দ্বিতীয় অধ্যায়
বিশ রাকাত তারাবীহ প্রসঙ্গে আপত্তির জবাব
১নং আপত্তিঃ
✦ মিশকাত শরীফের قيام شهر رمضان অধ্যায়ে ও মুয়াত্তা ইমাম মালিকে বর্ণিত আছে যে হযরত উমর (رضي الله عنه) আবি কা’ব ও দারমী (رضي الله عنه) কে নির্দেশ দিয়েছেন যেন লোকদেরকে এগার রাকাত নামায পড়ায়। এতে প্রমাণিত হয় যে তারাবীহ আট রাকাত; বাকী তিন রাকাত হচ্ছে বিতর।
উত্তরঃ এর জবাব কয়েক রকম করে দেয়া যায়।
প্রথমতঃ এ হাদীছটি ময্তরব (একই রাবী থেকে একই বিষয়ে বিভিন্ন রেওয়ায়েত এবং ময্তরব হাদীছ দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না। এ হাদীছের রাবী হচ্ছে মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ। মুয়াত্তাতে তাঁর থেকে এগার রাকাত বর্ণিত আছে, মুহাম্মদ ইবনে নসর মরুজী তাঁর বরাত দিয়ে তের রাকাত বর্ণনা করেছেন এবং মুহাদ্দিছ আবদুর রায্যাক তাঁর বরাত দিয়ে অন্য সনদে একুশ রাকাত বর্ণনা করেছেন। (বুখারী শরীফের শরাহ ফতুহুল বারীর চতুর্থ খণ্ড ১৮০ পৃষ্ঠায় এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেখুন। সুতরাং এ সমস্ত রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য নয়।)
দ্বিতীয়তঃ যদি তাদের কথা মত এ হাদীছটি সহীহ বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে তারাবীহ আট রাকাত প্রমাণিত হলো। এবং তিন রাকাত বিতরও প্রমাণিত হলো। কিন্তু তারা বিতর এক রাকাত পড়ে কেন? তাদের কথা মতো নয় রাকাতই হওয়া উচিত চিল। তাহলে কি হাদীছের অর্ধেকাংশ গৃহীত এবং অর্ধেকাংশ বর্জিত?
তৃতীয়তঃ হযরত উমর (رضي الله عنه) এর যুগে প্রথমে আট রাকাত তারাবীহের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। পরে বার রাকাত এবং শেষে বিশ রাকাত ধার্য হয়। কারণ,
✦ মিশকাত শরীফের قيام شهر رمضان শীর্ষক অধ্যায়ে সেই হাদীছের পরে বর্ণিত আছে-
وَكَانَ الْقَارِئُ يَقْرَأُ سُورَةَ الْبَقَرَةِ فِي ثَمَانِ رَكَعَاتٍ وَإِذَا قَامَ بِهَا فِي ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً رَأَى النَّاسُ أَنه قد خفف. رَوَاهُ مَالك
অর্থাৎ ক্বারী আট রাকাতে সূরা বাকারা পড়তেন এবং পরে যখন বার রাকাতে এ সূরা পড়তেন, তখন লোকদের কাছে হালকা মনে হতো। এ হাদীছের প্রেক্ষাপটে মিরকাতে বর্ণিত আছে -৬৫৯
➥659. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ৩/৯৭২
نَعَمْ ثَبَتَ الْعِشْرُونَ مِنْ زَمَنٍ عُمَرَ، فَفِي الْمُوَطَّأِ عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُومَانَ، قَالَ: كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ بِثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً، وَرَوَى الْبَيْهَقِيُّ فِي الْمَعْرِفَةِ عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: كُنَّا نَقُومُ فِي زَمَنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرِ، قَالَ النَّوَوِيُّ فِي الْخُلَاصَةِ: إِسْنَادُهُ صَحِيحٌ.
অর্থাৎ ওই সমস্ত রেওয়ায়েতকে এ জন্য একত্রিত করা হয়েছে, যাতে বোঝা যায় যে প্রথমে আট রাকাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, পরে বিশ রাকাতই স্থিরকৃত হয়। চতুর্থতঃ তারাবীহের নামায মূলত সুন্নাতে রাসুল্লাহ (ﷺ) এবং একে সব সময় পড়া, জামাত সহকারে পড়া ও বিশ রাকাত পড়া। এ তিনটি সুন্নাতে উমর ফারুক (رضي الله عنه)। হুযূর (ﷺ) সব সময় বিশ রাকাত পড়েন নি এবং সাহাবায়ে কিরামকে জামাত সহকারে পাড়ার নির্দেশও দেননি। তাই যদি আট রাকাতই পড়া হয়, তাহলে সুন্নাতে ফারুকী বাদ পড়ে যায়। তবে যদি বিশ রাকাত পড়া হয়, তাহলে সবার উপর আমল হয়ে যায়। কেননা বিশের মধ্যে আটও আছে কিন্তু আটের মধ্যে বিশ নেই। হাদীছ শরীফে আছে- আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের উপর আমল করুন। ওরাও (আপত্তি কারীরা) সব সময় ও নিয়মিতভাবে জামাত সহকারে তারাবীহও নামায পড়ে থাকে। অথচ এ দুটি বিষয় হুযূর (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নেই; এ গুলো হচ্ছে সুন্নাতে ফারুকী, তাই একটি বাদ দিবেন কেন, বিশ রাকাতই পড়ুন।
২নং আপত্তিঃ
✦ বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে যে হযরত আবু সালমা হযরত আয়েশা সিদ্দীকার কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন হুযূর (ﷺ) রমযানের রাতে কত রাকাত পড়তেন’? তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
مَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ وَلَا غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
হুযূর (ﷺ) রমযান ও গর রমযানে আট রাকাতের অতিরিক্ত পড়তেন না। ৬৬০
➥660. ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৫, হাদিস/২০১৩
প্রমাণিত হলো যে হুযূর (ﷺ) তারাবীহ আট রাকাত থেকে বেশী পড়তেন না। তাই বিশ রাকাত পড়াটা বিদ্আতে সাইয়া।
উত্তরঃ এ আপত্তিটারও কয়েকটি উত্তর রয়েছে। এক, উপরোক্ত হাদীছে তারাবীহের নামায নয়, তাহাজ্জুদের নামাযের কথঅ বলা হয়েছে। কেননা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বলেছেন যে, হুযূর (ﷺ) রমযানে ও গর-রমযানে আট রাকাতের অতিরিক্ত পড়তেন না। এতে বোঝা গেল যে এটা সেই নামায, যা সব সময় পড়া হয়। তাই এটা তারাবীহ হতে পারে না, কারণ তারাবীহ কেবল রমযানেই পড়া হয়। অধিকন্তু তিরমিযী শরীফে এ হাদীছের জন্য ➥661. ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩০২, হাদিস-৪৩৯।
بَابُ مَا جَاءَ فِي وَصْفِ صَلَاةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِاللَّيْلِ
নামে একটি অধ্যায় খাড়া করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে এটা সালাতুল লাইল অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামাযই, তারাবীহের নামায নয়। আরও উল্লেখ্য যে সেই হাদীছের শেষে হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন, আমি আরয করেছিলাম-ইয়া রসুলাল্লাহ, আপনি বিতরের আগে কেন শুয়ে পড়েন? হুযূর ইরশাদ ফরমান, ওহে আয়েশা, আমার চোখ ঘুমায়, কিন্তু অন্তর ঘুমায় না। এ বক্তব্য থেকে বোঝা গেল এ রাকাতগুলো ঘুম থেকে উঠে আদায় করতেন এবং এর সাথেই বিতর পড়তেন। তখনইতো হযরত আয়েশা অবাক হয়ে আরয করেছিলেন, আপনি আমাদেরকে বিতর পড়ে শুতে নির্দেশ দিয়েছেন অথচ আপনি শোয়া থেকে উঠে তাহাজ্জুদের সাথেই বিতর নামায পড়েন। উত্তরে বললেন, আমার জাগা সম্পর্কে পূর্ণ ভরসা আছে। কিন্তু যার ভরসা না থাকে, তার বিতর পড়ে শোয়া উচিত। উল্লেখ্য যে, তারাবীহ শোবার আগে পড়া হয়, তাহাজ্জুদ শোয়া থেকে উঠে পড়া হয়।
✦ মুদারেজুন নাবুয়াতের প্রথম খণ্ড ৪০০ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে-
تحقيق انست كه صلوة انحضرت در رمضان هماد نماز معتاد بود يازده ركعت كه دايم در تهجد مے گزارد
দুই, বিশ রাকাত তারাবীহ যদি বিদ্আতে সাইয়া হয়, তাহলে হযরত উমর ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম কেন পছন্দ করলেন এবং স্বয়ং হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) ওবা কেন বিরোধিতা করলেন না? তাঁদের বেলায় কি ফত্ওয়া দিবেন? অধিকন্তু আজ কাল সকল লা-মাযহাবীরা পুরা রমযান মাসে জামাত সহকারে তারাবীহ পড়ে থাকে। বলুন, ওদের এ অগ্রগামিতা বিদ্আতে সাইয়া কি না? যদিওবা হুযূর (ﷺ) আট রাকাত তারাবীহ পড়ে থাকেন, তাহলে দু-তিন দিনই পড়েছেন। কিন্তু আপনারা প্রতিদিন পড়াটা কোথা থেকে আবিষ্কার করলেন? যদি সম্পূর্ণ হাদীছের অনুসারী হয়ে থাকেন, তাহলে হাদীছ মুতাবিক পুরা রমযানে দু-তিন দিনই তারাবীহ পড়ুন।
তিরমিযী শরীফের রিওয়ায়েত থেকে আরও প্রমাণিত আছে যে মক্কাবাসীরা বিশ রাকাত ও মদীনাবাসীরা একচলিশ রাকাত তারাবীহের উপর ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ আট রাকাতের সমর্থক ছিলেন না। বলুন এ সব লোকেরা বিদ্আতী ও ফাসিক হলো কিনা? যদি হয়ে থাকে, তাহলে তাঁদের থেকে হাদীছ বর্ণনা করা সঠিক হবে কিনা? কারণ, ফাসিকের রিওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য নয়। আর কোন দেশে মুসলমানেরা আট রাকাত পড়ে বলে এ রকম কোন প্রমাণ আছে কি? তিন, উত্থাপিত হাদীছ দ্বারা আট রাকাত তারাবীহ যেমন প্রমাণিত হয়, তেমনি তিন রাকাত বিতরও প্রমাণিত হয়, কিন্তু আপনারা বিতর এক রাকাত পড়েন কেন? আসল কথা হলো আট রাকাত তারাবীহের সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ কোথাও নেই। আসলে ওই হাদীছ দ্বারা তাহাজ্জুদের নামায বোঝানো হয়েছে। দেখি, এমন কোন রিওয়ায়েত পেশ করুন, যেথায় আট রাকাত তারাবীহের কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। ইন্শাআল্লাহ, কখনও পারবেন না।