বিয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
মানুষ স্বাভাবিকভাবে আরামপ্রিয়। এ কারণেই সে দুঃখ কষ্টকে ভয় করে এবং এড়িয়ে চলতে চায়। প্রজ্ঞাময় আল্লাহ নর-নারীর মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে না দিলে মানুষ বিয়ের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতো এবং মানব বংশ বিস্তারের ধারা ব্যহত হতো। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ
অতঃপর তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো এবং যা কিছু আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা অর্জন করো। ৬৮
৬৮.সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাদাতাগণ বলেছেন- তোমরা সন্তান-সন্ততি লাভের আশায় স্ত্রী সঙ্গম করো নিছক যৌন প্রবৃত্তির তাড়না মিটানোর জন্য করোনা।
প্রাচীন সমাজে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী ব্যক্তিকে অর্থাৎ বিবাহে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিকতায় অপূর্ণ মনে করা হতো এবং তাকে খোদার নৈকট্য লাভের অযোগ্য মনো করা হতো। সুতরাং সেযুগের সাধু ব্যক্তিরা আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভের জন্য বিবাহ ও সংসারধর্ম বর্জনকে আবশ্যক মনে করতো। তারা সব রকমের পার্থিব তৎপরতা থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে খোদার ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়তো। কিন্তু ইসলাম প্রাচীনযুগের অযৌক্তিক ভ্রান্ত ধারণাকে সমূলে প্রত্যাখ্যান করে দেয় এবং বিয়ে ও সংসার করাকে পবিত্রতা ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের উত্তম মাধ্যম বলে ঘোষণা করে।
বিবাহ করা দু’একজন ছাড়া বাকী সব নবী-রাসূলে সুন্নাত। বিবাহ করা মহানবী (ﷺ)র আদর্শ। বিবাহের পবিত্র ছোঁয়ায় পরিচ্ছন্ন জীবন লাভ করে একজন বিবাহিত মর্দে মু’মিন। ইসলামী শরীয়তে বিবাহকে দ্বীনের অর্ধেক বলে ঘোষণা করেছে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষ শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ ও পবিত্রতার চরম শিখরে পৌঁছতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
তোমাদের মধ্যে যেসব ছেলেদের স্ত্রী নেই এবং যেসব মেয়েদের স্বামী নেই তাদের এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দাও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। ৬৯
৬৯.সূরা নূর, আয়াত: ৩২
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-
مَنْ أَرَادَ أَنْ يَلْقَى اللهَ طَاهِرًا مُطَهَّرًا، فَلْيَتَزَوَّجِ الْحَرَائِرَ
যে ব্যক্তি পূত পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চায় সে যেন স্বাধীন নারী বিবাহ করে। ৭০
৭০.ইমাম ইবনে মাজাহ র. (২৭৩হি.), ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃ. ১৩৫
عَنْ أَبِي أَيُّوبَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرْبَعٌ مِنْ سُنَنِ الْمُرْسَلِينَ: الحَيَاءُ، وَالتَّعَطُّرُ، وَالسِّوَاكُ، وَالنِّكَاحُ
হযরত আবু আইয়ুব(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- নবী-রাসূলগণের সুন্নত চারটি। লজ্জাবোধ, সুগন্ধি ব্যবহার, মিসওয়াক করা এবং বিবাহ করা। ৭১
৭১.ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী র. (২৭৯হি.) তিরমিযী শরীফ, পৃ. ১২৮
أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ،يَقُولُ: جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا، فَقَالُوا: وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَدْ غُفِرَلَهُمَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ، قَالَ أَحَدُهُمْ: أَمَّا أَنَا فَإِنِّي أُصَلِّي اللَّيْلَ أَبَدًا، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا، فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْهِمْ، فَقَالَ: ্রأَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا، أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিনজন সাহাবী নবী করিম (ﷺ)র স্ত্রীদের খেদমতে এস তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানতে চাইল। যখন তাঁর ইবাদত সম্পর্কে তাদের বলা হলো, তারা যেন তা একটু কম মনে করলো, আর বললো- তিনি কোথায় আমরা কোথায়? তাঁর তো আগ-পর সকল ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের একজন বললেন, আমি রাতে ঘুমাবোনা বরং সারা রাত নামায পড়বো। অপরজন বললেন, আমি সর্বদা রোযা রাখবো কখনো ইফতার করবো না। তৃতীয়জন বললেন, আমি নারীদের থেকে দূরে থাকবো-কখনো বিয়ে করবোনা। অতঃপর নবী করীম(ﷺ) তাদের নিকট তাশরীফ আনলেন আর বললেন, তোমরাই এমন লোক যারা এরূপ এরূপ বলেছ, সাবধান! খোদার শপথ। আমি তোমাদের সকলের চেয়ে আল্লাহকে বেশী ভয় করি, নামায পড়ি আবার নিদ্রাও যাই এবং নারীদেরকে বিবাহও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ থাকে সে আমার দলভুক্ত নয়। ৭২
৭২.বুখারী ও মুসলিম. সূত্র মিশকাত, পৃ. ২৭, হাদিস নং ১৩৪
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِذَا تَزَوَّجَ الْعَبْدُ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ نِصْفَا لدِّينِ فَلْيَتَّقِ اللهَ فِي النِّصْفِ الْبَاقِي
হযরত আনাস(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, কোনো বান্দা যখন বিয়ে করলো তখন সে দ্বীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করলো। অতঃপর সে যেন বাকী অর্ধেকের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে। ৭৩
৭৩.ইমাম বায়হাকী র (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত. পৃ. ২৬৮
মানবিক প্রাকৃতিক চাহিদার কারণেই মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কারণ ইসলামী শরীয়ত এটাকে পুরো দ্বীনের অর্ধেক বলে আখ্যায়িত করেছে। কারণ দুনিয়াবী প্রতিটি কাজকে ইসলামী শরা মোতাবেক করলে এবং নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকলে তা দ্বীনি কাজের রূপান্তরিত হয়। তাছাড়া সমস্ত ইবাদতে মানসিক শান্তি ও চারিত্রিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। আর তা অধিকাংশ অর্জিত হয় বৈবাহিক জীবনের মাধ্যমে পারিবারিক সুখ-শান্তি দ্বারা।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রيَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা তা চক্ষুকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। আর যে সামর্থ্য রাখেনা সে যেন রোযা রাখে। রোযা তার যৌনক্ষুধাকে অবদমিত করে।৭৪
৭৪.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৭
وَعَنْ مَعْقِلِ بْنِ يَسَارٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রتَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمُ الْأُمَم
হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার(رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, তোমরা প্রেমময়ী অধিক সন্তানসম্ভবা নারীকে বিয়ে করো, কারণ আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অন্যান্য উম্মতের উপর গর্ব করবো। ৭৫
৭৫.আবু দাউদ ও নাসাঈ, সূত্র. মিশকাত, পৃ. ২৬৭