সহীহ্ হাদীসসমূহে ইয়াযীদ সম্পর্কে সতর্কবাণীঃ


ইমাম বোখারী, হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه]’র বরাতে বর্ণনা করেছেন, হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করেন, ‘‘আমার উম্মতের ধ্বংস (অপূরণীয় বিপর্যয়) ক্বোরাঈশের ছেলেদের হাতে হবে।’’ হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه] বলেন, ‘‘তোমরা চাইলে আমি তার এবং তার পিতার নামও বলে দিতে পারি। সে হলো অমুখের পুত্র অমুক।’’ ইমাম আমর ইবনে ইয়াহিয়া বলেন, ‘‘আমি আমার দাদার সাথে সিরিয়া যেতাম। আমি সেখানে অল্পবয়স্ক যুবকদের দেখেছি। ইয়াযীদও তাদের মধ্যে ছিলো।’’ তাঁর ছাত্রগণ আরয করলেন, ‘‘তাহলে আপনি তার সম্পর্কে ভালভাবে জানতেন।’’ হযরত আমর ইবনে ইয়াহিয়া মারওয়ানকেও ওইসব অভিশপ্ত যুবকদের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। তিনি এ হাদীস শরীফকে উমাইয়া বংশের লোকদের বেলায় প্রযোজ্য বলেছেন।


সহীহ্ বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘কিরমানী’ তে আল্লামা কিরমানী বলেছেন, ‘‘হাদীস শরীফে ‘আহদাস’ শব্দ এসেছে।) ‘আহদাস’ হচ্ছে উঠতি বয়সের যুবকগণ। তাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হচ্ছে ইয়াযীদ। সে সাধারণত বয়স্ক বুযুর্গদেরকে শহরগুলোর নেতৃত্ব থেকে নামিয়ে অল্পবয়স্ক আত্মীয়-স্বজনদেরকে শাসক নিয়োগ করেছিলো।

সমস্ত ব্যাখ্যাকারী, হযরত মোল্লা আলী ক্বারীসহ একথার উপর একমত যে, হাদীস শরীফে উল্লেখিত غِلْمَةُ قُرَيْش(ক্বোরাইশ বংশের ছেলেগণ)-এর মধ্যে ইয়াযীদ অবশ্যই রয়েছে। 


হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه] বলেন, হুযূর রাহমাতুল্লিল আলামীন [ﷺ] এরশাদ করেন-

تَعَوَّذُوْا بِاللهِ مِنْ رَأْسِ السِّتِّيْنَ وَاِمَارَةِ الصِّبْيَانِ

[হে লোকেরা! (হিজরী) ষাট সালের প্রারম্ভ ও ছেলেদের আমীর বা শাসক হওয়া থেকে আল্লাহর পানাহ্ (আশ্রয়) কামনা করো।] [মিশকাত শরীফ: ৩২৩পৃ.]


‘ছেলেদের শাসক হওয়া’ মানে মূর্খ প্রকৃতির ছেলেদের রাজত্ব। যেমনঃ ইয়াযীদ ইবনে মু‘আভিয়া, মারওয়ান ইবনে হাকামের ছেলেরা। (সূত্র. মোল্লা আরী ক্বারী)


অন্য হাদীসে, হুযূর-ই আক্রাম তাঁর পবিত্র স্বপ্নে এদেরকেই মিম্বরের উপর খেলাধুলা করতে দেখেছিলেন। হুযূর-ই আক্রামের একটি হাদীসে এমনও বর্ণিত হয়েছে, যা আল্লামা সুয়ূত্বী ‘তারীখুল খোলাফা’য়, ইমাম ইবনে হাজর ‘সাওয়া-ইক্বে মুহরিক্বাহ্’য়, শায়খ মুহাম্মদ সাবগান ‘ইস‘আফুর রাগিবীন’-এ ‘মুসনাদ-ই আবূ ইয়া’লা’ থেকে বর্ণনা করেছেন- 

لاَ يَزَالُ اَمْرُ اُمَّتِىْ قَائِمًا بِالْقِسْطِ حَتّى يَكُوْنَ اَوْلُ مَنْ يُثَلْمِهُ رَجَلٌ مِّنْ بَنِىْ اُمَيَّةَ يُقَالُ لَه يَزِيْدُ 

অর্থাৎ : আমার উম্মতের বিষয়াদি ঠিকঠাক থাকবে যতক্ষণ না এক প্রথম ব্যক্তি তাতে ফাটল ধরাবে, সে হচ্ছে বনী উমাইয়ার এক ব্যক্তি, যার নাম ‘ইয়াযীদ’।


তিনি আরো বর্ণনা করেছেন-

سَمِعْتُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ اَوَّلُ مَنْ يُّبَدِّلُ سُنَّتِىْ رَجَلٌ مِّنْ بَنِىْ اُمَيَّةَ يُقُالُ لَه يَزِيْدُ

‘‘আমি হুযূর-ই আক্রাম রসূলুল্লাহ্ [ﷺ]’কে এরশাদ করতে শুনেছি, প্রথম ব্যক্তি, যে আমার সুন্নাতকে বদলে ফেলবে, সে বনী উমাইয়ার এক ব্যক্তি হবে, যার নাম হবে ইয়াযীদ।’’


ইয়াযীদ সম্পর্কে বুযুর্গ ব্যক্তিদের মন্তব্যঃ


 এক ব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয [رضي الله عنه]’র সামনে ইয়াযীদকে ‘আমীরুল মু’মিনীন’ বলেছিলো। তিনি লোকটাকে ‘বিশটি কশাঘাত’ করেছিলেন। (২০ দুররা মেরেছিলেন।)

[সূত্রঃ ‘সাওয়া-ইক্বি মুহরিক্বাহ্ ও তারীখুল খোলাফা, পৃ. ১৪৬]


 ইয়াযীদের সমসাময়িক হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হানযালাহ্ গসীলুল মালাইকাহ্ [رضى الله عنهما] ইয়াযীদ সম্পর্কে বলেছেন- ‘‘সে উম্মে ওয়ালা, কন্যা ও বোনদের সাথে বিবাহের প্রচলনদাতা, মদ্যপায়ী ও নামায বর্জনকারী।’’

[সূত্রঃ তারীখুল খোলাফা, পৃ. ১৪৬]


 হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী [رحمه الله عليه] ও লিখেছেন- ‘‘ইয়াযীদ-ই পলীদ ছিলো ফাসিক্ব-ফাজির (পাপাচারী), খোদাদ্রোহী, লুণ্ঠনকারী ইত্যাদি। এসব বিষয়ের পক্ষে অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে।’’ ইমাম হোসাঈন [رضي الله عنه]’র বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে তাঁকে শহীদ করার নেপথ্যে ইয়াযীদের হাত রয়েছে। এ-ই শায়খ মুহাক্বক্বিক্ব ‘আলাল ইত্বলাক্ব ‘জযবুল ক্বুলূব’-এ লিখেছেন, হযরত ইমাম আলী মাক্বামের শাহাদাতের পর সর্বাপেক্ষা মন্দ ও গর্হিত কাজ ও ঘটনা ইয়াযীদের শাসনামলে ঘটেছিলো, তা হচ্ছে ‘হাররার ঘটনা’। এ ঘটনায় ইয়াযীদ তার সেনাপতি মুসলিম ইবনে ওক্বাবাহকে বিরাট সেনাবাহিনীর সাথে মিলে মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছিলো। আর বলেছিলো, ‘‘যদি তাঁরা আনুগত্য স্বীকার না করেন, তাহলে তিনদিন যাবৎ এ ভূ-খন্ডকে তোমার জন্য মুবাহ্ করা হলো।’’ (হত্যাযজ্ঞের অনুমতি দেওয়া হলো।) সিরীয় পশুগুলো হেরম-ই পাকে ঢুকে সেটার মর্যাদাকে পদদলিত করেছে। এক হাজার সাতশ’ মুহাজির ও আনসার সাহাবী ও তাবে‘ঈ আলিম, সাতশ’ হাফেয-ই ক্বোরআন এবং দু’ হাজার জনসাধারণকে যবেহ (হত্যা) করেছে। আর হাজার হাজার পর্দানশীন কুমারীর শ্লীলতা নষ্ট করেছে। মসজিদে নবভী শরীফে ঘোড়া দৌঁড়িয়েছে। রিয়াযুল জান্নাতে ঘোড়া বেঁধেছে। (সেগুলোর পায়খানা-প্রস্রাব দ্বারা সেটাকে নাপাক করেছে।) তিনদিন যাবৎ মসজিদে নবভী শরীফে আযান ও নামায হয়নি। হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী [رضي الله عنه]’র দাড়ি মুবারক উপড়ে ফেলা হয়েছে। রক্ষা পেয়েছিলো একমাত্র তারাই, যারা এহেন দুশ্চরিত্র যালিম ইয়াযীদের বায়‘আত গ্রহণ করেছিলো।

 ইয়াযীদের পুত্র দ্বিতীয় মু‘আভিয়া যে খোৎবা (ভাষণ) দিয়েছিলেন, তাও ইয়াযীদের দুর্ষ্কম ও ইসলাম-বিদ্বেষের প্রমাণ বহন করে। (তিনি অবশ্য সৎ ও ন্যায়পরায়ণ লোক ছিলেন।) তিনি বলেন, ‘‘অতঃপর আমার পিতাকে রাজকীয় পোশাক পরানো হয়। সে অনুপযুক্ত ছিলো। রসূল-ই আক্রামের দৌহিত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এর ফলে তার জীবন হ্রাস পেয়েছে, বংশ নিপাত গেছে, সে তার কবরে তার পাপরাশির শাস্তিতে গ্রেফতার হয়ে আছে।’’

তারপর তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘‘আমাদের সবার জন্য অতি আফসোস ও মনোকষ্টের ব্যাপার হলো তার মন্দমৃত্যু ও মন্দ ঠিকানা (পরিণাম)। সে তো রসূলে আক্রামের সম্মানকে ভূ-লুণ্ঠিত করেছে। মদকে হালাল করেছে, কা’বা শরীফ ধ্বংস করেছে।’’ [সূত্রঃ সাওয়া-ইক্ব-ই মুহরিক্বাহ্, পৃ. ১৩৪]


◇ ইয়াযীদের অন্যান্য দুষ্কর্মঃ


হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হানযালাহ্ আল গাসীল [رضي الله عنه] বলেন, ‘‘আল্লাহরই শপথ, আমি ইয়াযীদকে তখনই ত্যাগ করেছি ও তার নিকট থেকে দূরে সরে গিয়েছি, যখন আমার আশঙ্কা হয়েছিলো যে, তার অসৎ কাজগুলোর কারণে আসমান থেকে পাথর বর্ষিত হবে কিনা। (যেভাবে হযরত লূত [عليه السلام]-এর সম্প্রদায়ের উপর বর্ষিত হয়েছিলো)

শাসনভার হাতে নিয়ে এ হতভাগা ‘মুহাররামাত’ (যেসব নারীকে বিবাহ্ করার হারাম)-এর সাথে বিবাহ্ করা বৈধ বলে ঘোষণা করলো, সুদের মতো হারাম কাজকে বৈধ বলে ঘোষনা দিয়ে প্রকাশ্যে তা চালু করছিলো। মদীনাতুর রসূল [ﷺ]-এর অবমাননা, কা’বাতুল্লাহর মানহানি ও গিলাফে কা’বায় অগ্নি সংযোগ করিয়েছিলো। দূরদর্শী ও গূঢ় রহস্যজ্ঞানী সাহাবীগণ তখনই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, যখন মুসলিম রাজ্যের শাসনভার এ হতভাগার হাতে এসেছিলো। ৫৯ হিজরীতে হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه] আল্লাহর দরবারে দো‘আ করেছিলেন, ‘‘হে আমার রব, আমি তোমার দরবারে পানাহ্ (আশ্রয়) চাচ্ছি ৬০ হিজরীর প্রারম্ভ ও অল্পবয়স্ক ছেলেদের রাজত্ব থেকে।’’ এ দো‘আ কবুল হয়েছিলো। তিনি ৫৯ হিজরীতে মদীনা তাইয়্যেবায় ওফাত পান। অর্থাৎ ৬০/৬১ হিজরীতে ইয়াযীদ সিংহাসন দখল করেছিলো; এর পূর্বে তিনি ওফাত পেয়ে যান। সাহাবী-ই রসূল হযরত আবুদ্ দারদা [رضي الله عنه] হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে- হুযূর-ই আক্বদাস এরশাদ করেছেন, ‘‘আমার সুন্নাতকে সর্বপ্রথম বদলে ফেলবে উমাইয়া বংশের এক লোক, যার নাম হবে ইয়াযীদ।’’ হযরত আবূ ওবায়দাহ্ [رضي الله عنه] থেকেও একই বিষয়বস্তুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

[সূত্রঃ সাওয়ানিহে কারবালা, কৃত. সদরুল আফাযিল [رحمه الله عليه]]

Top