বিষয় নং- ০৮: যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করলো তাঁর কলব মৃত্যুর পরও অমর।
“হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থের ৫৪৪-৫৪৫ পৃষ্ঠায় উক্ত হাদিস সম্পর্কে লিখেন-‘‘হাদীসটি বানোয়াট পর্যায়ের।’’
প্রথম সূত্র:
❏ ইমাম ইবনে মাযাহ (رحمة الله) সংকলন করেন-
حَدَّثَنَا أَبُو أَحْمَدَ الْمَرَّارُ بْنُ حَمُّويَةَ قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُصَفَّى قَالَ: حَدَّثَنَا بَقِيَّةُ بْنُ الْوَلِيدِ، عَنْ ثَوْرِ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ خَالِدِ بْنِ مَعْدَانَ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ ؓ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: مَنْ قَامَ لَيْلَتَيِ الْعِيدَيْنِ مُحْتَسِبًا لِلَّهِ لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ
-‘হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ইবাদতের জন্য জাগ্রত থাকবে (মৃত্যুর পরও) তার অন্তরের মৃত্যু হবে না, যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে।’’ ৯৫
➥{ইমাম ইবনে মাজাহ : আস-সুনান : ১/৪৬৭ পৃ. হাদিস:১৭৮২, ইমাম বুছুরী : মিসবাহুয যুজ্জাহ : ২/৮৫ পৃ, হাদিস: ৬৪৪, ইবনে হাজার হায়সামী : মাযমাউদ যাওয়াইদ, ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তী : জামেউস সগীর : ২/৬৪৪ : হা/৮৯০৩ ও জামিউল আহাদিস, ২১/১৯৭ পৃ. হাদিস, ২৩২৯৬, ইমাম তাবরানী : মু’জামুল আওসাত : ১/৯৫ পৃ. হা/২৮৭, দারাকুতনী, আল-ইলাল, ১২/২৬৯ পৃ .হাদিস, ২৭০৩, নববী, আল-আয্কার, ১৪৫ পৃ. এবং খুলাসাতুল আহকাম, ২/৮৪৭ পৃ. হা/২৯৯৭, তিনি হাদিসটি তাঁর এ গ্রন্থে হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه)‘র সূত্রে মারফূ, মাওকুফ সূত্রে এবং আবু দারদা (رضي الله عنه) থেকে মাওকুফ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। মিয্যী, তুহফাতুল আশরাফ, ৪/১৬৩পৃ. হাদিস, ৪৮৫৭, ইবনে কাসীর, জামিউল মাসানিদ ওয়াল সুনান, ৮/৫১২ পৃ. হা/১০৮৪৬, ইবনুল মুলাক্কীন, আল-বদরুল মুনীর, ৫/৩৯ পৃ., শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ৩/২১১ পৃ. হা/১২১২৭, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৮/৫৪৮ পৃ. হা/২৪১০৩, ইবনুল ইরাকী, তাখরীজে ইহইয়াউল উলূম, ২/৯৯৬ পৃ. তাহের পাটনী, তাযকিরাতুল মওদ্বুআত, ১/৪৬ পৃ. মুনযিরী, তারগীব ওয়াত তারহীব, ২/৯৮ পৃ. হা/১৬৫৫, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}
সনদ পর্যালোচনা:
❏ উক্ত হাদিস সম্পর্কে নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, হাফিযুল হাদিস, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (رحمة الله) বলেন, হাদিসটি ‘হাসান’ পর্যায়ের। ৯৬
➥{ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী : জামেউস-সগীর : ২/৬৪৪ পৃ. হা/৮৯০৩}
❏ এ হাদিসটির ‘বাক্বিয়াতুল বিন ওয়ালিদ’ রাবির কারণে আহলে হাদিস নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদিসটিকে তার এক গ্রন্থে জাল বলেছেন ৯৭
➥{আলবানী, দ্বঈফু সুনানি ইবনে মাজাহ, হা/১৭৮২, তিনি বলেন, হাদিসটি জাল।}
❏ তার অপর আরেক গ্রন্থে সনদটিকে সাধারণ দুর্বল বলেছেন ৯৮
➥{আলবানী, দ্বঈফু জামেউস সগীর, হা/৮৯০৩, তিনি এ গ্রন্থে বলেন, হাদিসটি দ্বঈফ।
❏ আবার তার অন্য আরেক পুস্তুকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। ৯৯
➥{আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ ওয়াল মাওদ্বুআহ, ২/১১ পৃ. হা/৫২১}
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! দেখুন সে এক মুখে কত রকমের কথা বলতে পারে? যে এমন আবোল তাবাল তাহক্বীক করে তার তাহক্বীক কতটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে! উক্ত রাবীর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত সামনে আমি দরুদ শরীফ সম্পর্কিত হাদিস ‘কিয়ামতে সেই ব্যক্তিই নবিজীর সবচেয়ে নিকটে থাকবে যে সবচেয়ে বেশী দরুদ পড়বে’ এর আলোচনায় উল্লেখ করা হবে, পাঠকবৃন্দের সেখানে দেখে নেয়ার অনুরোধ রইলো।
রাবী ‘বাকিয়্যাত ইবনে ওয়ালিদ’ এ হাদিসে তাদলীস করেছেন তার শায়খ ‘সাওর ইবনে ইয়াযিদ’ এর নামে, তার এ তাদলীস কোনো দুর্বলতার প্রভাব পড়বে না, কেননা তিনি তার এ শায়খ থেকে হাদিস শুনেছেন।
❏ ইমাম মিয্যী (رحمة الله) তার জীবনীতে লিখেন-
رَوَى عَنْ: محمد بْن زياد الأَلْهانيّ، وبَحير بْن سعْد، وثور بْن يزيد،
-‘‘তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ বিন যিয়াদ ইলহানী, বাহাইর বিন সা‘দ এবং সাওর ইবনে ইয়াযিদ হতে।’’
(ইমাম মিয্যী, তাহযিবুল কামাল, ৪/১০৮২ পৃ. ক্রমিক.৪৯)
বুঝা গেল, এ রাবী যদিও তিনি তাদলীস করছেন, তবে এ শায়খ থেকে তার হাদিস শুনাও প্রমাণিত। তাই হাদিসটি সহীহ, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
❏ উক্ত রাবীর বিষয়ে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেন-
له في مسلم
-‘‘তার থেকে সহীহ মুসলিমে ইমাম মুসলিম (رحمة الله) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।’’
(ইবনে হাজার আসাকলানী, তা‘রিফু আহলিল তাদলীস, ৪৯ পৃ. ক্রমিক. ১১৭)
দ্বিতীয় সূত্র:
❏ উক্ত হাদিসটির অপর আরেকটি সনদ ‘বাকিয়্যা’ এর সাথী থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়-
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يَحْيَى بْنِ خَالِدِ بْنِ حَيَّانَ قَالَ: نا حَامِدُ بْنُ يَحْيَى الْبَلْخِيُّ قَالَ: نا جَرِيرُ بْنُ عَبْدِ الْحَمِيدِ، عَنْ رَجُلٍ وَهُوَ: عُمَرُ بْنُ هَارُونَ الْبَلْخِيُّ، عَنْ ثَوْرِ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ خَالِدِ بْنِ مَعْدَانَ، عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ ؓ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَالَ: مَنْ صَلَّى لَيْلَةَ الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى، لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ
-‘‘হযরত উবায়দা বিন সামিত (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাতে নামায পড়বে, প্রত্যেকের কলবের মৃত্যু হলেও তার কলবের মৃত্যু হবে না।’’ ১০০
➥{ইমাম তাবরানী, মুজামুল আওসাত : ১/৫৯ পৃ. হা/১৫৯, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৫/৬৬ পৃ. হা/১২০৭৭, ও ৮/৫৪৯ পৃ. হা/২৪১০৮, দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ৩/৬১৯ পৃ. হা/৫৯৩৬, শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ৩/১৪৩ পৃ. হা/১৬৪৮, সাজারী, তারতিবুল আমালি, ২/৭৩ পৃ. হা/১৬৩৫ }
❏ উক্ত হাদিসে একজন রাবি দুর্বল রয়েছে বলে হাইসামী বলেন,
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الْكَبِيرِ وَالْأَوْسَطِ وَفِيهِ عُمَرُ بْنُ هَارُونَ الْبَلْخِيُّ وَالْغَالِبُ عَلَيْهِ الضَّعْفُ، وَأَثْنَى عَلَيْهِ ابْنُ مَهْدِيٍّ وَغَيْرُهُ، وَلَكِنْ ضَعَّفَهُ جَمَاعَةٌ كَثِيرَةٌ وَاللَّهُ أَعْلَمُ
-‘‘ইমাম তাবরানী তাঁর মু‘জামুল কাবীর ও আওসাত গ্রন্থে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, উক্ত সনদে উমর বিন হারুন বলখী’ রয়েছেন তার মধ্যে দুর্বলতা বিদ্যমান, ইবনে মাহদী ও অন্যান্য ইমামরা তার প্রসংশা করেছেন। তবে অনেকে তাকে দুর্বল বলেছেন, আর তাঁর ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ তা‘য়ালাই ভাল জানেন।’’ ১০১
➥{ইমাম ইবনে হাজার হাইসামী, মাযমাউদ যাওয়াইদ, ২/১১৮ পৃ. হা/৩২০৩, মাকতুবাতুল কুদসী, কায়রু, মিশর।}
❏ আল্লামা ইবনে হাজার হাইসামী তার এ গ্রন্থের একাধিক স্থানে তাকে সাধারণ দুর্বলতা আছে বলে উলেখ করেছেন। ১০২
এ হাদিসটির আরেকটি সূত্রও পাওয়া।
➥{ইমাম ইবনে হাজার হাইসামী, মাযমাউদ যাওয়াইদ, ২/১১৮ পৃ. হাদিস, ৩২০৩ ও ৫/১৩৮ পৃ. হা/৮৬২৩, ১০/২৮৬ পৃ. হা/১৮০৬০, মাকতুবাতুল কুদসী, কায়রু, মিশর।}
তৃতীয় হাদিস:
❏ শুধু তাই নয়, ইমাম যাহাবী (رحمة الله) আরো একটি দুর্বল সনদ বর্ণনা করেছেন। যেমন-
مفضل بن فضالة المصري، عن عيسى [بن إبراهيم القرشي، عن] سلمة بن سليمان الجزري، عن مروان بن سالم، عن ابن كردوس، عن أبيه، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من أحيا ليلتى العيد وليلة النصف من شعبان لم يمت قلبه يوم تموت القلوب
-‘‘তাবেঈ হযরত ইবনে কারদুস (رحمة الله) তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ও শবে বরাতের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে, মৃত্যুর পর প্রত্যেকের কলবই মৃত্যুবরণ করবে কিন্তু তাদের কলব অমর থাকবে।’’ ১০৩
➥{ইমাম যাহাবী : মিযানুল ই’তিদাল : ৩/২৯৭ পৃ. রাবী : ৬৯৯২, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, ইমাম দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ৩/৬১৯ পৃ. হা/৫৯৩৫, ইবনে কাসীর, জামিউল মাসানিদ ওয়াল সুনান, ৭/১৫৭ পৃ. হা/৮৯৪০, ইবনে হাজার আসকালানী, ইসাবা ফি তামীজিস সাহাবা, ৩/২৭৪ পৃ. ও তার অপর গ্রন্থ তালখিসুল হুবাইর, ২/১৬০ পৃ. ক্রমিক নং.৬৭৫, ও ২/১৬০ পৃ. হাদিস, ৬৭৬, ইবনে আছির, জামিউল উসূল, ৪/৪৬৬ পৃ. ইবনুল মুলাক্কিন, বদরুল মুনির, ৫/৩৮ পৃ. মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৮/৫৪৮ পৃ. হাদিস, ২৪১০৩, শাওকানী, ফাওয়াইদুল মওদ্বুআত, ১/৫২ পৃ. হা/১১০, ইবনে আরাবী, মু‘জামে ইবনে আরাবী, ৩/১০৪৭ পৃ. হা/২২৫২, ইমাম ইবনে জাওযী, আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়্যাহ, ২/৭২ পৃ. হা/৯২৫}
উক্ত সনদে ঈসা বিন তুহমান ও মারওয়ান বিন সালেম কিছুটা দুর্বল রাবি, অপরদিকে সনদটি মুরসালও বটে।
চতুর্থ হাদিস:
❏ এ বিষয়ে প্রথম হাদিসের মতনের ন্যায় হযরত আবু দারদা (رضي الله عنه) হতে মাওকুফ সূত্রে আরেকটি বর্ণনা রয়েছে। ইবনে হাজার সে সনদটি সম্পর্কে বলেন মাওকুফ হলেও সনদটি সহীহ, আর ইবনুল মুলাক্কিন ‘সহীহ নয়’ মত প্রকাশ করেছেন, হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ মুহাদ্দিসদের উক্তি দ্বারা হাদিসটি জাল হওয়া বুঝায় না, যা কিতাবের শুরুতে হাদিসের নীতিমালায় আলোকপাত করেছি। ১০৪
➥{ইমাম বায়হাকী, শুয়াবূল ঈমান, ৫/২৮৭ পৃ. হা/৩৪৩৮, ও মা‘রিফাতুল সুনানি ওয়াল আছার, ৫/১১৮ পৃ. ও ফাযায়েলুল ওয়াক্ত, ১/৩১২ পৃ. হা/১৫০, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, তালখিসুল হুবাইর, ২/১৯০ পৃ. হাদিস, ৬৭৫, ইবনুল মুলাক্কিন, বদরুল মুনীর, ৫/৩৮ পৃ.}
পঞ্চম হাদিস:
❏ এ বিষয়ে প্রথম হাদিসের মতনের ন্যায় হযরত মুয়ায বিন জাবাল (رضي الله عنه) হতে মারফূ সূত্রে আরেকটি বর্ণনা রয়েছে। ১০৫
এ সনদটি ‘হাসান’ পর্যায়ের।
➥{ইমাম দারাকুতনী, আল-ইলাল, ১২/২৬৯ পৃ. হা/২৭০৩, ইমাম ইবনে জাওযী, ইলালুল মুতনাাহিয়্যাহ, ২/৭২ পৃ. হা/৯২৫।}
ষষ্ঠ হাদিস:
এ ব্যাপারে তাবেয়ী মেকহুল শামী (رحمة الله) থেকে একটি সূত্র বর্ণিত আছে। এ সনদ নিঃসন্দেহে সহীহ। ১০৬
➥{ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, তালখিসুল হুবাইর, ২/১৯০ পৃ. হা/৬৭৫, তিনি বলেন, সনদটি সহীহ।}
সপ্তম হাদিস:
এ বিষয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (رحمة الله) থেকে তাবেয়ী বলকিনী (رحمة الله) সূত্রে একটি মাকতু হাদিস রয়েছে। ১০৭
➥{ইমাম মারুজী (ওফাত. ২৪৬ হি.), আল-র্বিরু ওয়াল সিলাত, ১/৩৩ পৃ. হাদিস, ৬৩, }
উক্ত বিষয়ের হাদিসটিকে কোন মতেই দ্বঈফ বা দুর্বল বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ বিভিন্ন সনদে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে।