ইমাম আ‘যম (رحمة الله) ইলমে ফিকহের প্রবর্তক
ইসলামে যে চারটি মাযহাব প্রচলিত আছে এর মধ্যে হানাফী মাযহাব বা ফিকহে হানাফীই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। ইমাম আ‘যম আবু হানিফা নু’মান ইবনে সাবিত (رحمة الله) হলেন এ মাযহাবের প্রবর্তক। তাঁর নামানুসারে এ মাযহাবের নামকরণ করা হয় ‘হানাফী মাযহাব’ বা ‘ফিকহে হানাফী’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের নিকট এ মাযহাবই সর্বাধিক সমাদৃত। মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন-
احنفية ثلثي المؤمنين
“বর্তমান দুনিয়ার এক তৃতীয়াংশ মু‘মিন হানাফী মাযহাবের অনুসারী।”
➥ মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হিঃ), মিরকাত, খন্ড ২, পৃষ্ঠাঃ ২৪
ফিকহে হানাফী সারা বিশ্বে এত সমাদৃত লাভ করার কারণ বর্ণনা করে শাফেঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস বুখারী শরীফের ভাষ্যকার আল্লামা কিরমানী (رحمة الله) বলেন,
فلولم يكن لله سر خفي فيه لما جمع له شطر الاسلام وما ينقاد به علي تقليده حتي عبد الله بفقهه وعمل برائه الي يومنا وفيه اول دليل علي صحته
“ফিকহে হানাফীতে যদি মহান আল্লাহর গোপন রহস্য নিহিত না থাকত, তাহলে ইসলামের অর্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত বিপুল সমাবেশ তাতে ঘটত না এবং এত বিপুল সংখ্যক লোক তাঁর অনুসরণ করত না। এমনকি আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (رحمة الله)তাঁর ফিকহ গ্রহণ করতেন না এবং আজ পর্যন্ত মানুষ তাঁর ফিকহ ও সিদ্ধান্তের উপর আমল করে আসছে। এটাই তাঁর মাযহাবের বিশুদ্ধতার প্রধান প্রমাণ।”
➥ আল মুগনা, পৃষ্ঠাঃ ৮০, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন বাইফা, পৃষ্ঠাঃ ১৯৯
উপরোক্ত অভিমত হিজরী দশম শতাব্দীর। এরপর আরো কয়েকশত শতাব্দী অতীত হয়েছে এবং মুসলমানদের সংখ্যাও বেড়েছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, বর্তমান বিশ্বে মুসলামনদের প্রায় অর্ধেকই হানাফী মাযহাবের অনুসারী ও অনুরাগী।
➥ ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা পৃষ্ঠাঃ ১৯৯
এ প্রসিদ্ধ ও বিশাল মাযহাবের প্রবর্তক যে, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে আল্লামা মুয়াফিফক (رحمة الله) বলেন:
وابو حنيفة رحمه الله اول من دون علم هذه الشريعة لم يسبقه احد ممن قبله
“ইমাম আবু হানিফাই সর্ব প্রথম এই শরিয়তের ইলম তথা ইলমে ফিকহ সংকলন করেন। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ফকীহদের কেউ তাঁকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়নি।”
➥ ইমাম মুয়াফিফক (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ), মানকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড২, পৃষ্ঠাঃ ১৩৬
আল্লামা সুয়ূতী শাফেঈ (رحمة الله) (৯১১হি.) বলেন-
انه اول من دون علم الشريعة ورتبها ابوابا ثم تبعه مالك بن انس ولم يسبق ابا حنيفة احد
“ইমাম আবু হানিফাই সর্বপ্রথম এই শরীয়ত তথা ইলমে ফিকহ সংকলন করেন এবং তা অধ্যায় হিসাবে বিন্যস্ত করেন। তারপর এ পথে তাঁর অনুসরণ করেন ইমাম মালিক ইবনে আনাস (رحمة الله)। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)কে কেউ এ বিষয়ে পেছনে ফেলতে পারেনি।”
➥ আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (رحمة الله) (৯১১হিঃ), তাবঈদুস সহীফা,পৃষ্ঠাঃ ৩৬
আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী শাফেঈ (رحمة الله) বলেন,
-انه اول من دون علم الفقه ورتبه ابوابا وكتب علي نحو ما هوعليه اليوم
“ইমাম আবু হানিফাই সর্বপ্রথম ইলমে ফিকহ সংকলন করেন এবং একে অধ্যায় হিসাবে বিন্যস্ত করেন। আর বর্তমানে ফিক্হ যেভাবে আছে সেভাবে তিনিই তা লেখার ব্যবস্থা করেন।
➥ ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৭৩
ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমূহ সমস্যার সমাধান কল্পে দীর্ঘ ২২ বছরকাল পর্যন্ত সাধনা করেন এবং তাঁর সুযোগ্য ও বিশিষ্ট ছাত্রদের নিয়ে চল্লিশ সদস্যের একটি ফিকহী বোর্ড গঠন করে কুরআন, হাদিস, ইজমায়ে সাহাবা, ফাতাওয়ায়ে সাহাবা এবং কিয়াসের মাধ্যমে ব্যাপক গবেষণা করে বিষয় ভিত্তিকভাবে ফিকহের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তুলেন যা ‘ইলমে ফিকহ’ নামে পরিচিতি ও সুবিদিত। সুদীর্ঘ ২২ বছর দিবারাত্রির পরিশ্রম ও সাধনা-গবেষণার পর ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র এ ফিকহ সম্পাদনা পরিষদের মাধ্যমে ‘মাজমুয়ায়ে ফিকহ’ তৈরি হয়ে আলিমদের হাতে পৌঁছে। এ মজমুয়ায় তিরাশি হাজার মাসয়ালা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে আটত্রিশ হাজার ইবাদত সম্পর্কীয়, এবং পঁয়তালিশ হাজার পরস্পর লেনদেন, চুক্তি ও শান্তি সম্পর্কিত ছিল। তিনি একাজ আরম্ভ করেছিলেন ১২১ হিজরীতে এবং ১৪৪ হিজরীর পূর্বেই তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু এরপরও এতে মাসয়ালা সংযোজন হতে থাকে। অবশেষে ফিকহে হানাফীর মাসয়ালা সংখ্যা পাঁচ লক্ষে গিয়ে পৌঁছাল। আল্লামা খাওয়ারেযমী (رحمة الله) জামেউল মাসাইল গ্রন্থে বলেন,
-وقد قيل بلغت مسائل ابي حنيفة خمسمأة الف مسألة كتبه وكتب اصحابه تدل علي ذالك
“বলা হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র লিপিবদ্ধ মাসাইলের সংখ্যা পাঁচ লক্ষে পৌঁছেছে। তাঁর ও তাঁর ছাত্রদের গ্রন্থরাজিই এর প্রমাণ বহন করে।”
➥ আল্লামা খাওয়ারেযমী (رحمة الله) জামেউল মাসাইল, পৃষ্ঠাঃ ৩৫
ইমাম আ‘যম (رحمة الله) ‘ইলমে ফিকহ’ সংকলন ও লিপিবদ্ধ করে সারা বিশ্বময় সুখ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা পেলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ‘ফিকহ’গণ মানুষের সার্বিক চাহিদা পূরণ করে মানুষের ঈমান-আকীদা, আমল-আখলাক, কাজ-কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-আদালত, তথা জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে অনন্য খিদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে।
রদ্দুল মোহতার গ্রন্থে বলা হয়েছে-
والحاصل ان ابا حنيفية النعمان من اعظم معجزات المصطفي بعد القران وحسبك من مناقبه اشتهار مذهبه ما قال قولا الا اخذ به امام الائمة الاعلام وقد جعل الحكم لاصحابه واتباعه من زمنه الي هذه الايام الي ان يحكم بمذ هبه عيسي عليه السلام وهذا يدل علي امرعظيم -
“মোদ্দাকথা হলো নিশ্চয় আবু হানিফা নু‘মান পবিত্র কুরআনের পর রাসূল (ﷺ) সবচেয়ে বড় মু’জিযা। তাঁর ফযীলতের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, তাঁর মাযহাব এতই প্রসিদ্ধ যে, অনেক বড় বড় ইমামগণও তাঁর মাযহাব গ্রহণ করেছেন এবং তৎকাল থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর শিষ্য ও অনুসারীরাই ফায়সালা ও বিচার কার্য আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। এমনকি হযরত ঈসা (عليه السلام) পৃথিবীতে আগমন করে ইমাম আ‘যমের মাযহাব মোতাবেক ফায়সালা করবেন। এটি এই মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বড় দলীল।
➥ আল্লামা শামী (رحمة الله) (১৩০৬হিঃ), রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ১৩৬
উক্ত গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে যে, নিশ্চয় ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র মাযহাব অনেক আউলিয়া কিরাম অনুসরণ করেছেন। যেমন-ইব্রাহীম ইবনে আদহাম, শকীক বলখী, মারূফ কারখী, বায়েজীদ বোস্তামী, ফুযাইল ইবনে আয়ায, দাউদ তাঈ, আবু হামেদ লাফফাক, খালাফ ইবনে আইয়ুব, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, আবু বকর ওয়াররাক প্রমুখ পদের সংখ্যা অগণিত। তাঁরা যদি এই মাযহাবে কোন সন্দেহভাজন কিছু পেতেন কখনই তারা এর অনুসরণ, অনুকরণ ও সমর্থন করতেন না।
➥ আল্লামা শামী (رحمة الله) (১৩০৬হিঃ), রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ১৩৬