তৃতীয় নজর
‘হিফজুল ঈমান গ্রন্থকার থানবীর উপর ক্বিয়ামত কুবরা কায়েমঃ
হে আল্লাহ! তােমার ক্ষমা আমরা প্রত্যক্ষ করছি এতদসত্ত্বেও যে, সমগ্র। জগত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, সীমাতিক্রম করছে, অনেক লােকের উপর গােমরাহ (ভ্রান্ত) মতবাদ ছেয়ে যাচ্ছে। আমি পূর্বেই আল্লাহতায়ালার সত্ত্বাগত জ্ঞান এবং শর্তহীন সীমাবদ্ধ জ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা উক্ত করেছে। এ জ্ঞানসমূহ এবং আল্লাহর জন্যই খাস্ বান্দার জন্য নয়। কিন্তু শর্তহীন প্রদত্ত জ্ঞান প্রত্যেক মুসলমানেরই রয়েছে, আম্বিয়ায়ে কিরামদের কথা আর কি বলবাে। কারণ যদি এ জ্ঞান না হয়, তাহলে ঈমানও বিশুদ্ধ হবে না; যেমন ইতােপূর্বে আলােচিত হয়েছে। হয়তাে এ বর্ণনা দ্বারা কোন কোন সন্দেহকারীর মনে। সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে যে, আমাদের ও আমাদের নবীর মধ্যে কেনি। পার্থক্যই রইলাে না। সুতরাং অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কিরামদের ব্যাপারে কি ধারণা রাখতে পারি? যেমন জ্ঞান হুজুরের (ﷺ) ও অন্যান্য নবীদের রয়েছে, অনুরূপ। আমাদেরও অর্জিত হয়েছে। আর যে শ্রেণীর জ্ঞান আমাদের অর্জিত হয়নি তা তাদেরও অর্জিত হয়নি। সুতরাং আমরা সবাই সমান হয়ে গেছি। এটা যদিও এমন বক্তব্য যা কোন জ্ঞানবান ব্যক্তিতাে দূরের কথা, কোন বুদ্ধিমানের নিকট থেকেও আশা করা যায় না, কিন্তু তী ওহাবীদের থেকে আশা করা অসম্ভব নয়। এ কারণে যে, তারা বুদ্ধিহীন সম্প্রদায় এবং তাদের কেউ সঠিক পথে নেই। আমার কি হলাে যে, আনুমানিকভাবে বলছি যা সংঘটিতই হয়ে গেছে। আপনারা . কি শুনেননি যে, ইদানিং ওয়াহাবীদের মধ্যে সাধু, শেখ ও সুফীর দাবীদার এক অহংকারী আবির্ভূত হয়েছে, যে কিনা একগুয়ে হিন্দুদের অন্তর্ভূক্ত! সে একটি . পুস্তিকা রচনা করেছে, যা চার পৃষ্ঠাও হবে না। যদ্বারা সাত আসমান ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এর নাম দিয়েছে ‘হিফজুল ঈমান’ (ঈমান সংরক্ষণকারী)। প্রকৃত পক্ষে তা ‘হিফজুল ঈমান নয় বরং “খিফদুল ঈমান’ তথা ঈমান হরণকারী। তাতে উপরােক্ত বর্ণনাই সুস্পষ্ট করা হয়েছে, কিয়ামত দিবসকে এতটুকু ভয় করেনি। এর ভাষ্য হলাে-‘অতঃপর কথা হলাে তাঁর পবিত্র সত্তায় অদৃশ্য জ্ঞানের হুকুম প্রয়োগ করা যদি যায়েদের কথামত বিশুদ্ধ হয়, তাহলে জিজ্ঞাসার বিষয় হলাে, হয়তাে এ গায়ব দ্বারা আংশিক গায়ব উদ্দেশ্য হবে কিংবা পূর্ণ গায়ব। যদি আংশিক উলুমে গায়ব (অদৃশ্য জ্ঞান) উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তাতে। হুজুর (ﷺ) এর বৈশিষ্ট্য কি? এমন অদৃশ্য জ্ঞানতাে জায়েদ, ওমর এমনকি প্রত্যেক শিশু ও পাগল বরং সকল চতুষ্পদ জন্তুরও রয়েছে। যদি পূর্ণ অদৃশ্য জ্ঞান উদ্দেশ্য হয়, এভাবেই যে, এর একটি এককও বহির্ভুত নয়, তাহলে এর বাতুলতা। যুক্তি ও অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত” এ গোয়ার ও মরদুদ জানেনা যে, গায়বের মধ্যে শর্তহীন প্রদত্ত জ্ঞান প্রকৃতপক্ষে আম্বিয়ায়ে কিরামের জন্য খাস। আল্লাহ তায়ালার এ বাণী মতে,“আল্লাহ অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞাত, তিনি তার নির্বাচিত নবীদের ব্যতীত অন্য কারাে কাছে তা প্রকাশ করেন না।” আর তাঁর এ ইরশাদ মতে,
• “আল্লাহর কাজ এটা নয় যে, তিনি তােমাদের স্বীয় গায়ব সম্পর্কে অবহিত করবেন, কিন্তু তাঁর পছন্দনীয় রাসুলদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে এর জন্য নির্বাচিত করেন।” সুতরাং তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত অন্যান্যদের যে জ্ঞান হাসিল হবে তা তার ফয়েজ, সাহায্য, কৃপা ও দানের দরুণ এবং পথ প্রদর্শনের দ্বারা অর্জিত হয়। সুতরাং সমান কিসের? এটা ব্যতীত আম্বিয়ায়ে কিরামের জ্ঞানসমূহ থেকে সামান্যতম ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। তাঁদের গায়বের জ্ঞানসমূহের যে সমুদ্র প্রবাহিত হয়, এর সম্মুখে কোন গণনা বর্ণনার আওতায় আসে না। আম্বিয়া (আঃ) আদি থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত যা হয়েছে ও যা হবে, সব কিছুই জানেন। বরং তারা সব কিছু দেখেন ও প্রত্যক্ষ করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন এভাবে আমি ইব্রাহীমকে আসমান ও পৃথিবীর সকল বাশাহী প্রত্যক্ষ করাই”।
ইমাম তাবরানী ‘মু’জামে কবীর ইবনে হাম্মাদ ‘কিতাবুল ফিতান' এবং আবু নঈম 'হুলইয়াতুল আওলিয়ায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে রেওয়ায়েত করেন, নবীয়ে করিম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,
إن الله قد رفع لى الدنيا فانا انظر اليها و إلى ماهو كان فيها إلى يوم القيامة الم
“নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমার সম্মুখে দুনিয়া উত্তোলন করেন। আমি তা ও তাতে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু সংঘটিত হবে সব এমনভাবেই দেখেছি যেভাবে এ হাতের তালুকে।”
এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নূর, যা আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীর জন্য প্রজ্জলিত করেছিলেন; যেভাবে পূর্বের নবীদের জন্য প্রজ্জলিত করেছেন। তাহলে ঐ ভ্রষ্ট যেখানে পূর্ণ ও আংশিকের ব্যবধান দেখিয়েছে তন্মধ্যে প্রথমটি বিদ্যমান নেই। আর দ্বিতীয়টিও সকলের জন্য শামিল বলে ধারণা করে হুকুম লাগিয়ে দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (ﷺ), যার জ্ঞানও সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রশস্ত, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাই শিক্ষা দিয়েছেন, যা তিনি জানতেন না। আল্লাহর করুণা তার উপর। মহান। সুতরাং তিনি পূর্বাপর সকল কিছুর জ্ঞানী হয়েছেন। যা গত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে সব তিনি জেনেছেন, আর যা কিছু আসমান ও জমীনে রয়েছে। এসব ব্যাপারেও তিনি জ্ঞাত হয়েছেন। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল প্রকারের জ্ঞান তাঁর আয়ত্বে এসে গেছে এবং সব কিছু তার নিকট সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা তার জন্য প্রত্যেক বস্তু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ভ্রষ্ট তাঁর আল্লাহ প্রদত্ত এ জ্ঞানকে জায়েদ, ওমর বরং অবুঝ শিশু, পাগল এমনকি প্রত্যেক চতুষ্পদ জন্তুর সমান করে দিয়েছে। দুর্ভাগা জানেনি যে, আংশিকের মধ্যে বড়, ছােট, মধ্যমও রয়েছে, যাতে এক ছােট বৃষ্টির কণার পরিমাণ থেকে। আরম্ভ করে লাখাে-কোটি সমুদ্রের তরঙ্গের পরিমাণও শামিল রয়েছে, যা পরিবেষ্টন করা যায় না। না তার কোন পার্শ্ব আছে, না এর কোন শেষ রয়েছে। অতএব, এটা সম্পূর্ণ নয়, বরং আল্লাহর জ্ঞানের আংশিক এবং তা তার জ্ঞানে। বেষ্টন করে না। কিন্তু তিনি যতটুকু চান। অতএব, যদি শুধুমাত্র আংশিক সমান। ও সাম্য এবং বিশেষত্ব অস্বীকারের জন্য যথেষ্ট হতাে, যেমন এ মরদুদ ও বঞ্চিত ধারণা করেছে, তাহলে এ হুকুমও প্রয়ােগ করে দিক যে, আল্লাহ তায়ালার শক্তি। যায়েদ ও ওমর বরং প্রত্যেক অবুঝ শিশু ও পাগল এমনকি প্রতিটি চতুষ্পদ জন্তুর শক্তির (টিকা ১) সমান! কেননা, সকল জন্তু কোন না কোন কর্ম ও নড়াচড়ার উপর। শক্তি রাখে, যদিও তাদের সৃষ্টি করার শক্তি নেই।
টিকাঃ বান্দার ক্ষমতা
আমরা আহলে সুন্নাত জামাত-আল্লাহ তায়ালার প্রদানের মাধ্যমে ‘ধ্বংসশীল শক্তিই প্রমাণ করে থাকি। যদিও তা অর্জিত, সৃষ্টিকারী নয়। আর এর সম্পূর্ণ বিপরীত জাহম ইবনে সাফওয়ানের মাযহাব যেমন মাওয়াকিফ ও এর ব্যাখ্যাগ্রন্থে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-অর্থাৎ তারা প্রত্যুষে মদীনা যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। অথচ, তাদের দান করার ও উপকার করার শক্তি ছিলাে। আল্লামা আবু মাসউদ স্বীয় তাফসীর “ইরশাদুল আকল আসসালীম” গ্রন্থে লিখেছেন-'এর অর্থ হলাে তারা চেয়েছিলাে মিসকীনদের উপর শক্তি প্রয়ােগ করবে এবং তাদের বঞ্চিত করবে অথচ তাদের উপকার করার শক্তি ছিলাে। আর আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-- যাতে কিতাবধারীরা জানে যে, আল্লাহর সামান্যতম অনুগ্রহের উপরও তাদের কোন ক্ষমতা নেই। তাফসীরে কবীরে রয়েছে যে, দ্বিতীয় উক্তি এই যে, লা শব্দটি অতিরিক্ত নয়। সুতরাং সর্বনাম রাসুলুল্লাহ (ﷺ) -এর প্রতি ইঙ্গিত বহন করে এবং তাঁর আসহাবদেরদের প্রতিও। আর শক্তি’ এভাবেই যে, যেন আহলে কিতাব না জানে যে, নবী ও মুসলমানগণ আল্লাহর অনুগ্রহ ক্রমে কোন বস্তুর উপর শক্তি রাখেনা। তারা যখন ওদের শক্তিশালী জ্ঞান করেনি, তাহলে নিজেদের শক্তিশালী জ্ঞান করেছে। আর জেনে রাখুন যে, এ তাফসীরই (উক্তি) সর্বোৎকৃষ্ট।'
যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তায়ালার কুদরত আজলী (অনন্তকালীন) আবদী (চিরস্থায়ী) ওয়াজিব (অপরিহার্য) ও সৃষ্টিকারী, আর বান্দার কুদরত এমন নয়। তাহলে আমি বলবাে, এটা সম্পূর্ণ ও আংশিক কর্মসূহের অন্তর্ভূক্ত নয়। আলােচনা উভয়ের মাঝামাঝি। ঐ প্রতারক কি বিশ্বাস করে যে, পাগল ও চতুষ্পদ জন্তুর উপর মুহাম্মদ (ﷺ) এর জ্ঞানের অনেক আধিক্যতা রয়েছে সিফাত (গুণাবলী), অবস্থাবলী, পরিবেষ্টনকারী ও উপকারী এবং গৌরবময় মর্যাদা সম্পন্ন, অধিক উপকারী, সৃষ্টিগত দিক দিয়ে প্রথম ও সাহায্যের ক্ষেত্রে উসিলা হওয়ার মধ্যে? এছাড়া জ্ঞানের অংশীদারিত্ব ব্যতীত আরও অনেক। পার্থক্যাবলী রয়েছে, যা ঐ প্রতারকের নিকট কোন দিকেই পাগল ও চতুষ্পদ জন্তুর চেয়ে। বেশী নয়। (নাউজুবিল্লাহ)
অন্য দিকে তার কুফর খুবই স্পষ্ট হয়ে গেছে। কেননা, সে অভিশপ্ত, ধুর্তবাজ ও মরদুদ নিজের জ্ঞানকে বলদ, গাধা, ষাঁড়, কুকুর ও শুকরের জ্ঞানের উপর অনেক মর্যাদা ও প্রাচুর্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। প্রথমতঃ সে (প্রতারক) সমান হবার হুকুমের ভিত্তি শুধুমাত্র আংশিকের মধ্যে অংশীদারে যখন নবীজির জ্ঞানের বিশেষত্বকে অস্বীকার করেছে। এ বিশ্বাস থাকা সত্বেও যে, রাসুলে পাক (ﷺ) -এর জ্ঞানসমূহের জন্য তার জ্ঞানের উপর ভিন্ন কারণে অধিক ও অসীম ফজিলত রয়েছে। সুতরাং আল্লাহর কুদরতের সাথে অসম্ভব হওয়া পূর্ণ হয়েছে। আর অতিরিক্তসমূহ দ্বারা বর্ণনা করা যা পূর্ণ ও আংশিকের বহিভূর্ত তা কোন উপকারে আসেনি। অতএব, জেনে নাও! আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।
তাহলে আংশিক সাব্যস্ত হয়েছে। আর আল্লাহ এ থেকে অনেক উর্দ্ধে যে, স্বীয় পবিত্রতম সত্তা ও স্থায়ী গুণাবলীর উপর শক্তিশালী হবেন না। কেননা, এমনটি সম্ভব হলেতাে (ঐ সময়) তিনি আল্লাহই থাকেন না। তখন আল্লাহ ও তার গুণাবলীসমূহও মাখলুক, নব আবিষ্কৃত (টিকা ১) ও অস্থায়ী সাব্যস্ত হবে। এ কারণে যে, যা শক্তি দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে তা সৃষ্টি করার দ্বারাও সৃষ্টি হয়।
আর যা সৃষ্টি করার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় তা প্রথমে সৃষ্টি হয়। সুতরাং এখানেও আংশিক সাব্যস্ত হয়েছে যে, সকল বস্তুর বেষ্টন এখানেও নেই। অতএব, সমান হওয়া ও সকল ত্রুটি আবশ্যক হয়ে পড়েছে । আমি একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করছি।
এক শক্তিমান বাদশাহ পরিপূর্ণ দুনিয়ার মালিক হলাে এবং প্রত্যেক ছােট বড় ধনভান্ডার তার মালিকানায় ছিলাে আর তার কিছু খলিফা (মন্ত্রী) ছিলাে। তাদের নিকট দিল্লীর ন্যায় এক একটি রাজ্যের (ধন-ভান্ডারের) চাবিকাঠি সােপর্দ করলাে যেন গরীব দুঃখীদের সাহায্য করে, মিসকীনদের দান করে। আর সকলের উপর একজন প্রধান খলিফা (মন্ত্রী) নির্বাচন করলাে, যার উপর বাদশাহ ব্যতীত আর কেউ নেই।
টিকা ১:
(১) অর্থাৎ সৃষ্টি করা ও অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বে আনা সম্পর্কে আহলে সুন্নাত জামাতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। (আল্লাহ তায়ালা তাঁদের প্রত্যেক অপবাদ থেকে হেফাজতে রাখুন)। আর মতবিরােধ এতেই রয়েছে যে, এর কোন অজুদগত প্রভাব কোন অতিরিক্ত বস্তুর মধ্যে রয়েছে কিনা? যেমন-نسبت(নিসবত) اضافة(এজাফত) اعتبارت(এতেবারাত) এর মধ্যে। কতেক এর নাম حال (হাল) রেখেছেন। আর অন্যরা এর অস্বীকারকারী নন যে, এতেবারগত বিষয়ে যাদের জন্য বাস্তবতার একটি অংশ রয়েছে, তা শুধুমাত্র কাল্পনিক আবিস্কার নয়, ভয়ানক বিপদের ন্যায়। আর যদি তাদের বক্তব্য, অবস্থাদি এবং অস্তিত্বহীনের মধ্যে মাধ্যম প্রমাণ করার মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়, তাহলে তা শাব্দিক দ্বন্দ্ব। যেমন মুহাক্কেকীনে কিরাম এর বিশ্লেষণ করেছেন। আর অধিকাংশ আশারিয়া তা শর্তহীন বলে স্বীকার করেননি। তাঁদের মতে কর্ম নশ্বর ও ধ্বংসশীল শক্তির জন্য নয়, তা কেবল সাথেই থাকে। বান্দার জন্য তা স্থানই হয়ে থাকে। আর হানাফীরা ধারণা করেছেন যে, কুদরত ও শক্তি অস্বীকারের জন্য যথেষ্ট নয়। তারা এর জন্য সৃষ্টি ইচ্ছার মধ্যে প্রমাণ করেছেন। আর ইচ্ছে হলাে নিশ্চিতরূপে امر اضافي (অমৌলিক কম), মূল সৃষ্ট (বস্তু নয়। সুতরাং এর দিকে সৃষ্টির সম্পর্ক হয় না। কেননা, তা না মুলের সম্পর্ক, না সৃষ্টবস্তুর সম্পর্ক। আর পদস্খলনের কোন নিশ্চয়তা ও গ্রহণযােগ্যতা নেই। কতেক আশারিয়াও এ মতামত পছন্দ করেছেন। যেমন ইমামুচ্ছুনাহ আল্লামা কাজী আবু বকর বাঙ্কুলানী (رحمه الله تعالي)। এর বিপরীতে আমার জ্ঞানে না কোন নস (প্রমাণ) রয়েছে, না কোন ঐকমত্য। এসব কিছু আমি স্বীয় রচিত “তাহবীরুল হিবর বিকাসমিল জবর” নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছি। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে নয় যারা তাতে গভীরভাবে অনুসন্ধান করেন। আল্লাহরই জন্য স্তুতিবন্দনা । আমার ঈমান (বিশ্বাস) তাই, যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত এবং যাতে উভয় সম্প্রদায় একমত পােষণ করেছেন, এর উপর সাক্ষ্য প্রদান করেছেন এবং অকাট্য দলীল যে দিকেই রয়েছে। এখন না বাধ্যবাধকতা রয়েছে, না শক্তি প্রয়ােগ, কিন্তু কর্ম উভয়ের মধ্যবর্তীতে রয়েছে। আয়ত্ব, কম্পন, আরােহন করা ও অবতীর্ণ হওয়া, লম্ফ প্রদান করা এবং নিমজ্জিত হওয়া ইত্যাদির নড়াচড়াসমূহের মধ্যে প্রত্যক্ষ পার্থক্য রয়েছে। মানুষের বিবেক এ থেকে অজ্ঞ নয় যে, কোন শিশু কোন জন্তু ও বান্দার জন্য সৃষ্টি থেকে কোন একটি বাক্যও নেই। তারা নিজের মধ্যে যে শক্তি, ইচ্ছা ও ইখতিয়ার অনুভব করে তা সবই আল্লাহর সৃষ্ট। যাতে না কারাে ইখতিয়ার (স্বাধীনতা) রয়েছে, না কারাে কুদরত, আর না কোন ইচ্ছে, যা তার আপন হবে। তােমরা কি করতে চাও কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছে তাই করেন। বস্তুতঃ তাই হয়, যা তিনি করতে চান, যদিও তা পরিহারের জন্য সমগ্র জাহান জড়াে হয়। তিনি যা চান না তা হবেই না, যদিও তা সফল করার জন্য সকল পূর্ববর্তী জ্বিন ও মানুষ শেষ প্রচেষ্টা চালায়। আল্লাহই আপনাদের সৃষ্টি করেছেন, আর যা কিছু আপনারা করছেন সবই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি যাকে ইচ্ছে পুণ্য প্রদান করেন। পূণ' হলাে তার করুণা। আর তিনি যাকে ইচ্ছে শাস্তি প্রদান করেন। শাস্তি হলাে তাঁর সুবিচার। আল্লাহ তাদের উপর যুলুম করেননা। কিন্তু তারা নিজেরাই জালিম । তারা যা অর্জন করে এর প্রতিদানই দেয়া
* সুতরাং কষ্ট সত্য, আর প্রতিদান এবং শাস্তিও হক। হুকুম হলাে সুবিচার! আর ইসলামের উপর আপত্তি উত্থাপন করা কুফর, ভ্রষ্টতা ও পাগলামী। আর পাগলেরও অনেক শ্রেণী বিভাগ ও বিষয় রয়েছে। আর কারাে জন্য আল্লাহর উপর কোন দলীল নেই যে, তিনি কি করেছেন? আল্লাহর জন্যই সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তার থেকে কোন কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না যে, তিনি কি করেছেন, বান্দাদের থেকেই জিজ্ঞেস করা হবে। এটাই হলাে, আমাদের ঈমান। এতে আমরা কিছুই বৃদ্ধি করবােনা। আর যা আমাদের থেকে জিজ্ঞেস করা হবে তাছাড়া অন্যান্য সব ব্যাপারে আমরা বলে দেবাে যে আমরা জানিনা। এর জন্য আমাদের কষ্ট দেয়া হবে না। আমরা এমন সমুদ্রে প্রবিষ্ট হবােনা যাতে সাঁতার কাটার শক্তি আমাদের নেই। আর আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি দ্বীনে হক তথা সত্য দ্বীনের উপর অটল থাকার জন্য। আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা, যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক।
টিকা শেষ___________
এখন বাদশাহ সকল রাজকীয় চাবিকাঠি তার কাছে হস্তান্তর করলাে এবং তাকে এগুলাে ব্যবহারে ইখতিয়ার দিয়ে দিলাে এবং নিজের সত্ত্বা ব্যতীত সব লেনদেন তাকে সােপর্দ করে দিলাে। অতঃপর এ প্রধানমন্ত্রীই অন্য সব মন্ত্রীদের উপর বন্টন করেন এবং তার নিম্ন পদস্থদের মধ্যে মর্যাদানুসারে বন্টন করেন। এমন কি শেষ পর্যন্ত তা ফকীরদের কাছেও পৌঁছে যায় এবং প্রত্যেকেই এর অংশ পায়। আর ঐ ফকিরদের মধ্যে এক দুর্ভাগা, মরদুদ যে বাদশাহ ও তাঁর মন্ত্রীদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, সে না তার উপর বিশ্বাস রাখে, না তাকে সম্মান করে, তাঁকে নিজ থেকে মর্যাদাবান মনে করে; অথচ সে একটি রুটির মুখাপেক্ষী, নিঃস্ব, দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও মিসকীন। তার মন্ত্রীদের বন্টনের দ্বারা শুধুমাত্র একটি পয়সা অর্জিত হয়। আর সেও বলে, আমি ও প্রধানমন্ত্রী উভয় ধন ও সম্পদে সমান। এজন্য যে, যদি সমস্ত মালের মালিকানা সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে তা প্রধানমন্ত্রীরও হাসিল হয়না। আর যদি আংশিক সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে এতে খলিফার (প্রধানমন্ত্রী) বিশেষত্ব কোথায়? আংশিকেরতাে আমিও মালিক, পয়সা কি আমার মালিকানায় নেই? তাহলে এ দুর্ভাগা, অকৃতজ্ঞ, পরমুখাপেক্ষী, অহংকারী ও গর্বিত, সে না খলিফার প্রদত্তকে স্বীকার করলাে, না খিলাফতের মান-মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখলাে, না তার একটি নগন্য পয়সা ও পরিপূর্ণ ধন-ভান্ডার যা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত পরিপূর্ণ তাতে পার্থক্য করলাে। বরং সে ঐ শক্তিশালী বাদশাহর মর্যাদার পরিচয় লাভ যেমন করেনি তেমনি তার এবং তাঁর খেলাফত ও হুকুমতের মর্যাদাকেও নগন্য জ্ঞান করলাে ।
সুতরাং সে বড় দুঃখজনক ও কঠোর মার এবং দীর্ঘ শাস্তির উপযােগী হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা হলেন বাদশাহ, আর তাঁর মহান খলিফা হলেন প্রিয় নবী (ﷺ), আর মন্ত্রী হলেন আম্বিয়া ও আওলিয়ায়ে কিরাম। আমরা হলাম তার দরবারের ফকির, আমরা তাঁর নিকট ভিক্ষা প্রার্থনাকারী। আর গালীদাতা মরদুদ (বিতাড়িত), নির্ধন-কাঙ্গাল, বহিস্কৃত, গোয়ার এবং কঠোর ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী। আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজীম। "
হে মুসলমানগণ! আল্লাহ আপনাদের রক্ষা করুন, আপনাদের কি এ ধারণা যে, এ হীন ও অপমানিত ব্যক্তি এ সহজ পার্থক্যও জানে না? নিশ্চয়ই ভাল করে জানে। কিন্তু নবীয়ে করীম (ﷺ) -এর ফজিলতের অস্বীকারের জন্যই এ প্রতিরােধ করছে। যদি আপনারা এর হাকীকত দেখতে চান, তাহলে কাছে গিয়ে দেখুন এবং তাকে এভাবেই সম্বােধন করুন-“হে জ্ঞান ও মর্যাদায় কুকুর ও শুকরের সমান ব্যক্তি’! তাকে দেখবেন-ক্রোধে জ্বলবে। এমনকি ক্রোধে মরার উপক্রম হবে। তখন তার কাছে জিজ্ঞাসা করবেন, আপনার জ্ঞান কি প্রত্যেক বস্তুকে পরিবেষ্টনকারী? যদি বলে, হাঁ! তাহলে নিঃসন্দেহে সে কাফির। যদি বলে, না, তাহলে বলবেন, এ জ্ঞানে আপনার বিশেষত্ব কি? আংশিক জ্ঞানতাে প্রত্যেক কুকুর ও শুকরের কাছেও রয়েছে। কি কারণে আপনাকে আলিম বলা হয়? কুকুর। ও শুকরের মত বলেনা কেন? এমনিভাবে সম্মানের ব্যাপারেও যে, সকল মর্যাদা তাে আপনার জন্য নয়, কুকুর ও শুকরতাে এমন আংশিক (মর্যাদা) থেকে শুণ্য। নয়। এ কারণে যে, কাফেররা তাদের থেকেও অধিক অপমানিত ও লজ্জিত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-“তারা সমগ্র সৃষ্টি জগতের চেয়ে অধ' নিকৃষ্ট।” ঐ সময়ই কম ও বেশী ঈমানের পার্থক্য হয়ে যাবে। পার্থক্য হয়ে যাবে আসলী, প্রকৃত, মধ্যস্থিত, প্রদত্ত ও ভিক্ষা প্রার্থনার। কারণ, কুকুর তার থেকে জ্ঞান হাসিল করেনি, শুকর তার মধ্যস্থতায় নয়, কিন্তু সমগ্র জাহানের ওলামায়ে কিরামের (টিকা ১) কাছে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, মুহাম্মদ(ﷺ) -এর সাহায্যেই অর্জিত হয়েছে।
যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
لتبين للناس ما نزل اليهم.
“যেন তােমরা লােকদের কাছে বর্ণনা করে দাও। যা কিছু তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে।” আর ‘কসিদায়ে বুরদায়’ ইমাম বুসিরীর বক্তব্য শুনেছেন “রাসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকেই ছােটবড় সকলেই প্রার্থনাকারী।” পংক্তিদ্বয়ের শেষ পর্যন্ত খােতবায় উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।
(টিকা ১) ইমাম আবদুল ওয়াহাব রচিত ‘আল ইওয়াক্কীত ওয়াল জাওয়াহির ফিল আকাঈদিল আকাবিরের ৩৩ তম পরিচ্ছেদে রয়েছে- যদি আপনারা বলেন, এখানে কি এমন কোন বশর রয়েছে, যে মুহাম্মদ (ﷺ) -এর মধ্যমবিহীন কোন জ্ঞান হাসিল করবে? জবাব তাই যা শেখ (رضى الله تعالي عنه) ১৯১ তম পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন- এমন কোন ব্যক্তি নেই যে দুনিয়াতে মুহাম্মদ (ﷺ) -এর রুহানিয়ত ও মাধ্যমবিহীন সামান্যতম জ্ঞানও হাসিল করবে। তিনি নবী, ওলী এবং আলিমগণ যেই হােকনা কেন এবং তা তাদের বেলায়ত ও নুবয়তের পূর্বাপর যে অবস্থায়ই হােক। (তাঁর মাধ্যম বিহীন কেউ জ্ঞান পান না)।
আমি বলবাে, প্রশ্নের বক্তব্য ও الانسان (মানুষ) الدنيا (দুনিয়াতে) উভয়ের ভাবার্থ বিপরীত নয়। কেননা, মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর সবচেয়ে মহান প্রতিনিধি এবং প্রতিটি বস্তুর বন্টনকারী। সুতরাং সমগ্র কায়েনাতে দুনিয়া ও আখেরাতের সব নিমাত তাঁর মােবারক হস্ত থেকেই অর্জিত হয়। যেমন এর বিশ্লেষণ করেছেন শীর্ষস্থানীয় ওলামা কিরাম। আর আমি এসব ব্যাখ্যা ও অভিমতসমূহ সালতানাতুল মােস্তফা ফি মালাকুতে কুল্লিল ওয়ারায় উল্লেখ করেছি।