❏ প্রশ্ন- ২১২:
(ا) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ الخ (২) وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا الخ(৩) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا الخ
উক্ত আয়াতগুলোর তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ১. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা বাকারার তৃতীয় রুকুতে ইরশাদ করেন,
جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ .
‘যে পবিত্রসত্তা! তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করেছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য ও ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের রিযিক হিসেবে। অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ তোমরা এসব জান।’
276. সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২
উক্ত আয়াতে আর্দ অর্থ পৃথিবী, ভূ-পৃষ্ঠ। যমিনের ভূ-পৃষ্ঠ যা দেখতে গোলাকার। কোরআন কারীম(ﷺ)র উক্ত আয়াতে আর্দ (ارض) শব্দ উল্লেখ এসেছে।
‘তাফসীরে মাদারিক’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, উক্ত আয়াতে পৃথিবী কি সমতল না গোলাকার সে বিষয়ে কোন দলিল পেশ করা হয়নি। কারণ বিছানা উভয় অবস্থায় হওয়া সম্ভব। অতএব, যে সকল লোক প্রশ্ন করেন যে, কোরআন মজিদে পৃথিবীকে বিছানা অর্থাৎ সোজাসুজি বিছানো হয়েছে এমন বস্তু বলা হয়েছে, যা জ্যোর্তি বিজ্ঞানীদের গবেষণার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ অকাট্য দলিল দ্বারা পৃথিবী গোলাকার প্রমাণিত। এটা তাদের অজ্ঞতা ও মুর্খতারই বহিঃপ্রকাশ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা শুধু একথাই বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীকে তোমাদের চলা-ফেরা, উঠা-বসা ও ঘুমানোর উপযুক্ত করে তৈরী করেছেন, তা গোলাকার হোক কিংবা সমতল এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অতএব উক্ত প্রশ্ন এবং আয়াতের মর্মের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।
২. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা রা‘দ-এ ইরশাদ করেন-
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا .
‘তিনিই পৃথিবীকে প্রশস্ত করেছেন এবং এতে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন।’
277. সূরা রা‘দ, আয়াত: ৩
مدّ শব্দের অর্থ বিস্তৃত ও প্রশস্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য- ভূ-মন্ডলকে বিস্তৃত করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী, জীব-জন্তু ও সকল সৃষ্টি জগত অবস্থান করতে পারে। এ আয়াতটিও পৃথিবী গোলাকার হওয়ার বিরোধী নয়।
৩. আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আন্-নাবাতে ইরশাদ করেন,
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا
‘হে লোকসকল! আমি কি যমিনকে তোমাদের জন্য বিছানা হিসাবে সৃষ্টি করিনি।’
278. সূরা আন্-নাবা, আয়াত: ৬
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যেভাবে সাত আসমান আছে, তেমনি সাত যমীনও রয়েছে। প্রত্যেক যমিন পরস্পরের মাঝে পাঁচ শত বছরের পথের দূরত্ব বিদ্যমান। এটির মর্ম এমনও হতে পারে যে, এক সৌরমন্ডল সূর্যের এক নিয়ম যা আমাদের সামনে দৃশ্যমান, যার কিরণ বিতরণ করে লক্ষ লক্ষ মাইল আলোকিত করছে। তাছাড়া এ রকম আরো ছয়টি গ্রহ সৌরমন্ডল রয়েছে। যেমন এই সৌরমন্ডলের একটি হচ্ছে এ ভু-মন্ডল, যেখানে আমরা বাস করছি। অনুরূপ অবশিষ্ট ছয় গ্রহের মধ্যে ছয়টিই ভূমন্ডলে।
ইসলামী সাহিত্যে সমুদ্রের ক্ষেত্রে ‘বাহরে মুহীত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বাহার অর্থ-সমুদ্র। আর মুহীত অর্থ-পরিবেষ্টনকারী। এটা এজন্য যে, সমুদ্র সকল মহাদেশ ও দ্বীপসমূহকে যেখানে মানুষ বসবাস করে চতুর্দিক দিয়ে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। অথবা এজন্য যে, সমুদ্র ভূ-পৃষ্ঠকে ঘিরে রেখেছে। ইসলামী শিক্ষায় বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর দূরত্ব শত বছরের পথ। এখানে পাঁচশত বছরের রাস্তা বলে নির্দিষ্ট সংখ্যা উদ্দেশ্য নয়। বরং পরিভাষা অনুযায়ী অধিক দূরত্ব ও দীর্ঘ সময় উদ্দেশ্য। শরয়ী বিধান মতে, পদব্রজে চলার হিসাব মতে দূরত্ব নির্ণয় করা হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পদব্রজে চলার গতিতে গোটা পৃথিবী অতিক্রম করা অনেক সময়ের প্রয়োজন অথবা এখানে দূরত্ব দ্বারা মর্যাদা উদ্দেশ্য।
সে নিরিখে পদব্রজে যদি গোটা পৃথিবী পরিমাপ করার জন্য একজন মানুষ নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তার জন্য পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর ও জল-স্থল এক কথায় সমগ্র পৃথিবীকে পাঁচশত বছরেও পরিমাপ করা সম্ভব হবে না। পবিত্র কা’বা শরীফ পৃথিবীর মধ্যভাগে অবস্থিত। কতিপয় ওলামা বলেছেন যে, বাইতুল মুকাদ্দাসের অবস্থান পৃথিবীর মধ্যভাগে। এ বর্ণনাটি যুক্তির কাছাকাছি। কারণ বর্ণিত উভয় স্থান শুষ্ক প্রান্তরের এমন অংশে অবস্থিত- যা পৃথিবীর সকল মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত। ইসলামী শিক্ষায় একথাও বলা হয়েছে যে, শয়তানের আসন সাগরে অবস্থিত। চিন্তা-ভাবনা করলে একথা সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য এবং ঘটনার অনুরূপ বলে মনে হয়।
শয়তানের কাজ হচ্ছে মানুষের মধ্যে পরস্পর শত্রুতামী করানো, মানব সন্তানের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া, যাদু-টোনা ও ঝাড়ফুঁক করা, মিথ্যা-কপটতা এবং পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি বিস্তার লাভ করা। কারণ শয়তানের কর্মকান্ড ও যাতায়াত স্থলভাগেও রয়েছে। তাই সে এ জাতীয় ফিৎনা-ফ্যাসাদ স্থলভাগেও সর্বদা সৃষ্টি করে আসছে।
কিন্তু যখন থেকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্য পানির জাহাজ নির্মাণে উন্নতি সাধন করে সমুদ্রে অধিকহারে যাতায়াত শুরু করে। সেহেতু সাগর হচ্ছে শয়তানের রাজধানী। তাই সমুদ্রে এ ধরনের ফিৎনা-ফ্যাসাদ, হত্যা, লুটপাট ও অরাজকতা স্থলের চেয়ে অধিক ভয়াল ময়দানে পরিণত হয়েছে। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, বর্তমানে পাশ্চাত্যে শয়তানি শিক্ষার যে চর্চা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে তা হচ্ছে না। ইউরোপীয়ানরা স্বভাব-চরিত্র, আধ্যাত্মিক, মাযহাবি, চারিত্রিক ও মানবিক দিক দিয়ে মানব সভ্যতা থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে। তাদের ধ্যান-ধারণা কার্যক্রম উৎসাহ-উদ্দীপনা এক কথায় প্রতিটা বিষয়ে তাদের ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সর্বস্থরে শয়তানি কানুন ও শাসনের প্রচলন প্রাধান্য লাভ করেছে। তাই তাদের রাষ্ট্র ও ধন-দৌলতের প্রতিযোগিতায় ভিন্ন জাতিকে ধ্বংস ও নিশ্চিন্ন করে তাদেরকে অস্থিত্বহীন করে দেয়া, তাদের জন্য বড় অহংকার ও গৌরবের বিষয়। ভিন্ন জাতি ধ্বংস করা এবং তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আকাঙ্খা উক্ত জাতির প্রকৃতিগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের সে আকাঙ্খা স্থলভাগেও পূর্ণ করছে, কিন্তু স্থলভাগের তুলনায় সমুদ্রে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের উপকরণ আরো বেশি শক্তিশালী। সে ভয়াল সমুদ্রের নাম শুনলেই মানবজাতি ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। বর্তমানে নিরবে নিস্তব্দে তাদের অনেক উত্তরাধিকারী সহকর্মী তৈরী করা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের অত্যাধুনিক জাহাজ এবং ক্রুজ মিশাইল ও ব্যবসায়িক যুদ্ধ জাহাজ বিভিন্ন দিক প্রদক্ষিণ করছে এবং চক্কর দিচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে অত্যাধুনিক ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র রকেট লাঞ্চার ইত্যাদি অগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করে স্থলবাসীদের ঘর-বাড়ি গুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেনা ঘাঁটির ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে তা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করছে। নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হচ্ছে। এ পৈশাচিকতা, যুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচার-নিপীড়ন সামুদ্রিক যুদ্ধে অধিকহারে সংঘটিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত স্থলযুদ্ধ অনেকবার হয়েছে কিন্তু অবর্ণনীয় এ দুর্দশার দৃশ্য একমাত্র সামুদ্রিক যুদ্ধেই ঘটেছে। এমন তো হবেও না কেন? সমুদ্র তো তাদের পীর-মুর্শিদের সিংহাসন স্থল।
উৎসর্গ হোক আমার প্রাণ উভয় জাহানের নবী (ﷺ) -এর অমীয় বাণীর ওপর, যিনি চৌদ্দশত বছর পূর্বে সহজ-সরল ও সাদাসিদে শব্দের মাধ্যমে এ সূক্ষ্ম রহস্যের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।
اللهم صلِّ عليه فصلِّ عليه ثم صلِّ عليه .
পৃথিবীর কোন প্রান্তে আবে-হায়াত বা জীবন সঞ্জীবনী পানির ঝর্ণাধারা বিদ্যমান থাকার কথা প্রসিদ্ধ আছে। যার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, উক্ত ঝর্ণা থেকে যে কেউ পানি পান করবে সে কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে। আরো একটি ‘কোহ-কাফ’-এর নামও অভিধানের কিতাবে লিখা আছে, যা সম্পূর্ণরূপে যমরুদ বা মূল্যবান সবুজ পাথরের বলা হয়ে থাকে এবং যা পৃথিবীর চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে। এ জাতীয় আরো অনেক কাহিনী মুসলমানদের মাঝে সাধারণত প্রসিদ্ধ আছে কিন্তু এগুলোর কোন শরয়ী অকাট্য দলীল পাওয়া যায়নি।
279. ইসলামী মা’লুমাত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ৬০-৬১