বি’ছাত (নুবুওয়াত) অস্বীকার কারীদের কতিপয় অভিযােগ প্রসঙ্গে 


যারা বি'ছাত বা নবী-রাসূল প্রেরণকে অস্বীকার করে, তাদের কতিপয় অভিযােগ হলাে : 

১. প্রথমতঃ যাকে প্রেরণ করা হয়, সে যেন জানতে পারে যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁকে এরূপ নির্দেশ দিয়ে পাঠাচ্ছেন : “আমি তােমাকে প্রেরণ করছি, কাজেই তুমি আমার পক্ষ থেকে লােকদের কাছে এ বাণী পৌঁছে দাও। আর প্রেরিত ব্যক্তির পক্ষে এ ধরনের কিছু জানা সম্ভব নয় কেননা, এরূপ 'ইলকা’ বা নির্দেশ নিক্ষেপ জিনদের পক্ষ থেকেও হতে পারে। আর জিনদের অস্তিত্ব সম্পর্কে তােমাদের অভিমতও অভিন্ন। 


এ অভিযােগের জবাব হলাে : প্রেরণকর্তা এর জন্য দলীল কায়েম করে দেন, যাতে রাসূল জানতে পারেন যে, “আমি তােমাকে রাসূল করে প্রেরণ করেছি", এরূপ বলার মালিক একমাত্র আল্লাহ, জিন্ নয়। কেননা, আল্লাহ তা'আলা এজন্য এমন ‘আয়াত বা নিদর্শনাবলী এবং মু'জিযাত' বা অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করেন; যাতে সমস্ত মাখলুক তার মুকাবিলা করতে অপারগ হয়ে পড়ে। আর তা এজন্যে যে, তা তার জন্য ইলম বা জ্ঞানের ফায়দা দেয়, অথবা তাঁর মধ্যে (নবী বা রাসূলের মধ্যে। ) অবশ্যই এ জ্ঞান সৃষ্টি করে দেওয়া হয় যে, “আমার প্রেরণকারী এবং নির্দেশ দানকারী হলেন-একমাত্র আল্লাহ”। 


২. দ্বিতীয়ত : যে নবীর প্রতি 'ইলকা’ বা বাক্য-নিক্ষেপ করে, সে যদি দেহধারী হয়, তবে এ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে যে, ‘ইলকার' সময় উপস্থিত সকলে তাকে দেখে ফেলবে', অথচ ব্যাপারটি এ ধরনের নয়, যেমন -তােমাদেরও অভিমত কিন্তু ইলকাকারী ব্যক্তি শরীর সম্ভুত না হয়ে যদি রুহ-সম্ভুত হয়, এমতাবস্থায় কথার মাধ্যমে 'ইলকা’ বা বাক্য নিক্ষেপ অসম্ভব। কেননা, রুহের প্রতি ওহী নিক্ষেপ, কথা বা বাক্যের মাধ্যমে, অসম্ভব। 


বস্তুতঃ প্রথম অংশের জবাব হলাে : মালাযামাত অর্থাৎ শরীর সম্ভুত হওয়ার কারণে এরূপ মনে করা যে, উপস্থিত সকলে দেখবে; এ গ্রহণীয় নয়। কেননা, এ দলীল সাপেক্ষে বৈধ যে, আল্লাহ তা'আলা সে সময় উপস্থিত সকলের দেখার শক্তি নাও দিতে পারেন। কারণ, তিনি সর্বশক্তিমান, তাঁর কুদরত কোন কারণেই অক্ষম নয়। 


উল্লেখ্য যে, উপস্থিত ব্যক্তিদের তা দেখার ক্ষমতা না দেওয়া, এটা বাস্তবেও সম্ভব এবং এও আল্লাহর কুদরতের অন্যতম দলীল। যেমন-আমাদের সামনে বড় 

বড় শহর এবং বড় বড় পাহাড় আছে, কিন্তু আমরা তা সবই দেখতে পাই না। পক্ষান্তরে, ঢােল-তবলা বাজছে; অথচ আমরা তা শুনতে পাইনা, এটা অবাস্তব। 

এক্ষণে আমার বক্তব্য হলাে : আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা'আলা সমধিক অবহিত যে, 'ইলকা বা নিক্ষেপকারী সত্ত্বা সূক্ষ শরীরের অধিকারী, অর্থাৎ ফিরিশতা; এবং এরূপ সত্ত্বাকে দেখা সম্ভব নয়। 


অতঃপর দ্বিতীয় অংশের জবাব হলাে : রূহ বা আত্মা হলাে একটা লতীফা বা সূক্ষ্ম জিনিস। এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.) সেই কথা শুনতেন, যা আল্লাহর তরফ থেকে তার প্রতি ওহী করা হতাে। এ আলােচনা আগে করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কোন জটিলতা নেই।

 

৩. তৃতীয়তঃ রিসালাতের প্রত্যয়ন প্রেরিত ব্যক্তির জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল, আর সে জ্ঞান হলাে : কি তার জন্য জায়েয এবং কি জায়েয নয়। আর এ জ্ঞান কিছু সময় অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত অর্জন করা সম্ভব নয়। আর ঐ চিন্তা ভাবনা যা ঐ জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছায়, তা হাসিলের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়, যেমন দিন বা বছরের-নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না; বরং তার ব্যক্তিত্ব ও অবস্থার কারণে এতে পার্থক্য হতে পারে। 


কাজেই দায়িত্ব প্রাপ্ত লােকের জন্য এ হক থাকবে যে, সে দূরদৃষ্টি লাভের জন্য সময় চাইবে। অন্যথায়, সে যদি কোন সময় বলে বসে আমি এসব জানিনা; এমতাবস্থায় তার নবীর দায়িত্ব ক্ষুন্ন হবে এবং ফলে, নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে এ ধরনের সময় চাওয়ার সুযােগ দেননি, বরং কোন সময় না দিয়েই তাকে তা সত্য বলে গ্রহণ করাকে ওয়াজিব করেছেন। এর ফলে, নবীর জন্য “এমন তাকলীফ বা কষ্ট যা বহনযােগ্য নয়”-অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। কেননা, রিসালাতের সত্যতা আলােচ্য জ্ঞানের ভিত্তিতে না হলে তা এমন হবে, যার অস্তিত্ব আদৌ কল্পনা করা যায় না এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে এটা খুবই গর্হিত। আর এ ধরনের কাজ প্রকাশ পাওয়া, মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ হতে খুবই অবাঞ্ছিত। 

এ অভিযােগের জবাব হলাে : সময় দেওয়া আদৌ জরুরী নয় কেননা, আমি আগেই বর্ণনা করেছি যে, যখন কোন নবী রিসালাতের দাবী করবে এবং সে দাবীর সাথে মু'জিযাও উপস্থিত থাকবে, যা অলৌকিক; তখন তার অনুসরণ করা, কোনরূপ কালক্ষেপন না করেই, ওয়াজিব হয়ে যায়। কেননা, মু'জিযা প্রকাশের সাথে সাথেই, নবীর সত্যবাদী হওয়ার বাস্তব জ্ঞান হাসিল হয়ে যায়। অতএব চিন্তা কর, অনুধাবন কর। 

চতুর্থত : বি’ছাত বা নবীর প্রেরণ তাকলীফ বা কষ্ট মুক্ত নয়। আর বি’ছাতের ফায়দা এটাই। আর কয়েক কারণে এ কষ্ট বরণ করা সিদ্ধ নয়।


যেমন-১, এ ব্যবস্থা কঠোরতাকে প্রতিষ্ঠা করে; কেননা, বান্দার কাজ আল্লাহর কুদরতে অনুষ্ঠিত হয় এবং তােমাদের অভিমত হলাে : বান্দার কুদরত বা শক্তি ফলদায়ক নয়; কাজেই অন্যের কাজের জন্য কষ্ট দেওয়া, তা এমন কষ্ট যা বহনযােগ্য নয়, অনুচিত। 

এ প্রশ্নের জবাব হলাে : বান্দার কুদরত বা শক্তি যদিও ফলদায়ক নয়, তবুও তার সম্পর্ক হলাে কাজের সাথে, যাকে 'কসব’ বা উপার্জন বলা হয়। আর এ হিসেবে তাকে কষ্ট দেওয়া জায়েয এবং এজন্যে তা এমন কষ্ট নয়, যা বহনযােগ্য নয়। 


২. এ তাকলীফ বা কষ্ট বান্দার ক্ষতি করে। কেননা, এমতাবস্থায় তার উপর কাজের কষ্ট এবং তা পরিত্যাগে ‘আযাবের কষ্ট’ অবধারিত হয়ে যায়। আর কারাে ক্ষতি করা তাে মহা অপরাধ এবং আল্লাহ তা'আলা এ থেকে অতি পবিত্র। এর জবাব হলাে : তাকলীফ বা কষ্টের মধ্যে দ্বীন ও দুনিয়ার যে কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত আছে, তা তার ক্ষতির চাইতে বহু গুণ বেশী। যার আলােচনা সামনে আসবে। কাজেই, বহু কল্যাণকে অল্প কষ্টের জন্য পরিত্যাগ করা বৈধ নয়। 


৩. এ তাকলীফের মাঝে যে কঠোরতা আছে, হয়তাে তা উদ্দেশ্যবিহীন হবে। আর এরূপ হওয়া অবান্তর, নেহায়েত খারাপ। অথবা কোন উদ্দেশ্যের জন্য হবে-যার সম্পর্ক হবে হয়তাে আল্লাহর সঙ্গে, অথচ আল্লাহ তা'আলা উদ্দেশ্য হতে পবিত্র; অথবা তার সম্পর্ক হবে বান্দার সাথে। এ অবস্থায় হয়তাে বান্দার ক্ষতি হবে, যা সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থিত নয়, নয়তাে বান্দার উপকার হবে। কাজেই, উপকার লাভের জন্য কষ্ট করা এবং তা হাসিল না হওয়ার কারণে আযাব দেওয়া-জ্ঞান বহির্ভূত কাজ। কেননা, এটা ঐরূপ যেন তাকে বলা হয়েছে : তুমি তােমার জন্য উপকার হাসিল কর, অন্যথায় আমি তােমাকে চিরস্থায়ী আযাবে গ্রেফতার করবো। 


এর জবাব হলাে : জ্ঞান যাকে ভাল বা মন্দ হওয়ার হুকুম দিচ্ছে, এখানকার বক্তব্যটি তার একটি শাখা, অথবা আল্লাহ তা'আলার কাজে উদ্দেশ্য থাকা অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। আমি এ দুটি বক্তব্যকে এখানে বাতিল ঘােষণা করছি। বরং তাকলীফ বা কষ্ট এমন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, যা বান্দার সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও মঙ্গল হাসিলের জন্য যে সব কষ্টদায়ক কাজ সম্পন্ন করতে হয় তার লাভ, ক্ষতির চাইতে বহুগুণে অধিক। বাকী থাকলাে বান্দার শাস্তির ব্যাপারটি। কিন্তু এ শাস্তি এ কারণে নয় যে, সে কোন উপকার হাসিল করেনি-তাই; বরং তার শাস্তির কারণ হবে সে তার মনিব বা সর্দারের হুকুম মান্য করেনি-সেজন্য। কারণ, এখানে মনিবকে ঘৃণা করা হয়েছে।


আমি বলতে চাই-এবং আল্লাহু সুবহানুহু ওয়া তা'আলা অধিক জ্ঞানী-যে, অভিযােগকারী এরূপ বলতে পারতাে যে, আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা'আলা কেন তাকে তাকলীফ দেবেন, এ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যে, বান্দা তার পায়রী করবে ? আর না তিনি তার দ্বারা কোন ফায়দা হাসিল করবেন? কাজেই, এর দ্বারা তার তাে কেবল ক্ষতিই করা হবে এবং এ কাজটি খুবই মন্দ। 

এর জবাব এভাবে দেওয়া যেতে পারে : তাকলীফ যদিও তার ক্ষতি করে তবুও বড় কল্যাণ লাভের জন্য, কম ক্ষতি স্বীকার করে নেওয়া জ্ঞানের দিক দিয়েও উচিত। কাজেই, এ মন্দ নয় যেমন আগে আলােচিত হয়েছে। মু'তাযিলা সম্প্রদায়ের লােকেরা বলে : কাফিরদের তাকলীফ দেওয়ার মধ্যেও ফায়দা বা উপকার আছে। এ হলাে সওয়াবের বিপরীত, সওয়াব নয়। কেননা, যিনি তাকলীফ দেন, তার অনুসরণের কারণে সওয়াবের ফায়দা হাসিল করা হয়; সেটা তাকলীফের ফায়দা নয়। ব্যাপারটি এ উদাহরণের সাহায্যে বুঝা সহজ হতে পারে। যেমন কোন ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিল, অথচ সে জানে যে, সে ব্যক্তি তার দাওয়াত আদৌ কবুল করবে না, কিন্তু তবুও সে তাকে দাওয়াত দেওয়ার সময় বিভিন্ন কায়দায় ভদ্র ও মার্জিতভাবে দাওয়াত দিল। যদি দাওয়াতকারী, দাওয়াতের সময় এরূপ ভদ্র ও মার্জিতভাবে দাওয়াত দিত, তবে সে স্বীয় উদ্দেশ্য সাধনে অপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতাে।

Top