চতুর্থ পরিচ্ছেদ

ইলমে গায়ব সম্পর্কে উত্থাপিত যুক্তি নির্ভর (আকলী)

আপত্তি সমূহের বিবরণ


১নং আপত্তিঃ 

ইলমে গায়ব হচ্ছে খোদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এতে কাউকে অংশীদার গণ্য করা খোদার গুণাবলীতে শির্ক করার নামান্তর। সুতরাং,  রাসূল (ﷺ)-এর জন্য ইলমে গায়ব বিশ্বাস করাটা ‘শির্ক’।


উত্তরঃ অদৃশ্য বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে জানাটা যেমন খোদার বৈশিষ্ট্য; তেমনি দৃশ্যমান যাবতীয় জ্ঞানও খোদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা গুণ 


❏  عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ 


(তিনি দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।) 


অনুরূপ, শোনা, দেখা, জীবিত হওয়া ইত্যাদিও খোদার গুণাবলী। সুতরাং, কাউকে কোন দৃশ্যমান বস্তু বা বিষয়ে জ্ঞাত বলে স্বীকার করা বা কাউকে শ্রোতা, দ্রষ্টা অথবা, জীবিত বলে মেনে নেওয়া প্রত্যেকটি কাজই শির্করূপে গণ্য হবে। কিন্তু তা’ কখনও হতে পারে না। কেননা, শুধু এতটুকু পার্থক্য নির্ণয় করা হয় যে, আমাদের শ্রবণ, দর্শন, জীবিত থাকা প্রভৃতি হচ্ছে সত্বাগত, সহজাত ও চিরন্তন। তাই শির্ক কিরূপে হলো? তদ্রুপ নবী (ﷺ)  এর ইলমে গায়বও খোদা প্রদত্ত, অচিরন্তন এবং সসীম।


পক্ষান্তরে, খোদার এ বৈশিষ্ট্য সত্ত্বাগত, চিরন্তন এবং তার সম্পূর্ণ জ্ঞাত বিষয়াদিও অসীম। অধিকন্তু, এ শিরকের ব্যাপারটি আপনাদের বেলায়ও প্রযোজ্য, কেননা আপনারাও তো  রাসূল (ﷺ)-এর অদৃশ্য জ্ঞানের কথা আংশিকভাবে হলেও স্বীকার করেন। খোদার কোন গুণে সার্বিকভাবে হোক কিংবা আংশিকরূপে, যে কোন অবস্থায় অংশীদার স্বীকার করাটা শির্ক। 


❏ আরও উল্লেখ্য যে মওলবী হোসাইন আলী সাহেব, যিনি মওলবী রশীদ আহমদ সাহেবের খাস শাগরিদ, স্বীয় কিতাব ‘বলগাতুল হয়রান’ এ আয়াতে করীমা

{সূরাঃ হুদ, আয়াতঃ ৬, পারাঃ ১২}


وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ


এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন- “আল্লাহ তা’আলাও সব সময় সৃষ্টিকুলের কর্মকান্ড সম্পর্কে জ্ঞাত হন না।” 

বরং বান্দাগণ যখনই তাদের কার্যাবলী সমাধা করে, তখনই অবগত হন। এখনতো ইলমে গায়বও খোদার গুণ হিসেবে গণ্য হলো না। তাহলে কারো জন্য ইলমে গায়ব স্বীকার করলে শির্ক হবেই বা কেন?


❏ ২নং আপত্তিঃ  

রাসূল (ﷺ) কখন ইলমে গায়বের অধিকারী হলেন? আপনারা কখনো বলে থাকেন যে মিরাজের রাতে তাঁর বুকে এক ফোঁটা পানি পতিত হয়েছিল, ফলে তিনি ইলমে গায়বের অধিকারী হয়েছেন। আবার কখনো বলেন যে স্বপ্নে খোদার দর্শন লাভে ধন্য হয়েছিলেন। মহাপ্রভূ তার কুদরতের হাতখানা  রাসূল (ﷺ)-এর স্কন্ধ মুবারকের উপর রেখেছিলেন। যার ফলে তিনি যাবতীয় জ্ঞান লাভ করেছিলেন। কোন সময় এ রকমও বলেন যে কুরআনের মাঝে সমস্ত কিছুর বর্ণনা রয়েছে, এর অবতরণের মেয়াদ সমাপ্ত হওয়ায় ইলমে গায়ব সম্পূর্ণরূপে অর্জিত হয়েছে। এসব বক্তব্যসমূহের কোনটি সঠিক? যদি কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেই এ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকেন, তবে কুরআন থেকেই বা কি পেলেন? অর্জিত বস্তুর অর্জন তো অসম্ভব।


উত্তরঃ আসল ইলমে গায়বতো  রাসূল (ﷺ)কে তাঁর জন্মের আগেই দান করা হয়েছিল। কেননা, 


❏ তিনি জন্মের আগে আত্মিক জগতে নবী ছিলেন


 كُنْتُ نَبِيًّاوَاَدَمُ بَيْنَ الطِّيْنِ وَالْمَاءِ 


‘‘আমি তখনও নবী ছিলাম, যখন আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করা হয়নি।’’  

{ক. আল্লামা আজলূনীঃ কাশফুল যাফাঃ ২/১২৯ পৃ.

খ. ইমাম সাখাভীঃ মাকাসিদুল হাসানঃ ৫২০-৫২১ পৃ.

গ. শায়খ ইউসূফ নাবহানীঃ জাওয়াহিরুল বিহারঃ

ঘ. ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ জামিউল আহাদিসঃ ৬/৪৬৩

ঙ. ইবনে কাসীরঃ সিরাতে নববীয়্যাতঃ ১/৩৩৬ পৃ.

চ. ইমাম হাকেমঃ মুস্তাদরাকঃ ২/৬০৮

ছ. ইমাম বায়হাকীঃ দালায়েলুল নবুয়তঃ ১/৮৪ পৃ.

জ. ইমাম আবু নুঈমঃ হুলিয়াতুল আওলিয়াঃ ৭/১২২পৃ.

ঝ. তাবরানীঃ মু’জামুল কবীরঃ ২০/৩৪৩ পৃ. হাদিসঃ ৮৩৩

ঞ. ইমাম বুখারীঃ তারীকুল কবীরঃ ৭/২৫১ হাদিসঃ ১০৯৪৪

ট. আহমদঃ আল-মুসনাদঃ ৫/৫৯

ঠ. ইবনে হিব্বানঃ আস-সহীহঃ হাদিসঃ ২০৯৩

ড. ইবনে সা’দঃ তবকাতুল কোবরাঃ ১/১৪৮ পৃ.

ঢ. আবি শায়বাহঃ আল-মুসান্নাফঃ ১৪/২৯২ পৃ.

ণ. ইবনে হাজার আসকালানীঃ আল-ইসাবাঃ ৪/৩৭ হাদিসঃ ৪৫৮৯}

  

আর নবী তো তাঁকেই বলা হয়, যিনি অদৃশ্য বিষয়ের খবর দেন। 


❏ তবে, مَاكَان وَمَا يَكُوْنَ পূর্বাপর যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান ছিল প্রত্যক্ষ দর্শন জনিত। অর্থাৎ সমস্ত কিছু নিজ চোখে দেখেই জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 


❏ এ জন্যেই কুরআনে উল্লেখিত আছেঃ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْئٍ অর্থাৎ- কুরআন প্রত্যেক কিছুর বর্ণনা সম্বলিত।  

{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৮৯, পারাঃ ১৪}

  

❏ আর মিরাজে যা কিছু ঘটেছে তা হলো 


فَتَجَلَّي لِيْ كُلُّ شَيٍْء وَعَرَفْتُ 


অর্থাৎ- প্রত্যেক কিছুই আমার নিকট উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হয়েছে ও আমি সব কিছুই জানতে, চিনতে পেরেছি।’’  

{হাদিসের আলোকে ইলমে গায়ব অধ্যায়ে এটির তাখরীজ দেয়া আছে ।}

  

দেখা একথা, আর বর্ণনা আর এক কথা। যেমন হযরত আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করে মহাপ্রভূ সমস্ত কিছুই দেখিয়ে দিয়েছেন। তার পরেই সে সমস্ত কিছুর নাম বলে দিয়েছেন। আগেরটা হচ্ছে প্রত্যক্ষ দর্শন আর পরেরটা হচ্ছে বর্ণনা। যদি বস্তুসমূহ দেখানো না হতো, 


❏ তাহলে ثُمَّ عَرَ ضَهُمْ عَلَي الْمَلَئِكَةِ 


(অতঃপর সে সমস্ত বস্তু ফিরিশতাগণের সামনে উপস্থাপন করলেন আল্লাহ)  

{সূরাঃ বাক্বারাঃ আয়াতঃ ৩১, পারাঃ ১}


এর কি তাৎপর্য হতে পারে? সুতরাং, উভয়বিধ উক্তিই সঠিক। অর্থাৎ মেরাজেও জ্ঞান লাভ করেছেন এবং কুরআন থেকেও। যদি বলা হয়, তাহলে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? সমস্ত বিষয়তো হুযুরের আগে থেকেই জানা ছিল; জ্ঞাত বিষয়ে জ্ঞান লাভের কি অর্থ হবে? কারণ অজ্ঞাত বিষয়ই তো জ্ঞাত করা হয়। এর উত্তর হলো- কুরআনের অবতরণ কেবল  রাসূল (ﷺ)-এর জ্ঞান লাভের জন্য নয়, বরং এর নানাবিধ উদ্দেশ্য ছিল। যেমন কোন আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আয়াত এর সাথে সংশি­ষ্ট আহকাম বা বিধিবিধান জারী হবে না; তার তিলাওয়াত ইত্যাদিও হবে না। আর কুরআনের অবতরণ যদি হুযুর (ﷺ)  এর জ্ঞান লাভের জন্য হতো, তাহলে কোন কোন সুরা দু’বার অবতীর্ণ হলো কেন?

যেমনঃ


❏  ‘তাফসীরে মাদারেকে’ আছেঃ


فَاتِحَةُ الْكِتَابِ مَكِّيَّةٌُ وَّقِيْلَ مَدَ نِيَّةٌُ وَالْاصَحُّ اَنَّهَ-

 مَكِيَّةٌُ وَمَدَنِيَّةٌُ نَزَلَتْ بِمَكَّةَ ثُمَّ نَزَلَتْ بِالْمَدِيْنَةِ


অর্থাৎ- সূরা ফাতিহা হচ্ছে মক্কী সূরা, আবার কেউ কেউ বলেন যে, তা মাদানী সূরা। তবে সর্বাধিক সঠিক মত হলো তা মক্কী সূরা, আবার মাদানী সূরাও। প্রথমে এ সূরা মক্কায়, পরে মদীনায় অবতীর্ণ হয়। 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৫ পৃ.}

 

❏ মিশকাত শরীফে মিরাজের বর্ণনা সম্বলিত একট হাদীছে আছে যে, মিরাজের রাত্রে  রাসূল (ﷺ)কে পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং সুরা বাকারার শেষ আয়াত সমূহ দান করা হয়েছিল। 


❏ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, মিরাজতো মক্কা শরীফে হয়েছিল সূরা ‘বাকারা’ হলো মাদানী সূরা। তাহলে এর শেষ আয়াত সমূহ মিরাজে কিভাবে দান করা হলো? 


❏ তিনি নিজেই এর উত্তর দিচ্ছেন -


حَصِلَهُ اَنَّهُ وَقَعَ تَكْرَارُ الْوَحِيْ فِيْهِ تَعْظِيْمًا لَّهُ وَاِهْتِمَامًا لِّشَانِهِ فَاَوْحيَ اللهُ اِلَيْهِ فِي تِلْكَ اللَّيْلَةِ بِلاَوَاسِطَةِ جِبْرٍيْلَ


-‘‘সার কথা হলো, এ সম্পর্কে ওহী দু’বার নাযিল হয়েছিল হুযুর আলাইহিস সারাম এর সম্মান ও মাহাত্মের প্রতি গুরুত্বারোপের জন্যই। আর মিরাজের সময়েও সে আয়াতগুলো হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) এর মাধ্যম ছাড়াই প্রত্যক্ষভাবে ওহী করা হয়েছিল। 

{মোল্লা আলী ক্বারীঃ মেরকাতঃ ১১/১৫৬ পৃ.}

  

❏ এ হাদীছের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ‘লুমআত’ গ্রন্থে বর্ণিত আছেঃ


نَزَلَتْ عَلَيْهِ صَلَّي اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةَ الْمِعْرَاجِ بِلاَ وَاسِطَةٍ ثُمَّ نَزَلَ بِهَا جِبْرٍيْلُ فَاُثْبِتَ فِي الْمَصَاحِفِ


অর্থাৎ- মিরাজের রাতে এ আয়াতসমূহ মাধ্যম ব্যতিরেকে সরাসরি অবতীর্ণ হয়েছিল। পুনরায় সে এগুলোকে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) এর মাধ্যমে অবতীর্ণ হরা হয়, এর ফলে কুরআনের অন্তভুর্ক্ত হয়। 

{হাশীয়ায়ে মেশকাতঃ ৫২৯-৫৩০ পৃ., নূর মুহাম্মদ কুতুবখানা, করাচী}


এখন বলুন, দু’বার অবতীর্ণ হলো কেন?  রাসূল (ﷺ)-এরতো প্রথমবার অবতীর্ণ হওয়ার পরেই সংশি­ষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জিত হয়েছিল। অধিকন্তু, প্রতি বছর রমযান মাসে জিব্রাইল আমীন  রাসূল (ﷺ)কে সম্পূর্ণ কুরআন পড়ে শুনাতেন। 


❏ ‘নুরুল আনোয়ার’ গ্রন্থে ভূমিকায় ‘কিতাব’ (কুরআনের) এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছেঃ


لِاَنَّهُ كَانَ يَنْزِلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ دَفْعَةً وَّاحدةً فِيْ كُلِّ شَهْرِ رَمْضَانَ جُمْلَةً


-‘‘প্রতি রমযান মাসে সমগ্র কুরআন একবার হুযুর (عليه السلام) এর প্রতি অবতীর্ণ হতো।’’ 

{মোল্লা জিওনঃ নূরুল আনোওয়ারঃ ৫পৃ.}

  

এখন বলুন এ অবতরণ কি জন্যে? বরং কুরআন থেকে জানা যায় যে, সমস্ত আসমানী কিতাবের পূর্ণ জ্ঞান হুযুর (عليه السلام) এর ছিল। 


❏ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ


يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ


-‘‘হে কিতাবীগণ, তোমাদের কাছে আমার সেই রাসূল আগমন করেছেন, যিনি তোমাদের কিতাবের অনেক গোপনকৃত তথ্য উদঘাটন করছেন এবং অনেক বিষয়ে তোমাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন।’’ 

{সূরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ১৫, পারাঃ ৬}


যদি সমস্ত ঐশী গ্রন্থ  রাসূল (ﷺ)-এর জ্ঞানের আওতাভুক্ত না হয়, তাহলে সে সমস্ত গ্রন্থ থেকে তাঁর তথ্য উদ্ঘাটন করা বা না করার কি অর্থ হতে পারে? আসল কথা হচ্ছে  রাসূল (ﷺ) প্রথম থেকে কুরআন সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত ছিলেন, কিন্তু কুরআনী অনুশাসন সমূহ কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার আগে জারী করেন নি। এ জন্য বুখারী শরীফের প্রথম হাদীছে উল্লেখিত আছে যে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) হেরা গুহায় প্রথমবার আগমন করে আরয করেছিলেন- اِقْرَءْ (আপনি পাঠ করুন) একথা বলেন নি যে, অমুক আয়াতটি পাঠ করুন। আর ‘পড়’ কথাটি তাকেই তো বলা হয়, যিনি জানেন।  রাসূল (ﷺ) বলেন بِقَارٍ (আমি পাঠক নই) আমি বরং পড়াবার লোক। পাঠ তো আগেই করেছি। কারণ, লওহে মাহফুজে কুরআন বিধৃত আছে, আর সেই লওহে মাহফুজতো প্রথম থেকেই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। তিনি জন্মের আগে থেকেই কুরআনধারী নবী। ওহি প্রাপ্তি ছাড়া নবুয়াত ঘোষিত হয় কিভাবে? স্বীকার করতেই হবে যে, রাসূল (ﷺ)  জন্মের আগে থেকেই কুরআন সম্পর্কে অবগত।

অনেক শিশু হাফিয হিসাবে জন্মগ্রহণ করে।


❏ হযরত ঈসা (عليه السلام) ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই বলেছেনঃ اَتَانِىَ الْكِتَابَ 

(আল্লাহ আমাকে কিতাব দিয়েছেন।)  

{সূরাঃ মারইম, আয়াতঃ ৩০, পারাঃ ১৬}

  

বোঝা গেল যে, তখন থেকেই তিনি কিতাব সম্পর্কে জ্ঞাত। কোন কোন নবী সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে- اَتَيْنَاهُ الْحُكْمَ صَبِيًّا 

(আমি তাঁকে শৈশবে জ্ঞান দর্শনদার করেছি)।   

{সূরাঃ মারইম, আয়াতঃ ১২, পারাঃ ১৬}

  

রাসূল (ﷺ) জন্মের সাথে সাথেই সিজদায় গিয়ে উম্মতের জন্য সুপারিশ করেছেন, অথচ সিজদা ও শাফাআত হলো কুরআনী বিধি ব্যবস্থার অন্তভুর্ক্ত। গাউছে পাক (رضي الله عنه) রমযান মাসে মায়ের দুধ পান করেন নি। এটাও (রমযান মাসে দুধ পানে বিরত থাকা) কুরআনী বিধানের অন্তভুর্ক্ত। 


❏ ‘নুরুল আনোয়ার’ গ্রন্থের ভূমিকায় চারিত্রিক গুণাবলীর আলোচনায় উল্লেখিত আছেঃ


اِنَّ الْعَمَلَ بِالْقُرْاَنِ كَانَ جِبِلَّةً لَّهُ مِنْ غَيْرِ تَكَلُّفٍ


অর্থাৎ- কুরআন অনুযায়ী তাঁর চালচলন তাঁরই স্বভাবজাত, কষ্টার্জিত আচরণ নয়।  

{মোল্লা জিওনঃ নূরুল আনওয়ারঃ ৫-৬ পৃ.}


বোঝা গেল যে, কুরআন অনুযায়ী আমল করাটা ছিল  রাসূল (ﷺ)-এর জন্মগত অভ্যাস বা স্বভাবসুলভ আচরণ। রাসূল (ﷺ)  সব সময়ই ধাত্রী মাতা হযরত হালীমার ডান স্তন থেকেই দুধ পান করেছেন এবং অপর স্তনটি ভাইয়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এ ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারও কুরআনী হুকুম প্রসূত। যদি কুরআন সম্পর্কে প্রথম থেকেই অবহিত না হতেন, তাহলে এ ধরনের বিধান সম্মত আমল কিভাবে করছেন তিনি?

দেওবন্দীদের আরও একটি বহুল আলোচিত আপত্তি হলো আপনাদের উপস্থাপিত আয়াত সমূহের ব্যাপকতা থেকে এটা অপরিহার্যরূপে প্রতীয়মান হয় যে, হুযুরের জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের সমতুল্য। কিন্তু আপনারা সে সব আয়াতে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের সীমারেখা অংকন করেন।


 مَالَمْ تُكُنْ تَعْلَمُ (যা আপনি জানতেন না)


এ আয়াতাংশে না তো কিয়ামত অবধি সময়ের সীমারেখা আছে, না مَاكَانَ وَمَا يَكُوْنَ পূর্বাপর সবকিছুর উল্লেখ আছে। নিয়ম হচ্ছে একবার ‘খাস’ বা সীমিত করলে পরবর্তীতেও বিশেষত্বের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ একবার কোন ব্যাপক বিষয়ের পরিধিকে সংকোচন করা হলে, আরও অধিক সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। (উসুলের কিতাবসমূহে দেখুন) সুতরাং, আমরা ওইসব আয়াতে শরীয়তের অনুশাসন সমূহকে লক্ষ্যার্থরূপে গ্রহণ করে আয়াতের অর্থকে সংকুচিত করি। অর্থাৎ আমরা বলি যে ওই সমস্ত আয়াতে শুধু শরীয়তের অনুশাসন সমূহের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে; পূর্বাপর সব কিছুর জ্ঞানকে বোঝানো হয়নি।


এর উত্তর হলোঃ সংশি­ষ্ট আয়াতে বিশেষত্ব জ্ঞাপক কোন শর্তের উল্লেখ নেই, বরং যুক্তি নির্ভর ব্যতিক্রমের কথাই বিধৃত হয়েছে। কেননা আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে অসীম আর সৃষ্টিকূরের মস্তিষ্ক অসীম জ্ঞান ধারণ করতে পারে না। কেননা, শৃঙ্খল পরম্পরার ‘অসীমতা’ বাতিল বলে স্বীকৃত। সুতরাং, যুক্তিসঙ্গত কারণে সৃষ্টিকূলের জ্ঞান অসীম হবে। হাদীছ সমূহ থেকে প্রমাণ মিলে যে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের অনেক কিছুর খবর দিয়েছেন হুযুর (عليه السلام)। এ জন্য এ দাবী করা হয়েছে। ‘ব্যতিক্রম’ ও ‘বিশেষত্বের’ বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। দেখুন اَقِيْمُوالصُّلَوةَ (নামায কায়েম কর) দ্বারা যে বিধান নির্দেশিত হয়, সে বিধানের আওতায় শিশু, পাগল, ঋতুবর্তী মহিলা আসে না। তাই এটি বিশেষথ্ব জ্ঞাপক নির্দেশ নয়, বরং ব্যতিক্রম ধর্মী নির্দেশ।


এ অসহায় ব্যক্তি (গ্রন্থকার) ইলমে গায়ব সম্পর্কে এ সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেছে। এ সম্পর্কে যদি আরও অধিক জানতে চান, তাহলে বরকত মন্ডিত পুস্তিকা- “আল কলিমাতুল উল্য়া” অধ্যয়ন করুন। আমি যা কিছু বলেছি, তা সে অগণিত তরঙ্গ সমৃদ্ধ সমুদ্রের যেন একটি মাত্র তরঙ্গ। যেহেতু আমাকে অন্যান্য আরও মাসায়েল সম্পর্কে আলোকপাত করতে হবে, সেজন্য এতটুকু লিখেই বক্ষ্যমান আলোচনা সমাপ্ত করলাম।


وصلى الله تعلى على خير خلقه سيد نا محمد واله واصحابه اجمعين برحمتك وهوار حم الر احمين

 

দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলবী কাসেম সাহেব তাঁর রচিত ‘তাহযীরুন নাস গ্রন্থে ১০ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ এ আয়াতের اَوْلَى শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘নিকটতর’।


তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় ‘নবী মুসলমানদের কাছে তাঁদের প্রাণের চেয়েও ‘নিকটতর’। আমাদের নিকটতম হচ্ছে আমাদের প্রাণ; এ প্রাণ থেকেও নিকটতর হচ্ছেন নবী আলাইহিস সালাম। বলা বাহুল্য যে, অতি নিকটে অবস্থিত বস্তু দৃষ্টিগোচর হয় না। অত্যধিক নৈকট্যের কারণে আমরা তাঁকে [প্রিয়নবী (ﷺ)] চোখে দেখতে পাই না।


বিঃ দ্রঃ- এখানে কিছু সংখ্যক লোক এ আপত্তিটা উত্থাপন করে থাকেন যে, আপনারা যেহেতু মুক্কালি­দ, আপনাদের জন্য কুরআনের আয়াত ও হাদীছ সমূহ থেকে দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করাতো জায়েয নয়। একজন মুকালি­দের উচিত তার বক্তব্যের সমর্থনে স্বীয় ইমাম (মুজতাহিদ ইমাম) এর উক্তি পেশ করা। সুতরাং, আপনারা কেবল আবু হানীফা (رحمة الله) এর উক্তিই পেশ করতে পারেন।



এর উত্তর কয়েকভাবে দেয়া যায়ঃ


(ক) আপনারা নিজেরাই যেহেতু ‘হাযির-নাযির’ না হওয়ার আকীদা পোষণ করেন, সেহেতু আপনাদেরই উচিত ছিল আপন আকীদা এর সমর্থনে ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর উক্তি উপস্থাপন করা। 


(খ) আমি তাকলীদের’ আলোচনায় পূর্বেই উলে­খ করেছি যে, আকীদা সম্পর্কিত কোন মাসআলায় তাকলীদ হয় না; কেবলমাত্র ফকীহগণের গবেষণালবদ্ধ মাসায়েলের ক্ষেত্রেই ‘তকলীদ’ প্রযোজ্য হয়। আলোচ্য বিষয়টি হচ্ছে ‘আকীদা’ এর একটি মাসআলা। 


(গ) মুকালি­দ সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীছ সমূহ থেকে দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে। তবে হ্যাঁ এসব দলীলের ভিত্তিতে নিজে মাসায়েল বের করতে পারে না। 


❏ এ প্রসঙ্গে ‘তাহাবী’ শরীফে উলে­খিত আছেঃ


وَمَافُهِمَ اَلاَحْكَامُ مِنْ نَحْوِ الظَّاهِرِ وَالنَّصِّ اَلْمُفَسَّرِ فَلَيْسَ مُخْتَصًّا بِهِ (اَىْ بِالْمُجْتَهِدِ) بَلْ يَقْدِرُ عَلَيْهِ الْعُلَمَآءُ الْاَعَمُّ


-‘‘যে সমস্ত আহকাম বা শরীয়ত বিধি কুরআনের ‘যাহির’ ‘নাস’ ও ‘মুফাসসার’ ইত্যাদি প্রকৃতির আয়াত থেকে সরাসরি সুস্পষ্টভাবে বোধগম্য হয় সে সকল মাসায়েলও মুজতাহিদের গবেষণা প্রসূত হতে হবে, এমন কথা বলা যায় না। এসব মাসায়েলও বরং সাধারণ আলিমগণও বের করার সামর্থ রাখেন।’’


❏ সুবিখ্যাত ‘মুসাল্লামুছ ছবুত’ নামক ‘উসুলে ফিক্হ’ এর গ্রন্থ উলে­খিত আছে


وَاَيْضًا شَاعَ اِحْتِجَاجُهُمْ سَلْفًا وَخَلْفًا بِالْعُمُوْمَاتِ مِنَ غَيْرٍ نكير


-‘‘অধিকন্তু, ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করার রীতি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ধর্মীয় মনীষীদের মধ্যে কোনরূপ ওজর আপত্তি ছাড়াই প্রচলিত হয়ে আসছে। 


❏ কুরআন করীমও ইরশাদ করছেঃ


فَاسْئَلُوْا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ


-‘‘যদি তোমরা না জান, তবে জ্ঞানীদের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করো।’’   

{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৪৩, পারাঃ ১৪}


ইজতিহাদী মাসায়েল যেহেতু আমরা জানি না, সে জন্য আমরা ইমামদের অনুসরণ করি। আর সুস্পষ্ট অর্থবোধক আয়াতসমূহের অর্থ আমরা বুঝি, সেজন্য এসব ব্যাপারে তকলীদ নিষ্প্রয়োজন। 


(ঘ) ‘হাযির-নাযির’ এর মাসআলা সম্পর্কে সুবিখ্যাত ফকীহ, মুহাদ্দিছ ও তাফসীরকারকদের উক্তিসমূহের বিশদ বর্ণনা পরবর্তী পরিচ্ছেদ সমূহেও করা হবে। গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন যে, ‘হাযির-নাযির’ এর এ আকীদা সমস্ত মুসলমানই পোষণ করে।

Top