ইছুবাতুন নুবুওতের বিভিন্ন পদ্ধতি 


‘উলামাগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নুবুওতের-প্রমাণ দান করার জন্য কয়েকটি দলীল পেশ করেছেন । 


(১) প্রথম দলীল, যা অধিকাংশ ‘আলেমের নিকট খুবই বিশ্বস্ত ও গ্রহণযােগ্য, তাহলাে : হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুবুওতের দাবী করেন এবং তার হাত থেকে মু'জিযাও প্রকাশিত হয়। প্রথম কথা যা হলাে নুবুওতের দাবি, এতাে বর্ণনা পরস্পরায় গ্রথিত এবং সে বর্ণনা পরস্পরার ধারা এমনই মজবুত সূত্রে গ্রথিত, যা নিজেদের চোখে-দেখার সমতুল্য। কাজেই, এতে অবিশ্বাসের কোন অবকাশ নেই। আর দ্বিতীয় কথা, যা হলাে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুজিযা। আল-কোরআন এজন্যই মু'জিযা যে, তিনি তা দিয়ে চ্যালেঞ্জ (Challenge) পেশ করেন; আর সে চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে কেউ-ই সক্ষম হয়নি। আর সেজন্যে-ই আল-কোরআন মু'জিযা এবং জীবন্ত মু'জিযা, যার মুকাবিলা অদ্যাবধি দুনিয়ার কোন মানুষের পক্ষে করা আজও সম্ভব হয়নি, তা ঐ লাগাতার বর্ণনা পরস্পরা সূত্রের মত, যার মাঝে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। 


আল-কোরআনুল কারীমের মাঝে এমন অসংখ্য আয়াত আছে, যদ্বারা অবিশ্বাসীদেরকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা'আলার এ বাণী : 

فَلۡيَاۡتُوۡا بِحَدِيۡثٍمِّثۡلِهٖ  “তারা যেন এর অনুরূপ কথা নিয়ে আসে। (আল-কোরআন, ৫২:৩৪)


আরো আল্লাহর বানী فَاۡتُوۡا بِعَشۡرِ سُوَرٍمِّثۡلِهٖ مُفۡتَرَيَاتٍ  তােমরা এর (আল-কোরআনের) অনুরূপ দশটি সূরা বানিয়ে আনাে”।(আল-কোরআন, ১১: ১৩) এছাড়া আল্লাহ তা'আলার আরাে ইরশাদ :  فاۡتُوۡا بِسُوۡرَةٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ   তােমরা এর অনুরূপ একখানি সূরা নিয়ে এসাে”। (আল-কোরআন, ২: ২৩)।


আশ্চর্যের ব্যাপার হলাে : এই চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা সে যুগে কেউ করতে সক্ষম হয়নি এবং আজও নয়। কাজেই, আল-কোরআনের এই মুজিযা চ্যালেঞ্জরূপে সর্বযুগে ও সর্বকালে বিদ্যমান। এ ব্যাপারে সংশয়ের বিন্দুমাত্র কোন অবকাশ নেই। কোরআন যে যুগে নাযিল হয় সে যুগে আরবে আরবী সাহিত্যের বড় বড় বিজ্ঞ-জ্ঞানী, গুণী, কবি ও ভাষাবিদ বিদ্যমান ছিল, যারা আল-কোরআনের বিরােধিতার জন্য তাদের জান মাল অকাতরে বিলিয়েও দিয়েছিল; কিন্তু আক্ষেপ! তারা আল-কোরআনের অনুরূপ একটি সূরা তৈরী করে এনে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং একথা অবিসংবাদিতরূপে সত্য যে, তারা যদি ভাষার মুকাবিলার মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম হতাে, তবে তারা এর বিরােধিতার জন্য নিজেদের এবং তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের জান-মাল উৎসর্গ করতাে না, বরং ভাষা দিয়ে এর মুকাবিলা করতাে! আর যদি তারা এ কাজটি করতে সক্ষম হতাে, তবে সে খবরও-নিরবচ্ছিন্ন বর্ণনা পরস্পরা সূত্রে অবশ্যই আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতাে। কাজেই, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারা আল-কোরআনের চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা সে যুগেও করতে পারেনি, যেমন পারছেনা এ যুগেও কেউ এবং তা পারা কোন মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে না (সুবহানাল্লাহ)। 


উপরােক্ত আলােচনার সূত্রে নিঃসন্দেহে এ মন্তব্য করা যায় যে, যার চ্যালেঞ্জ করা হলাে, আর সে চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে কেউ যখন সক্ষম হলাে না কাজেই তা মু'জিযা। এ ব্যাপারটি “মু'জিযার হাকীকাত এবং তার শর্তাবলী” অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে। 


অবশ্য এ বিষয়টির উপর কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে। যেমন-১, এরূপ বলা যেতে পারে যে, হয়তাে এ চ্যালেঞ্জ তাদের কাছে পৌছায়নি, যারা এর মুকাবিলা করতে সক্ষম ছিল; ২. অথবা মু'জিযার দাবীদারের পক্ষ হতে প্রচুর ধন-সম্পদ প্রাপ্তির কারণে তারা তার অনুকূলে সমর্থন দেয় এবং বিরােধিতা পরিহার করার কারণে চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করেনি; অথবা এও কারণ ছিল যে, প্রথমে তারা এটাকে সাধারণ ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং মনে করেছিল যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওতের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে না, পরবর্তীতে তারা তার শান-শওকত ও অসংখ্য, অগণিত ভক্তবৃন্দের ভয়ে শংকিত হয়ে বিরােধিতা পরিহার করে; কিম্বা জীবন যাত্রার স্বচ্ছলতার অভিপ্রায়ে কোরআনের চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করা থেকে বিরত থাকে; ৩, অথবা এও হতে পারে যে, চ্যালেঞ্জের মুকাবেলা করা হয়েছিল, কিন্তু কোনরূপ নিষেধাজ্ঞার কারণে তা প্রকাশ পায়নি, অথবা তা প্রকাশ পেয়েছিল, কিন্তু হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবী ও অনুসারীদের প্রভাব ও দাপটের ফলে তা গােপন রাখা হয়েছিল, এমনকি তার চিহ্ন পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়ে তা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল। 


এসব প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব হলাে তা, যা আগেই দেওয়া হয়েছে। আর কেবল ধারণার দ্বারা কোন বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করা সমীচিন নয়। তবুও উপরােক্ত তিনটি প্রশ্নের জবাব এখানে বিস্তারিতভাবে পেশ করার চেষ্টা করা হলাে : “হয়তাে চ্যালেঞ্জ সে লােকদের কাছে পৌছায়নি, যারা এর জবাব দানে সক্ষম ছিল”। এ বক্তব্যের জবাবে বলা যেতে পারে যে, নুবুওতের দাবীদার যদি এরূপ কিছু নিয়ে আসে, যা তার দাবীর সত্যতা প্রমাণ করে এবং তিনি তা দিয়ে চ্যালেঞ্জও প্রদান করেন, কিন্তু লােকেরা সে চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে অক্ষম হয়; তখন এর দ্বারা যে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তা এই যে, নবী তার নুবুওতের দাবীতে সত্য। আর একে অস্বীকার করা নিছক নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। 


দুই : “প্রথমতঃ লােকেরা এ ব্যাপারটিকে সাধারণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছিল, পরে তারা তাঁর শান-শওকত ও অসংখ্য অগণিত সাহাবীদের ভয়ে শংকিত হয়ে, তার বিরােধিতা করা থেকে বিরত থাকে। এ ধরনের উক্তির জবাবে বলা যেতে পারে যে, সাধারণতঃ দেখা যায় যে, লােকেরা সে ব্যক্তির বিরােধিতায় তৎপর হয়, যে কোন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে একক শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হয়; যদ্বারা তার সমকালীন লােকদের উপর তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া সে লােকদের জান ও মালের ব্যাপারেও হুকুম জারী করতে থাকে। | উল্লেখ্য যে, এ ধরনের ব্যাপারে কোন ব্যক্তি এ রকমের অভিযোেগ করতে পারে না যে, সে ব্যক্তির বিরােধিতা বা মুকাবিলা আদৌ করা সম্ভব হবে না; বরং করা সম্ভব, কেননা তার এ দাবী সে শক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। পক্ষান্তরে, নবীদের নুবুওতের দাবী এমনই একটি স্বভাব সিদ্ধ ব্যাপার যাকে প্রতিহত করা বা তার অলৌকিক কর্মকাণ্ডের মুকাবিলা করা, আদৌ কারাে পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই, এর দ্বারা যে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলাে : নুবুওতের দাবীদারের দাবী সত্য এবং বাস্তব, এবং তিনি যেসব মু'জিযা পেশ করেন, তা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কুদরতে করে থাকেন। 


তিন : “সে মু'জিযার মুকাবিলা করা হয়েছিল, কিন্তু কোন প্রতিবন্ধকতার কারণে তা প্রকাশ পায়নি। এ বক্তব্যের জবাবে বলা যেতে পারে যে, সাধারণ নিয়মানুসারে জানা যায় যে, কারাে শক্তিকে স্বীকার করে নিলেও, যদি কোন কাজে-কারবারে তার বিরােধিতার প্রয়ােজন দেখা দেয়, তবে তা করা উচিত। একইভাবে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী দেখা যায় যে, সে মুকাবিলা বা বিরােধিতা প্রকাশ পাওয়া দরকার কেননা, তদ্বারা মাকসুদ হাসিল হয়ে থাকে। আর কোন সময়, কোন ব্যাপার বা বিষয় প্রকাশ না হতে পারার অর্থ এই নয় যে, সে বিষয়টি আর কখনাে প্রকাশ পেতে পারবে না; বরং যে প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটি প্রকাশ হতে পারছিল না, তা তিরােহিত হবার পর সেটি প্রকাশ পেতে আপত্তি কি? বস্তুত, মু'জিযার মুকাবিলা যদি করা হয়েই থাকে, তবে তা গােপন রাখা কখন-ই সম্ভব নয়; সেটা নুবুওতের দাবীদারের সাথীদের প্রাধান্য প্রাপ্তি ও বিজয়ী হবার সময়ও সম্ভব নয়; আর এছাড়া অন্যদের পক্ষে তা গােপন রাখার কোন প্রশ্ন-ই তাে আসে না। সুতরাং উপরােক্ত আলােচনা থেকে স্পষ্টতঃ জানা গেল 

যে, যে ধরনের সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে, নবী ও নুবুওতের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে তা অবাস্তব এবং বাতিল। কাজেই, নবীদের নুবুওত যে সত্য, তা অকাট্য দলিল দিয়ে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হলাে।

Top