দ্বিতীয় অধ্যায়
মু'জিযা সম্পর্কে
আমাদের নিকট মু'জিযা হলো ঐ জিনিস, যদ্বারা ঐ ব্যক্তির প্রত্যয়ন করা মাকুসদ হয় যে দাবী করে যে, “সে আল্লাহর রাসূল”। এর জন্য কয়েকটি শর্ত আছে ১. মু'জিযা হবে আল্লাহর কাজ; কেননা, সত্যতা প্রতিপাদন তখনই সম্ভব হবে, যখন তাঁর তরফ থেকে তা সম্পাদিত হবে; ২. মু'জিযা হবে আলৌকিক ও অস্বাভাবিক কোন কাজ। কেননা, যে সমস্ত কাজ নিয়ম মাফিক, রুটিন অনুযায়ী সম্পাদিত হয়; যেমন প্রত্যহের সূর্যোদয়, প্রতি বসন্তে ফুলের সমারোহ-এইগুলি সত্যতা প্রতিপাদনের জন্য দলীল নয়, যেমন তুমি নিজেই বুঝতে পার; ৩, মু'জিয়া প্রতিহত করা সম্ভব নয়, কেননা অলৌকিকত্বের মূল স্বরূপ হলো এরূপ ৪. মু'জিযা নুবূওত প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে, যাতে জানা যায় যে, এটাই তার সত্যতা প্রতিপাদনকারী; ৫. মু'জিযা-দাবীর অনুরূপ হতে হবে। বস্তুত কেউ যদি বলে “আমার মু'জিযা হলো, আমি মৃতকে জীবিত করি”। কিন্তু তার থেকে যদি এছাড়া অন্য কোন অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায়, যেমন পাহাড় ঝুলিয়ে রাখা, এমতাবস্থায় এ তার জন্য সত্যতা প্রদানকারী হবে না। কেননা, তাঁর এ প্রত্যয়ন আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পন্ন হয়নি; ৬. মু'জিযার দাবীদার ব্যক্তি যখন মু'জিযা হিসাবে কোন কিছু পেশ করে, তখন তা যেন তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন না করে। যেমন যদি কেউ দাবী করে যে, আমার মু'জিযা হলো : গুইসাপ কথা বলবে। কিন্তু সেই গুইসাপ কথা বলার সময় বললো যে, “সে মিথ্যাবাদী”। তখন তার দাবী সত্য বলে প্রমাণিত হবে না, বরং সে যে মিথ্যাবাদী তা চরমভাবে প্রতিপন্ন হবে কেননা, তার অলৌকিক ক্ষমতা তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করলো ৭. নুবূওতের দাবীর পূর্বে যা সংঘটিত হয় তা মু'জিযা নয়; কেননা, নুবুওয়ত দাবীর পূর্বে তা প্রত্যয়ন করার ব্যাপারটি বোধগম্য নয়। এ কারণে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দোলনায় কথা বলা, শুষ্ক বা মৃত খেজুর গাছ থেকে তাজা খেজুর পতিত হওয়া, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীনা মোবারক বিদীর্ণ করা এবং তাঁর কলব বা আত্মা ধৌত করা, তার উপর মেঘের ছায়াদান করা; পাথর ও টিলায় তাকে সালাম দেওয়া এসব এমনই ব্যাপার, যা তাঁর নুবূওত প্রাপ্তির আগে সংঘটিত হয়। কাজেই এগুলি মু'জিযা নয়; বরং এগুলি কারামত। এমতাবস্থায় এগুলোকে নুবূওতের ভিত্তিমূল বলা যেতে পারে।
পক্ষান্তরে, যে সব মু'জিযা দাবীর পরে অনুষ্ঠিত হয়, অথবা তা এত পরে সংঘটিত হয় যে, তা স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হতে ঐরূপ সময় লাগে; এমতাবস্থায়, এ স্পষ্ট যে, এটি তাঁর সত্যবাদী হওয়ার দলীল। কিন্তু যদি সে মু'জিযা সংঘটিত হতে বেশী সময় লাগে; যেমন-এরূপ বলা যে, আমার মুজিযা হলো, অমুক জিনিস এক মাসের মধ্যে প্রকাশ পাবে, আর তা সেভাবেই সংঘটিত হলো। এমতাবস্থায় সকলে একমত যে, এটিও মু'জিযা এবং তা নুবূওতের জন্য স্পষ্ট দলীল। তবে তা অনুসরণের জন্য কষ্ট দেওয়া যাবে না, যতক্ষণ না সে দাবীকৃত মু'জিযা অনুষ্ঠিত হয়। কেননা, তার জন্য এটি শর্ত যে, সে জানবে তার মু'জিযার ব্যাপারটি। আর সেটি তখন প্রকাশ পেয়ে যাবে, যখন তা সংঘটিত হবে, যার ওয়াদা সে করেছিল।
এখন অবশিষ্ট রইলো, নুবূওতের দাবীদার সত্য হওয়ার উপর মু'জিযার ব্যাপারটি। তার সম্বন্ধে জানতে হবে যে, তাঁর এ ব্যাপারটি কেবল জ্ঞান সম্ভুত নয়, বরং তা বাস্তব। যেমন-কর্মের ব্যাপারটি নির্ভর করে কর্ম-সম্পাদনকারীর উপর। আর কার্যটি কতখানি বাস্তব ও সঠিক তা নির্ভর করে তার উপর যার দ্বারা সেটি সম্পন্ন হয় এবং সে তা জানেও। কেননা, জ্ঞান সম্ভুত দলীল, তার মাদ্লুলের সাথে সম্পৃক্ত। আর এরূপ ধারণা করা সঠিক হবে না যে, এর থেকেও ব্যাপারটি বুঝা যায় না। বস্তুত মু'জিযা এরূপ নয়; কেননা, আসমানের চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া, নক্ষত্ররাজীর কক্ষচ্যুত হওয়া, পাহাড়ের টুকরো-টুকরো হয়ে যাওয়া, দুনিয়ার শেষ জীবনে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া ইত্যাদি এবং এ সময় কোন প্রেরিত পুরুষ থাকবে না। একইভাবে, আওলিয়াদের মাধ্যমে কারামত প্রকাশ পায়। তবে নবীদের জন্য তাঁর নুবূওতের দাবী, তার সত্যবাদিতা প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত জরুরী। কেননা, এ সত্যটি নবীর সত্যবাদী হওয়ার উপর নির্ভরশীল। সাইয়েদ সনদ (রহ.) ‘শরহে মাত্তাকিফে’ এরূপ বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তা'আলা ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা করেন এবং তাঁরই তরফ থেকে তাওফীক আসে। আমি বলবো : চ্যালেঞ্জ এবং মুকাবিলার প্রকাশ্য আহবান, যদিও 'জমহুর' বা অধিকাংশ আলেমের মতে মু'জিযার জন্য শর্ত নয়, তবুও সাধারণভাবে অবস্থার প্রেক্ষিতে যা বুঝা যায় তা হলো : চ্যালেঞ্জ সেই সমস্ত ব্যাপারে করা হয়েছে, যা মু'জিযা হিসাবে সবার জন্য প্রয়োজন এবং তা ব্যতীত সেটি মু'জিযা হতে পারে না। পক্ষান্তরে, এমন বিষয়ের খবর-যা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার সময় সংঘটিত হবে অথবা কিয়ামত কায়েম হওয়ার সময় অনুষ্ঠিত হবে তা মু'জিযার অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা, এসব ব্যাপারে আদৌ কোন চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়নি। প্রকাশ্যতঃ এরূপ না হওয়ার কারণ তো স্পষ্ট। পরোক্ষভাবেও স্পষ্ট যে, সে সময় এমন কেউ-ই অবশিষ্ট থাকবে না, যাকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। এমনিভাবে ঐ সমস্ত কারামত যা আওলিয়াদের মারফত প্রকাশ পায়, তাও মু'জিযা নয়। কেননা, সেখানে না আছে কোন মুকাবিলার আহ্বান, আর না কোন চ্যালেঞ্জ। সুতরাং নুবূওতের দাবীদারের সত্যতার উপর, এই সমস্ত অলৌকিক বিষয়কে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে, মু'জিযার বৈশিষ্ট্য ও প্রাধান্য ক্ষুন্ন হতে পারে না। এটিই তাৎপর্য, অনুধাবন কর। এক্ষণে, যদি তুমি বল যে, নুবূওতের দাবীদারের সত্যতার উপর মু'জিযার প্রাধান্য এজন্যে যে, তা অস্বাভাবিক ও অলৌকিক এবং তাতে মু'জিযার বিশেষ কোন ভূমিকা নেই। এর জবাবে আমি বলবো : ব্যাপারটি সেরূপ নয়, যেরূপ তুমি ধারণা করেছ। বরং মুকাবিলা করতে অপারগ হওয়া এবং অন্যদের তার অনুরূপ কিছু পেশ করার ক্ষমতা না থাকাই-মু'জিযার হাকীকত, বাস্তবতা। এটিই নবূওতের দাবীদারের সত্যতা প্রমাণ করে। সুতরাং জানা গেল যে, নবীর নুবূওতের জন্য মু'জিযা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য বিষয়।
আর এরূপ বলা সংগত হবে না যে, সাইয়েদ সনদ শরীফ ‘শরহে মাত্তাকিফ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, কেবল নকলী দলীল যথেষ্ট নয়, কেননা খবর দাতার সত্যবাদী হওয়াও জরুরী এবং এটা 'আকল' বা জ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর ব্যাপার হলো : মু'জিযা, যা সত্য প্রতিষ্ঠাকারী, যদি এর প্রতি লক্ষ্য করা যায় তবে বুঝা যাবে যে, নবী সত্যবাদী হওয়ার উপর মু'জিযা নির্ভরশীল এবং এটি ‘আকল' বা জ্ঞান সম্মত দলীল। একথাটির অর্থ হলো : সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত মু'জিযার উপরে জ্ঞানের-পর্যায়ে লক্ষ্য করতে হবে, যাতে জানা যায় যে, খবরদাতা অর্থাৎ নবী সত্যবাদী।
একইরূপে বলা যায় যে, নবীর সত্যবাদী হওয়ার উপর মু'জিযা নির্ভরশীল এবং এটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। কেননা, আল্লাহ তাআলার অভ্যাস এই যে, মু'জিযা প্রকাশ হওয়ার পর তিনি সত্যবাদী হওয়ার ইলম্ বা জ্ঞান সৃষ্টি করে দেন। কেননা, মিথ্যাবাদী থেকে মু'জিযা প্রকাশ করা জ্ঞানের দিক থেকেও যদিও সম্ভব, কিন্তু তা আদত বা বাস্তবতার খেলাফ। কেননা যে ব্যক্তি বলে যে, আমি নবী, পরে পাহাড় সাথে নিয়ে আসে এবং লোকদের মাথার উপর তা লটকিয়ে দিয়ে বলে : যদি তোমরা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত কর, তবে তা তোমাদের উপর আপতিত হবে; আর যদি তোমরা আমাকে সত্যবাদী বলে স্বীকার কর, তবে এ তোমাদের থেকে দূরে সরে যাবে। আর লোকেরা যখন তাকে সত্যবাদী বলে ধারণা করে, তখন সে পাহাড় তাদের থেকে দূরে সরে যায়। পক্ষান্তরে, লোকেরা যখন তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে ধারণা করে, তখন সে পাহাড় তাদের নিকটবর্তী হয়। এ থেকে বাহ্যতঃ জানা যায় যে, সে তার দাবীতে সত্যবাদী ছিল। আর বাস্তবতার নিরিখে জানা যায় যে, মিথ্যাবাদী থেকে এ ধরনের ব্যাপার প্রকাশ পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়।
আর লোকেরা এর জন্য একটি উদাহরণ বর্ণনা করেছেন, যেমন-কোন ব্যক্তি যদি অনেক লোকের উপস্থিতিতে এরূপ দাবী করে যে, আমি এই বাদশাহর তরফ থেকে তোমাদের কাছ দূত হিসেবে আগমন করেছি। অতঃপর সে বাদশাহকে বলে : যদি আমি সত্যবাদী হই, তবে আপনি আপনার অভ্যাসের খেলাফ করুন এবং নিজের আসল জায়গা সিংহাসন পরিত্যাগ করে ঐ স্থানে উপবেশন করুন, যেখানে বসতে আপনি অভ্যস্ত নন। তখন বাদশাহ যদি এরূপই করে, তবে ঐ ব্যক্তির বক্তব্য সত্য বলে বাস্তবায়িত হবে এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে কেউ এ ব্যাপারে সন্দিহান হবে না। ব্যাপারটি এমন নয় যে, গায়েব বা অদৃশ্যকে হাযির বা উপস্থিতের উপর ধারণা করা হয়েছে। বস্তুতঃ আমাদের বক্তব্য হলো : মু'জিযা প্রকাশ পাওয়ায়, নবীর সত্যবাদী হওয়া বুঝা যায়।
ব্যাপারটি বোধগম্য করার জন্য আলোচনাটি আরো দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। যেমন-মু'তাযিলা সম্প্রদায় বলে : -মিথ্যাবাদীর দ্বারা মু'জিযা প্রকাশ করতে আল্লাহ তাআলা সক্ষম। কেননা, তিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। কিন্তু এরূপ হওয়া তাঁর হিকমতের দিক দিয়ে সিদ্ধ নয়। কেননা, এমতাবস্থায় তার সত্যবাদী হওয়ার ধারণা সৃষ্টি হয়, যা বিভ্রান্তিকর। তাই, আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে মিথ্যাবাদীর দ্বারা মু'জিযা প্রকাশ পাওয়া আদৌ সংগত নয়।
শায়েখ এবং আমাদের কোন সাথী বলেন : মিথ্যাবাদীর দ্বারা মু'জিযা প্রকাশ করা আদৌ আল্লাহর ইচ্ছা নয়। কেননা, মু'জিযা তো সত্য প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়। কাজেই, সত্যবিরোধী সব কিছুই পরিত্যজ্য। বস্তুতঃ মু'জিযা সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করে দেয়। পক্ষান্তরে, ঐ মু'জিযা-যা মিথ্যাবাদীর দ্বারা প্রকাশ পায় এবং তা সত্য প্রতিষ্ঠিত করে, তখন মিথ্যাবাদী সত্যবাদী হয়ে যাবে এবং তা অসম্ভব। অন্যথায় মু'জিযা ঐ বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, যা তার জন্য একান্ত প্রয়োজন। আর এরূপ হওয়াও অসম্ভব, অবাস্তব।
আর কাযী বলেছেন যে, মু'জিযা প্রকাশ পাওয়াকে নবীর সত্যবাদীতার সাথে সম্পৃক্ত করা কোন জরুরী ব্যাপার নয়; বরং কাজের অস্তিত্ব যেমন কর্মীর অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল, তদ্রুপ ওটি একটি অভ্যাসগত ব্যাপার, যেমন পূর্বে আলোচিত হয়েছে। বস্তুত, আমরা যদি তার আসল স্থান থেকে সরিয়ে আনাকে জায়েয বা বৈধ মনে করি, তবে মু'জিযা যে সত্য নয়-এরূপ ধারণা করা সঠিক হবে। এমতাবস্থায় মিথ্যাবাদী থেকে তা প্রকাশ পাওয়াও বৈধ হবে। এতে কোন জটিলতা বা মতানৈক্য নেই যে, মু'জিযাতে অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ব্যাপারটি প্রকাশ পায়, আর এরূপ হওয়াই উচিত। সুতরাং বলা যায় যে, মিথ্যাবাদী দ্বারা মু'জিযা প্রকাশ পাওয়া বৈধ নয়; কেননা, মিথ্যাবাদীর সত্যবাদী হওয়া আদতেই সম্ভব নয়।
আমি বলতে চাই, যদি আসল জিনিসকে তার আসল অবস্থান থেকে সরিয়ে নেওয়াকে বৈধ মনে করা হয়, তবে মু'জিযাকে-নবীর সত্যবাদী হওয়ার বিশ্বাস থেকে খালি করাও বৈধ। কেননা, তার সত্যতার ইলম বা জ্ঞান মু'জিযার পর প্রকাশ পায়। এমতাবস্থায় সত্যবাদীর পার্থক্য-মিথ্যাবাদী থেকে হতে পারে না; এবং ইছবাতে নুবূওত বা নুবূওতের প্রতিষ্ঠার দরওয়াজা বন্ধ হয়ে যায়। কেননা, এটি প্রতিষ্ঠার জন্য এর উপর বিশ্বাস করতে হয় যে, মু'জিযা প্রকাশের সময়, নবীর সত্যবাদী হওয়ার ‘ইলম’ (বা জ্ঞান) অবশ্যই হাসিল হবে, বরং তা খুবই জরুরী। অন্যথায়, মু'জিযা আর মু'জিযা থাকবে না। কেননা অস্বাভাবিক ও অলৌকিক হওয়ার কারণে একে মু'জিযা বলা হয় এবং তা সত্যবাদীতার উপর নির্ভরশীল।
পক্ষান্তরে, যদি আমরা কেবলমাত্র অস্বাভাবিক ব্যাপারকে বৈধ বলে স্বীকার করি এবং সততা ও সত্যবাদীতাকে অগ্রাহ্য করি; এমতাবস্থায়, ব্যাপারটি 'উমুরে আদিয়া' বা অভ্যাসগত ব্যাপারের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন-আমরা প্রত্যহ পূর্বের আকাশে সূর্যোদয় হতে দেখি এবং পশ্চিমাকাশে অস্ত যেতে দেখি। কাজেই, আসল ও বাস্তব কথা যা আমি বর্ণনা করেছি, তা হলো : আমি অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ব্যাপারকে কেবলমাত্র ‘মু'জিযা' হিসাবে নবীদের জন্য এবং 'কারামত' হিসাবে ওলীদের জন্য জায়েয মনে করি। কেননা, প্রতি যুগে-যুগে এ সংঘটিত হয়েছে, এমনকি এ ‘আদতে-মুসতামাররা' বা 'চলমান-অভ্যাসের' রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ সত্য অস্বীকার করা আদৌ সম্ভব নয়।
এতদ্ব্যতীত অন্যান্য অবস্থায় দেখা যায় যে, ‘আদত' বা অভ্যাস স্বীয় অবস্থার উপর বিদ্যমান থাকে, কোন অবস্থাতেই তা পরিবর্তিত হয় না। তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না এবং তাতে অলৌকিকত্বও কখনও জায়েয বা বৈধ নয়, অন্যথায় এ অবশ্যম্ভাবী হবে যে, ঐ পাহাড়-যাকে আমরা আগে দেখেছি, তা সোনায় পরিণত হয়ে যাওয়া জায়েয বলতে হবে। এভাবে সমুদ্রের পানি-রক্ত বা তেলে পরিণত হওয়া, ঘরের আসবাবপত্র মৃত ‘আলমের রূপ পরিগ্রহ করা জায়েয হয়ে যাবে, অথবা এমনও হওয়া বৈধ মনে করতে হবে যে, বৃদ্ধ ব্যক্তি বাপ-মা ছাড়াই হঠাৎ ভূমিষ্ঠ হয়ে পড়লো।
আর এমন যদি হয়, যার থেকে মু'জিযা বা আলৌকিক ব্যাপার প্রকাশ পায় অথচ সে নুবূওতের দাবীদার নয়, অর্থাৎ নবী নয়; তার দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের কাজে-কর্মে অকল্যাণ ও অমঙ্গল ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায় না; যা কোন গোপন ব্যাপার নয়।
বস্তুত, আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা'আলা যদি মিথ্যাবাদীদের দ্বারা মু'জিযা প্রকাশ করে দেন, তবুও ঐ মু'জিযার দ্বারা সেই ব্যক্তির সত্যবাদী হয়ে যাওয়ার বিশ্বাস-আদৌ সম্ভব নয়। কেননা, মিথ্যাবাদীর সত্যবাদী হয়ে যাওয়া অসম্ভব, অবাস্তব। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর তরফ থেকে মু'জিযা প্রকাশ পাওয়ার উদ্দেশ্য হলো-মিথ্যাবাদীদের প্রত্যয়ন করা। আর মিথ্যাবাদীদের প্রত্যয়ন করা হলো মিথ্যা বলা। যেমন কোরআন মজীদে উল্লেখ আছে :
سُبۡحٰنَهٗ وَتَعَالٰی عَمَّا يَقُوۡلُوۡنَ عُلُوًّا كَبِيۡرًا
অর্থাৎ “আল্লাহ তা'আলা তা থেকে মহান ও পবিত্র, যা তারা বলে”। (১৭: ৪৩) পক্ষান্তরে, যাদু, ভেল্কিভাজী ও তেলেসমাতী তো ঐ পর্যায়ের ব্যাপার যে, কারণ সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষিতে-তার ফল প্রকাশ পায়। অলৌকিকত্বের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে, তারা ভেল্কিবাজী ও তেলেসমাতীর মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ করে, যার সাথে বাস্তবের কোন সম্পর্ক নেই। যেমন বলা যায়-এ হলো ঐ মরীচিকার মত, পিপাসার্ত পথিক যাকে দূর থেকে মনে করে পানি। কিন্তু যখন সে তার কাছে যায়, তখন কিছুই পায় না।