ভ্রান্তির বেড়াজালে পর্দাবিধান
পর্দাবিধানটি আজ নানা ষড়যন্ত্র এবং নানাবিদ সমস্যায় জর্জরিত। নানান ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে পর্দাবিধান। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, খোদ মুসলিমদের দ্বারাই লঙ্ঘিত আজ পর্দার প্রকৃত বিধান। এসব মুসলমান উপলব্ধি করতে পারছে না যে, এটি নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের শামিল। ইসলামের এই বিধানটি শুধু আমাদের আখেরাতে নাজাতেরই উপায় নয়, আমাদের দুনিয়ার জীবনের শান্তি, স্বস্তি ও পবিত্রতারও রক্ষাকবচ। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও বিভিন্ন অপপ্রচারকারীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আমরা নিজেদের আদর্শ ত্যাগ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি।
কথিত আধুনিক দাবিদাররা এ কথার ডাকঢোল পিটিয়ে বেড়াচ্ছে যে, ইসলামী পর্দাবিধান নারীদেরকে ঠকিয়েছে। বস্তুত ইসলামী শরীয়তের মাধ্যমে নারীরা অনেক বড় নেয়ামত, দয়া সহানুভূতি ও উপকার লাভ করেছে। যেমন ইসলাম নারীদের ইজ্জত সম্মান ও পুত-পবিত্রতা রক্ষা করেছে এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছে। ইসলাম নারীদের উচ্চ মর্যাদার আসন দিয়েছে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে হ্যাঁ! নারীদের জন্য ইসলাম লেবাস-পোশাক, সৌন্দর্য প্রদর্শন ও চলাফেরা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যেসব বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তা শুধু সামাজিক অনিষ্টতা ও ফেতনা ফাসাদে যাবতীয় উপায় উপকরণের পথকে বন্ধ করার নিমিত্ত এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যেই করেছে; নারীদের প্রতি অবিচার কিংবা কোনো প্রকার বৈষম্য সৃষ্টির জন্য নয়।
ইসলাম নারীর প্রতি বিধি-নিষেধ আরোপ করে তাদের স্বাধীনতা হরণ কিংবা তাদের গৃহবন্দি করেনি; বরং তারা যাতে তাদের জীবনে চলার পথে চরম অবনতি ও অপমানের খপ্পরে না পড়ে এবং যাতে মানুষের দৃষ্টির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না হয়, তা থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলাম এই বিধি-নিষেধ ও পর্দাবিধান প্রদান করেছে।
তাই সর্বাগ্রে ভালোভাবে জানতে হবে যে, প্রকৃতরূপে পর্দা কাকে বলে? এছাড়া পর্দার উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা এবং তার উপকারিতা-অপকারিতা সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে হবে। মূলত আল কুরআনের নির্দেশ থেকেই ইসলামী সমাজে পর্দার সূচনা। অতঃপর এ প্রসঙ্গে আর যত আয়াতই নাজিল হয়েছে, তার সমষ্টিকে ‘আহকামে হিজাব’ বা পর্দাবিধান বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা নূর ও সূরা আহযাবে এ সম্পর্কিত নির্দেশাবলি বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
এসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহিলারা যেন তাদের মর্যাদাসহ আপন ঘরেই বসবাস করে এবং জাহেলী যুগের মেয়েদের মতো বাইরে নিজেদের রূপ সৌন্দর্যের ফেরি করে না বেড়ায়। একান্ত যদি তাদের ঘরের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে আগেই যেন চাদর (কাপড়) দ্বারা তারা নিজেদের দেহকে আবৃত করে নেয় এবং ঝংকারদায়ক অলংকারাদি পরিধান করে ঘরের বাইরে না যায়। ঘরের ভেতরেও যেন তারা মাহরাম পুরুষ ও গায়রে মাহরাম পুরুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং ঘরের চাকর ও মেয়েদের ব্যতীত অন্য কারো সামনে যেন জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে না বেরোয়। মাহরাম পুরুষদের সামনে বের হওয়া সম্পর্কেও এ শর্তারোপ করা হয়েছে যে, তারা বের হওয়ার পূর্বে যেন ওড়না দ্বারা তাদের মাথাকে আবৃত করে নেয় এবং নিজেদের সতর লুকিয়ে রাখে।
অনুরূপভাবে পুরুষদেরকেও তাদের মা বোনদের নিকট যাওয়ার পূর্বে অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেন অসতর্ক মুহূর্তে মা-বোনদের দেহের গোপনীয় অংশের প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়তে না পারে।
কুরআন মাজীদে উল্লিখিত এ সমস্ত নির্দেশকেই আমরা পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি। নবী করীম (ﷺ) এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মহিলাদের সতর হচ্ছে মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা ব্যতীত দেহের অবশিষ্টাংশ। এই সতরকে মুহাররাম (যাদের সাথে দেখা করা বৈধ) পুরুষ এমনকি পিতা, ভাই প্রমুখের সামনেও ঢেকে রাখতে হবে। মেয়েরা এমন কোনো মিহি কাপড় পরিধান করতে পারবে না, যাতে তাদেরগোপনীয় অংশ বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হতে পারে। তাছাড়া তাদেরকে মাহরাম পুরুষ ছাড়া অন্য কারো সাথে ওঠাবসা কিংবা ভ্রমণ করতে নবী করীম (ﷺ) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। শুধু তাই নয়, নবী করিম মহিলাদেরকে সুগন্ধি মেখেও ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি মসজিদে জামায়াতের সাথে নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য পৃথক স্থান পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। নারী ও পুরুষকে মিলিতভাবে একই কক্ষে বা একই স্থানে নামায আদায়ের তিনি কখনো অনুমতি প্রদান করেননি। এমনকি নামায শেষে খোদ নবী করীম (ﷺ) ও তার সাহাবীগণ মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে আগে বের হওয়ার সুযোগ দিতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মসজিদ থেকে সম্পূর্ণরূপে বের না হতেন ততক্ষণ পুরুষরা তাঁদের কক্ষের ভেতরেই অপেক্ষা করতেন। পর্দার এই সকল বিধান সম্পর্কে যদি কারো মনে সংশয় থাকে, তাহলে তিনি কুরআনের সূরা নূর ও সূরা আহযাব এবং হাদীসের বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন। বর্তমানে আমরা যাকে পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি, তার বাহ্যিক রূপে কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বটে। কিন্তু মূলনীতি ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার দিক দিয়ে রাসূলে কারীম (ﷺ) কর্তৃক মদিনার ইসলামী সমাজে প্রবর্তিত পর্দাব্যবস্থারই অনুরূপ। বস্তুত পর্দা সম্পর্কে আমাদের মনে যদি কোনো প্রকার সন্দেহমূলক বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে থাকে, তাহলে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়ারই বা কী অধিকার আছে? কারণ পর্দা কোনো মনগড়া জিনিস নয়, বরং এটি আল্লাহ এবং রাসূলেরই প্রদত্ত বিধান।