আওলিয়া কিরামের মাযারের উপর গম্বুজ তৈরী করা প্রসঙ্গে আলোচনা
মুসলমানকে দু’শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। সাধারণ মুসলমানগণ এক শ্রেণীভুক্ত এবং উলামা, মাশায়িখ ও আওলিয়া কিরাম, যাদের তাযীম আসলে ইসলামেরই তাযীম, অন্য শ্রেণীভুক্ত।
(১) সাধারণ মুসলমাদের কবরকে পাকা করা বা এর উপর গম্বুজ তৈরী করা যেহেতু অনর্থক, সেহেতু নিষেধ। তবে কবরের নিশানা ঠিক রাখার অভিপ্রায়ে মাটি ইত্যাদি দেয়া ও ফাতিহা ইত্যাদি পাঠ করা জায়েয।
(২) উলামা, মাশায়িখ ও আওলিয়া কিরামের মধ্যে যাদের মাযার সমূহে জনগণের ভীর থাকে এবং লোকেরা ওখানে বসে কুলখানি, ফাতিহা ইত্যাদি পাঠ করে, আগতদের আরামের জন্য এবং ছাহেবে কবরের শান-মান প্রকাশ করার জন্য এবং আশে-পাশে ছায়ার জন্য গম্বুজ ঘর ইত্যাদি তৈরী করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয বরং সুন্নাতে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত।
(৩) যেসব সাধারণ মুসলমাদের কবর সমূহ পাকা করা বা এর উপর গম্বুজ বিশিষ্ট ঘর তৈরী করা নিষেধ, তাদের কবর সমূহ যদি পাকা করে ফেলা হয়, তাহলে এগুলোকে ভেঙ্গে ফেলা হারাম। প্রথম মাসআলা সম্পর্কে সবাই একমত কিন্তু শেষের দু’মাসায়েলা প্রসংগে আপত্তি রয়েছে। এজন্য আমি আলোচ্য বিষয়টাকে দু’টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছি। প্রথম অধ্যায়ে এর সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ প্রসংগে উত্থাপিত আপত্তি সমূহের জবাব দেয়া হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়
আওলিয়া কিরামের মাযারের উপর ইমারতের প্রমাণ
এখানে তিনটি বিষয় জানার আছে- এক: কবর পাকা করা; দুই: কবরকে সুন্নাত পরিমাণ থেকে অর্থাৎ এক হাত থেকে বেশী উঁচু করা; তিন: কবরের আশে-পাশে ইমারত তৈরী করা জায়েয কিনা? আবার কবর পাকা করার দুটি রূপ রয়েছে। একটি হচ্ছে রের অভ্যান্তরিন অংশ পাকা করা, যা লাশের সাথে জড়িত থাকে, অপরটি হচ্ছে কবরের উপরাংশ পাকা করা, যা কবরের উপরে দেখা যায়।
(১) কবরের অভ্যান্তরিন অংশ পোড়া উট দ্বারা পাকা করা এবং ওখানে লাকড়ী স্থাপন করা নিষেধ। তবে পাথর ও সিমেন্ট ব্যবহার করা জায়েয আছে। কেননা লাকটি ও ইটের মধ্যে আগুনের প্রভঅব রয়েছে। কবরের বহিরাংশ সাধারণ মুসলমাদের বেলায় পাকা করা নিষেধ। কিন্তু বিশেষ বিশেষ উলামা ও মাশায়িখের জন্য জায়েয।
(২) কবরের চৌহদ্দী একহাত থেকে বেশী উঁচু করা নিষেধ। তবে যদি আশে-পাশে উঁচু করে কবরকে একহাত পরিমাণ উঁচু করা জায়েয।
(৩) কবরের আশে-পাশে বা কবরের সন্নিকটে কোন ইমারত তৈরী করা সাধারণ মুসলমানদের কবরের ক্ষেত্রে নিষেধ। কিন্তু ফকীহ ও আলিমগণের কবরের বেলায় জায়েয। এর দলীল সমূহ নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ-
(১) মিশকাত শরীফের কিতাবুল জানায়েযের الدفن শীর্ষক অধ্যায়ে আবু দাউদ শরীফের বরাত দিয়ে বর্ণিত আছে- হযরত উছমান ইবনে মযউন (رضي الله عنه) কে যখন দাফন করা হয়, তখন হুযুর আলাইহিস সালাম তাঁর কবরের শিয়রে একটি পাথর রাখলেন এবং ইরশাদ ফরমান-
أُعَلِّمُ بِهَا قَبْرَ أَخِي وَأَدْفِنُ إِلَيْهِ مَنْ مَاتَ من أَهلِي . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد.
-‘‘আমরা এর দ্বারা নিজের ভাইয়ের কবর সনাক্ত করতে পারবো এবং এখানে স্বীয় আহলে বাইতের লাশ সমূহ দাফন করবো।’’ ১৫৪
➥{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, কিতাবুল জানায়িয, কাফনুল মায়্যিত, ১/৫৩৬ পৃঃ হা/১৭১১, পরিচ্ছেদ:, আলবানী এ হাদিসের তাহকীকে একে ‘হাসান’ বলেছেন, ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ৩/২১২ পৃঃ হা/৩২০৬}
(২) বুখারী শরীফে কিতাবুল জানায়েয بَابُ الجَرِيدِ عَلَى القَبْرِ শীর্ষক অধ্যায়ে অন্য হাদীছের সনদের সাথে যুক্ত করে একটি হাদীচ হযরত খারেজা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন-আমরা হযরত উছমানের যুগে জীবিত ছিলামঃ
وَإِنَّ أَشَدَّنَا وَثْبَةً الَّذِي يَثِبُ قَبْرَ عُثْمَانَ بْنِ مَظْعُونٍ حَتَّى يُجَاوِزَهُ.
-‘‘তখন আমাদের মধ্যে সেই বড় লম্ফদানকারী ছিলেন, যিনি উছমান ইবনে মযউন (رضي الله عنه) এর কবরকে অতিক্রম করতে পারতেন।’’ ১৫৫
➥{ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ২/৯৫ পৃঃ }
কবরের মাথার দিকে পাথর ছিল এবং বুখারী শরীফের রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায় তাঁর কবরের উপরিভাগ ঐ পাথরের দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। উভয় রেওয়ায়েতটা এভাবে একত্রিতকরণ করা যায় যে মিশকাত শরীফে কবরের মাথার দিকে যেই পাথর স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে কবরের উপরই মাথার দিক থেকে এটা স্থাপন করা হয়েছে। বা ভাবার্থ এটাও হতে পারে যে, কবরটা সম্পূর্ণ উক্ত পাথরের ছিল, কিন্তু এ হাদীছে শূধু শিয়রের কথা উলেখিত হয়েছে। এ দু’হাদীচ থেকে এটা প্রমাণিত হলো যে কোন বিশেষ কবরের চিহ্ন বহাল রাখার জন্য যদি কবরকে কিছু উঁচু করে দেয়া হয় বা পাথর দ্বারা পাকা করে দেয়া হয়, তা জায়েয আছে, যেন বুঝতে পারা যায় যে, এটা কোন বুযুর্গের কবর। এর আগে আরও দু’টি মাসআলা জানা গেছে। অধিকন্তু ফকীহগণ বলেন-যদি মাটি নরম হয় এবং লোহা বা কাঠের বাক্সে লাশ দাফন করতে হয়, তাহলে ভিতরের অংশের চারিদিকে মাটির সাথে মিলিয়ে দিন। (ফত্ওয়ায়ে শামী, আলমগীরী ও অন্যান্য কিতাবের دفن الميت অধ্যায় দ্রষ্টব্য।) এর থেকে আরও বোঝা গেল যে, কবরের নিম্ন ভাগ কাঁচা হওয়া চাই। দু’টি মাসায়েলই প্রমাণিত।
(৩) উলামা মাশায়িখ ও আওলিয়া কিরামের মাযারের আশে-পাশে বা এর সন্নিকটে ইমারত তৈরী করা জায়েয। কুরআন করীম, সাহাবায়ে কিরাম ও সাধারণ মুসলমানদের আমল ও উলামায়ে কিরামের উক্তিসমূহ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
❏ কুরআন করীম আসহাবে কাহাফের কাহিনী বর্ণনা প্রসংগে ইরশাদ করেন-
قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا.
‘‘-তিনি বললেন, তাঁরা যে কাজে নিয়োজিত ছিলেন (ইবাদত বন্দেগীতে) তাঁদের সেই স্মৃতির উদ্দেশ্যে মসজিদ নিমার্ণ করা হবে।’’ ১৫৬
➥{সূরা কাহাফ, আয়াত নং-২১}
❏ তাফসীরে রূহুল বায়ানে এ আয়াতের بُنْيَانًا এর ব্যাখ্যা প্রসংগে উলেখিত আছে -
لَا يَعْلَمُ أَحَدٌ تُرْبَتَهُمْ وَتَكُوْنَ مَحْفُوْظَةً مِنْ تَطَرُّقِ النَّاسِ كَمَا حُفِظْتُ تُرْبَةُ رَسُوْلُ اللهِ بِالْحَظِيْرَةِ.
-‘‘তাঁরা প্রস্তাব দিলেন, আসহাবে কাহাফের জন্য এমন একটি প্রাচীর তৈরী করুণ, যা তাদের কবরকে পরিবেষ্টিত করবে এবং তাদের মাযার সমূহ জনগণের আনাগোনা থেকে হিফাজতে থাকবে, যেমন হুযুর আলাইহিস সালামের রওযা পাককে চার দেয়ালের দ্বারা পরিবেষ্টিত করা হয়েছে।’’ ১৫৭
➥{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, ৫/২৩২ পৃঃ দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}
কিন্তু তাদের এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলো, মসজিদই নির্মাণ করা হলো।
❏ উক্ত রূহুল বয়ানে مَسْجِدًا এর তফ্সীর এভাবে করা হয়েছে -
يُصَلِّى فِيْهِ الْمُسْلِمُوْنَ وَيَتَبَرَّكُوْنَ بِمَكَانِهِمْ.
-‘‘জনগণ সেখানে নামায আদায় করবে এবং ওদের থেকে বরকত হাসিল করবে।’’ ১৫৮
➥{টিকাঃ
আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, ৫/২৩২ পৃঃ দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
☞বিখ্যাত তাফসিরকারক ইমাম নাসাফী (رحمة الله) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-
➥{مَّسْجِدًا} يُصَلِّى فِيْهِ الْمُسْلِمُوْنَ وَيَتَبَرَّكُوْنَ بِمَكَانِهِمْ
-‘‘জনগণ সেখানে নামায আদায় করবে এবং ওদের থেকে (মাজার শরীফ থেকে) বরকত হাসিল করবে।’’
(ইমাম নাসাফী, মাদারিকুত তানযিল, ২/২৯৩ পৃঃ , দারুল কালামুল তৈয়্যব, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪১৯ হিঃ)
☞আল্লামা যামাখশারী (رحمة الله) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-
مَّسْجِدًا يُصَلِّى فِيْهِ الْمُسْلِمُوْنَ وَيَتَبَرَّكُوْنَ بِمَكَانِهِمْ
-‘‘মসজিদ এ জন্য বানাবে যে মুসলমানগণ যেন নামায পড়বেন এবং সেখান থেকে (মাজার থেকে) বরকত লাভ করবেন।’’
(তাফসিরে কাশ্শাফ, ২/৭১১ পৃঃ ) বিখ্যাত তাফসিরকারক আল্লামা নিযামুদ্দীন নিশাপুরী (ওফাত. ৮৫০ হিঃ)
☞তার এ আয়াতের তাফসিরে লিখেন-
لأِنَّهُمْ بنوا عَلَيْهِمْ مَّسْجِدًا يُصَلِّى فِيْهِ الْمُسْلِمُوْنَ وَيَتَبَرَّكُوْنَ بِمَكَانِهِمْ
-‘‘আসহাবে কাহাফের নিকটে একটি মসজিদ তৈরী করা হবে যেন নামায পড়তে পারেন এবং সেখান থেকে (মাজার থেকে) বরকত লাভ করতে পারেন।’’ (তাফসিরে নিশাপুরী, ৪/৪১১ পৃঃ , দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)
☞আল্লামা ড. ওহ্হাব বিন মুস্তফা জুহাইলী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-
لنتخذن على باب الكهف مَّسْجِدًا يُصَلِّى فِيْهِ الْمُسْلِمُوْنَ وَيَتَبَرَّكُوْنَ بِمَكَانِهِمْ
-‘‘আসহাবে কাহাফের দরজায় একটি মসজিদ তৈরী করা হবে যেন মুসলমানরা নামায পড়বেন এবং সেখান থেকে তারা (মুসলমানগণ মাজার থেকে) বরকত লাভ করবেন।’’
(জুহাইলী, তাফসিরুল মুনীর, ১৫/২২৬ পৃঃ)}
কুরআন করীম সেসব লোকদের দু’টি বক্তব্য উলেখ করেছেন। এক: আসহাফে কাহাফের আস্তানার আশে পাশে গম্বুজ ও সমাধি তৈরী করার পরামর্শ। দুই: ওদের সন্নিকটে মসজিদ তৈরী করার সিদ্ধান্ত। কুরআন করীম কোনটাকে অস্বীকার করেনি। যার ফলে প্রতীয়মান হলো যে, উভয় কাজটা তখনও জায়েয ছিল এবং এখনও জায়েয আছে। যেমন উসূলের কিতাবসমূহ দ্বারা প্রমাণিত আছে-
شَرَائِعَ قَبْلِنَا يَلْزِمْنَا.
-‘‘আগের যুগের শরীয়ত আমাদের জন্য পালনী।’’
হুযুর আলাইহিস সালামকে হযরত সিদ্দীক (رضي الله عنه) এর কুটিরে দাফন করা হয়। যদি এটা নাজায়েয হতো, তাহলে সাহাবায়ে কিরাম প্রথমে ওটা ভেংগে ফেলতেন, অতঃপর দাফন করতেন; কিন্তু তা করলেন না। হযরত উমর (رضي الله عنه) স্বীয় খিলাফতের যুগে এর চারিদিকে কাঁচা ইটের দেওয়াল তৈরী করে দিয়েছিলেন। অতঃপর ওলিদ ইবনে আবদুল মালিকের যুগে সৈয়্যদেনা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর সকল সাহাবায়ে কিরামের জীবিত থাকা অবস্থায় ঐ ইমারতটাকে খুবই মজবুত করেছেন এবং এতে পাথর স্থাপন করেছেন।
❏ যেমন সৈয়দ সমহুদী (رحمة الله) স্বীয় وفاء الوفاء بأخبار دار المصطفى নামক কিতাবের (২/২১১ পৃষ্ঠায় এবং ২/২৫৫ পৃষ্ঠায়, যা দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন) ১০ম পরিচ্ছেদের ১৯৬ পৃষ্টায় হুযূরা সম্পর্কিত আলোচনায় লিপিবদ্ধ করেছেন -
حَدَّثنا حَمَّادْ بن زيد قال: سَمعت عمرو بن دينار وعبيد الله بن أبي يزيد قَالَا: لَمْ يَكُنْ عَلَى عَهْدِ النَّبِي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى بَيْتِ النَّبِي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَائط، وَكَانَ أَوَّلُ مَنْ بنى عليه جِدَارًا عُمر بن الخطاب رضي الله عنه.
قَال عُبَيْدُ الله بْنِ أَبِي يَزِيْد: كَانَ جِدَارَهُ قَصِيْرًا، ثُمَّ بناه عبد الله بن الزبير الخ...... وَقَالَ السُهَيْلِي: قَالَ الحَسَن البَصْرِي: كُنْتُ أَدْخُلَ بُيُوْتَ رَسُوْلَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا غُلاَمٌ مَرَاهِقُ وَأَنَالَ السَّقْفِ بِيَدِي، وَكَانَ لِكُلِّ بَيْتِ حَجَرَةٌ، وَكَانَتْ حَجَرَة مِنَ أكَسية مِنْ خُشُبٍ عَرْعَرَ.
(উপরের বক্তব্যটাই এর অনুবাদ) বুখারী শরীফের প্রথম খন্ড কিতাবুল জানায়েযের-
بَابُ مَا جَاءَ فِي قَبْرِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَأَبِي بَكْرٍ، وَعُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا.
শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত ওরওয়াহ (رحمة الله) হতে বর্ণিত আছে, ওলীদ ইবনে আবদুল মালিকের যুগে রাসূল (ﷺ) এর রওযা পাকের একটি দেওয়াল ধসে পড়ে গিয়েছিল। যখন أَخَذُوا فِي بِنَائِهِ সাহাবায়ে কিরাম একে মেরামত করার কাজে নিয়োজিত হলেন।
فَبَدَتْ لَهُمْ قَدَمٌ، فَفَزِعُوا وَظَنُّوا أَنَّهَا قَدَمُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
-‘‘তখন একটি পা দৃষ্টিগোচর হলো। এতে তাঁরা ঘাবড়ে গেলেন এবং মনে করলেন এটা হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র কদম মোবারক।’’
حَتَّى قَالَ لَهُمْ عُرْوَةُ: لاَ وَاللَّهِ مَا هِيَ قَدَمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا هِيَ إِلَّا قَدَمُ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ.
শেষ পর্যন্ত হযরত ওরওয়াহ (رضي الله عنه) বললেন, খোদার কসম, এটা হুযুর আলাইহিস সালামের কদম নয়, এটা হযরত ফারুকের (رضي الله عنه) কদম।’’ ১৫৯
➥{ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুল জানাইয, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৩, হাদিস/১৩৯০)}
‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ গ্রন্থে শেখ আবদুল হক (رحمة الله) লিপিবদ্ধ করেছেন যে, ৫৫০ হিজরীতে জামাল উদ্দিন ইষ্ফাহানী তথাকার উলামায়ে কিরামের উপস্থিতিতে দেয়ালের চারিদিকে চন্দন কাঠের জালী তৈরী করে দিয়েছিলেন এবং ৫৫৭ হিজরীতে কয়েকজন ঈসায়ী ধার্মিকের ছদ্মবেশে মদীনা শরীফ এসেছিল এবং সুড়ংগ খনন করে লাশ মুবারক বের করে নিতে চেয়েছিল। হুযুর আলাইহিস সালাম তৎকালীন বাদশাহকে তিনবার স্বপ্ন দেখালেন। অতঃপর বাদশাহ তাদেরকে কতল করার নির্দেশ দিলেন এবং রওযা পাকের চারিদিকে পানির স্তর পর্যন্ত ভিত্তি খনন করে সীসা ঢেলে একে ভরাট করে দিয়েছিলেন। আবার ৬৭৮ হিজরীতে সুলতান কালাউন সালেহী সবুজ গম্বুজটা, যা এখনও মওজুদ আছে, তৈরী করেছিলেন।
উপরোক্ত ভাষ্য থেকে এটা বোঝা গেল যে, পবিত্র রওযা মুবারত সাহাবায়ে কিরাম তৈরী করেছিলেন। যদি কেউ বলে, এটাতো হুযুর আলাইহিস সালামের বিশেষত্ব, এর উত্তরে বলা যাবে, এ রওযা শরীফে হযরত সিদ্দীক (رضي الله عنه) ও হযরত উমর (رضي الله عنه) কেউ দাফন করা হয়েছিল এবং হযরত ঈসা (عليه السلام) কেউ দাফন করা হবে। সুতরাং এটা হুযুর আলাইহিস সালামের বৈশিষ্ট বলা যায় না।
❏ বুখারী শরীফের প্রথম খন্ডে কিতাবুল জানায়েয এবং মিশকাত শরীফের الْبكاء على الْمَيِّت শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, যখন ইমাম হাসান ইবনে আলী (رضي الله عنه) ইন্তিকাল করেছিলেন-
ضَرَبَتِ امْرَأَتُهُ القُبَّةَ عَلَى قَبْرِهِ سَنَةً.
-‘‘তখন তাঁর স্ত্রী তাঁর কবরের উপর এক বছর পর্যন্ত গম্বুজ বিশিষ্ট্য ঘর তৈরী করে রেখেছিলেন।’’ ১৬০
➥{ইমাম খতিব তিবরিযি, মিশকাত, হা/১৭৪৯, ১/৫৪৮ পৃঃ ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ২/৮৮ পৃঃ পরিচ্ছেদ: بَابُ مَا يُكْرَهُ مِنَ اتِّخَاذِ المَسَاجِدِ عَلَى القُبُورِ}
এটাও সাহাবায়ে কিরামের যুগে সবার বর্তমানে হয়েছিল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেননি। অধিকšতৃ তাঁর স্ত্রী ওখানে কেবছর পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন, অতঃপর ঘরে ফিরে আসেন। এ হাদীছ থেকে বুর্যুগানে কিরামের মাযার সমূহের কাছে খাদিমের অবস্থান করাটাও প্রমাণিত হলো।
এ পর্যন্ত কুরআন হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত করা হলো। এবার ফকীহ, মুহাদ্দীছ, তাফসীরকারীগণের উক্তি সমূহ প্রত্যক্ষ করুন।
❏ রূহুল বয়ানের তৃতীয় খন্ডে দশম পারায় সূরা তাওবা এর ১৮ নং আয়াত-
إِنَّما يَعْمُرُ مَساجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ
এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন-
فَبَنَاءُ القُبَابٍ عَلَى قُبُوْرِ العُلَمَاءِ وَالْأَوْلِيَاءِ وَالصَّلِحَاءِ ......اَمَرٌ جَائِزٌ إِذَا كَانَ القَصْدُ بِذَلِكَ التَّعْظِيْمُ فِى أَعْينِ العَامَّةِ حَتَّى لَا يَحْتَقِرُوْا صَاحِبَ هَذَا الْقَبْرِ.
-‘‘উলামা, আউলিয়া ও বুযুর্গাণে কিরামের কবরের উপর ইমারত তৈরী করা জায়েয। যদি মানুষের মনে শ্রেষ্টতম ধারণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে; যাতে লোকেরা ঐ কবরবাসীকে নগণ্য মনে না করে।’’
➥{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪০০।}
❏ মিরকাত শরহে মিশকাতের কিতাবুল জ্নায়েয بَابُ دَفْنِ الْمَيِّتِ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وَقَدْ أَبَاحَ السَّلَفُ الْبِنَاءَ عَلَى قَبْرِ الْمَشَايِخِ وَالْعُلَمَاءِ وَالْمَشْهُورِينَ لِيَزُورَهُمُ النَّاسُ، وَيَسْتَرِيحُوا بِالْجُلُوسِ فِيهِ.
-‘‘পূর্বসূরী আলিমগণ, মাশায়িখ ও উলামায়ে কিরামের কবর সমূহের উপর ইমারত তৈরী করা জায়েয বলেছেন, যাতে লোকেরা যিয়ারত করে এবং ওখানে বসে আরাম পায় ’’ ১৬২
➥{আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১২১৭, হাদিস/১৬৯৭ এর আলোচনা।}
❏ শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী ‘শরহে সফরুস সা’আদত কিতাবে উলেখ করেছেন -
در آخر زمان بجهت اقتصار نظر عوام برظاهر مصلحت در تعمير وترويج مشاهد ومقاهر مشائخ وعظماء ديده چيزها افزوز ندتا انجا هيبت وشوكت اهل اسلام واهل اصلاح پيدا آيد خصوصا درديار هند كه اعدائے دين از هنود وكفار بسيار اند. وترويج واعلاء شان ايں مقامات باعث رعب وانقياد ايشاں است وبسيار اعمال وافعال واوضاع كه درزمان سلف از مكروهات بوده اندر رآخر زمان از مستحسنات گشته.
-‘‘শেষ জামানায় সাধারণ মানুষ যখন বাহ্যিক বেশভূষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেল, তখন মাশায়িখ ও বুর্যুগানে কিরামের কবর সমূহের উপর ইমারত তৈরী করার প্রতি বিশেষ অভিপ্রায় জোর দেয়া হয়, যেন মুসলমান ও আওলিয়া কিরামের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পায়। বিশেষ করে হিন্দুস্থানে, যেথায় হিন্দু, কাপির ও অনেক শত্রর অবস্থান, তথায় পুণ্যাত্মা মনীষীদের শান-মান প্রকাশ, সেসব কাফিরদের মনে ভীতি ও আনুগত্য সৃষ্টির সহায়ক। অনেক কাজ আগের যুগে মাকরূহ ছিল কিন্তু শেষ জামানায় মুস্তাহাবে রূপান্তরিত হয়ে যায়।’’ ১৬৩
➥{শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, সাফরুস সা’আদত যিয়ারাতুল কুবুর পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা-২৭২, নূরীয়া রেযভীয়া, দিদিল্লী, ভারত।}
❏ ফতওয়ায়ে শামীর প্রথম খন্ড دَفْنِ الْمَيِّتِ অধ্যায়ে লিখা আছে
وَفِي الْأَحْكَامِ عَنْ جَامِعِ الْفَتَاوَى: وَقِيلَ لَا يُكْرَهُ الْبِنَاءُ إذَا كَانَ الْمَيِّتُ مِنْ الْمَشَايِخِ وَالْعُلَمَاءِ وَالسَّادَاتِ.
-‘‘যদি মৃতব্যক্তি মাশায়িখ, উলামা বা সৈয়দ বংশ থেকে কেউ হয়ে থাকেন, তাঁর কবরের উপর ইমারত তৈরী করা মাকরূহ নয়।’’ ১৬৪
➥{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, কিতাবুয-জানাইয, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৭, দাফনুল মায়্যিত।}
❏ সেই একই অধ্যায়ে দুর্রুল মুখতারে উলেখিত আছে -
لَا يَرْفَعُ عَلَيْهِ بِنَاءٌ. وَقِيلَ: لَا بَأْسَ بِهِ، وَهُوَ الْمُخْتَارُ.
-‘‘কবরের উপর ইমারত তৈরী করা অনুচিত। কেউ কেউ বলেছেন, এতে কোন ক্ষতি নেই। এবং এ অভিমতটাই পছন্দনীয়।’’ ১৬৫
➥{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, কিতাবুয-জানাইয, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৭, দাফনুল মায়্যিত।}
কতেক লোক মনে বলেন যে, শামী ও দুর্রুল মুখতারের ইমারতের বৈধতার কথাটা যেহেতু শব্দ قِيلَ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন, সেহেতু এ অভিমতটা দুর্বল। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ফিকাহ শাস্ত্রে قِيلَ শব্দ ব্যবহারটা দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং কোন কোন স্থানে একটি মাসআলার জন্য দু’টি মতামত ব্যক্ত করা হলে উভয় মতামতই قِيلَ শব্দ দ্বারা অর্থাৎ পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায়। তবে হ্যাঁ, যক্তি বিদ্যায় قِيلَ শব্দটা দুর্বলতার নিদর্শন। কবরে আযান শীর্ষক আলোচনায় قِيلَ শব্দের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে।
❏ ‘তাহতাবী মারাকিল ফালাহ’ গ্রন্থের ৬১১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে-
وَقَدْ اِعْتَادَ أَهْل مِصْرِ وَضَعَ الأَحْجَارِ حِفْظًا لِلْقَبُوْرِ عَنْ الإِنْدَارَسِ وَالنَّبْشِ وَلَا بَأَسَ بِهِ وِفِي الدُّرَر وَلَا يُجَصَّصَ وَلَا يَطَيْنَ وَلَا يَرْفَعُ عَلَيْهِ بِنَاءَ وَقِيْلَ لَا بَأَسَ بِهِ هُوَ المُخْتَارُ.
-‘‘মিসরের লোকেরা কবর সমূহের উপর পাথর স্থাপন করে, যাতে বিলীন বা উচ্ছেদ হয়ে না যায় এবং কবরকে যেন পলেস্তারা করতে না পারে আর যেন কবরের উপর ইমারত তৈরী করতে না পারে। কেউ কেউ এগুলোকে জায়য বলেন এবং এটাই গ্রহণযোগ্য।’’ ১৬৬
➥{ইমাম তাহতাভী, তাহতাভী আ’লা মারাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা-৬১১, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}
❏ ‘মীযানুল কুবরা’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডের শেষে কিতাবুল জানায়েযে ইমাম শারানী (رحمة الله) বলেন-
وَمِنْ ذَالِكَ قَوْلُ الاَئِمَّةَ اَنَّ القَبْرَ لَايَبْنٰى وَلَا يُجَصَّصُ مَعَ قَوْلِ اَبِى حَنِيْفَةَ يَجُوْزَ ذَالِكَ قَالَ الاَوَّلُ مُشَدَّدُ وَالثَّانِى مَخَفَّف .
-‘‘অন্যান্য ইমামগণের মতামত হচ্ছে, কবরের উপর ইমারত তৈরী করা এবং একে চুন দিয়ে আলাপন করা যাবে না। তা সত্তে¡ও ইমাম আবু হানীফার বক্তব্য হচ্ছে এসব জায়েয। সুতরাং প্রথম উক্তিতে কঠোরতা এবং দ্বিতীয় উক্তিতে নমনীয়কা প্রকাশ পায়।’’ ১৬৭
➥{ইমাম আব্দুল ওহহাব শা’রানী, মিযানুল কোবরা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫৩।}
এখনতো আর কিছু বলার নেই। স্বয়ং মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম আবু হানীফার অভিমত পাওয়া গেল যে, কবরের উপর গম্বুজবিশিষ্ট ইমারত ইত্যাদি তৈরী করা জায়েয।
আল্লাহর শুকর, কুরআন হাদীস ও ফিকাহের বিভিন্ন ইবারত এমন কি স্বয়ং ইমাম আবু হানীফার উক্তি থেকে প্রমাণিত হলো যে আওলিয়া কিরামের কবরের উপর গম্বুজ ইত্যাদি তৈরী করা জায়েয। বিবেকও বলে যে এটা জায়েয। কারণ
প্রথমতঃ এটা লক্ষ্য করা গেছে যে, সাধারণ কাঁচা কবরের প্রতি জনগণের মনে তেমন কোন আদব বা সম্মানবোধ থাকে না, তাতে না ফাতিহা পাঠ করা হয়, না শ্রোদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় বরং জনগণ একে পদদলিত করে। কিন্তু যদি কোন পাকা কবর সামনে পড়ে এবং এর উপর গিলাফ ইত্যাদি চড়ানো দেখে, মনে করে যে এটা কোন বুযুর্গের মাযার হবে। তখন সসম্মানে একে অতিক্রম করে এবং আপনা থেকে মুখে ফাতিহা পাঠ এসে যায়। মিশকাত শরীফের الدفن অধ্যায়ে এবং মিরকাতে উলেখিত আছে জীবিত কালে এবং মৃত্যুর পর একই রকম সম্মান করা উচিৎ। অনুরূপ ফত্ওয়ায়ে আলমগীরীর কিতাবুল কারাহিয়াত এবং আশআতুল লুমআত গ্রন্থের الدفن অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, মা-বাপের কবরকে চুমা দেয়া জায়েয। ফকীহগণ আরও বলেন যে, কবর থেকে এতটুকু দুরত্বে বসবেন, যে পরিমাণ দুরুত্বে কবরস্থ ব্যক্তির সামনে জীবিত অবস্থায় বসতেন। এর থেকে বোঝা গেল মৃত ব্যক্তি তার জীবিত থাকাকালীন সম্মানের সমঅধিকারী। ইহজগতে আল্লাহর ওলীগণ বাদ্যতামূলক সম্মানের অধিকারী ছিলেন। সুতরাং মৃত্যুর পরও তাঁরা সম্মানের অধিকারী। কবরের উপর ইমারত তৈরী করা হচ্ছে সেই সম্মান প্রকাশের মাধ্যম বিশেষ। তাই তাকে কমপক্ষে মুস্তাহাব ধরে নেয়া যায়।
দ্বিতীয়তঃ সমস্ত ইমারত সমূহের মধ্যে সরকারী ভবন বা মসজিদসমূহ হচ্ছে বিশেষ খ্যাত। যাতে লোকেরা অনায়াসে সেগুলোকে খুঁজে বের করে উপকৃত হতে পারে। উলঅমায়ে কিরামের বেশভূষা ও পোষাক-পরিচ্ছেদ জ্ঞানী সুলভ হওয়া চাই। যেন লোকেরা তাদেরকে সনাক্ত করে মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে পারেন। অনুরূপ মাশায়িখ ও উলামায়ে কিরামের কবর সমূহ অন্যান্যদের কবর থেকে উন্নততর হওয়া চাই, যেন লোকেরা সনাক্ত করে ফয়েজ হাসিল করতে পারেন।
তৃতীয়তঃ আল্লাহর ওলীগণের মাযার আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ, যেমন আমি ইতিপূর্বে তফসীরে রুহুল বয়ানের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছি যে, আল্লাহর নিদর্শন সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন প্রয়োজন, যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং কবরসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন উচিৎ। সম্মান প্রদর্শন স্থান ও কাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। যে কোন প্রকারের সম্মান প্রদর্শন, যদি তা ইসলাম বিরোধী না হয়, জায়েয। হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র যুগে হাড় ও চামড়ার উপর কুরআন লিখা হতো, মসজিদে নববী ছিল কাঁচা এবং এর ছাউনি ছিল খেজুর পাতার, যেখানে বৃষ্টির সময় পানি টপকিয়ে পড়তো। কিন্তু পরবর্তী যুগে মসজিদে নববীকে খুবই শানদার করে এবং রওযা পাককে একান্ত যত্ম সহকারে তৈরী করা হয়েছে। কুরআন শরীফকে উন্নতমানের কাগজ দ্বারা ছাপানো হয়েছে।
❏ দুররুল মুখতারে কিতাবুল কারাহিয়ায় البيع শীর্ষক পরিচ্ছেদে উলেখিত আছে -১৬৮
➥{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮৬।}
جَازَ (تَحْلِيَةُ الْمُصْحَفِ) لِمَا فِيهِ مِنْ تَعْظِيمِهِ كَمَا فِي نَقْشِ الْمَسْجِدِ.
এ প্রসংগে শামীতে أَيْ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ কুরআন করীমকে সোনা-চান্দি দ্বারা অলংকৃত করা জায়েয। কেননা এতে এর প্রতি সম্মান প্রকাশ পায়, যেমন মসজিদে কারুকার্য করা হয়।’’ ১৬৯
➥{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮৬।}
সাহাবায়ে কিরামের যুগে নিদের্শ ছিল কুরআনকে আয়াত, রুকু এবং ইরাব (যের, পেশ, যবর ইত্যাদি) থেকে মুক্ত রাখুন। কিন্তু পরবর্তী যুগে যখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তখন এসব কাজ বৈধ বরং আবশ্যক হয়ে গেছে।
❏ সেই একই জায়গায় আরও বর্ণিত আছে-
مَا رُوِيَ عَنْ ابْنِ مَسْعُودٍ جَوِّدُوا الْقُرْآنَ كَانَ فِي زَمَنِهِمْ وَكَمْ مِنْ شَيْءٍ يَخْتَلِفُ بِاخْتِلَافِ الزَّمَانِ وَالْمَكَانِ.
-‘‘ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে- ‘কুরআনকে ইরাব ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখুন’। এ আদেশটা তৎকালীন যুগের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু অনেক বিষয় কাল ও স্থানের পরিবর্তনের ফলে পাল্টে যায়।’’ ১৭০
➥170. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮৬।}
একই জায়গায় শামীতে আরও উল্লেখিত আছে কুরআনকে ছোট করে ছাপাবেন না অর্থাৎ ছোট আকারের করবেন না বরং এর কলম মোটা, হরফ বড় এবং আয়াত চিহ্ন স্পষ্ট হওয়া চাই। এ সব নির্দেশ কেন? একমাত্র কুরআনের মর্যাদার জন্যই এসব নিদের্শনাবলী। অনুরূপ প্রথম যুগে কুরআন তিলওয়াত, আযান ও ইমামতির জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া হারাম ছিল, যা হাদীছ ও ফিক্হ শাস্ত্রে বিদ্যমান আছে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রয়োজন বোধে জায়েয করা হয়েছে। হুযুর ﷺ'র যুগে জীবিতদের জন্য পাকা ঘর তৈরী নিষেধ ছিল। জনৈক সাহাবী একটি পাকা ঘর তৈরী করেছিলেন। এতে হুযুর ﷺ নাখোশ হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর সালামের জবাবও দেননি। ওই ঘরটি ভেংগে ফেলার পরই সালামের জবাব দিয়েছেন।
❏ (মিশকাত শরীফের كتاب الرقاق এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দেখুন) একই পরিচ্ছেদে অনত্র বর্ণিত আছে যে হুযুর ﷺ ইরশাদ ফরমান -
وَعَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا لَمْ يُبَارَكْ لِلْعَبْدِ فِي مَالِهِ جَعَلَهُ فِي المَاء والطين.
-সম্পদে না-বরকত হয়, যদি তা ইটের কাজে ব্যয় করে।’’ ১৭১
{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, কিতাবুর রিকাক, তৃতীয় পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা-৪৪৪, হাদিস/৫২০৯, ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, ১৩/২২৭ পৃঃ হা/১০২৩৪}
কিন্তু এ সব নিদের্শ থাকা সত্ত্বেও মুসলমানগণ পরবর্তী যুগে পাকা ঘর তৈরী করেছেন এবং মসজিদও পাকা করেছেন। আশ্চর্যের বিষয়! যারা আল্লাহর ওলীদের কবর সমূহ পাকা করা বা ওগুলোর উপর গম্বুজ বিশিষ্ট ঘর তৈরী করাকে হারাম বলে, তারা নিজেদের ঘর সমূহকে কেন আলিশান ও পাকা করে?
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ.
তারা কি কতেক হাদীছকে বিশ্বাস করে আর কতেককে অস্বীকার করে? ’’ ১৭২
{সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৮৫।}
আল্লাহ তাদেরকে বোধশক্তি দান করুন। চতুর্থতঃ আল্লাহর ওলীগণের কবর সমূহ পাকা হওয়া এবং সেগুলোর উপর ইমারত স্থাপিত হওয়া ইসলাম প্রচারের সহায়ক। আজমীর শরীফ ও অন্যান্য মাযারে দেখা গেছে যে, তথায় মুসলমানদের থেকে বেশী হিন্দু ও কাফিরগণ যাতায়াত করে। আমি এমন অনেক হিন্দু ও রাফেজীকে দেখেছি, যারা খাজা সাহেবের দরবারে শান-শওকত দেখে মুসলমান হয়ে গেছে।
বর্তমান হিন্দুস্থানে কাফিরগণ মুসলমানদের ওই সমস্ত ওয়াক্ফকৃত জায়গাগুলো দখল করে নিচ্ছে, যেগুলোতে কোন নিদর্শন নেই। এভাবে অনেক মসজিদ, খানকা, কবরস্থান নিদর্শন বিহীন হওয়ার কারণে ওদের দখলে চলে গেছে। কবরস্থানের সমস্ত কবর কাঁচা হলে, এ গুলো কিছু দিন পর ভেংগে চুরে সমান হয়ে যায়, এ সুযোগে কাফিরগণ দখল করে নেয়। সুতরাং এখন প্রত্যেক কবরস্থানের কিছু কিছু কবর পাকা হওয়া একান্ত প্রয়োজন। যাতে কবরস্থানের চিহ্ন এবং এর সীমানা জানা থাকে।
আমি নিজ গ্রামে স্বয়ং দেখেছি যে, দু’টি কবরস্থান ভরাট হয়ে গিয়েছিল। একটিতে কেবল দু’তিনটি কবর ছাড়া বাকী সবই কাঁচা কবর ছিল, অপরটির কিছু অংশে পাকা কবর ছিল, গরীব মুসলমানেরা গোপনে এ কবরস্থান দুটি বিক্রি করে দিয়েছিল, যার জন্য মুকাদ্দমা হয়েছিল। প্রথম কবরস্থানটি পাকা কবরগুলো বাদ দিয়ে বাকী অংশ মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কেননা ওটাকে হাকিম নাল জমিন হিসেবে সাব্যস্ত করেছিলেন। দ্বিতীয় কবরস্থানের অর্ধেকাংশে অর্থাৎ যে পর্যন্ত পাকা কবর ছিল, মুসলমানেরা পেয়েছিল, বাকী অংশের যেথায় কাঁচা কবর ছিল এবং সমতল হয়ে গিয়েছিল, কাফিরদের হাতে চলে গেছে। কেননা সেই কবরস্থানের সীমানা পাকা কবরের চিহ্ন দ্বারা নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং বাকী অংশের বিক্রয় সঠিক বলে রায় দেয়া হয়েছিল। এর থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে হিন্দুস্থানে কিছু কবর পাকা করা বিশেষ দরকার। কেননা এটা ওয়াক্ফ বলবৎ রাখার মাদ্যমে বিশেষ, যেমন মসজিদের জন্য মিনার।
১৯৬০ সালের জুলাই মাসে সংবাদপত্র সমূহে এ খবরটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল যে, মৌলভী ইসমাইল সাহেবের পীর সৈয়দ আহমদ সাহেব বেরলভী কবর, যা বালাকোটে অবহেলিত অবস্থায় আছে, মেরামত করা হবে এবং এর উপর গম্বুজ হতে যাচ্ছে। ১৯৬০ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ পাকিস্থানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কায়েদে আযমের কবরের উপর ইমারত তৈরীর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্টানে প্রায় এক লাখ মুসলমান অংশ গ্রহণ করেছিল এবং এ ইমারতের জন্য পচাঁত্তর লাখ টাকা বাজেট করা হয়েছিল। উক্ত অনুষ্টানে দেওবন্দীদের নেতা মৌলভী ইহতেশামুল হক থানবীও বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর বক্তব্য রাওয়াল পিন্ডির দৈনিক জংগ পত্রিকায় ১৯৬০ সালের ১২ ই আগষ্ট প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর বক্তব্যে তিন আনন্দ প্রকাশ করে বলেছিলেন-“অশেষ ধন্যবাদ, আজ বিফ্লবের নায়ক পাকিস্থানের জনকের কবরের উপর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। পাকিস্থানের বিগত সরকারগুলো এ পবিত্র কাজে অনেক অবহেলা করেছেন’। মুসলমানগণ, এরাই সেই দেওবন্দী, যারা এখনও মুসলমানদের কবর সমূহ ভেংগে ফেলার পক্ষপাতি এবং যারা নযদী সরকারকে সাহাবায়ে কিরামের কবর সমূহ ভেংগে ফেলার কারণে তার যোগে মুবারকবাদ জানিয়েছিল। অথচ আজ তারা কায়েদে আযমের কবরের উপর গম্বুজ ইত্যাদি তৈলী করায় অভিনন্দন জানাচ্ছে। তাদের কিতাবী মাযহাব এক ধরনের আর মৌখিক আমলী মাযহাব অন্য ধরনের। তাদের কথা হলো যেদিকে বাতাস সেদিক চলো। যা হোক দেওবন্দীরাও মাযহাবের উপর গম্বুজ তৈরী করার সমর্থন হলো।