হাদিস শরীফের আলোকে ইসলামে নারীর মর্যাদা
যাহেলী যুগে নারীদের অবস্থা যখন অবনতির চরমসীমায় পৌঁছেছে, তখন নারী মুক্তির অগ্রদূত হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) মানবতার ধর্ম ইসলাম সহকারে আত্মপ্রকাশ করলেন। তিনি অতল সাগরে ডুবে যাওয়া নারীকে উদ্ধার করে সসম্মানে তীরে তুলে আনলেন, নারীকে পুরুষের পদতল থেকে মাথার মুকুট বানিয়ে দিলেন। আমরা হাদিস শরীফের আলোকে এ বিষয়ে আলোকপাত করবো।
حُبِّبَ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيبُ، وَجُعِلَ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- পৃথিবীর নিয়ামত সমূহের মধ্যে আমার নিকট প্রিয় বানানো হয়েছে নারী, সুগন্ধি এবং নামাযের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে। ৩৯
৩৯.আহমদ ইবনে শোয়াইব র. (৩০৩ হি.) নাসাঈ শরীফ, খণ্ড.২, পৃ. ৯৩
الدُّنْيَا كُلُّهَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَة الصَّالِحَة
হযরত আব্দুল্লাহ ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- বিশ্ব ভূমণ্ডল পুরোটাই উপকৃত বস্তু সামগ্রী, তম্মধ্যে সর্বোত্তম উপকৃত সামগ্রী হলো নেককার নারী। ৪০
৪০.মুসলিম শরীফ, সূত্র, মিশকাত শরীফ, পৃ;.২৬৭, হাদিস নং-৩০৮৩
উপরোক্ত হাদিস দু’খানাতে নারী জাতির মর্যাদা ফুটে উঠেছে। প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে-রাহমাতুললিল আলামীনের নিকট নারীকে প্রিয় করে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত আগত মুসলমানদের নিকটও নারী জাতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ উম্মতের ওপর নবী করিম (ﷺ)র অনুসরণ ফরয। সুতরাং নারী জাতির জন্য অহংকারের বিষয় হলো যে, তারা প্রিয় নবীর কাছে প্রিয়। আর দ্বিতীয় হাদিসে সৎ নারীদেরকে পৃথিবীর সর্বোত্তম নিয়ামত বলা হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, যার গৃহে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলো। অতঃপর সে তাকে কষ্ট দেয়নি, তার ওপর অসন্তুষ্টও হয়নি আর পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রাধান্যও দেয়নি তাহলে তার এ কন্যা সন্তানের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ৪১
৪১.ইমাম আহমদ ইবনে হম্বল র. ২৭১ হি. মুসনাদে আহমদ, খণ্ড.১, পৃ. ২২৩
হযরত উকাবাহ ইবনে আমের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি- যার তত্ত্বাবধানে তিযনজন কন্যা সন্তান রয়েছে, অতঃপর সে তাদের লালন-পালনের কষ্ট সহ্য করেছে এবং সামর্থানুযায়ী তাদের পানাহার ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেছে। কিয়ামত দিবসে ঐ কন্যা সন্তানেরা তার জন্য জাহান্নামের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। ৪২
৪২.মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ র. (২৭৩ হি.), ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃ. ২৬১
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ ابْتُلِيَ بِشَيْءٍ مِنَ البَنَاتِ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ.
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করিম ইরশাদ করেন, যাকে কন্যা সন্তান দ্বারা পরীক্ষায় লিপ্ত করা হয়েছে, আর সে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করেছে ঐ কন্যা সন্তানরা কিয়ামত দিবসে তার জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের উপলক্ষ হবে। ৪৩
৪৩.ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী (২৭৯ হি.) তিরমিযী শরীফ
যে নারী জাতিকে অন্যান্য ধর্মে ‘নরকের দরজা’ বলা হয়েছে ইসলামে তাকে জান্নাতে প্রবেশের উপলক্ষ ও উসীলা বলা হয়েছে।
عَائِشَةَ، أَنَّهَا قَالَتْ: جَاءَتْنِي مِسْكِينَةٌ تَحْمِلُ ابْنَتَيْنِ لَهَا، فَأَطْعَمْتُهَا ثَلَاثَتَ مَرَاتٍ، فَأَعْطَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا تَمْرَةً، وَرَفَعَتْ إِلَى فِيهَا تَمْرَةً لِتَأْكُلَهَا، فَاسْتَطْعَمَتْهَا ابْنَتَاهَا، فَشَقَّتِ التَّمْرَةَ، الَّتِي كَانَتْ تُرِيدُ أَنْتَ أْكُلَهَا بَيْنَهُمَا، فَأَعْجَبَنِي شَأْنُهَا، فَذَكَرْتُ الَّذِي صَنَعَتْ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: إِنَّ اللهَ قَدْ أَوْجَبَ لَهَا بِهَا الْجَنَّةَ، أَوْ أَعْتَقَهَا بِهَا مِنَ النَّارِ
হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমার নিকট একদা এক গরিব মিসকীন মহিলা আগমণ করলো-যার দু’টি কন্যা সন্তানও ছিল।আমি তাদেরকে খাওয়ার জন্য তিনটি খেজুর দিলাম। তখন ঐ মহিলা প্রত্যেক কন্যা সন্তানকে একটি করে খেজুর দিল এবং নিজে একটি খেজুর খাওয়ার জন্য মুখের নিকট নিয়ে গেল। তখন তার কন্যাদ্বয় নিজেদেরটা খেয়ে ঐ খেজুরটাও তার থেকে চাইতে লাগল। তখন তাদের মা ঐ খেজুরটিকে দু’টুকরো করে দু’জনকে ভাগ করে দিল। হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ এই মেয়েদের কারণে তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। ৪৪
৪৪.ইমাম মুসলিম ইবনে হুজ্জাজ কুশাইরী র. (২৬১ হি.) সহীহ মুসলিম, পৃ. ৩৩০
যখন কন্যা সন্তান জন্ম নিলে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন অসন্তুষ্ট হতো এবং নারী জাতিকে কলংকের কারণ মনে করা হতো আর কলংক মুক্ত হওয়ার জন্য কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো সে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করাকে সৌভগ্যের সোপান ঘোষণা করেছেন- "
من بركة المرأة تبكيرها بالأنثى، أما سمعت الله تعالى يقول: {يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثاً وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ}.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, নারী ভাগ্যবতী হওয়ার প্রমাণ হলো তার প্রথম সন্তান কন্যা হওয়া। ৪৫
৪৫.আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসসামউদ্দিন র. (৯৭৫ হি.), কানযুল উম্মাল, খণ্ড.৬, পৃ. ৬১১
বর্তমান আমদের সমাজেও জাহেলী যুগের ন্যায় কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে পিতা-মাত, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও অন্যান্য নিকটত্মীয় স্বজন নাখোশ হয়। একজন পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে সকলের মুখে আনন্দের যে উল্লাস পরিলক্ষিত হয় একজন কন্যা সন্তানের বেলায় হয় তার বিপরীত। অনেকেই পুনরায় কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করার ভয়ে সন্তান নিতে চায় না। পুত্র সন্তানের নাম রাখা ও আকীকা অনুষ্ঠান যেভাবে ধুমধামের সহিত করা হয় তা কন্যা সন্তানের বেলায় অনুপস্থিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কন্যা সন্তান গর্ভধারণ করেছে বলে স্ত্রীর প্রতি স্বামী ও স্বামী পক্ষের লোকজন অসন্তুষ্ট থাকে এবং শশুর বাড়িতে স্ত্রীর গুরুত্ব কমে যায়। তাদের আচরণ দেখে মনে হয় গর্ভের সন্তান নারী পুরুষ হওয়া না হওয়ার মধ্যে স্ত্রীর হাত রয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-“তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন।” ৪৬
৪৬.সূরা শুরা, আয়াত: ৪৯
কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে অসন্তুষ্ট হওয়ার অর্থ হলো স্বয়ং আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হওয়ার শামিল। আর আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট বান্দার জন্য কুফুরী। কন্যা সন্তান জন্মের সংবাদ শুনলে চেহারা মলিন হয়ে যাওয়া জাহেলী যুগের কাফির-মুশরিকদের আলামত। সুতরাং এ আলামত মু’মিনদের মধ্যে পাওয়া যাওয়া অনুচিত ও অন্যায়।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা যদি মানব সৃষ্টির ব্যাপারে মানুষের চাহিদা মত কাজ করতেন, তাহলে মানব জাতি আর বাকী থাকতো না, কারণ তারা কেবল ছেলে চায় মেয়ে চায় না। আর সবাই যদি ছেলে হয়ে যায় তাহলে মেয়ের অভাবে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
وعن أنس أن رجلا كان عند النبي صلى الله عليه وسلم فجاء ابن له فقبله وأجلسه على فخذه وجاءته بنت له فأجلسها بين يديه فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : " ألا سويت بينهم "
হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্নিত, এক ব্যক্তি নবী করিম (ﷺ)র দরবারে বসা ছিলেন। ইতিমধ্যে তার এক পুত্র সন্তান এলো। সে তাকে চুম্বন করে উরুর উপর (আদরের সহিত) বসালো। একটু পরে তার এক কন্যা সন্তান এলো। সে তাকে সামনে বসিয়ে দিলো। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন, কেন তুমি দু’জনের সাথে সমান আচরণ করলেনা? ৪৭
৪৭.নুরুদ্দীন আলী ইবনে আবু বকর র. (৮০৮হি.), মাজমাউয যাওয়ায়েদ