বিষয় নং-৩: ‘মু‘মিনের কলব আল্লাহর আরশ’ হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা:
মহান রব তা‘য়ালা স্থান কালের উর্ধ্বে। আল্লাহর কোন সৃষ্টি তাকে পরিবেষ্টন করতে অক্ষম।
❏ মহান রব তা‘য়ালা ইরশাদ করেন-
إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُحِيطٌ
-‘‘নিশ্চয়ই মহান রব সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।’’ (সূরা ফুস্সিলাত, আয়াত ৫৪)
❏ ইমাম ত্বাহাবী (رضي الله عنه) বলেন-
مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ وَقَدْ أَعْجَزَ عَنِ الإحاطة خلقه
-‘‘প্রত্যেক বস্তুই তাঁর পরিবেষ্টনে রয়েছে এবং তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আর সৃষ্টিকুল তাঁকে পরিবেষ্টনে অক্ষম।’’ (ইমাম তাহাভী, আক্বিদাতুল তাহাভী, ৫৬পৃ. ক্রমিক. ৫১, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪১৪হি.)
❏ মহান রব তা‘য়ার প্রিয় ভাজন ব্যক্তিদের মুহাব্বতের বিষয়ে একটি বর্ণনা-
مَا وَسِعَنِي أَرْضِي وَلَا سَمَائِي وَلَكِنْ وَسِعَنِي قَلْبُ عَبْدِي الْمُؤْمِنِ
-‘‘আসমান ও যমীন আমাকে সংকুলান করে না, কিন্তু একমাত্র আমার মুমিন বান্দার কলব আমাকে সংকুলান করে।’’ (ইমাম গায্যালী, ইহইয়াউল উলূম, ৩/১৫ পৃ., আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফুআ, ৩১০ পৃ. হা/৪২৩)
‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থে মাওলানা মুতীউর রহমান ৭৮ পৃষ্ঠায় এ বর্ণনাটিকে লোক মুখে প্রসিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর লিখিত ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ২৭৮ পৃষ্ঠায় একইভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন।
এ শব্দে সনদগতভাবে হাদিসটি কোথাও সংকলিত পাওয়া না গেলেও কিন্তু এর মমার্থ সহীহ। মুহাদ্দিসীনে কিরামের বক্তব্য হলো, এ হাদিসের মমার্থ বিশুদ্ধ। এবার আমরা হাদিসটির মূল বক্তব্যে পক্ষে কোনো সনদসহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে কীনা তা দেখবো।
প্রথম সূত্র:
❏ ইমাম তাবরানী (رحمة الله) সংকলন করেন-
حَدَّثَنَا جَعْفَرُ الْفِرْيَابِيُّ، ثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ رَاهَوَيْهِ، ثَنَا بَقِيَّةُ بْنُ الْوَلِيدِ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ زِيَادٍ، عَنْ أَبِي عِنَبَةَ الْخَوْلَانِيِّ، يَرْفَعُهُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ لِلَّهِ آنِيَةً مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ وَآنِيَةُ رَبِّكُمْ قُلُوبُ عِبَادِهِ الصَّالِحِينَ , وَأَحَبُّهَا إِلَيْهِ أَلْيَنُهَا وَأَرَقُّهَا
-‘‘বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবি ইনাবাতাল খাওলানী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে (ﷺ) ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ্ তা‘য়ালা বলেন, যমীনে আমি স্থান নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু যমীন আমাকে ধারণ করতে পারেনি, আমাকে ধারণ করেছেন আমার প্রিয় পূণ্যবান বান্দাদের অন্তর বা কলব, আর তার এ ধারণ ক্ষমতাকে এবং সূক্ষ্মতাকে আমি ভালবেসেছি।’’ ১০
১০. ইমাম তাবরানী : মুসনাদিশ শামীয়্যীন : ২/১৯ পৃ. হা/৮৪০, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি, জামেউস সগীর, ১/৩৬৪ পৃ : হা/২৩৭৫, ইমাম আবদুর রহমান সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা : পৃষ্ঠা নং ৩৮০, হা/৯৯০, আল্লামা আজলূনী : কাশফুল খাফা : ২/১৭৫ পৃষ্ঠা, হা/২২৫৪, আলবানী : সিলসিলাতুল আহাদিসুস সহীহা : হা/১৬৯১, সহিহুল জামে, হা/২১৬৩, আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি : জামেউল আহাদিস, ৯/১৯৬ পৃ. হাদিস: ৮২৩৩, শায়খ ইউসূফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ১/৩৭৭ পৃ. হা/৪০৯১, নাবিল সাদুদ্দীন সালিম র্জারার, ইমাঈ ইলা যাওয়াইদ, ৬/২১১ পৃ. হা/৫৫০৩, ইবনুল ইরাকী, তাখরীজে ইহইয়া, ১/৮৯০ পৃ., মানাভী, ফয়যুল কাদীর, ২/৬২৯ পৃ. ছুয়াইব আব্দুল জাব্বার, আল-জামেউস সহীহ লিল সহীহ লিল সুনান ওয়াল মাসানীদ, ২/৭৮৬ পৃ. ও ৩/১৬২ পৃ.
সনদ পর্যালোচনা:
● এ হাদিসের সমস্ত রাবীই বিশ্বস্ত ইনশা আল্লাহ। এমনকি আহলে হাদিসদের তথাকথিত শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেন, হাদিসটির মান ‘হাসান’।
(আলবানী, সহীহুল জামেউস সগীর ওয়া যিয়াদা, হা/২১৬৩, সিলসিলাতুল আহাদিসুস সহীহহা, ৪/২৬৩ পৃ. হা/১৬৯১)
আমার গভীর দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই উক্ত হাদিসটি সহীহ, যদিও আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন। আলবানী উক্ত হাদিসের অন্যতম একজন রাবী ‘বাকীয়্যাতু বিন ওয়ালিদ বিন ছয়ীদ’ এর উপর তাদলীস করার অভিযোগ করে হাদিসটির মান ‘হাসান’ বলেছেন। আমি বলবো,
❏ এ হাদিসের উস্তাদ (মুহাম্মদ ইবনে যিয়াদ) সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله) লিখেন-
وَرَوَى عَنْ: مُحَمَّدِ بنِ زِيَادٍ الأَلْهَانِيِّ -
‘‘তিনি মুহাম্মদ ইবনে যিয়াদ হতে বর্ণনা করেছেন।’’ (যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৫১৮ পৃ. ক্রমিক. ১৩৯)
বুঝা গেল যে, রাবী ‘মুহাম্মদ বিন যিয়াদ’ থেকে রাবী ‘বাকিয়্যাতুল’ শুনা প্রমাণিত।
❏ ইমাম সাখাভী (رحمة الله) লিখেন-
وفي سنده بقية بن الوليد، وهو مدلس، ولكنه صرح بالتحديث.
-‘‘এ সনদে রয়েছে ‘বাকিয়্যাত ইবনে ওয়ালিদ’ তিনি মুদাল্লিস বা তাদলিসকারী। তবে তিনি এ হাদিসে তাদলীস করেননি।’’ (সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, ৫৯০ পৃ. হা/৯৯০)
❏ ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন- الحَافِظُ، العَالِمُ -‘‘তিনি ছিলেন হাফেযুল হাদিস, আলিম।’’ (যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৫১৮ পৃ. ক্রমিক. ১৩৯)
আসল কথা হলো তিনি বুখারী মুসলিমের রাবী।
দ্বিতীয় সূত্র:
❏ ছয় লক্ষেরও বেশী হাদিসের হাফেয ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এ বিষয়ের সমর্থনে আরেকটি বর্ণনা এভাবে উল্লেখ করেন-
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ، حَدَّثَنِي أبِي، أَخْبَرَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ خَالِدٍ، حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ عُبَيْدٍ، أَنَّهُ سَمِعَ وَهْبَ بْنَ مُنَبِّهٍ يَقُولُ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ فَتَحَ السَّماَوَاتِ لِحِزْقِيلَ حَتَّى نَظَرَ إِلَى الْعَرْشِ - أَوْ كَمَا قَالَ - فَقَالَ حِزْقِيلُ: سُبْحَانَكَ، مَا أَعْظَمَكَ، يَا رَبِّ، فَقَالَ اللَّهُ: إِنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَمْ تُطِقْ أَنْ تَحْمِلَنِي، وَضِقْنَ مِنْ أَنْ تَسَعَنِي، وَسِعَنِي قَلْبُ الْمُؤْمِنِ الْوَارِعِ اللَّيِّنِ
-‘‘আসমানী ৭১ টি কিতাবের জ্ঞানী হযরত ওহাব ইবনে মুনাব্বাহ (رحمة الله) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘য়ালা হিযকিল নামক ফেরেশতার জন্য আসমান সমূহকে খুলে দিলেন। ফলে তিনি আরশ পর্যন্ত দেখতে পেলেন এবং বললেন আল্লাহ্ তুমি পাক পবিত্র, তোমার শান কত মহান। হে রব! অত:পর আল্লাহ্ তা‘য়ালা বললেন, নিশ্চয় আসমান ও যমিন আমাকে ধারণ করতে দূর্বলতা প্রকাশ করেছে, আমাকে দুনিয়াবিমুখ মু‘মিনের দিল বা অন্তর নম্রতা প্রকাশ করে আমাকে গ্রহণ করেছে।’’১১
১১. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল : কিতাবুত যুহুদ, যুহুদে ইউসূফ (আ.) অধ্যায়, ১/৬৯ পৃ. হা/৪২৩, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪২০ হি., আল্লামা ইমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা : ৪২৯ পৃ. হা/৯৮৮, আল্লামা আজলূনী : কাশফুল খাফা : ২/১৯৫ পৃ., আল্লামা ইমাম মানাবী : ফয়জুল কাদীর, ১/২৮২ পৃ., আল্লামা তাহের পাটনী : তাযকিরাতুল মওযুআত : ১/১৩০ পৃ., আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভি : আসারুল মারফ‚‘আ : ৩১০, কিরমানী, ফাওয়াইদুল মাওদ্বুআত, ৭৮ পৃ., ইবনুল ইরাক, তানযিহুশ শরীয়াহ, ১/১৪৮ পৃ., ইমাম সুয়ূতি, লা-আলিল মাসনুআ, ২৯৩ পৃ., মোল্লা আলী ক্বারী, আসারুল মারফূআ, ৩১০ পৃ., আল্লামা মানাবী : হাদীসে কুদসী : হা/৯৯
সনদ পর্যালোচনা:
এ হাদিসের সনদে কোনো সমালোচিত রাবী নেই। উক্ত হাদিসটি সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, সাখাভী, আজলূনী এবং মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) প্রমুখ মুহাদ্দিস নীরবতা পালন করেছেন।
তৃতীয় সূত্র:
❏ ইমাম গায্যালী (رحمة الله) একটি হাদিস সংকলন করেন-
حَدِيث ابْن عمر: قيل لرَسُول الله، يَا رَسُول الله أَيْن الله فِي الأَرْض أَو فِي السَّمَاء. قَالَ فِي قُلُوب عباده الْمُؤمنِينَ
-‘‘হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা কেউ রাসূল (ﷺ) এর দরবারে আরজ করলেন, হে আল্লাহর প্রিয়তম রাসূল! আমি জানতে চাই ‘‘আল্লাহ্ কী আসমানে না যমিনে? রাসূল (ﷺ) তাঁর নূরাণী জবানে বললেন, আল্লাহ্ মু‘মিন বান্দাদের হৃদয়ে।’’ ১২
১২. ইমাম গায্যালী, ইহ্ইয়াউল উলুমুদ্দীন, ৩/১৫ পৃ, দারুল মা‘রিফ, বয়রুত, লেবানন।
তবে এ সূত্রটির কোন সনদ আমি খুঁজে পাইনি।
তাই এ বিষয় বস্তুটি প্রমাণিত হল, আরও প্রমাণ পাওয়া গেল এ বিষয়ে সনদসহই হাদিসে পাক রয়েছে।