বিষয় নং-০৫: পিতা-মাতার দিকে নেক নজরে তাকালে কবুল হজ্জের সাওয়াব:
বর্তমান যুগের অন্যতম আহলে হাদিস নাসিরুদ্দীন আলবানী তার সিললিাতুল আহাদিসুদ্-দ্বঈফাহ গ্রন্থের ৬/২৪২ পৃষ্ঠা হাদিস নং ২৭১৬ ও ১৩/৫৯০ পৃ. হা/৬২৭৩ এ এবং দ্বঈফু মিশকাত এর ৩/১৩৮৩ পৃ. হাদিস নং ৪৯৪৪ এ উক্ত হাদিসটিকে জাল বলে উলেখ করেছে।
প্রথমে উলেখ করা জরুরী মনে করছি যে উক্ত হাদিসটি সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর সুত্রে বর্ণিত। আর তাঁর থেকে তার দু‘জন ছাত্র হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। ইকরামা ও যাহ্হাক, কিন্তু যাহ্হাকের সনদ দ্বঈফ কিন্তু ইকরামার সনদ নয়। অথচ ধোঁকাবাজ আলবানী একটি সনদকে উলেখ করে অন্যটিকে গোপন করেছেন।
প্রথম বর্ণনা:
عَنِ الْحَكَمِ بْنِ أَبَانَ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؓ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ: مَا مِنْ وَلَدٍ بَارٍّ يَنْظُرُ نَظْرَةَ رَحْمَةٍ إِلَّا كَتَبَ اللهُ بِكُلِّ نَظْرَةٍ حَجَّةً مَبْرُورَةً ، قَالُوا: وَإِنْ نَظَرَ كُلَّ يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ؟ قَالَ: نَعَمْ، اللهُ أَكْبَرُ وَأَطْيَبُ
-‘‘হযরত হাকাম ইবনে আবান (رحمة الله) তাবেঈ ইমাম ইকরামা (رضي الله عنه) হতে তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছন, যখন সদাচারী সন্তান নেক দৃষ্টিতে নিজের মাতাপিতার দিকে তাকায়, তখন আল্লাহ্ তা‘য়ালা তার প্রতিটি নেক দৃষ্টির বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি কবুল হজ্জের সাওয়াব লিপিবদ্ধ করেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! সন্তান যদি দৈনিক একশ বার দৃষ্টিপাত করে? রাসূল (ﷺ) বললেন, হ্যাঁ, তাহলেও (দৈনিক একশত হজ্জের সাওয়াব পাওয়া যাবে) আল্লাহ্ অতি মহান ও অতি পবিত্র।’’ ৩০
৩০. বায়হাকী : শুয়াবুল ঈমান : ১০/২৬৫ পৃ. হাদিস:৭৪৭২, অধ্যায়: কিতাবুল র্বিরুল ওয়ালিদাইন, খতিব তিবরিযী : মিশকাতুল মাসাবীহ : ৪/২০৯ পৃষ্ঠা, হা/৪৯৪৪, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাত : ১০/২৪৮ পৃ. হা/৪৯৪৪, শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : আশিয়াতুল লুম‘আত : ৩/১৮৪ পৃ. হা/৪৯৪৪
পর্যালোচনা:
অনেকে আবার উক্ত সনদে থাকা ‘হাকাম ইবনে আবান’ নামক রাবী থাকার কারণে আপত্তি তুলতে পারেন, তাই তার গ্রহণযোগ্যতাও আলোকপাত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভবব করছি।
আল্লামা ইবনে হাজার হাইসামী (رحمة الله) একটি হাদিস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন-
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ، وَفِيهِ الْحَكَمُ بْنُ أَبَانٍ، وَثَّقَهُ النَّسَائِيُّ وَجَمَاعَةٌ، وَضَعَّفَهُ ابْنُ الْمُبَارَكِ، وَبَقِيَّةُ رِجَالِهِ رِجَالُ الصَّحِيحِ.
-‘‘হাদিসটি তাবরানী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন আর উক্ত সনদে ‘হাকাম বিন আবান আল-আদনী’ রয়েছেন, তাকে ইমাম নাসাঈ ও একজামাআ‘ত মুহাদ্দিসে কেরাম সিকাহ বা বিশ্বস্ত বলেছেন, তবে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক তাকে দ্বঈফ বলেছেন, আর এ হাদিসের বাকি সমস্ত রাবী সিকাহ।’’ ৩১
৩১. ইমাম ইবনে হাজার হাইসামী, মাযমাউয-যাওয়াইদ, ৭/৩৩পৃ.হাদিস, ১১০৫১, অধ্যায়, কিতাবুত-তাফাসীর, সূরা বারাআ‘ত।
অন্যত্র ইমাম হায়সামী (رحمة الله) এই রাবী সম্পর্কে বলেন-
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ، وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ غَيْرَ الْحَكَمِ بْنِ أَبَانَ وَهُوَ ثِقَةٌ
-“ইমাম তাবারানী (رحمة الله) ইহা বর্ণনা করেছেন, এর সকল রাবীগণ বিশুদ্ধ তবে ‘হাকাম ইবনে আবান’ ব্যতীত, আর তিনিও বিশ্বস্ত।” (ইমাম হায়সামী: মাজমাউয যাওয়াইদ, হা/১৩৯২৭)
এই রাবী সম্পর্কে ইমাম মিযযী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
قال إسحاق بْن منصور، عَن يحيى بْن مَعِين: ثقة. وكذلك قال النَّسَائي. وَقَال أَبُو زُرْعَة: صالح. وَقَال أَحْمَد بْن عَبد اللَّهِ العجلي: ثقة صاحب سنة.
-“ইসহাক্ব ইবনে মানছুর (رحمة الله) বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) বলেছেন: সে বিশ্বস্ত। অনুরূপ ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) বলেছেন। হযরত আবু যুর‘আ (رحمة الله) বলেছেন: সে নেক বান্দাহ। ইমাম আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আজলী বলেন: বিশ্বস্ত ও ছাহেবে সুন্নাহ।” (ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, ৭/৮৭ পৃ. রাবী নং ১৪২২)
অতএব, এই হাদিস নির্ভরযোগ্য, কারণ বর্ণনাকারী الْحَكَمِ بْنِ أَبَانَ ‘হাকাম ইবনে আবান’ নির্ভরযোগ্য রাবী।
وثَّقه ابن معين، والنسائي.
-“ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) ও ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন।” (ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, ৩৮ পৃ.)
ইমাম মিয্যী (رحمة الله) আরও লিখেন-
وَقَال أَبُو زُرْعَة: صالح.
-“ইমাম আবু যুরাআ (رحمة الله) বলেন: সে গ্রহণযোগ্য।” (ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, ৭/৮৭ পৃ. রাবী নং ১৪২২)
ইমাম মিয্যী (رحمة الله) আরও লিখেন-
وَقَال أَحْمَد بْن عَبد اللَّهِ العجلي: ثقة صاحب سنة.
-“ইমাম আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আজলী (رحمة الله) বলেছেন: সে বিশ্বস্ত ও ছাহেবে সুন্নাহ।” (ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, ৭/৮৭ পৃ. রাবী নং ১৪২২)
وذكره بن حبان في الثقات
-“ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।” (ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, ২/৪২৩ পৃ. রাবী নং ৭৩৬)
وحكى بن خلفون توثيقه عن بن نمير وابن المديني وأحمد بن حنبل
-“ইমাম ইবনে খালিফুন (رحمة الله) তার বিশ্বস্ততার কথা বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে নামির (رحمة الله), ইবনে ইবনে মাদানী (رحمة الله) ও ইমাম আহমদ (رحمة الله) থেকে।” (ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, ২/৪২৩ পৃ. রাবী নং ৭৩৬)
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! প্রমাণিত হলো যে, এ হাদিসটির সনদ সহীহ তাতে কোন সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয় হাদিস:
نَهْشَلُ بْنُ سَعِيدٍ، عَنِ الضَّحَّاكِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ : مَا مِنْ وَلَدٍ بَارٍّ يَنْظُرُ إِلَى وَالِدَتِهِ نَظْرَةَ رَحْمَةٍ إِلَّا كَانَ لَهُ بِكُلِّ نَظْرَةٍ حَجَّةٌ مَبْرُورَةٌ ، قَالُوا: وَإِنْ نَظَرَ إِلَيْهَا كُلَّ يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ؟ قَالَ: نَعَمْ، اللهُ أَكْبَرُ وَأَطْيَبُ
-‘‘নাহশাল বিন সাঈদ ‘বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম যাহ্হাক (رحمة الله) হতে তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, যখন কোন সদাচারী সন্তান রহমতের দৃষ্টিতে নিজের মাতা পিতার দিকে তাকান প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি কবুল হজ্জের সাওয়াব দান করেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন কেউ যদি একশতবার তাকায়? রাসূল (ﷺ) বললেন, তাহলে একশত হজ্জের সাওয়াবই পাবে। আল্লাহ্ মহান ও অতি পবিত্র।’’৩২
৩২. ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান : ১০/২৬৬ পৃ., হা/৭৪৭৫
পর্যালোচনা:
এ হাদিসের সনদটি নিঃসন্দেহে দ্বঈফ তা আমরা স্বীকার করি, কেননা রাবী ‘নাহশাল’ সুপরিচিত দুর্বল রাবি, তবে জাল নয়; কেননা উপরের সহীহ হাদিসটির এটির শাওয়াহেদ হওয়ায় এটিকে শক্তিশালী করেছে।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেন-
وَقَال عَباس الدُّورِيُّ عَنْ يَحْيَى ضعيف
-“আব্বাস দূরী (رحمة الله) ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন: সে দুর্বল রাবী।”
তিনি আরও লিখেন- وقال أبو داود ليس بشيء -
“ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) বলেন: তার হাদিস কিছু নয়।” তিনি আরও লিখেন- وقال الدارقطني وأبو حاتم: ضعيف -“ইমাম দারাকুতনী ও আবি হাতিম (رحمة الله) তাকে দুর্বল বলেছেন।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন-
وقال الجوزجاني غير محمود في حديثه -
“ইমাম যুজাযানী (رحمة الله) বলেন, তার হাদিস প্রশংসিত নয়।”
তিনি আরও লিখেন-
وقال النسائي ليس بثقة -
“ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) বলেছেন: সে বিশ্বস্ত রাবী নয়।”
(ইবনে হাজার আসকালানী, তাহজিবুত তাহজিব, ৭ম খণ্ড, ২৫০ পৃ.)
তাই প্রমাণিত হলো আহলে হাদিস আলবানীর কথা অকাট্য মিথ্যা। আর উক্ত আলোচনার দ্বারা আলবানীর তাহক্বীক ভূয়া বলে প্রমাণিত।