হুজুর (ﷺ)কে মানুষ কিংবা ভাই বলে আখ্যায়িত করা সম্পর্কে আলোচনা এ আলোচনাকে একটি ভূমিকা ও দুইটি অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে।
ভূমিকা
নবীর সংজ্ঞা ও তাঁদের মর্যাদার স্তর সম্পর্কিত বর্ণনা
আক্বিদাহঃ নবী হচ্ছেন সে সব পুরুষ মানুষ, যাঁদেরকে আল্লাহ তা’আলা শরীয়তের বিধি নিষেধ প্রচার করার জন্য পাঠিয়েছেন (শরহে আকায়েদ) অতএব, ‘নবী’ মানুষ ভিন্ন অন্য কেউ নন; আর মহিলা নন।
❏কুরআন ইরশাদ করছেঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ
-‘‘হে নবী (ﷺ)! আমি আপনার আগে যাঁদেরকে পাঠিয়েছিলাম, তাঁরা হচ্ছেন মানব জাতির সে সব মহাপুরুষ, যাঁদের প্রতি ওহী প্রেরণ করতাম।’’
{সূরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ১৭}
একথা থেকে জানা যায় যে, জ্বীন, ফিরিশতা, মানবজাতির মহিলা বা অন্য কোন জীব নবী হতে পারে না।
আকীদাহঃ নবী সব সময়ই উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন, উচ্চ বংশোদ্ভুত হয়ে থাকেন এবং অতি উত্তম স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী হন। নিচু বংশোদ্ভুত হওয়া ও অশোভনীয় চাল-চলন থেকে তাঁরা মুক্ত (বাহারে শরীয়ত)।
❏বুখারী শরীফের ১ম খন্ডের শুরুতে আছে যে, রোমের সম্রাট হিরাকলের নিকট হুজুর (ﷺ) এর সুমহান ফরমানঃ اَسْلِمْ تَسْلَمُ [ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন] পৌঁছার পর তিনি আবু সুফিয়ানকে হুজুর (ﷺ) সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করলেন। প্রথম প্রশ্নটি ছিল
كَيْفَ نَسْبُهُ فِيْكُمْ
-‘‘আপনাদের মধ্যে সে নবীর পারিবারিক ও বংশ মর্যাদা কিরূপ?’’ হযরত আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) বললেনঃ
هُوَ فِيْنَا ذُوْ نَسَبٍ
অর্থাৎ- তিনি আমাদের মধ্যে খুবই উচ্চ বংশ জাত ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারের লোক। তিনি হচ্ছেন কুরা্শী, হাশেমী ও সুপ্রসিদ্ধ আবদুল মোতালিবের পরিবারভুক্ত।
এরপর হিরাকল বলেনঃ
وَكَذَالِكَ الرُّسُلُ تَبْعَثُ فِىْ قَوْمِهَا
-‘‘আম্বিয়ায়ে কিরাম সব সময় উচ্চ বংশ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবার থেকেই হয়ে থাকেন।’’
{ক. মুসলিমঃ আস-সহীহঃ ৩/১৩৯৩ হাদিসঃ ১৭৭৩
খ. নাসায়ীঃ সুনানে কোবরাঃ ৬/৩০৯-৩১০ হাদিসঃ ১১০৬৪
গ. তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ ৫/৬৯ঃ হাদিসঃ ২৭১৭}
এর থেকে জানা যায় যে, সম্মানিত নবীগণ উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবারেই আবির্ভূত হন।
বিঃ দ্রঃ- কেউ কেউ বলেন য, প্রত্যেক জাতির মধ্যে নবী আবির্ভূত হয়েছেন। অর্থাৎ খোদা মাফ করুন, শেতর, চামার, হিন্দ, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও তাদের জাতি থেকে নবীদের আবির্ভাব হয়েছে। অতএব লাল গুরু, কৃষ্ণ, গৌথম বুদ্ধ প্রমুখ যেহেতু নবী হতে পারে, সেহেতু তাদের সম্পর্কে খারাপ কোন ধারণা পোষণ করতে নেই। কুরআন ইরশাদ করেছে- لِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ -‘‘প্রত্যেক জাতির মধ্যে পথ প্রদর্শক আছেন।’’ অধিকন্তু, অনেক মহিলাও নবী হয়েছে, কেননা, হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এর মা ও হযরত মারয়ামের (আলাইহিস সালাম) এর নিকট ওহী প্রেরিত হয়েছে এবং যার নিকট ওহী আসে; সেই-ই নবী।
❏কুরআন ইরশাদ করছেঃ
وَاَوْحَيْنَا اِلَى اُمِّ مُوْسَى
-‘‘আমি হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এর মায়ের নিকট প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি।’’
{সূরাঃ কাসাস, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ২০}
উপরোক্ত মত দুইটি ভ্রান্ত-
প্রথমতঃ এজন্য যে, উলেখিত আয়াতটির সম্পূর্ণ অংশের উলেখ করা হয়নি সেখানে আর সে জন্য অনুবাদও সঠিক হয়নি। সম্পূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে এ রকমঃ
إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ
-‘‘হে নবী (ﷺ), আপনি হচ্ছেন ভীতি প্রদর্শনকারী ও প্রত্যেক জাতির পথ প্রদর্শক।’’
{সূরাঃ রা’দ, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ১৩}
প্রত্যেক জাতির পথ প্রদর্শক হওয়াটাই হুযুর (আলাইহিস সালাম) এর একমাত্র বৈশিষ্ট। অন্যান্য নবীগণ পৃথক পৃথক জাতিরই নবী। আর যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া হয় যে, আলোচ্য আয়াতের অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক জাতির মধ্যেই পথ প্রদর্শক আবির্ভূত হয়েছেন, তা হলেও একথা কোথায় আছে যে, প্রত্যেক জাতির মধ্যে সেই জাতির থেকে পথপ্রদর্শক হয়েছেন? এও হতে পারে যে, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতির থেকেই পথ প্রদর্শক হয়েছেন? এও হতে পারে যে, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতির মধ্যে নবীর আবির্ভাব হয়েছিল, আর অন্যান্য জাতি তাঁরই হিদায়তের অধীন ছিল।
হুজুর (ﷺ) হলেন কুরাইশী, কিন্তু পাঠান, শেখ, সৈয়দ মোটকথা সমস্ত জাতির, এমনটি সমস্ত মখলুকের নবী হচ্ছেন তিনি। তাছাড়া উলেখিত هَادِىْ ‘হা্দী’ শব্দটির ব্যাপক অর্থ রয়েছে- নবী ও নবী নয় এমন পথ প্রদর্শক উভয়কেই অন্তভুর্ক্ত করে। সুতরাং, আয়াতাংশটির এ অর্থ হতে পারে যে, প্রত্যেক জাতির মধ্যে কেউ কেউ জাতির অন্তভুর্ক্ত অন্যান্যদের জন্য পথ প্রদর্শকরূপে নিয়োজিত ছিলেন। অধিকন্তু, মহাদেব, কৃষ্ণ প্রমুখের অস্তিত্ব সম্পর্কে শরীয়ত সম্মত কোন প্রমাণ নেই। কুরআন হাদীছে তাদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কেবল মূর্তি পূজারীদের মাধ্যমে তাদের কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। তাও এরূপ যে কারো চার হাত, কারো ছয় পা, কারো মুখে হাতীর মতই শুড় গজানো, কারো পিছনে কালো মুখ ও দীর্ঘ লেজ বিশিষ্ট বানরের মত লম্বা লেজ সংযোজিত। তাদের নাম যেমন মনগড়া, আকৃতি সমূহও মনগড়া।
❏মহান প্রভু আল্লাহ তা’আলা আরবের মূর্তি পূজারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেনঃ
إِنْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاءٌ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ
-‘‘সেগুলো হচ্ছে তোমাদের ও তোমাদের বাপ-দাদাদের মনগড়া কতগুলো নাম মাত্র।’’
{সূরাঃ নাজম, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ২৭}
অতএব, যখন ওদের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিতরূপে কিছু বলা যাচ্ছে না, সেহেতু তাদেরকে নবী হিসেবে জ্ঞান করার কীই বা যৌক্তিকতা থাকতে পারে?
আর ২য় মতটি এজন্য ভ্রান্ত যে, হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) এর শ্রদ্ধেয় মাতার অন্তরে একটি ভাবের অবতারণা করা হয়েছিল বা তাঁর অন্তরে বিশেষ একটি বিষয়ের অভ্যুদয় ঘটানো হয়েছিল, যার বর্ণনা কুরআন এভাবে দিয়েছেঃ اَوْ حَيْنَا ‘ওহী’ শব্দটি ইলহাম’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
❏যেমন কুরআন আছেঃ
وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْل
-‘‘আপনার প্রভু মধু মক্ষিকার অন্তরে এ ধারণার সৃষ্টি করেছেন।’’ এখানে ‘ওহী’ শব্দটি অন্তরে অভ্যুদয় ঘটানো অর্থেই প্রয়োগ করা হয়েছে।
{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৬৮, পারাঃ ১৪}
আর হযরত মরিয়মের প্রতি যে ওহী পাঠানো হয়েছিল, তা’ প্রচারধর্মী ছিল না। তাঁকে প্রচারধর্মী বিধি-নিষেধ সমূহ প্রচারের জন্য পাঠানো হয়নি। তাছাড়া ফিরিশতাদের প্রত্যেকটি কথা ‘ওহী’ নয়, আবার প্রত্যেক ওহীও প্রচারধর্মী নয়। কোন কোন সাহাবীও তাঁদের কথা শুনেছেন; আর মৃত্যুর সময় ও কবর ও হাশরে সবাইতো ফিরিশতাদের সাথে কথা বলবেন। তাই বলে তারা সবাইতো নবী নয়। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্যাবলী জানতে হলে আমার রচিত ‘শানে হাবীবুর রহমান’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করুন।
আক্বীদাহঃ কোন ব্যক্তি নিজের ইবাদত ও ধর্মীয় কার্যাবলী সুচারুরূপে সম্পন্ন করার দ্বারা ‘নবুওয়াত’ লাভ করতে পারে না। নবুওয়াত হচ্ছে একমাত্র খোদার দান।
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
-‘‘কোথায় রিসালাতের ভার অর্পিত হবে, তা আল্লাহ ভালরূপেই জানেন।’’
{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ১২৪, পারাঃ ৮}
আর, নবী নয় এমন ব্যক্তি গাউছ, কুতুব, আবদাল যা’ই হোন না কেন, না নবীর সমতুল্য হতে পারেন, না নবীকে অতিক্রম করে যেতে পারেন। একথা কয়টি খেয়াল রাখা চাই।
প্রথম অধ্যায়
[নবী (আলাইহিস্ সালাতু ওয়াস সালাম) কে মানুষ, ভাই ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করা যে হারাম, সে সম্পর্কিত বিবরণ।]
নবী মানব জাতির মধ্যে আবির্ভূত হয়ে থাকেন, আর তিনি মানবই হন; জ্বিন কিংবা ফিরিশতা নন। এটি হচ্ছে পার্থিব বিধি-বিধান অনুযায়ী। কেননা মনুষ্য সৃষ্টির সূচনা হয় হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে তিনিই হলেন মানুষের পিতা। আর, হুজুর (ﷺ) সে সময়েও নবী ছিলেন, যখন আদি পিতা হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) মাটি ও পানির সাথে একাকার ছিলেন।
❏স্বয়ং হুজুর (ﷺ) ইরশাদ করেছেনঃ كُنْتُ نَبِيَّا وَاَدَمُ بَيْنَ الْمَاءِ وَالطِّيْنِ [আমি তখনও নবী ছিলাম, যখন হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) পানি ও মাটির সাথে একীভূত ছিলেন।] সে সময় অর্থাৎ হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) এর সৃষ্টির পূর্বে হুজুর (ﷺ) নবী ছিলেন ‘মানব’ ছিলেন না। এসব কিছুই সঠিক। তবে, নবীদেরকে ‘বশর’ বা ‘ইনসান’ বলে আহবান করা, কিংবা হুজুর (ﷺ) কে ‘হে মুহাম্মদ’, ‘হে ইব্রাহীমের পিতা’, ‘হে ভাই’, ‘হে দাদা’, ইত্যাদি ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নির্দেশক শব্দাবলী দ্বারা সম্বোধন করা ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ। যদি কেউ অবমাননার উদ্দেশ্যে এভাবে সম্বোধন করে, তা’হলে ‘কাফির’ বলে গণ্য হবে।
❏‘আলমগীরী’ ও অন্যান্য ফিকাহ এর কিতাবসমূহে আছে, যে ব্যক্তি হুজুর (ﷺ) কে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে هَذَا الرَّجُلُ এ লোকটি’ বলে অভিহিত করে, সে ‘কাফির’। তাঁকে বরং ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‘ইয়া শাফীয়াল মুযনেবীন’ ইত্যাদি সম্মানসূচক শব্দাবলী দ্বারা স্মরণ করা জরুরী। কবিগণ তাদের কাব্যে ‘ইয়া মুহাম্মদ’ লিখে থাকেন বটে, তবে তা স্থানের সংকীর্নতার কারণে লিখা হয়। অবশ্য কবিতা পাঠকারী যেন (ﷺ) পড়ে নেন।
❏যেমনঃ এ পংক্তিতে বলা হয়েছে-
واه كيا جود وكرم هے شه بطحاتيرا
(বাহ! হে সুপ্রশস্থ, বিস্তীর্ণ ভূ-খন্ড তথা মক্কার বাদশাহ! ‘তোর’ দান ও বদান্যতা কী অপূর্ব!) এ ‘তোর’ শব্দটি নিবিড় সম্পর্ক ও আবদার নির্দেশক শব্দ। যেমন- বলা হয়ে থাকে- ‘হে মওলা! আমি তোর জন্য উৎসর্গকৃত। ওহে মা! তুই কোথায়? ‘হে আল্লাহ! তুই আমাদের প্রতি দয়া কর’। এ ধরনের ‘তুই’ ও ‘তোর’ প্রভৃতি শব্দাবলীর তাৎপর্য ভিন্ন।
(১) কুরআন করীম ইরশাদ করেছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
-‘‘তোমরা তোমাদের মধ্যে রাসূলকে ডাকার এমন রীতির প্রচলন করিও না, যেমন করে তোমরা একে অপরকে ডেকে থাক। তাঁর সমীপে চেঁচিয়ে কথা বলিও না যেমন করে তোমরা পরস্পরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বল; পাছে তোমাদের ‘আমলসমূহ তোমাদের অজ্ঞাতসারে ব্যর্থতায় পর্যবসিত (বিনষ্ট) না হয়।’’
আমলসমূহ কুফরের কারণে নস্যাৎ হয়ে থাকে।
{ক. সূরাঃ নূর, আয়াতঃ ৬৩, পারাঃ ১৮
খ. সূরা হুজরাত, আয়াতঃ ২, পারাঃ ২৬}
❏‘মাদারেজ’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে وصل از جمله رعايت حقوق او ليست শীর্ষক আলোচনায় উলেখিত আছেঃ
مخوانيد اورابنام مبارك اوچنانكه مى خوانيد بعضے از شما بعض را بلكه بگويد يارسول الله يانبى الله يا توقير وتوضيع
অর্থাৎ- নবী (ﷺ) কে তাঁর পবিত্র নাম ধরে ডাকতে নেই, যেমন তোমরা পরস্পরকে ডেকে থাক। বরং তাঁকে আদব, সম্মান ও বিনয় সহকারে এভাবেই ডাকবে- ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’। ইয়া নবীয়াল্লাহ’।
❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ উক্ত আয়াত এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে এরূপঃ
وَالْمَعْنَى لاَتَجْعَلُوْا نِدَاء كمْ اِيَّاهُ وَتَسْمِيْتَكُمْ لَهُ كَنِدَاء بَعْضِكُمْ بَعْضًا لْاِسْمِهِ مِثْلُ يَامُحَمَّدُ وَيَااِبْنَ عَبْدِ اللهِ ولَكِنْ بِلَقَبِهِ الْمُعَظَّمِ مِثْلُ يَانَبِىَّ اللهِ وَيَارَسُوْلَ اللهِ كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى يَااَيُّهاالنَّبِيُّ وَيَااَيُّهَا الرَسُوْلُ
-‘‘মূল কথা হচ্ছে হুজুর (ﷺ) কে ডাকার ও তাঁর নাম লওয়ার সময় এমনভাবে ডাকবে না, যেভাবে তোমরা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকাডাকি। কর। যেমন- হে মুহাম্মদ! ওহে আবদুল্লাহর পুত্র! ইত্যাদি। তবে, তাঁকে মহিমান্বিত উপাধিসমূহের মাধ্যমে ডাকবে, যেমন- ওহে আল্লাহর নবী! ওহে আল্লাহর রাসূল! যেমন স্বয়ং মহা প্রভু আল্লাহ তাঁকে ‘হে নবী’। হে রাসূল! বলে সম্বোধন করে থাকেন।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৬/২৪০ পৃ.}
এসব কুরআনের আয়াত, তাফসীরকারক ও হাদীছবেত্তাগণের উক্তিসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, যে কোন অবস্থায় হুজুর (ﷺ) এর মান-মর্যাদার প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, চাই ডাকার সময় হোক, বা কথা বলার সময় হোক কিংবা তাঁর সাতে যে কোন আচরণের সময় হোক।
(২) পার্থিব মান-সম্মানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গকেও তাদের নাম ধরে ডাকা যায় না। মাকে ‘আম্মা সাহেবানী’, বাপকে ‘শ্রদ্ধেয় পিতা’ এবং ভাইকে ‘ভাইজান’ ইত্যাদি শব্দাবলীর দ্বারা অভিহিত করা হয়। কেউ যদি নিজের মাকে বাপের বউ, বাপকে মা’র স্বামী বলে অভিহিত করে, কিংবা তাদের নাম ধরে ডাকে, বা ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে আহবান করে, তাকে বেআদব, অভদ্র বলা হবে, যদিও কথাগুলো সত্য। তার সম্পর্কে বলা হবে- সমতাসূচক শব্দাবলী দ্বারা কেন সে মুরুব্বীদের সম্বোধন করলো? আর হুজুর (ﷺ) হচ্ছেন আল্লাহ পাকের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, তাঁর নাম ধরে ডাকা, বা তাঁকে ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করা নিশ্চিতরূপে ‘হারাম’। ঘরের মধ্যে বোন, মা, স্ত্রী ও কন্যা সবই মেয়ে লোক কিন্তু তাদের নাম, কাজকর্ম ও তাদের সাথে আচরণের রীতি-নীতি ভিন্ন। কেউ যদি ‘মা’ কে স্ত্রী বরে বা স্ত্রীকে ডাকে, সে বেঈমান; যে ব্যক্তি তাদের সবাইকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে, সে ‘মরদুদ’। অনুরূপ, যে নবীকে উম্মত ও উম্মতের কাউকে নবীর মত মনে করে, সে ‘মলউন’ (অভিশপ্ত)। দেওবন্দীগণ নবীকে উম্মতের সমপর্যায়ে নিয়ে এসেছে বা তাদের পথে দিশারী/ নেতা মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী, সৈয়দ আহমদ বেরেলবীকে নবীর স্তরে নিয়ে গেছেন। খোদা মাফ করুন।
(‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ গ্রন্থের সমাপ্তি পর্ব দ্রষ্টব্য)
(৩) মহান আল্লাহ যাঁকে কোন বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন, তাঁকে সাধারণের জন্য ব্যবহৃত উপাধি দ্বারা আহবান করা তাঁর উচ্চ পদ মর্যাদাকে অস্বীকার করার নামান্তর। পার্থিব সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যদি ‘নবাব’ বা খাঁন ‘বাহাদুর’ খেতাব পান, তাহলে তাঁকে ‘মানুষ’, ‘মানব সন্তান’ বা ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে ডাকা তথা তাঁর প্রাপ্ত উপাধির মাধ্যমে না ডাকা অপরাধ হিসেবে গণ্য। কারণ এ ধরনের আচরণ দ্বারা সরকার প্রদত্ত উপাধিসমূহের প্রতি তার অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে। তাহলে যে মহান সত্ত্বাকে আল্লাহ তা’আলা ‘নবী-রাসূল’ ইত্যাদি উপাধিকে ভুষিত করেছেন, তাকে ওসব উপাধি বাদ দিয়ে ‘ভাই’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করা মারাত্মক অপরাধ।
(৪) স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা মহা প্রতিপালক হয়েও যেখানে কুরআন করীমের মধ্যে হুজুর (ﷺ) কে ‘হে মুহাম্মদ’ হে ‘মুমিনদের ভাই’ বলে সম্বোধন করেন নি, বরং ‘হে নবী’ ‘হে রাসূল’ ‘হে কম্বলাবৃত বন্ধু’ ‘হে চাদর পরিহিত বন্ধু’ প্রভৃতি প্রিয়-উপাধিসমূহ দ্বারা সম্বোধন করেছেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের মত গোলামদের তাঁকে ‘মানুষ’ বা ‘ভাই’ বলে আখ্যায়িত করার কি অধিকার আছে?
(৫) কুরআন মক্কার কাফিরদের চিরাচরিত প্রথার বর্ণনা দিচ্ছে-
قَالُوْا مَا اَنْتُمْ اِلاَّ بَشَرٌُ مِّثْلَنَا
-‘‘তাঁরা বলত, আপনারা আমাদেরই মত মানুষ বৈ অন্য কিছু নন।’’
{সূরাঃ ইয়াসীন, আয়াতঃ ১৫, পারাঃ ২২
لَئِنْ اَطَعْتُمْ بَشْرً امِثْلَكُمْ اِنَّكُمْ اِذًا لَّخَسِرُوْنَ
-‘‘তোমরা যদি তোমাদের মত একজন মানুষের কথা মত চল, তাহলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য।’’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
{সূরাঃ মু’মিনুন, আয়াতঃ ৩৪, পারাঃ ১৮}
এ ধরনের আরও অনেক আয়াত আছে। এভাবে সমতা বিধান বা আম্বিয়ায়ে কিরামের মান-সম্মান খর্ব করা ইবলীসেরই রীতি।
❏সে বলেছিল-
خَلَقْتَنِىْ مِنْ نَّارٍ وَّ خَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ
-‘‘হে খোদা! তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে, আর তাঁকে (হযরত আদম আলাহিস সালাম কে) সৃষ্টি করেছে মাটি থেকে।’’
{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ১২}
এ কথার তাৎপর্য হলো ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ’। এরূপ আমাদের ও পয়গাম্বরদের মধ্যে কি পার্থক্য’ আমরা যেমন মানুষ তাঁরাও সেরূপ মানুষ’ বরং আমরা জীবিত, তাঁরা মৃত-এসব ইবলীসী কথা ও ধ্যান ধারণা।