৬. স্ত্রীকে প্রহার না করা
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাই প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার উপর প্রতিষ্ঠিত। রূপ-সৌন্দর্য্য ক্ষণস্থায়ী। বয়সকালে রূপ সৌন্দর্য্য হ্রাস পেলেও ভালোবাসা আরও মজবুত হয়। স্বামী নিজেকে সদা স্ত্রীর প্রভু মনে করা এবং তুচ্ছ বিষয়ে স্ত্রীকে মারধর করা, কথায় কথায় স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা ভালোবসার অন্তরায়। হাদিস শরীফে আছে-
عَنْ مُعَاوِيَةَ بن حيدة قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا حَقُّ زَوْجَةِ أَحَدِنَا عَلَيْهِ؟، قَالَ: أَنْ تُطْعِمَهَا إِذَا طَعِمْتَ، وَتَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَيْتَ، أَوِ اكْتَسَبْتَ، وَلَا تَضْرِبِ الْوَجْهَ، وَلَا تُقَبِّحْ، وَلَا تَهْجُرْ إِلَّا فِي الْبَيْتِ
হযরত মুয়াবিয়া ইবনে হায়দাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের কোন ব্যক্তির উপর তার স্ত্রীর কী অধিকার রয়েছে? তিনি বললেন, তুমি যখন আহার কর তাকেও আহার করাও, তুমি যখন পরিধান কর, তাকেও পরিধান করাও এবং ঘরের মধ্যে ছাড়া তার কাছ থেকে পৃথক হইওনা। হাদিসখানা হাসান। ১৫৯
১৫৯.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.), আবু দাউদ, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৬
অনুরূপ হাদীস হাকীম ইবনে মুয়াবিয়া কুশাইরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে। ১৬০
১৬০.আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
عَنْ إِيَاسِ بْنِ عَبْدُ اللَّهِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: ্রلَا تَضْرِبُوا إِمَاءِ اللَّهِ فَجَاءَ عُمَرُ إِلَى رَسُولِ الله فَقَالَ: ذَئِرْنَ النِّسَاءُ عَلَى أَزْوَاجِهِنَّ فَرَخَّصَ فِي ضَرْبِهِنَّ فَأَطَافَ بَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نِسَاءٌ كَثِيرٌ يَشْكُونَ أَزْوَاجَهُنَّ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَقَدْ طَافَ بِآلِ مُحَمَّدٍ نِسَاءٌ كَثِيرٌ يَشْكُونَ أَزْوَاجَهُنَّ لَيْسَ أُولَئِكَ بِخِيَارِكُمْহযরত ইয়াস ইবনে আব্দুল্লাহ আবি যুবাব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর বন্দীনীদের প্রহার করো না। অতঃপর হযরত ওমর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ কাছে এসে বললেন, (বর্তমান) স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের উপর চড়াও হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ স্বামীদের অনুমতি দিয়েছেন স্ত্রীদের প্রহার করতে। ফলে অনেক মহিলা রাসূলুল্লাহ ’র পরিবারের নিকট এসে তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে (প্রহার করার) অভিযোগ করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমাদের অনেক মহিলা এসে মুহাম্মদের পরিবারের কাছে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এরা (যারা স্ত্রীকে প্রহার করে) তোমাদের মধ্যে মোটেও উত্তম লোক নয়। ১৬১
১৬১.ইমাম তিরমীযী র. (২৭৯ হি.) তিরমিযী, হাদীসখানা হাসান, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৭, মিশকাত; পৃ. ২৮২
عَنْ لَقِيطِ بْنِ صَبْرَةَ" قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ لِي امْرَأَةً وَإِنَّ فِي لِسَانِهَا شَيْئًا - يَعْنِي الْبَذَاءَ - قَالَ: فَطَلِّقْهَا إِذًا قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لَهَا صُحْبَةً، وَلِي مِنْهَا وَلَدٌ، قَالَ: " فَمُرْهَا يَقُولُ: عِظْهَا فَإِنْ يَكُ فِيهَا خَيْرٌ فَسَتَفْعَلْ، وَلَا تَضْرِبْ ظَعِينَتَكَ كَضَرْبِكَ أُمَيَّتَكَ
"ইবনে সাবুরা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল। আমার এক স্ত্রী আছে, যার মুখ চলে। অর্থাৎ ঝগড়াটে। তিনি বললেন, তুমি তাকে তালাক দিয়ে দাও। আমি বললাম তার ঘরে আমার সন্তান রয়েছে এবং সে আমার দীর্ঘদিনের সহবাসের সঙ্গিনী। তিনি বললেন, তাহলে তুমি তাকে উপদেশ দাও। যদি তার মধ্যে কোন কল্যাণ থাকে তবে সে তা সহজে গ্রহণ করবে। কিন্তু তুমি তোমার বিছানার সাথীকে বাঁদীর ন্যায় প্রহার করোনা।১৬২
১৬২.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮১
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زَمْعَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لاَ يَجْلِدُ أَحَدُكُمُ امْرَأَتَهُ جَلْدَ العَبْدِ، ثُمَّ يُجَامِعُهَا فِي آخِرِ اليَوْمِ وفى رواية ্রيَعْمِدُ أَحَدُكُمْ، فَيَجْلِدُ امْرَأَتَهُ جَلْدَ العَبْدِ، فَلَعَلَّهُ يُضَاجِعُهَا مِنْ آخِرِ يَوْمِهِ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যামআ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যেন নিজের স্ত্রীকে দাসের ন্যায় প্রহার না করে, অতঃপর দিন শেষেই তার সাথে সহবাস করে। অপর বর্ণনায় আছে তোমাদের কেউ যখন তার স্ত্রীকে মারতে উদ্যত হয় তখন সে গোলামের ন্যায় মারে, অথচ ঐদিন শেষেই তার সাথে শোয়। ১৬৩
১৬৩.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৮০ ও রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৫
উপরিউক্ত হাদীসসমূহে নিজ স্ত্রীকে দাস দাসীর ন্যায় তুচ্ছ বিষয়ে প্রচণ্ডভাবে প্রহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুনিব দাস-দাসীর পুরো শরীরের মালিক। সুতরাং কোন মুনিব যদি অধীনস্থ কোন দাস-দাসীকে খুনও করে তবুও তার উপর কিসাস আবশ্যক হবে না। কিন্তু পুরুষ মাহর আদায় করে কোন মহিলাকে বিয়ে করলে সে কেবল স্ত্রীর নির্দিষ্ট একটি অঙ্গের মালিক হয়, স্ত্রীর পুরো শরীরের মালিক হয় না। ফলে তাকে নির্যাতন ও প্রহার করার অধিকার স্বামীর নেই।
তবে স্ত্রী যদি পাপাচারিণী হয় কিংবা স্বামীর চরম অবাধ্য হয় তবে তাকে মৃদু প্রহার করা বৈধ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًاআর যে স্ত্রী সম্পর্কে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং (মৃদুভাবে) প্রহার কর। যদি তাতে তারা তোমার অনুগত হয়ে যায়, তবে তাদের ব্যাপারে অন্য কোন পথ অনুসরণ করো না। ১৬৪
১৬৪.সূরা নিসা, আয়াত: ৩৪
অর্থাৎ, স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর অবাধ্য ও নাফরমানী পাওয়া যায় কিংবা আশংকা করে তখন তাদের সংশোধনের প্রথম ধাপ হলো নম্রভাবে তাদের বোঝাবে, উপদেশ দিবে। যদি তাতেও বিরত কিংবা সংশোধন না হয়, তবে দ্বিতীয় ধাপ হলো নিজের বিছানা থেকে স্ত্রীকে পৃথক করে দিবে। যাতে স্বামীর অসন্তুষ্টি বুঝতে পারে এবং কৃতকর্মে জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্বামীর অনুগত হতে পারে। কারণ আদর্শ স্ত্রীর জন্য স্বামীর বিছানা থেকে বঞ্চিত হওয়া বড় ধরনের একটা শাস্তি। কুরআনে করীমেفي المضاجع শব্দ উল্লেখ দ্বারা বুঝা যায়, কেবল ঘরের মধ্যে বিছানা পৃথক করবে, ঘর থেকে বের করে দেবে না। এতে যদি স্ত্রী সংশোধন হয়ে যায় তাহলে ভালো। নতুবা তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে বলা হয়েছে তোমরা স্ত্রীকে মৃদু প্রহার কর। এটা সর্বশেষ পন্থা যেটাকে আমরা প্রথম ধাপে উন্নীত করে দিয়েছি। এরপর যদি স্ত্রী স্বামীর অনুগত হয়ে যায় তবে তাদের ব্যাপারে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করো না।
এ প্রসঙ্গে হযরত আমর ইবনে আহওয়াস আল জুমাশি (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন
-أَلَا وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّمَا هُنَّ عَوَانٌ عِنْدَكُمْ، لَيْسَ تَمْلِكُونَ مِنْهُنَّ شَيْئًا غَيْرَ ذَلِكَ، إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ، فَإِنْ فَعَلْنَ فَاهْجُرُوهُنَّ فِي المَضَاجِعِ، وَاضْرِبُوهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ، فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا، أَلَا إِنَّ لَكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ حَقًّا، وَلِنِسَائِكُمْ عَلَيْكُمْ حَقًّا، فَأَمَّا حَقُّكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ فَلَا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ مَنْ تَكْرَهُونَ، وَلَا يَأْذَنَّ فِي بُيُوتِكُمْ لِمَنْ تَكْرَهُونَ، أَلَا وَحَقُّهُنَّ عَلَيْكُمْ أَنْ تُحْسِنُوا إِلَيْهِنَّ فِي كِسْوَتِهِنَّ وَطَعَامِهِنَّ
সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর। কেননা তারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তোমরা তাদের নির্দিষ্ট স্থান থেকে উপকৃত হওয়া ব্যতীত অন্য কিছুর মালিক নও। কিন্তু যদি তারা প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়। যদি তারা এরূপ করে তবে তোমাদের বিছানা থেকে তাদেরকে পৃথক করে দাও এবং তাদেরকে প্রহার করো কিন্তু কঠোরভাবে নয়। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তবে তাদের জন্য বিকল্প পথ অনুসন্ধান করো না। সাবধান! তোমাদের স্ত্রীদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে তেমনই তোমাদের উপর তাদের অধিকার রয়েছে। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হলো- তারা তোমাদের অপছন্দনীয় ব্যক্তিদের দ্বারা তোমাদের বিছানা কলুষিত করবে না এবং তাদেরকে তোমাদের ঘরে প্রবেশ করতে অনুমতি দিবে না। তোমাদের উপর তাদের অধিকার হলো- তোমরা তাদের জন্য উত্তম ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে। ১৬৫
১৬৫.ইমাম তিরমীযী র. (২৭৯ হি.) সুনানে তিরমিযী, হাদীসখানা হাসান, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৪৬
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا يُسْأَلُ الرَّجُلُ فِيمَا ضَرَبَ امْرَأَتَهُ عليه –
হযরত ওমর (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, স্ত্রীকে প্রহার করার ব্যাপারে কোনো স্বামীকে (কিয়ামত দিবসে) জিজ্ঞাসা করা হবে না। ১৬৬
১৬৬.আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৮২
অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের বর্ণনা মতে যৌক্তিক কারণে স্বামী স্ত্রীকে মৃদু প্রহার করলে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর কাছে জবাবদীহি করতে হবে না। বরং ক্ষমাযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই বলে অযৌক্তিক কারণে প্রচন্ডভাবে স্ত্রীকে প্রহার ও আঘাত করলে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত আদালতে গিয়ে বিচারিক ব্যবস্থা নিতে পারবে। এটা নারীর আইনগত অধিকার।