হাদিস শাস্ত্রে ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র অবস্থান
হাদিস শাস্ত্রের সর্বোচ্চস্থান হলো ‘হাকেম’। আর হাকেম বলা হয় ঐ মুহাদ্দিসকে যিনি রাসূল (ﷺ) ’র সব হাদিস জানেন। ইমাম আ‘যম (رحمة الله) হাদিসশাস্ত্রে ‘হাকেম’ ছিলেন। মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সামায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-
اِنَّ الِامَامَ ذَكَرَفِي تَصَانِيْفِه بِضْعِ وَسَبْعُوْنَ حَدِيْثٍ وَانْتَخَبَ الاثَارَمِنْ اَرْبَعِيْنَ اَلْفَ حَدِيْثٍ-
“ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) স্বীয় গ্রন্থসমূহে সত্তর হাজারের অধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং চল্লিশ হাজার হাদিস থেকে নির্বাচিত করে তিনি কিতাবুল আসার লিপিবদ্ধ করেছেন।”
➥ মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হিঃ) মানকিব বিযাইলিল জাওয়াহের, খন্ড ২, পৃষ্ঠাঃ ৪৭৪
সদরুল আইম্মা ইমাম মুয়াফ্ফিক (رحمة الله) বলেন,
وَاِنْتَخَبَ اَبُوُحَنِيْفَةَ الَاثَارَ مِنْ اَرْبَعِيْنَ اَلْفَ حَدِيْثٍ
“ইমাম আবু হানিফা চল্লিশ হাজার হাদিস থেকে কিতাবুল আসার নির্বাচিত করেছেন।”
➥ ইমাম মুয়াফিফক মক্কী (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ) মানাকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ৯৫
ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ (رحمة الله)’র বর্ণনা মতে ইমাম আ‘যম আবু হানিফা (رحمة الله) যেসব হাদিস বেলা তকরার (বারংবার ছাড়া) বর্ণনা করেছেন, এর সংখ্যা চার হাজার।
➥ ইমাম মুয়াফিফক মক্কী (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ) মানাকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ৯৬
রাসূল (ﷺ) ’র বেলা তাকরার বিশুদ্ধ হাদিসের সংখ্যা হলো সর্বমোট চার হাজার চার শত। যেমন আল্লামা আমীর ইয়ামানী (رحمة الله) লিখেছেন:
اِنَّ جُمْلَةَ الَاحَادِيْثَ المُسْنَدِ عَنِ النَبِّي يَعْنِي الصَّحِيْحَةَ بِلاَ تَكْرَارِ اَرْبَعَةَ الافِ وَاَرْبَعُ مِائَـةٍ -
“নিশ্চয় সমস্ত বিশুদ্ধ হাদিস যা তাকরার ব্যতীত নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এর সংখ্যা হলো চার হাজার চারশত।”
➥ আল্লামা আমীর ইয়ামানী (رحمة الله) তাওযীহুল আফকার, পৃষ্ঠাঃ ৬৩, সূত্র: গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ ৮১
এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে রাসূল (ﷺ) ’র মোট হাদিসের সংখ্যা চার হাজার চারশত আর ইমাম আবু হানিফার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা মাত্র চার হাজার। তাহলে তিনি কিভাবে ‘হাকেম’ হবেন? এর উত্তরে বলা হবে যে, চার হাজার হাদিস বর্ণনা করা মানে এই নয় যে, তিনি বাকী চারশত হাদিস জানেন না। কেননা, হাসান ইবনে যিয়াদের বর্ণনায় বাকী চারশত হাদিসের জ্ঞানকে নফী বা অস্বীকৃতি করা হয়নি। ইমাম আ‘যম কেবল আহকাম বিষয়ক হাদিসগুলো তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন, যা সুনান হিসেবে প্রসিদ্ধ। হতে পারে বাকী চারশত হাদিস সুন্নাহ বা আহকাম সম্পর্কীয় ছিলনা বিধায় তিনি তা বর্ণনা করেননি। সুতরাং তিনি বর্ণনা করেননি বলে তা জানেন না একথা বলা যাবে না। যেমন ইমাম বুখারী (رحمة الله) ছয় লক্ষ হাদিস থেকে বুখারী শরীফে তাকরার ব্যতীত ইমাম আসকালানীর মতে মাত্র ২৬২৩টি মারফু হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি বাকী হাদিসগুলো জানেন না। ইবনে সালাহর মতে তাকরার হাদিস বাদ দিলে বুখারী শরীফে হাদিস হয় চার হাজার।
তবে কেউ যদি বলে যে, ইমাম আ‘যম সত্তর হাজার হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে নির্বাচিত করে “কিতাবুল আসার” প্রণয়ন করেছেন এটি তেমন কোন উল্লেখযোগ্য যোগ্যতা নয়। কেননা যেখানে ইমাম বুখারী (رحمة الله)’র একলক্ষ বিশুদ্ধ হাদিস, দুই লক্ষ অবিশুদ্ধ হাদিস মুখস্থ ছিল এবং তিনি ছয় লক্ষ হাদিস থেকে নির্বাচিত করে সহীহ বুখারী শরীফ প্রণয়ন করেন, সেখানে ইমাম বুখারীর মোকাবিলায় ইমাম আ‘যমের স্থান বহুগুণ নিচে মনে হয়। এর জবাবে বলা হবে যে, হাদিসের কম-বেশী মূলত তুরুক ও সনদের কম-বেশীর দ্বারা হয়ে থাকে। একই হাদিসের মতনকে যদি একশত ধরনের পদ্ধতি ও সনদে বর্ণনা করা হয় তখন মুহাদ্দীসগণের পরিভাষা অনুযায়ী একশত হাদীসই গণ্য করা হয়ে থাকে। অথচ ঐসব হাদিসের মতন বা মূল ইবারত একটি।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র একশত চৌদ্দ বছর পরে জন্ম লাভ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে অসংখ্য রাবীগণ এক একটি হাদিসকে শত সহস্র রাবীগণের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। ফলে ইমাম আ‘যম ও ইমাম বুখারীর মধ্যে হাদিসের সংখ্যার এত তফাত হয়ে গিয়েছে। এগুলোতে মূলত সনদের সংখ্যার তারতম্য হয়েছে মুল হাদিসের নয়। নতুবা মূল হাদিসের দিক দিয়ে, ইমাম বুখারী থেকে ইমাম আ‘যমের বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা অনেক বেশী।
➥ আল্লাম গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ ৮১
ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র ‘কিতাবুল আসার’ ইলমে হাদিসে তাঁর উচ্চ মর্যাদার ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রমাণ। এই কিতাবটি ‘ফিকহী আবওয়াব’ তথা ফিকহের অধ্যায়ে সুসজ্জিত করে লিখিত প্রথম কিতাব। ইমাম সুয়ূতী (رحمة الله) ‘তাবঈদুস সহীফা’ গ্রন্থে বলেন-ইলমে হাদীসে ইমাম আবু হানিফার অবদান ও মর্যাদা কম নয়। তিনিই সর্বপ্রথম ফিকহী বাব অনুযায়ী হাদিসের কিতাব প্রণয়ন করেছেন। এই মর্যাদায় অন্য কেউ পৌঁছতে পারেননি। এই কিতাবটিকে ইমাম মালিক (رحمة الله)’র মুয়াত্তার উৎস বলে ধরে নেওয়া যায়। কেননা হাফেয যাহাবী (رحمة الله) মানাকিব গ্রন্থে কাযী আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবিল আওয়াম (رحمة الله)’র “আখবারে আবি হানিফা” গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে মুত্তাসিল সনদের সাথে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল আজিজ দিরাওয়ার্দী (رحمة الله)’র উক্তি বর্ণনা করেন, তা হলো,
-كان مالك ينظرفي كتب ابي حنيفة وينتفع بها
“ইমাম মালিক (رحمة الله) ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র কিতাব সমূহ দেখতেন এবং এগুলো থেকে উপকৃত হয়েছিলেন।” এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র ‘কিতাবুল আসার’ এর স্থান মুয়াত্তা ইমাম মালিকের উপরে।
আল্লামা মুয়াফিফক হাফেয আবু ইয়াহিয় যাকারিয়া ইবনে ইয়াহিয়া নিশাপুরী (رحمة الله)’র ‘মানকিবে আবি হানিফা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-
سَمِعْتُ اَبَا حَنِيْفَةَ يَقُوْلُ عِنْدِيْ صَنَادِيْقَ مِنَ الحَدِيْثِ مَا اَخْرَجْتُ مِنْهَا اِلَّا لشَّيُ اليَسِيْر الذَّيْ يَنْتَفِع بِه –
“আমি আবু হানিফাকে বলতে শুনেছি, আমার নিকট হাদিসের অনেক সিন্দুক রয়েছে, ওখান থেকে কেবল সহজ ও উপকৃত হওয়া যায় এমন হাদিস বের (বর্ণনা) করি।”
আল্লামা যুবাইদী (رحمة الله) ‘عقود الجواهرالمنيفه’ গ্রন্থে হাফেয আবু নঈম ইস্পাহানী (رحمة الله)’র সূত্রে ইয়াহিয়া ইবনে আবু নসর (رحمة الله)’র উদ্ধৃতি বর্ণনা করে বলেন- তিনি বলেন, আমি একদা আবু হানিফার নিকট গেলাম। তাঁর কামরা কিতাবে পূর্ণ ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কিসের কিতাব? উত্তরে তিনি বলেন-এগুলো সব হাদিসের কিতাব।
➥ মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হিঃ), শরহে মুসনাদে ইমাম আ‘যম, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ৯
ইমাম সাখাবী (رحمة الله) (৯০২হি.) বলেন,
-وَالثُنَيَاتُ فِي المُوَطَّا لِلامَامِ مَالِكِ وَالوَحْدَان فِي حَدِيْثِ الِامَامِ اَبِي حَنِيْفَةَ
“ইমাম মালিক (رحمة الله)’র মুয়াত্তার হাদিস সমূহে সুনায়াত তথা দু’জনের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) মাত্র একজনের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।”
➥ ফতহুল মুগীছ, পৃষ্ঠাঃ ২৪১, সূত্র: গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন পৃষ্ঠাঃ ২৭৪
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বুখারী শরীফে বর্ণিত ২২টি ‘সুলাসিয়াত’ তথা তিনজনের মাধ্যমে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে ১১টি হাদিস ইমাম আ‘যমের ছাত্র মক্কী ইবনে ইব্রাহীম থেকেই বর্ণনা করেছেন। আর এই মক্কী ইবনে ইব্রাহীম সম্পর্কে আল্লামা মুয়াফিফক (رحمة الله) বলেন-
وَلَزِمَ اَبَا حَنِيْفَةَ رَحِمَةُ اللهُ وَسَعَ مِنْهُ الحَدِيْثَ“
তিনি নিজের উপর হাদিস শ্রবণের জন্য ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)কে আবশ্যক করে নিয়েছিলেন।”
➥ ইমাম মুয়াফিফক (৫৬৮হিঃ), মানকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২০৩
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম বুখারী উত্তম সনদের সাথে ‘সুলাসিয়াত’ হাদিস অর্জনের যে মর্যাদা লাভ করেছেন তা ইমাম আ‘যমের ছাত্রের বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। শুধু তা নয় বরং যে সকল (নির্ভরযোগ্য) শায়খগণের মাধ্যমে সিহাহ সিত্তাহর ভিত্তি হয়েছে তাদের অধিকাংশ হযরত আবু হানিফা (رحمة الله)’র ইলমে হাদিসে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ এ শিষ্য।
➥ গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন, উর্দু,পৃষ্ঠাঃ ৮৪
ইমাম আব্দুল ওহাব শা’রানী (رحمة الله) মাসানীদে ইমাম আ‘যমের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলেন-
وَقَدْ مَنَّ اللهُ عَليَ بِمُطَا لِعَةِ مَسَانِيْدِ اللاِمَام اَبِي حَنِيْفَةَ الثَلَاثَةَ فرأيته لا يروي حديثا الا عن اخبار التابعين العدول الثقات الذين هم من خير القرون بشها دة رسول الله صلي الله عليه وسلم كا لا سودو علقمة وعطاء وعكرمه ومجاهد ومكهول والحسن البصري واضرابهم رضي الله عنهم اجمعين فكل الرواة الذين هم بينه وبين رسول الله صلي الله عليه وسلم عدول ثقات اعلام اخيار ليس فيهم كذاب ولا متهم بكذب
“আল্লাহ তায়ালা আমার উপর দয়া করেছেন যে, আমি ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র তিনটি মাসানিদ অধ্যয়ন করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি দেখেছি যে, তিনি সিকা ও সাদিক তাবেঈগণ ব্যতীত অন্য কারো থেকে রেওয়ায়েত করেননি, যাদের ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) “খায়রুল কুরুন” তথা উত্তম যুগের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন, আসওয়াদ, আলকামা, আতা, ইকরামা, মুজাহিদ, মাকহুল ও হাসান বসরী এবং এদের ন্যায় আরো অনেক থেকে রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম আ‘যম ও রাসূল (ﷺ) ’র মধ্যখানে সকল বর্ণনাকারী আদেল, সিকাহ এবং প্রসিদ্ধ সৎলোক ছিলেন, যাদের মধ্যে কেউ মিথ্যুক এ কথা কল্পনাও করা যাবে না।”
➥ ইমাম আব্দুল ওহাব শা’রানী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ) মীযানুশ শরীয়তুল কুবরা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ৬৮