নুবূওয়াতের আসল অর্থ কি?
জেনে রাখ, কালামশাস্ত্রবিদদের নিকট তিনি-ই নবী, যিনি আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে এরূপ নির্দেশ প্রাপ্ত হন যে, “আমি তোমাকে অমুক কাওমের নিকট অথবা সমস্ত লোকের নিকট প্রেরণ করেছি”। অথবা-“তুমি এ বার্তা আমার তরফ থেকে তাদের কাছে পৌছে দাও” । কিম্বা এ ধরনের বাক্য হবে, যা এরূপ অর্থের সমার্থক হবে। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, “আমি তোমাকে তাদের নিকট প্রেরণ করেছি, “অথবা তাদেরকে এ খবর দিয়ে যাও"।
এই ধরনের প্রেরণের মাঝে কোন শর্ত আরোপিত হয়নি এবং প্রেরিত ব্যক্তির শক্তি ও ক্ষমতার ব্যাপারেও কোনরূপ শর্ত আরোপ করা হয়নি-এটাই 'হুকামা' বা জ্ঞানী-গুণীদের অভিমত। বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ যাকে চান, তাঁকে স্বীয় রহমতের সাথে খাস করে নেন। আর আল্লাহ তা'আলা ভাল করেই জানেন যে, তাঁর পক্ষ থেকে রিসালাতের দায়িত্ব তিনি কাকে অর্পণ করবেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা ‘কাদেরে মতলাক’ বা সমস্ত ক্ষমতার উৎস, তিনি যা চান তাই করেন এবং যা ইচ্ছা করেন, তা সম্পন্ন করেন।
আমার অভিমত হলো ; কালাম শাস্ত্রবিদরা নবীর জন্য মু'জিযার অধিকারী হওয়াকে শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন-এরূপ ধারণা করা ঠিক নয়। আর না তারা নবীর জন্য মু'জিযার অধিকারী হওয়াকে তার বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছেন, যাতে অন্যদের থেকে তারা অধিক সম্মানিত হতে পারেন। আর তা এজন্যে যে, তাদের নিকট মু'জিযা নবী হওয়ার জ্ঞানের জন্য শর্ত স্বরূপ, নবী হওয়ার জন্য নয়। আর বিশেষ সম্মান বা মর্যাদার অর্থ-জ্ঞানের মর্যাদা বিশিষ্ট, ব্যক্তির মর্যাদার অর্থ নয়।
পক্ষান্তরে, এ ব্যাপারে দার্শনিকদের অভিমত হলো : তিনি-ই নবী, যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটবে, যার ফলে তিনি অন্যদের থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হবেন। প্রথম বৈশিষ্ট্য হবে-যিনি নবী হবেন তিনি বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের জ্ঞানে জ্ঞানী হবেন। এ ব্যাপারে আমার অভিমত হলো-আমরা এবং তোমরা সবাই এ বিষয়ে একমত যে, নবীদের জন্য এ ওয়াজিব নয় যে, তারা সমস্ত অদৃশ্য জগতের বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হবেন। তবে কিছু বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার ব্যাপারটি কেবল নবীদের জন্য খাস নয়, বরং তা সুফী, সাধক, আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি, এমনকি স্বপ্নযোগে নিদ্রিত ব্যক্তিও জানতে পারে। সুতরাং এ পর্যায়ে কোনরূপ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী তাঁরা হতে পারেন না। আমার মতে, তাদের এরূপ বক্তব্যের অর্থ হলো, নবীগণ অধিকাংশ গায়েবের বিষয় সম্পর্কে অবহিত, তবে তা স্বভাবগত জ্ঞানের কারণে নয়, বরং অস্বাভাবিকভাবে। আর এরূপ কিছু হওয়া অবাস্তব নয়, বরং তা আগে থেকে প্রচলিত আছে এবং সংঘটিত হয়ে আসছে।
এখন বাকী রইল, যদি কেউ দু একবার গায়ের সম্পর্কে অবহিত হয় এবং সে তা প্রকাশও করে দেয়, কিন্তু তা পুনঃ পুনঃ সংঘটিত হয় না, তবে এরূপ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এরূপ কিছু হলে-নবী, গায়ের নবী(গায়ের-নবী' অর্থাৎ যিনি নবী-নন, এরূপ ব্যক্তি) থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হবেন।
জেনে রাখ, মুতাকাল্লেমীন বা কালাম শাস্ত্রবিদগণও একথা স্বীকার করেন যে, আম্বীয়া আলাইহিমুস সালামগণ, আল্লাহ তা'আলা জানানোর ফলে গায়েব সম্পর্কে অবহিত হন। কিন্তু এরূপ শর্ত নির্ধারণ করা সঠিক নয়। এভাবে, ঐ কারণও রদ যোগ্য, যা দার্শনিকগণ গায়েব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য বর্ণনা করেছেন। কেননা, এটি আহলে-ইসলামের বিধি-বিধানের সাথে সুসম্পর্কিত নয়।
একটি বিষয়ের আলোচনা অবশিষ্ট রইলো এবং তা হলো : উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গায়েব সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া, অন্য বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পৃক্ত হবে। কেননা, এটি ঐ সমস্ত ‘আ’জীব' বা আশ্চর্যজনক বিষয়ের মধ্যে শামিল-যা অভ্যাসের বিপরীত। বস্তুত এ সম্পর্কে আলাদা বর্ণনা করার তেমন কোন প্রয়োজন নেই।
২. দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো : নবী থেকে এমন কর্মকাণ্ড প্রকাশ পাবে, যা অস্বাভাবিক। আর তা এজন্য যে, সৃষ্ট-জগতের মূল সত্ত্বা তাঁর অনুসারী এবং তাঁর নির্দেশের অনুগামী; যেমন-শরীর নাফসের অনুসারী। বস্তুত এরূপ হওয়া অবাঞ্ছিত নয় যে, নবীর নাফস এত শক্তিশালী যে, সে নিজের ইচ্ছা ও প্রয়োগ শক্তির দ্বারা সৃষ্ট জগতের বিধানের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এমনকি তাঁর ইচ্ছার কারণে যমীনের বুকে হাওয়া প্রবাহিত হতে পারে, ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে, অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হতে পারে, বন্যা বা সয়লার আসতে পারে, যালিমরা ধ্বংস হতে পারে এবং পাপীদের শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে। আমি বলবো শরীর-স্থিত নাফসের প্রভাবে এরূপ হতে পারে। এ ব্যাপারে আগে আলোচনা করা হয়েছে যে, প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত আর কেউ-ই কিছু করতে সক্ষম নন। বস্তুতঃ অস্বাভাবিক, আশ্চর্যজনক কোন ঘটনা প্রকাশ পাওয়া নবীর সাথে সম্পৃক্ত নয়, যেমন তোমরা তা স্বীকার কর।
এমতাবস্থায়, নবী এবং গায়ের নবীর মধ্যে আমরা কিরূপে পার্থক্য নির্ধারণ করবো?
আমার মতে, দার্শনিকগণ যদিও ‘গায়ের-আম্বীয়া" ( ‘গায়ের-আম্বীয়া অর্থাৎ যারা নবী নন এমন ব্যক্তি) থেকে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পাওয়াকে জায়েয বলেন, কিন্তু তারা বার বার সংঘটিত হতে পারে তা মনে করেন না; যেমন পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে জানা যায়। এ পর্যায়ে নবী ও গায়ের-নবীর মাঝে পার্থক্য সূচিত করা খুবই সহজ। কেননা, তিনি-ই নবী, যার থেকে অস্বাভাবিক ও অলৌকিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ পায়। পক্ষান্তরে, যারা নবী নন, তাদের থেকে এরূপ কিছু সংঘটিত হয়না। আল্লাহ তায়ালা হাকীকতে হাল বা বাস্তব-অবস্থা সম্পর্কে অধিক ওয়াকিফহাল।
৩. তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো : নবী ফিরিশতাদের বিশেষ সুরতে দর্শন করবে এবং তাদের কথাবার্তা শ্রবণ করবে যখন আল্লাহর কালাম বা ওহী নিয়ে তারা আসবে। আমি বলবো : এরূপ উক্তি দার্শনিকদের মাযহাব ও বিশ্বাসের অনুরূপ নয়। কেননা, তারা এরূপ বলে না যে, ফিরিশতাদের খালি চোখে দেখা যায়।
বরং তাদের দৃষ্টিতে ফিরিশতা হলো এমন সৃষ্টি, যা যাতের দিক দিয়ে সূক্ষ্ম এবং সৃষ্টি জগতের পরিচালনার সংগে সম্পর্কিত এবং এদেরকে “মালায়েকা-ই সামাবীয়া” বা “আসমানের ফিরিশতা” বলা হয়ে থাকে। অথবা যাত ও কর্মের দিক দিয়ে তারা জ্ঞান-সম্ভুত এবং এদেরকে “মালা-ই ‘আলা' বা উৰ্দ্ধ-জগতের ফিরিশতা বলা হয়। আর এদের এমন কোন কথা নেই যা শোনা যেতে পারে, কেননা, তা জড় দেহের সাথে সম্পর্কিত। এ কারণে, বর্ণ ও ধ্বনি তাদের কাছে তাই, যা সংমিশ্রিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে।
আমার অভিমত হলো : দার্শনিকগণ সম্ভবত সূক্ষ বস্তু দৃষ্টিগোচর হওয়া এবং তার কথাবার্তা শোনাকে তখন সম্ভব বলে মনে করেছে, যখন তা কোন আকার আকৃতি সম্ভুত হবে না। যেহেতু এটি বৈধ যে, যদি তা আকার-আকৃতির সাথে প্রতিভাত হয় এবং শরীরের সাথে প্রকাশিত হয়, তখন দেখার সম্পর্ক তো তার সাথে হবেই এবং তার কথা শোনাও সম্ভব হবে। কেননা, প্রত্যেক অবস্থার জন্য, জায়েয ও না-জায়েয হওয়ার দিক দিয়ে হুকুম আলাদা। তাই, তারা যখন তাদের উচ্চ কর্তব্য ও মর্যাদা থেকে নেমে আসে এবং অবতরণের পোশাক পরিধান করে, তখন তাঁরা এখানকার বিধি-বিধান এখতিয়ার করে এবং এতে কোনরূপ বাধা বিপত্তি নেই। অতএব গভীরভাবে অনুধাবন কর। আল্লাহ, পবিত্র মহান, এ ব্যাপারে অধিক অবহিত।