পঞ্চত্রিংশ অধ্যায়
দুরুদ শরীফ পাঠ করা
দুরূদ শরীফ ব্যতীত কোনো দোয়া আল্লাহ ﷻ'র নিকট গ্রহণযোগ্য হবেনা। সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ও উলামায়ে কেরামের একথার উপর ইজমা হয়ে গেছে যে, দোয়ার শুরুতে, মধ্যভাগে এবং দোয়ার শেষ দিকে দুরূদ শরীফ পাঠ করা সুন্নাত এবং ইহা অতি ফলদায়ক।
দুরূদ শরীফ পাঠের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে কবি বলেন-
‘‘দুরূদ পড় সবে মিলে ওহে মুমিন- মুসলমান
দুরূদেতে আল্লাহ রাজি খুশী নবী দোজাহান।’’
কবি আরো বলেন-
‘‘কবর যদি চাও উজালা দুরূদবানাও গলের মালা
খুলবে তোমার দিলের তালা দেখবে নবী মোস্তফা’’
সেই মহিমান্বিত মকবুল ইবাদত দুরূদ শরীফ পাঠ করার প্রতি রাসুল ﷺ অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দুরূদ শরীফের ফজিলত সম্পর্কে অগণিত হাদীস রয়েছে। দুরূদ শরীফের ফজিলত সম্পর্কিত কয়েকখানা হাদীস নিম্নে পেশ করা হল:-
১. হযরত আবু হুরায়রা رضي الله عنه হতে বর্ণিত- তিনি বলেন রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- ‘‘যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে আল্লাহ পাক তার উপর দশটি রহমত নাজিল করবেন’’
(মুসলিম- আবু দাউদ)।
২. হযরত ইবনে মাসউদ رضي الله عنه হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তিই আমার সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হবে, যে আমার উপর সর্বাধিক দুরূদ শরীফ পাঠ করবে
(তিরমীজি)।
৩. হযরত আনাস رضي الله عنه হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে আল্লাহপাক তার উপর দশটি রহমত নাজিল করবেন, দশটি গুনাহ মাফ করবেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন
(নাসায়ী।
৪. হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির رضي الله عنه থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই আল্লাহপাক আমার রওজা শরীফে একজন ফেরেস্তা মোতায়েন করে রেখেছেন যাকে সমস্ত বিশ্ববাসীর কথা শুনার শক্তি দান করেছেন। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত যে কোন ব্যক্তিই আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করবে সে ফেরেস্তা তার ও তার পিতার নাম উল্লেখ করে এভাবে আমার নিকট দুরূদ শরীফ পেশ করবে যে, অমুক ব্যক্তির পুত্র অমুক আপনার খেদমতে দুরূদ শরীফ প্রেরণ করেছেন।
(আল কাউলুল বাদী, আত-তারগীব ওয়াত- তারহীব)।
৫. হযরত আনাস رضي الله عنه হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি জুমআর দিনে একশতবার এবং জুমআর রাতে একশত বার আমার উপর দুরূদ পাঠ করবে আল্লাহপাক তার একশতটি হাজত পূরণ করবেন। এর মধ্যে সত্তরটি হাজত হচ্ছে পরকালীন এবং ত্রিশটি হাজত হচ্ছে ইহলৌকিক। তিনি এর জন্য একজন ফেরেস্তা মনোনীত রেখেছেন যিনি আমার কবরে তা পৌছিয়ে দেবেন। যেভাবে তোমাদের কাছে কেউ হাদিয়া নিয়ে যায়। আমার ইন্তেকালের পরের জ্ঞান আমার জীবনকালীন জ্ঞানের মত। যে কেহ আমার উপর দুরূদ পাঠ করবে, ফেরেস্তা তার নাম ও বংশ পরিচয় সহ আমাকে সংবাদ দিবেন। তারপর আমি একটি উজ্জ্বল বইয়ে তার নাম- ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে রাখব।
(বায়হাকী)
৬. হযরত আবুদারদা رضي الله عنه হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- শুক্রবার দিন তোমরা আমার উপর অধিক পরিমাণে দুরূদ পাঠ কর। কারণ ইহা এমন এক বরকতময় দিন যেদিন ফেরেস্তাগণ নাজিল হন। যখন কোন ব্যক্তি আমার উপর দুরূদ পাঠ করে, সাথে সাথেই তার দুরূদ আমার নিকট পেশ করা হয়। হযরত আবুদারদা رضي الله عنه বলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার ইন্তেকালের পরও কি এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে? তখন রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- হযাঁ, কেননা আল্লাহপাক মাটির জন্য নবীদের দেহকে ভক্ষণ করা হারাম করে দিয়েছেন।
(ইবনে মাজাহ)
৭. রাসুলে পাক ﷺ ইরশাদ করেন- কোন বান্দা যেকোন স্থান থেকেই আমার উপর দুরূদ পাঠ করলে তার আওয়াজ আমার নিকট পৌছে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার ওফাতের পরেও নাকি? রাসুল ﷺ জবাবে বললেন- হযাঁ। (জালাউল আফহাম)। অন্য হাদীসে রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- তোমরা সোমবার ও শুক্রবারে আমার উপর বেশী করে দুরূদ পাঠ কর। কেননা আমি তোমাদের দুরূদ সরাসরি শুনতে পাই।
(আনিসুল জালিছ)
৮. হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুছুর رضي الله عنه থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালার হামদ এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করা হয়না, ততক্ষণ পর্যন্ত সকল প্রকার দোয়াই আল্লাহ ﷻ'র দরবারে পৌছেনা বরং ঝুলন্ত থাকে। আর যখন আল্লাহ ﷻ'র হামদ এবং রাসুলের উপর দুরুদ শরীফ পাঠ করা হয় তখনই সকল প্রকার দোয়া আল্লাহ ﷻ'র দরবারে কবুল হয়।
(আল কাউলুল বাদী।)
৯. হযরত আবুহুরায়রা رضي الله عنه থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন- কোন লোক যখন আমার প্রতি সালাম প্রেরণ করে তখনই আল্লাহ তায়ালা আমার রূহকে তার প্রতি ফিরিয়ে দেন। যাতে আমি তার সালামের উত্তর প্রদান করি
(আবু দাউদ মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী)।
১০. একখানা হাদীসে আছে, নবী ﷺকে প্রশ্ন করা হল- হে নবী! যারা অনুপস্থিত এবং যারা আপনার পরে পৃথিবীতে আসবে তাদের পঠিত দুরূদ আপনার কাছে কিভাবে পৌছবে? নবী ﷺ জবাবে বললেন- যারা আমার আশিক তাদের দুরূদ আমি নিজ কানে সরাসরি শুনি ও তাদেরকে চিনি। আর অন্যান্যদের দুরূদ আমার নিকট ফেরেস্তাদের মাধ্যমে পেশ করা হয়।
(দালাইলুল খাইরাত)।
১১. হযরত কাব বিন উজরা رضي الله عنه থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল ﷺ সাহাবায়ে কেরামকে বললেন তোমরা মিম্বরের নিকটবর্তী হও। আমরা হাজির হলাম রাসুল ﷺ যখন মিম্বরের প্রথম সিড়িতে কদম মোবারক রাখলেন তখন বলে উঠলেন ‘আমিন।’ যখন তিনি মিম্বরের দ্বিতীয় সিড়িতে কদম মোবারক রাখলেন তখনও বলে উঠলেন ‘আমিন।’ যখন তিনি মিম্বরের তৃতীয় সিড়িতে কদম মোবারক রাখলেন তখন আবার বলে উঠলেন ‘আমিন।’ আমরা আরজ করলাম ইয়া রাসুলাল্লাহ! আজ আমরা আপনার নিকট থেকে এমন কিছু শুনলাম যা ইতিপূর্বে কোন দিন শুনিনি। রাসুল ﷺ তখনই বললেন- আমার নিকট হযরত জিব্রাঈল عليه السلام এসেছিলেন। আমি যখন মিম্বরের প্রথম সিড়িতে পা রাখলাম হযরত জিব্রাঈল عليه السلام তখন বললেন- সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে ব্যক্তি রমজান মাস পাওয়ার পরও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারেনি। আমি তখন ‘আমিন’ বললাম। আমি মিম্বরের দ্বিতীয় সিড়িতে থাকাবস্থায় জিব্রাঈল এই দোয়া করলেন সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক যার সম্মুখে আপনার নাম মোবারক উচ্চারণ করা হল অথচ সে আপনার উপর দুরুদ শরীফ পাঠ করলনা। তখন আমি বললাম ‘আমিন।’ আমি মিম্বরের তৃতীয় সিড়িতে থাকাবস্থায় হযরত জিব্রাঈল বললেন সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে মাতাপিতা উভয়কে বা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেলো অথচ তাদের সেবা করে জান্নাতবাসী হতে পারলোনা। তখন আমি বললাম ‘আমিন।’
(হাকীম- বুখারী)।