব্যতীত নুবুওতের আর যে সব বৈশিষ্ট্য আছে, তার ধারণা আমরা ‘রিয়াযত' বা সাধনার মাধ্যমে, তাসাওউফের তরীকায় এবং আল্লাহর ওলীদের তরীকা অনুসরণের দ্বারা হাসিল করতে পারি। কিন্তু এই বিশেষ-বৈশিষ্ট্যটি অর্থাৎ মু'জিযাকে স্বীকার করা ঈমানের জন্য অপরিহার্য। এ সম্পর্কে ইমাম গাযযালী (রহ.) তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ আল-মুনকিযু মিনাদ্-দালাল’ এ বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। দার্শনিকদের অভিমত হলাে : বি’ছাত বা নবী-রাসূল প্রেরণ খুবই উত্তম কাজ কেননা, এর দ্বারা অনেক উপকার হয়। যেমন-“আকল’ বা জ্ঞানের শক্তি দ্বারা ঐ সমস্ত ব্যাপারে বৃদ্ধি পায়, যা জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত; যথা- ‘অজুদে বারী তা'আলা' বা মহান আল্লাহর অস্তিত্ব; আল্লাহর সম্পর্কে জ্ঞান এবং তার কুদরাত সম্পর্কে জ্ঞান-ইত্যাদি। এছাড়া আল্লাহর নবীদের হুকুম বা নির্দেশ থেকে ঐসব ব্যাপারে উপকৃত হওয়া যা জ্ঞানের পরিধির আওতাভুক্ত নয়, যেমন 'কালাম' বা কথা, 'রুইয়াত' বা দর্শন ইত্যাদি, যাতে রাসূলগণের আগমনের পর মানুষের জন্য আর কিছু বলার না থাকে। আর আল্লাহ তা'আলার ‘মুলুকে' বা বাদশাহীতে তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছু করার জন্য যে ভয় সৃষ্টি হয়, নেক-আমলের দ্বারা তা দূরীভূত হয়। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি নেক আমল করে তার জ্ঞান তাকে সঠিক দিক-নির্দেশ করে। নবীগণের কর্মকাণ্ড হলাে মানুষ ও মানবতাকে রক্ষা করা। কেননা, মানুষেরা পরস্পরের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। কাজেই এখন এমন শরীয়তের প্রয়ােজন, যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এবং তার অনুসরণ ও অনুকরণ মানুষের জন্য অবধারিত। আর মানুষের মূল সত্ত্বাকে বিভিন্ন ধরনের ইলম ও আমল দ্বারা সুসজ্জিত করা প্রয়ােজন, যাতে তার মৌলিক গুণ বিকশিত হতে পারে। এ ধরনের লােকদের শিক্ষা হলাে-নেক কাজে উৎসাহ দেওয়া এবং অসৎ কাজ থেকে লােকদের ফিরিয়ে রাখা ইত্যাদি। 

উপরােক্ত আলােচনায় জানা গেল যে, বি'ছাত বা নবী রাসূল প্রেরণ ‘ওয়াজীব' বা অপরিহার্য। বস্তুত হুসন' এর অর্থ যা ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত।এর সমর্থনে দার্শনিকদের কোন কোন মন্তব্যে দেখা যায় যে, 'বিছাত ওয়াজিব।'

Top