দ্বিতীয় অধ্যায়

এ প্রসঙ্গে উত্থাপিত আপত্তি সমূহের উত্তর


    বুজুর্গানে কিরামের হাত-পা চুম্বন ও পবিত্র বস্তুর তাযীম প্রসঙ্গে বিরোধিতাকারীগণ নিম্নবর্ণিত আপত্তিগুলো উত্থাপন করে থাকে। ইনশাআল্লাহ, এ আপত্তিগুলো ছাড়া তাদের কাছে আর কিছু বলার নেই।

   

১নং আপত্তিঃ 


ফকীহগণ বলেন যে, উলামায়ে কিরামের সামনে মাটি চুমু দেয়া, এমন কি মাথানত করে সম্মান করা হারাম, কেননা এটা রূকুর অনুরূপ এবং তাযিমী সিজদা যেমন হারাম হয়ে গেছে তদ্রুপ তাযিমী রূকুও হারাম হয়ে গেছে। আর যখন কারো পা চুমুর জন্য ওর পায়ে মুখ রাখলেন, তা তো রূকু কেন, সিজদা হয়ে গেল। সুতরাং এটা হারাম। 


✧ দুর্রুল মুখতার কিতাবুল কারাহিয়াতের الاستبراء- শীর্ষক অধ্যায়ের মুসাফাহা পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে-

(تَقْبِيلِ الْأَرْضِ بَيْنَ يَدَيْ الْعُلَمَاءِ) وَالْعُظَمَاءِ فَحَرَامٌ .... لِأَنَّهُ يُشْبِهُ عِبَادَةَ الْوَثَنِ

উলামায়ে কিরাম ও বড় বড় বুযুর্গানে কিরামের সামনে মাটি চুম্বন হারাম কেননা এটা মূর্তিপূজার সমতুল্য।’’  ৪১৮

➥418. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮৩।


✧ এর প্রেক্ষাপটে ফাতওয়ায়ে শামীতে বর্ণিত আছে-

الْإِيمَاءُ فِي السَّلَامِ إلَى قَرِيبِ الرُّكُوعِ كَالسُّجُودِ وَفِي الْمُحِيطِ أَنَّهُ يُكْرَهُ الِانْحِنَاءُ لِلسُّلْطَانِ وَغَيْرِهِ اهـ وَظَاهِرُ كَلَامِهِمْ إطْلَاقُ السُّجُودِ عَلَى هَذَا التَّقْبِيلِ

সালাম দেয়ার সময় রূকুর কাছাকাছি নত হওয়া সিজদা করার মত এবং ‘মুহীত’ গ্রন্থে উল্লে­খিত আছে যে, বাদশাহ ও অন্যান্যদের সামনে মাথা নত করা মাকরূহ এবং ফকীহগণের সুস্পষ্ট অভিমত হলো-ঐ ধরনের চুম্বনকে সিজদাই বলা যায়।’’ ৪১৯


উপরোক্ত ইবারত থেকে প্রতীয়মান হয় যে কোন মানুষের সামনে মাথা নত করা বা সিজদা করা শিরক। তাই কারো পা-চুম্বনও শিরক। হযরত মুজাদ্দিসে আলফে ছানী (رحمة الله)কে দরবারে আকবরীতে তলব করা হয়েছিল এবং দরবারে প্রবেশ করার দরজা ছোট আকারের করা হয়েছিল, যাতে এ কৌশলে আকবরের সামনে তাঁর মাথা নত হয়। কিন্তু যখন তিনি ওখানে তশরীফ নিয়ে গেলেন, তখন উক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় প্রথমে পা প্রবেশ করান, যাতে মাথা নত করতে না হয়। (সাধারণ দেওবন্দী ওহাবীরা এ আপত্তিটা বেশীর ভাগ উত্থাপন করে এবং এটাই তাদের প্রধান আপত্তি।)


উত্তরঃ আমি প্রথমে সিজদার সংজ্ঞা, অতঃপর এর আহকাম বর্ণনা করবো। এর পর বর্ণনা করবো কারো সামনে মাথা নত করলে এর কি হুকুম। এতটুকু জানতে পারলে, এ আপত্তিটার নিষ্পত্তি অনায়াসে হয়ে যাবে। শরীয়তের পরিভাষায় সিজদা হচ্ছে সাত অঙ্গ অর্থাৎ দু’হাতের তালু, দু’জানু, দু’হাত, নাক ও কপাল মাটিতে রাখা এবং এতে সিজদার নিয়তও হওয়া চাই। ফিকাহ শাস্ত্রের প্রায় গ্রন্থে কিতাবুস সালাতের সিজদা শীর্ষক আলোচনায় দেখতে পাবেন যে, যদি কেউ সিজদার নিয়ত বিহীন উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে, সেটা ‘সিজদা’ হবে না। যেমন কতেক লোক অসুখ ও শীতের কারণে হাত পা চারটি গুটিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। সিজদা দু’রকম-সিজদায়ে তাহিয়্যাত ও সিজদায়ে ইবাদত। সিজদায়ে তাহিয়্যা হচ্ছে, যেটা কারো সাক্ষাতে করা হয় এবং সিজদায়ে ইবাদত হচ্ছে, যেটা খোদাকে বা কাউকে খোদা জ্ঞান করে করা হয়। সিজদায়ে ইবাদত গায়রুল্লাহকে করা শিরক। কোন নবীর ধর্মে এটা জায়েয ছিল না। কেননা প্রত্যেক নবী একেশ্বরবাদের প্রচার করেছেন; কেউ শিরকের প্রসার ঘটাননি। কিন্তু সিজদায়ে তাহিয়্যা হযরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে হুযুর (ﷺ) এর যুগের আগ পযর্ন্ত জায়েয ছিল। 

ফিরিশতাগণ হযরত আদম (عليه السلام)কে সিজদা করেছেন। হযরত ইয়াকুম (عليه السلام) ও হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর ভায়েরা হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে সিজদা করেছেন। তাফসীরে রুহুল বয়ানে ১২ পারায় সূরা হাজর আয়াত।’’ ৪২০

➥420. সূরা হুদ, আয়াত নং-৪৪।


 وَقِيلَ بُعْدًا لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত আবু আলিয়া (رضي الله عنه) থেকে একটি রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, হযরত নূহ (عليه السلام) এর যুগে শয়তান তওবা করতে চেয়েছিল। তখন হযরত নূহ (عليه السلام)কে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) নির্দেশ দেয়া হয়েছিল- ‘শয়তানকে বল, আদমের কবরকে সিজদা করার জন্য।’ তখন শয়তান বললো- যখন আমি আদমকে জীবিতাবস্থায় সিজদা করিনি এখন আর কবরকে কি সিজদা করবো। অতঃপর ইসলাম সেই সিজদায়ে তাহিয়্যাকে হারাম করেছেন। অতএব, কোন মুসলমান যদি কোন ব্যক্তিকে সিজদায়ে তাহিয়্যা করে, তাহলে সে গুনাহগার, অপরাধী ও হারামকারী বলে গণ্য হবে, কিন্তু মুশরিক বা কাফির বলা যাবে না। 

✧ আপত্তিকারী দুর্রুল মুখতারের যেই ইবারত উদ্ধৃত করেছে, সেই একই জায়গায় বর্ণিত আছে-

عَلَى وَجْهِ الْعِبَادَةِ وَالتَّعْظِيمِ كُفْرٌ وَإِنْ عَلَى وَجْهِ التَّحِيَّةِ لَا وَصَارَ آثِمًا مُرْتَكِبًا لِلْكَبِيرَةِ

-যদি এ মাটি চুম্বনটা ইবাদত বা সম্মানের জন্য হয়ে থাকে, তাহলে কুফুরী আর যদি অভিবাদনের জন্য হয়ে থাকে, তাহলে কুফুরী নয়। তবে কবীরা গুনাহগার বলে সাব্যস্ত হবে।’’  ৪২১

➥421. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮৩।



এ ইবারতটা ফাতওয়ায়ে শামীতে আরও পরিস্ফুটন করা হয়েছে। এখন বলা বাকী রইলো মাথা নত করার প্রসঙ্গটা। এটা দু’ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমতঃ তাযীমের জন্য মাথা নত করা যেমন, মাথা নত করে সালাম করা বা সম্মানিত ব্যক্তির সামনে মাটি চুম্বন করা। এক্ষেত্রে যদি রূকু সম মাথা নত করা হয় তাহলে হারাম। ফকীহগণ এ ধরনের মাথা নত করাকে নিষেধ বলেছেন। দ্বিতীয়তঃ মাথা নত করা অন্য কাজের জন্য, তবে কাজটা সম্মানের জন্য হয়ে থাকে। যেমন কোন বুযুর্গের জুতা যথাস্থানে রাখা, পায়ে চুমু দেয়া। এখানে যদিওবা মাথা নত হয় কিন্তু তা হচ্ছে জুতা সোজা করা বা পায়ে চুমু দেয়ার জন্য এবং সেই কাজটা বুযুর্গের তাযীমের জন্য করা হয়, তাহলে তা জায়েয। যদি এ ধরনের প্রতিবিধান করা না হয়, তাহলে ইতিপূর্বে আমার উল্লে­খিত হাদীছসমূহ ও ফকীহ ইবারত সমূহের কি ভাবার্থ হবে? অধিকন্তু এ আপত্তিটা দেওবন্দীদেরও বিপরীত, কারণ তাদের নেতা মৌলভী রশীদ আহমদ সাহেবও পায়ে চুমু দেয়াকে জায়েয বলেছেন। দরবারে আকবরীতে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের আচরণটা ছিল তাঁর চূড়ান্ত তাকওয়ারই প্রতিফলন। তিনি ধারণা করেছিলেন যে আকবর বাদশাহের সামনে মাথা নত করার জন্য এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিল। আর তিনি জানতেন যে দরবারে আকবরীতে বাদশাহ আকবরকে সিজদা করা হতো। এ জন্যে তিনি মাথা নীচু করে প্রবেশ করেন নি। অন্যথায় তিনি যদি মাথা নীচু করে প্রবেশ করতেন, তাতে তাঁর প্রতি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন অভিযোগ উত্থাপন করা যেত না। কারণ তাঁর ওই মাথা নীচু করার উদ্দেশ্যে আকবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বোঝাতো না।


২ নং আপত্তিঃ 


✧ হাদীছ শরীফে আছে যে, হযরত উমর (رضي الله عنه) হাজর আসওয়াদকে চুমু দিয়ে বলেছিলেন-

وَإِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ، وَأَنَّكَ لَا تَضُرُّ وَلَا تَنْفَعُ، وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبَّلَكَ مَا قَبَّلْتُكَ

-ওহে হাজর আসওয়াদ, আমি ভাল মতে জানি, তুমি একটি পাথর মাত্র, না উপকার, না ক্ষতি করতে পার। যদি আমি হুযুর (ﷺ) কর্তৃক তোমাকে চুমু দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুমু দিতাম না।’’  ৪২২

➥422. ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল হাজ্জ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৯২৫, হাদিস-১২৭০।


এর থেকে বোঝা গেল হযরত ফারুকে আযমের (رضي الله عنه) কাছে হাজর আসওয়াদকে চুমু দেয়াটা অপছন্দ ছিল। কিন্তু যেহেতু সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে, সেহেতু বাধ্য হয়ে চুমু দিলেন। কিন্তু পবিত্র বস্তুর ক্ষেত্রে যেহেতু কোন সুস্পষ্ট দলীল নেই, তাই চুম্বন না দেয়াটাই উচিৎ।


উত্তরঃ 


✧ মৌলানা আবদুল হাই সাহেব হেদায়ার মুকাদ্দমাতে হাজর আসওয়াদ প্রসঙ্গে হাদীছটি উদ্ধৃত করে বলেন-হযরত হাকিম (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে যে হযরত আলী (رضي الله عنه) হযরত ফারুকে আযম (رضي الله عنه) কে জবাব দিয়েছিলেন-ওহে আমীরুল মুমিনীন, হাজর আসওয়াদ কল্যাণ করতে পারে আবার ক্ষতিও করতে পারে। আহা! আপনি যদি কুরআন শরীফের সেই আয়াতের ব্যাখ্যার প্রতি মনোযোগ দিতেন -৪২৩

➥423. সূরা আ‘রাফ, আয়াত, নং-১৭২



وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ

✧ যখন মিছাকের দিন (রূহের জগতে প্রতিজ্ঞার দিন) আল্লাহ তাআলা প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা নিয়েছিলেন, তখন সেই ওয়াদানামা একটি পাতায় লিখে এই হাজরে আসওয়াদে রেখেছেন এবং কিয়ামতের দিন এই পাথর আগমন করবে। এর চোখ, জিহবা ও ঠোঁট হবে এবং মুমিনের পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। সুতরাং এটা আল্লাহর আমানতদার এবং মুসলমানদের সাক্ষী। তখন হযরত ফারুক (رضي الله عنه) ফরমান, ওহে আলী, যেখানে তুমি থাকবে না, সেখানে আল্লাহ যেন আমাকে না রাখে।’’  ৪২৪

➥424. 

(১)ইমাম কাস্তাল্লানী, ইরশাদুস সারী শরহে সহীহুল বুখারী, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৫৬।

(২)ইমাম জুরকানী, শরহে মুয়াত্তায়ে মালেক, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৮৭।


এবার বোঝা গেল যে, হাজর আসওয়াদ লাভ-ক্ষতি উভয় করতে পারে এবং এর প্রতি সম্মান মানে দ্বীনের প্রতি সম্মান। অধিকন্তু, হযরত ফারুক (رضي الله عنه) কর্তৃক হাজর আসওয়াদের প্রতি এ ধরনের সম্বোধন এ জন্য ছিল না যে, তিনি সেই হাজর আসওয়াদকে চুমু দিতে নারাজ ছিলেন। তিনি ভালই জানতেন সুন্নাতের প্রতি অনীহা প্রকাশ কুফরী। তিনি কেবল এই জন্যই বলেছিলেন যে, আরববাসীগণ প্রথমে মূর্তিপূজারী ছিল। তারা যেন এ ধারণা না করে যে ইসলাম কতেক মূর্তিকে হটিয়ে একটি পাথরের প্রতি তাদের মনোনিবেশ করিয়েছে। এই বক্তব্য থেকে জনগণের জানা হয়ে গেল যে, ওটা ছিল পাথরের পূজা করা। আর এটা হলো পাথরকে চুমু দেয়া। পূজা এক জিনিস এবং চুম্বন আর এক জিনিস। হযরত আলী (رضي الله عنه) ও এ উদ্দেশ্যকে নাকচ করেন নি বরং- لَا تَضُرُّ وَلَا تَنْفَعُ এর দ্বারা শ্রোতাদের কাছে যে ভুল ধারণা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল, তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, হযরত ফারুকে আযম (رضي الله عنه) এর এ ধরনের বলার উদ্দেশ্য হলো এ পাথর মূলতঃ লাভ-ক্ষতির অধিকারী নন, যেমন আরববাসী মূর্তিদেরকে মনে করতো। আর এ ভাবার্থও নয় যে এ পাথরে লাভ-ক্ষতি কিছুই নেই। তাহলে বোঝা যায় যে, হযরত ফারুকে আযমের বক্তব্যও জনগণকে বোঝানোর জন্য ছিল এবং হযরত আলী (رضي الله عنه) এর উদ্দেশ্যও তা-ই ছিল। আমার এ বিবরণ থেকে রাফেজী ও ওহাবীদের আপত্তি হাওয়া হয়ে গেল।

কি আশ্চয! হযরত ফারুকে আযম এখানে হাজর আসওয়াদকে চুমু দিতে তোমাদের কথা মত অনিচ্ছুক। অথচ, তিনি নিজে হুযুর (ﷺ) এর সমীপে আরয করেছিলেন-আমরা মকামে ইব্রাহীমকে নিজেদের ইবাদতগাহে পরিণত করতে পারতাম এবং এর সামনে সিজদা করতে এ নফল নামায পড়তে পারতাম। 


✧ তাঁর এ আরযের পরিপ্রেক্ষিতে-

وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى

-‘‘তোমরা মকামে ইব্রাহীমকে নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ কর।’’ ৪২৫

➥425. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১২৫


এ আয়াত নাযিল হয়। মকামে ইব্রাহীমও একটি পাথর কিন্তু এর সামনে নফল নামায পড়া ও সিজদা করা তাঁর পছন্দ ছিল।

   

৩ নং আপত্তিঃ 


কতেক লোক এ-ও বলে যে আজকাল যে সব পবিত্র বস্তু হুযুর (ﷺ) এর বলে দাবী করা হয়, তা সঠিক, না বেঠিক বলা মুশকিল, কেননা এর সঠিক হওয়ার কোন প্রমাণ নেই। তাই একে চুমু দেয়া বা সম্মান করা জায়েয নয়। হিন্দুস্থানের অনেক জায়গায় চুল মুবারক প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু ওগুলো যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের চুল, এর কোন নজির বা প্রমাণ নেই।

   

উত্তরঃ এ পবিত্র বস্তু প্রমাণের জন্য মুসলমানদের মধ্যে হুযুর (ﷺ) এর পবিত্র বস্তু বলে প্রসিদ্ধিই যথেষ্ট। এর প্রমাণের জন্য কুরআনের আয়াত বা বুখারী শরীফের হাদীছের প্রয়োজন হয় না। এক এক জিনিসের প্রমাণ এক এক রকম। যেমন যেনা প্রমাণিত করার জন্য চার জন পরহিযগার মুসলমানের সাক্ষ্য প্রয়োজন। অন্যান্য আর্থিক লেনদেন প্রমাণের জন্য দু’জনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট এবং রমযানের চাঁদের জন্য কেবল একজন মহিলার সংবাদই বিবেচিত। নিকাহ, বংশ পরিচয়, স্মরণীয় ঘটনা এবং বিভিন্ন সময়ের প্রমাণের জন্য কেবল প্রসিদ্ধি বা বিশেষ আলামতই যথেষ্ট। একজন বিদেশী পুরুষ কোন মহিলার সাথে স্বামী স্ত্রীর মত বসবাস করছে। আপনি এতটুকু লক্ষণ দেখে ওদের বিবাহের সাক্ষ্য দিতে পারেন। আমরা বলি আমি অমুকের ছেলে, অমুকের নাতী। এর কোন প্রমাণ কুরআন বা হাদীছে নেই, এমন কি আমাদের মায়ের বিবাহের সাক্ষীও মওজুদ নেই। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এর যে প্রসিদ্ধি রয়েছে, তা-ই যথেষ্ট। অনুরূপ স্মরণীয় বিষয়ের প্রমাণের জন্য কেবল খ্যাতি থাকলেই ভালো।

 

✧ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-

أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ

-এ সব লোকেরা কি পৃথিবী পরিভ্রমণ করে না, যাতে তারা, তাদের পূর্বসূরীদের কি পরিণাম হয়েছে, তা’ দেখতে পায়। ’’  ৪২৬

➥426. সূরা রূম, আয়াত নং-৯।


এ আয়াতে মক্কার কাফিরদেরকে আগের দিনের কাফিরদের স্মৃতিচিহ্ন ও ওদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বস্তুসমূহ দেখার জন্য আগ্রহান্বিত করা হয়েছে, যাতে তারা নাফরমানদের পরিণতি দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে। এখন কথা হলো এটা কি ভাবে চিহ্নিত করা হলো যে, অমুক জায়গা অমুক সম্প্রদায় আবাদ করেছিল? কুরআন শরীফও এ ব্যাপারে নীরব। কেবল প্রসিদ্ধির ভিত্তিতে তা মেনে নেয়া হয়েছে। তাই প্রতীয়মান হলো যে, কুরআন শরীফেও সেই প্রসিদ্ধিকে মেনে নিয়েছেন। 


✧ শেফা শরীফে বর্ণিত আছে-

وَمِنْ إِعْظَامِهِ وَإِكْبَارِهِ إِعْظَامُ جَمِيعِ أَسْبَابِهِ، وَإِكْرَامُ مَشَاهِدِهِ وَأَمْكِنَتِهِ مِنْ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ، وَمَعَاهِدِهِ . وَمَا لَمَسَهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْ عُرِفَ به

এটাও হুযুর (ﷺ) মান সম্মানের অর্ন্তভূক্ত যে হুযুরের আসবাবপত্র, তাঁর বাসস্থান সমূহ, তাঁর পবিত্র শরীরের সাথে যা স্পর্শিত হয়েছে এবং যেটা সম্পর্কে হুযুর (ﷺ) এর বলে খ্যাতি আছে ওসবের যেন সম্মান করা হয়।’’  ৪২৭

➥427. ইমাম কাযি আয়াজ, শিফা শরীফ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২৬, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।


✧ শরহে শেফা শরীফে মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) উপরোক্ত ইবারতের প্রেক্ষাপটে বলেন-

وَالْمُرَادُ جَمِيْعُ مَا يَنْسِب إِلَيْهِ وَيُعْرَفُ بِهِ ﷺ

এর ভাবার্থ হচ্ছে, যে জিনিস হুযুর (ﷺ) এর বলে দাবী করা হয় এবং প্রসিদ্ধি লাভ করে, সেটার সম্মান করা চাই।’’  ৪২৮

➥428. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে শিফা, ২/৯৮ পৃষ্ঠা


✧ মৌলানা আবদুল হাকীম সাহেব লক্ষ্ণৌভী, স্বীয় রচিত কিতাব নুরুল ঈমানে শেফা শরীফের এ ইবারতটা উদ্ধৃত করে وَيُعْرَفُ بِهِ প্রসঙ্গে টীকা লিখেছেন-

اى ولو كان على وجه الاشتهار من غير ثبوت اخبار فى اثاره كذا قال على القارى

-যদিওবা এ দাবীটা কেবল প্রসিদ্ধির ভিত্তিতে হয়ে থাকে এবং হাদীছ দ্বারা এটা প্রমাণিত না হয়। মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) অনুরূপ বলেছেন।  তিনি তাঁর কিতাব مسلك متقسط এ একই বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। এ রকম উলামায়ে উম্মত আহকামে হজ্ব প্রসঙ্গে যে সব গ্রন্থাদি প্রকাশ করেছেন, সে সব গ্রন্থে যিয়ারত কারীদের উপদেশ দেয়া হয়েছে হেরমাইন শরীফাইনের ও সব জায়গা যেন যিয়ারত করে, সেগুলোকে সাধারণ লোকেরা ইযযত-সম্মান করে। 


আশ্চর্যের বিষয়! ফকীহগণ ফযায়েলে আমালের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীছকেও গ্রহণযোগ্য মনে করেন। আর এরা পবিত্র বস্তুর প্রমাণের জন্য বুখারী শরীফের হাদীছ দাবী করেন।

عاشقاں رچه كار باتحقيق- هركجا نام او ست قربانيم

-অর্থাৎ প্রেমিকেরা এত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরওয়া করে না; যেখানেই আপন মাহবুবের নাম পাবে, সেখানে নিজকে উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করে না।

   

একটি ঘটনাঃ 


আমি একবার ১২ই রবিউল আওয়াল শরীফে কাথিয়া ওয়ার্ডের নগীনা মসজিদে ওয়াজ করতে গিয়েছিলাম। ঐ দিন সেই মসজিদে হুযুর পাকের চুল মুবারক দেখানো হচ্ছিল। মুসলমানেরা যিয়ারত করতে ছিল ও দরূদ শরীফ পড়তে ছিল। কেউ কেউ কান্নাকাটিও করছিল। আবার কেউ মুনাজাতরত ছিল। মোট কথা একটা মনোরম পরিবেশ বিরাজমান ছিল। কিন্তু মসজিদের এক কোণায় এক ব্যক্তি মুখ বিকৃতি করে দাঁড়িয়েছিল, তার চেহারাটা যেন অর্ধাঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, জনাব, আপনি এত মর্মাহত কেন? তিনি বললেন, মসজিদে শিরক হচ্ছে; এ চুল যে হুযুর (ﷺ) এর এর কোন প্রমাণ আছে কি? আর হুযুরের হলেও এ সম্মানের কি কোন প্রমাণ আছে? আমি এর জবাব দিলাম না। বরং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নাম কি? বললেন- আবদুর রহমান। বাপের নাম জিজ্ঞাসা করলাম, বললেন-আবদুর রহীম। এবার আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম-আপনি যে আবদুল রহীমের ছেলে, এর প্রমাণ কি? একেতঃ আপনার কাছে এর কোন সাক্ষী নেই আর থাকলেও তা বিবাহের আকদের কিন্তু আপনি যে আপনার পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছেন, এর প্রমাণ কি? তখন তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন-

জনাব, মুসলমানেরা তো বলে যে, আমি ওনার ছেলে আর মুসলমানদের সাক্ষ্য গ্রহণ যোগ্য। তখন আমি বললাম, জনাব, মুসলমানেরা বলে যে এটা হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র চুল মোবারক, আর মুসলমানদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। এবার তিনি লজ্জিত হলেন এবং বললেন, এটা অন্য কথা। জিজ্ঞাসা করলাম কোথাকার শিক্ষাপ্রাপ্ত? বললেন, দেওবন্দের। বললাম- আর কি জিজ্ঞাসা করবো, আপনি তো রেজিস্ট্রিকৃত। মৌলানা কুতুবউদ্দিন ব্রাক্ষাচারী (কুঃ)র কাছে এক দেওবন্দী বলেছিলেন-হুযুর (ﷺ) কে হুযুর বলা বিদআত, নাম নেয়াটাই উচিৎ। কেননা হুযুর বলাটা কোথাও প্রমাণিত নেই। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘চুপ থাকো, বোকারাম।’ ওনি বললেন, এটা কি ধরনের ব্যবহার? তিনি বললেন, আপনাকে ‘জনাব’ বা ‘আপনি’ বলা বিদআত। কারণ এর কোন প্রমাণ নেই। আমার ধারণা হচ্ছে কিয়ামতের দিন দেওবন্দীদের খুবই খারাপ লাগবে, যখন হুযুরে পাক মকামে মাহমুদে তশরীফ রাখবেন এবং তাঁর শান সমগ্র জগতে প্রকাশ পাবে। হে আল্লাহ, আমাদেরকে নবীজীর শাফাআত দান করুন।

آج لے ان كى پناه اج مدد مانگ ان سے

پهر نه مانيں كے قيامت ميں اگر مان گيا

অর্থাৎ আজই তাঁর (ﷺ) আশ্রয় প্রার্থনা কর, তাঁর সাহায্য কামনা কর। কিন্তু কিয়ামতের দিন শত কান্নাকাটি করলেও কোন কাজ হবে না।

   

৪ নং আপত্তিঃ 


নালাইন শরীফের (পাদুকাদ্বয়) নকশা আসল নালাইন নয়। এটা হচ্ছে রংতুলি দ্বারা তৈরী ফটো। এটাকে কেন সম্মান করা হয়?

উত্তরঃ এটা আসল নালাইন শরীফের অনুকরণ এবং এর কাহিনী রয়েছে। কাহিনীরও সম্মান করা উচিৎ। লাহোরের ছাপানো কুরআন শরীফ, এর কাগজ কালি আসমান থেকে নাযিল হয়নি, আমাদেরই তৈরী। কিন্তু একে অবশ্যই তাযিম করতে হবে, কেননা এটা আসলের অনুলিপি। প্রত্যেক রবিউল আউয়াল মাসের প্রত্যেক সোমবার পবিত্র। কারণ এটা হলো আসলের অনুকরণ।

Top