বিষয় নং-০৭: ‘যে নিজকে চিনেছে সে তার রবকে চিনেছে’:


“হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থের ২৭৭ পৃষ্ঠায় উক্ত গ্রন্থের লেখক বলেন,  ‘মুহাদ্দিসগণ এক বাক্যে বলেছেন যে, এই বাক্যটি রাসূল (ﷺ) এর কথা নয়।’


‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থে মাওলানা মুতীউর রহমান ১৩১ পৃষ্ঠায় শুধু মাত্র ইবনে তাইমিয়ার দলীল দিয়ে দাবী করেছেন এটি রাসূল (ﷺ) এর হাদিস নয়,  মিথ্যা বানোয়াট কথা। মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পাদিত ‘প্রচলিত জাল হাদীস’ গ্রন্থের ৮৪ পৃষ্ঠায় এ হাদিস সম্পর্কে লিখা হয়েছে যে-‘‘এটি হাদীস শাস্ত্রের বিজ্ঞ ইমামগণের দৃষ্টিতে মোটেই হাদীস নয়।’’


পর্যালোচনা:


এ হাদিসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের তিনটি অভিমত পাওয়া যায়। একটি অভিমত হলো এটি রাসূল (ﷺ)-এর কালাম, দ্বিতীয় অভিমত হলো এটি আমিরুল মু‘মিনীন হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর বাণী। তৃতীয় অভিমত হলো, এটি মাশায়েখে কেরামের বাণী। 


প্রথম অভিমত:


আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী আল মক্কী (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সনদবিহীন উল্লেখ করেছেন- 


قوله عليه الصلوة و السلام: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ-


-‘‘রাসূল (ﷺ) এর বাণী,  যে নিজকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনেছে।’’   ২৫

২৫ . আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী : ফাতোওয়ায়ে হাদীসিয়্যাহ : ২১১ পৃ. মীর মোহাম্মদ কারখানা, করাচি, পাকিস্তান, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী: তাফছিরে রুহুল বয়ান, ১ম খণ্ড, ২৭১ পৃ: ও ৩০৮ পৃ:, ৫ম খণ্ড, ২২৭ পৃ:, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৯৩ পৃ:; ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী: তাফসিরে কাবীর, ৩০তম খণ্ড, ২০১ পৃ: সূরা কিয়ামা’র শুরুতে, ৯ম খণ্ড, ১১৭ পৃ:; তাফসিরে ছা’লাবী, ১ম খণ্ড, ২৭৯ পৃ:; তাফছিরে ওয়াছিত লিল ওয়াহেদী, ১ম খণ্ড, ২১৪ পৃ:; তাফছিরে রাগেব ইস্পাহানী, ১ম খণ্ড, ৫৫ পৃ:; তাফছিরে বাগবী, ১ম খণ্ড, ১৬৯ পৃ:; তাফসিরে খাযেন, ১ম খণ্ড, ৮৩ পৃ:; আল লুভাব ফি উলুমিল কিতাব, ২য় খণ্ড, ৪৯৮ পৃ:; তাফছিরে নিছাপুরী, ২য় খণ্ড, ১৭৫ পৃ:; তাফছিরে সিরাজুম মুনীর, ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃ:; তাফছিরে আবু সাউদ, ৯ম খণ্ড, ১৭৫ পৃ:; তাফছিরে মাজহারী, ১ম খণ্ড, ১৩২ পৃ:; ইমাম গায্যালী: এহইয়াউল উলুমুদ্দিন, ৩য় খণ্ড, ২২৪ পৃ:; গাউছে পাক: ছেররুল আছরার, ৫৯ পৃ:; হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী: যিয়াউল কুলুব, ৭১ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মাওদ্বআতুল কাবীর, ১২২ পৃ., ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ২য় খণ্ড, ২৩৪ পৃ:; তাফছিরে বায়দ্বাবী, ২য় খণ্ড, ২৮০ পৃ:


এ হাদিস যারাই উল্লেখ করেছেন তাদের কেহই এটির কোন সনদ সূত্র সংকলন করেননি। ইমাম আবুল হাছান আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাবিব বাছরী বাগদাদী মাওয়ারদী (رحمة الله) {ওফাত ৪৫০ হিজরী} তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন, 


وَقَدْ قَالَتْ عَائِشَةُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَتَى يَعْرِفُ الْإِنْسَانُ رَبَّهُ؟ قَالَ: إذَا عَرَفَ نَفْسَهُ


-“অবশ্যই হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষ কখন রব তা’লাকে চিনতে পারে? রাসূল (ﷺ) বললেন: যখন সে নিজেকে চিনতে পারে।” (আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বীন, ১ম খণ্ড, ৭৫ পৃ:)


একাধিক আইম্মা ও ফুকাহাগণ ইহাকে হাদিস হিসেবে তাদের স্ব স্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন তাফসিরের কিতাবেও ইহাকে হাদিস হিসেবে উল্লেখ করা আছে। যেমন আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম ছা’লাবী (رحمة الله) ওফাত ৪২৭ হিজরী হাদিসটি এভাবে উল্লেখ করেছেন,


كما جاء في الخبر: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ


-“যেমন খবরে (হাদিসে) এসেছে ‘যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনলো’।” (তাফছিরে ছা’লাভী, ১ম খণ্ড, ২৭৯ পৃ:)।


শারিহে বুখারী ইমাম শামছুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ সাফারী (رحمة الله) ওফাত ৯৫৬ হিজরী বলেন-


وأما حديث: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ


-“আর হাদিস হচ্ছে, ‘যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (শরহে বুখারী লিছ সাফারী, ১ম খণ্ড, ৪৫৮ পৃ:)


বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিছ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ওফাত ১০১৪ হিজরী তদীয় কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেন-


وَفِي الْحَدِيثِ: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ


-“আর হাদিস শরীফে আছে, ‘যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৮২ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)


প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা জয়নুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে মাদউবি’ আব্দির রউফ আল মানাভী (رحمة الله) ওফাত ১০৩১ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন-


قَالَ عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ


-“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (আল্লামা মানাভী: আত তাইসীর বিশারহে জামেউস সগীর, ১ম খণ্ড, ৪৯৩ পৃ:)


হুজ্জাতুল ইসলাম আব্দুল হামিদ ইমাম গায্যালী (رحمة الله) ওফাত ৫০৫ হিজরী বলেন:


وقال النبي صلى الله عليه وسلم: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ


-“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (কিমিয়ায়ে সাদাৎ, ১ম খণ্ড, ১২৪ পৃ:)


এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম শামছুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন,


ولذلك رَبَطَ النَّبِيّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وسَلَّمَ معرفةَ الحقِّ بمعرفة النّفس، فَقَالَ: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ عَرَفَ رَبَّهُ


-“এ কারণেই আল্লাহর নবী (ﷺ) স্বীয় স্বত্বার পরিচিতির মাধ্যমে হক্বকে চিনেছেন এবং সার্বক্ষনিক চক্ষুষ্মান ধ্যানে থাকতেন। আর তিনি বলেছেন: যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, ৪৬তম খণ্ড, ৩৭৮ পৃ: ৫৪৯ নং রাবীর ব্যাখ্যায়)


আল্লামা আবুল হাছান আলী ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ওয়াহেদী নিছাপুরী (رحمة الله) ওফাত ৪৬৮ হিজরী বলেন: 


ما روي فِي الحديث: من عرف نفسه عرف ربه -“হাদিস শরীফে যা রয়েছে: যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (তাফছিরে ওয়াছিত লিল ওয়াহেদী, ১ম খণ্ড, ২১৪ পৃ:)


আল্লামা ইমাম রাগেব ইস্পাহানী (رحمة الله) ওফাত ৫০২ হিজরী তদীয় কিতাবে ইহাকে এভাবে উল্লেখ করেছেন,


وقال عليه السلام: أعلمكم بنفسه أعلمكم بربه، وقيل فيما أنزل الله في السفر الأول: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ 


-“তোমরা নিজেদেরকে জানতে পারলে রব তা’আলাকে জানতে পারবে। কেউ কেউ বলেন, সফরের প্রথমে যা নাজিল হয়েছে: যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (তাফছিরে রাগেব ইস্পাহানী, ১ম খণ্ড, ৫৫ পৃ:)।


ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) ওফাত ৬০৬ হিজরী বলেন,


وَقَوْلُهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ عَرَفَ رَبَّهُ مَعْنَاهُ مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ بِالْحُدُوثِ عَرَفَ رَبَّهُ بِالْقِدَمِ، وَمَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ بِالْإِمْكَانِ عَرَفَ رَبَّهُ بِالْوُجُوبِ، وَمَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ بِالْحَاجَةِ عَرَفَ رَبَّهُ بِالِاسْتِغْنَاءِ،


-“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর কওল হল, যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’ এর অর্থ হল: যারা নশ্বরের মধ্যে নিজেকে চিনবে সে অবিনশ্বর সত্ত্বাকে চিনবে। যে তার নিজেকে স্থান সমূহে চিনবে সে তার রবকে চিরস্থায়ীভাবে চিনবে। যে তার হাজতের মাধ্যমে আল্লাতে চিনবে সে সাহায্য পাওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তা’লাকে চিনবে।” (ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী: তাফছিরে কবীর, ৯ম খণ্ড, ৪৬০ পৃ:)


আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম ইবনে উমর আল-মারুফ খাজেন (رحمة الله) ওফাত ৭৪১ হিজরী বলেন,


وقد جاء من عرف نفسه فقد عرف ربه ومعناه: أن يعرف نفسه بالذل والعجز والضعف والفناء، ويعرف ربه بالعز والقدرة والقوة والبقاء


-“অবশ্যই (হাদিসে) এসেছে, যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’। এর অর্থ হল: নিশ্চয় যে ব্যক্তি তার নিজের অচল অবস্থা, দুর্বলতা ও ক্ষণস্থায়িত্ত্বতাকে চিনবে সে কুদরত, শক্তি ও চিরস্থায়ী রব তা’লাকে চিনবে।” (তাফছিরে খাজেন, ১ম খণ্ড, ৮৩ পৃ:)


আল্লামা নিজামুদ্দিন হাছান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হুছাইন নিছাপুরী (رحمة الله) ওফাত ৮৫০ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন:  


قال صلى الله عليه وسلم مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ


-“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (তাফছিরে নিছাপুরী, ২য় খণ্ড, ১৭৫ পৃ:)


আল্লামা শামছুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল খতিব শাফেয়ী (رحمة الله) ওফাত ৯৭৭ হিজরী বলেন, روي: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ -“বর্ণিত আছে, যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’।” (তাফছিরে সিরাজুম মুনীর, ৩য় খণ্ড, ২০৫ পৃ:)


দ্বিতীয় অভিমত: 


আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله) সংকলন করেন-


قال امير المؤمنين على بن ابى طالب رضى الله عنه مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ


-‘‘আমিরুল মু‘মিনীন হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল।’’ (ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বয়ান, ৬ষ্ঠ খণ্ড ৩৯৩ পৃ.) 

এ বর্ণনায় পাচ্ছি এটি মাওকুফ হাদিস, কিন্তু এটির কোন সনদ সূত্র তিনি উল্লেখ করেননি।


তৃতীয় অভিমত:


তবে এটি হযরত সুফিয়ান (رحمة الله) এর কওল হিসেবেও সামান্য শাব্দিক ব্যবধানে বর্ণিত আছে। যেমন ইমাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আলী ইবনে আছেম ইস্পাহানী মাশহুর ইবনে মুকরী (رحمة الله) ওফাত ৩৮১ হিজরী একটি সনদসহ রেওয়াত উল্লেখ করেন:


حَدَّثَنَا أَحْمَدُ قَالَ: سَمِعْتُ إِبْرَاهِيمَ بْنَ سَعِيدٍ الْجَوْهَرِيَّ قَالَ: سَمِعْتُ سُفْيَانَ بْنَ عُيَيْنَةَ يَقُولُ: قَالَتِ الْعُلَمَاءُ: لَا يَضُرُّ الْمَدْحُ مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ


-“ইব্রাহিম ইবনে সাঈদ আল জাওহারী (رحمة الله) বলেন, আমি সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি, উলামায়ে কেরাম বলেন: যে তার নিজকে চিনল সে আনন্দকে প্রত্যাহার করবে না।” (মু’জামে ইবনে মুকরী, হাদিস নং ৪০৬; ইমাম আবু নুয়াইম: হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৭ম খণ্ড, ৩০২ পৃ:)


ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (رحمة الله) ওফাত ৪৩০ হিজরী উল্লেখ করেন, 


وَسُئِلَ سَهْلٌ عَنْ قَوْلِهِ: مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ، قَالَ: مَنْ عَرَّفَ نَفْسَهُ لِرَبِّهِ عَرَّفَ رَبَّهُ لِنَفْسِهِ


-“হযরত সাহল (رضي الله عنه) কে এই হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল যে ‘যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’ তিনি বলেন: যে তার রবের জন্য নিজকে চিনবে সে তার নিজের জন্য রব তা‘আলাকে চিনবে।” (ইমাম আবু নুয়াইম: হিলইয়াতুল আউলিয়া, ১০ম খণ্ড, ২০৮ পৃ:)


একদিকে ইহা রেওয়ায়েত লিল মায়ানা হিসেবে ‘হাদিসে রাসূল’ ও অন্যদিকে ইহা হযরত আলী (رضي الله عنه) এর কউল হিসেবে ‘হাদিস’। অপরদিকে হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (رحمة الله) এর কউল, যা রেওয়াত আকারে প্রমাণিত। কেউ কেউ এই হাদিসটুকুকে ইমাম নিছাপুরী (رحمة الله) এর ‘কউল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (দেখুন: আনওয়ারুছ ছালিকীন, ১৭ পৃ:)


এই হাদিস সম্পর্কে ১১শ শতাব্দির মোজাদ্দেদ, হানাফী মাজহাবের উজ্জ্বল নক্ষত্র, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে লিখেন:


وَقَالَ النَّوَوِيُّ إِنَّهُ لَيْسَ بِثَابِتٍ يَعْنِي عَنِ النَّبِيِّ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ وَإِلَّا فَمَعْنَاهُ ثَابِتٌ


-“ইমাম নববী (رحمة الله) বলেন: এই হাদিসের ‘মাআনা’ বা ভাবার্থ ছাবিত রয়েছে।” (ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফুয়া, ২৩৮ পৃ:)


এই হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইমাম আজলুনী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে লিখেন:


أن الشيخ محي الدين قال هذا الحديث وإن لم يصح من طريق الرواية فقد صح عندنا من طريق الكشف. 


-“নিশ্চয় শায়খ মহিউদ্দিন ইবুল আরাবী (رحمة الله) বলেন: ইহা হাদিস, তবে ইহা সনদের রেওয়াত দ্বারা সহীহ্ প্রমাণিত নয় কিন্তু কাশফের ত্বরিকা দ্বারা বিশুদ্ধ প্রমাণিত।” (ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, ২য় খণ্ড, ২৩৪ পৃ:)।


এই হাদিস সম্পর্কে ৯ম শতাব্দির মোজাদ্দেদ আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) বলেন: وللحافظ السيوطي فيه تأليف لطيف سماه القول الأشبه في حديث 


-“হাফিজ জালালুদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) এই হাদিস সম্পর্কে সূক্ষ বিশ্লেষণ করে ইহার নাম রেখেছেন হাদিসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ‘কওল’।” (ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, ২য় খণ্ড, ২৩৪ পৃ:; ইমাম সুয়ূতি: আল-হাবী লিল ফাতওয়া, ২য় খণ্ড, ২৮৮ পৃ:)।  


আহলে হাদিসদের ইমাম হাফিজ ইবনে তাইমিয়া এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:


مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ بِالْعُبُودِيَّةِ عَرَفَ رَبَّهُ بِالرُّبُوبِيَّةِ وَمَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ بِالْفَقْرِ عَرَفَ رَبَّهُ بِالْغِنَى وَمَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ بِالْعَجْزِ عَرَفَ رَبَّهُ بِالْقُدْرَةِ وَمَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ بِالْجَهْلِ عَرَفَ رَبَّهُ بِالْعِلْمِ 


-“যে ব্যক্তি তার নিজেকে ইবাদতের দ্বারা চিনবে সে রবের রবুবিয়্যাতের মাধ্যমে রবকে চিনবে। যে তার নিজেকে দরিদ্রতার দ্বারা চিনবে সে রবকে ধনী হিসেবে চিনবে। যে তার নিজেকে অসহায়ত্ব দ্বারা চিনবে সে তার রবকে কুদরত দ্বারা চিনবে। যে তার নিজেকে অজ্ঞতা দ্বারা চিনবে সে তার রবকে জ্ঞানী হিসেবে চিনবে।” (হাফিজ ইবনে তাইমিয়া: মাজমাউল ফাতওয়া, ৯ম  খণ্ড, ২৯৭ পৃ:)


হাফিজ ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র হাফিজ ইবনে কাইয়্যুম জাওযিয়া তদীয় কিতাবে বলেন:


مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ عَرَفَ رَبَّهُ وَلَيْسَ هَذَا حَدِيثًا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِنَّمَا هُوَ أَثَرٌ


-“যে নিজকে নিজে চিনল সে রবকে চিনিল’ ইহা রাসূল (ﷺ) থেকে কোন হাদিস নয়, নিশ্চয়  ইহা ‘আছার’।” (মাদারেজুস সালেকীন, ১ম খণ্ড, ৪২৬ পৃ:)


এতজন ইমাম ও মুহাদ্দিস ইহাকে হাদিস বলার পরেও কথিত ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদিসের নামে জালিয়াতি’ বইয়ে ২৭৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন: “মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে বলেছেন যে, এ বাক্যটি রাসূল (ﷺ) এর কথা নয়”। দেখুন মুহাদ্দিসগণের নামে কতবড় মিথ্যাচারিতা! ইহা হাদিস হওয়ার ব্যাপারে ইমাম নববী (رحمة الله), ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله), মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله), ইমাম আজলুনী (رحمة الله) ও ইমাম মহিউদ্দিন ইবনুল আরবী (رحمة الله), ইবনে কাইয়্যুম জাওযিয়্যাহ সহ সকলেই একমত। তাই যা “রেওয়ায়েত লিল মাআনা” হিসেবে সহীহ্ তা নিয়ে কটাক্য করা চরম মূর্খতা বৈ কিছু নয়।

Top