তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(ফকীহ ও উলামায়ে উম্মতের উক্তিসমূহ
থেকে ‘হাযির-নাযির’ এর প্রমাণ)
(১) সুবিখ্যাত ‘দুররুল মুখতার’ ৩য় খন্ডের المرتد অধ্যায়ের ‘কারামাতে আওলিয়া’ শীর্ষক আলোচনায় উলেখিত আছেঃ
يَا حَاضِرُ يَا نَاظِرُ لَيْسَ بِكُفْرٍ
-‘‘হে হাযির, হে নাযির’ বলে সম্বোধন করা ‘কুফর’ হিসেবে গণ্য নয়।’’
{.ইমাম ইবনে আবেদীনঃ ফতোয়ায়ে শামীঃ ৪/২৫৯পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন}
❏উপরোক্ত উক্তির ব্যাখ্যায় ‘ফতোয়ায়ে শামী’তে উলেখিত আছেঃ
فَإِنَّ الْحُضُورَ بِمَعْنَى الْعِلْمِ شَائِعٌ - {مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى ثَلاثَةٍ إِلا هُوَ رَابِعُهُمْ} [المجادلة: ৭]- وَالنَّظَرُ بِمَعْنَى الرُّؤْيَةِ - {أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى} [العلق: ১৪]- فَالْمَعْنَى يَا عَالِمَ مَنْ يَرَى
-‘‘এর কারণ হলো ‘হুযুর’ (حضور) শব্দটি জ্ঞান অর্থে বহুল প্রচলিত। কুরআন শরীফে আছে-‘তিন জনের মধ্যে গোপনীয়ভাবে যা’ কিছু পরামর্শ হয়ে থাকে, আল্লাহ তা’আলা ওদেরই ‘চতুর্থজন’ হিসেবে বিদ্যমান থাকেন।’
(সুরা মুযদালাহ, ৭)
আর, نظر ‘নযর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দেখা’। যেমনঃ
❏ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, ‘কেন, সে জানে না যে, আল্লাহ দেখেন?”
(সুরা আলাক্ব, ১৪)
সুতরাং, ‘ইয়া হাযিরু! ইয়া নাযিরু’! শব্দ দুইটির অর্থ হলো হে জ্ঞানী! হে দ্রষ্টা! অতএব, এ উক্তি ‘কুফর’ হতে পারে না।’’
{ইমাম ইবনে আবেদীনঃ ফতোয়ায়ে শামীঃ ৪/২৫৯পৃ. প্রাগুক্ত}
❏ ‘দুররুল মুখতার’ গ্রন্থে, প্রথম খন্ডের كيفية الصلوة শীর্ষক অধ্যায়ে আছেঃ
وَيَقْصِدُ بِاَلْفَاظِ التَّشَهُّدِ الْاِنْشَاءَ كَاَنَّهُ يُحَىِّ عَلَى اللهِ وَيْسَلِّمُ عَلَى نَبِيِّهِ نَفْسِهِ
-‘‘নামাযে আততাহিয়্যাত বা ‘তাশাহুদ’ এর শব্দগুলি উচ্চারণ করার সময় নামাযীর এ নিয়ত থাকা চাই যে, কথাগুলো যেন তিনি নিজেই বলছেন, তিনি নিজেই যেন আপন প্রতিপালকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছেন ও স্বয়ং নবী আলাইহিস সালামের প্রতি সালাম আরয করছেন।’’
{আলাউদ্দিন হাস্কাফীঃ দুররুল মুখতারঃ ১/৪৭৬ পৃ.}
❏ এ ইবারতের তাৎপর্য বিশেষণ প্রসঙ্গে ‘ফত্ওয়ায়ে শামী’তে বলা হয়েছেঃ
اَىْ لاَيَقْصِدُ الْاَخْبَارَ وَالْحِكَايَةَ عَمَّا وَقَعَ فِى الْمِعْرَاجِ مِنْهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ وَمِنْ رَّبِّهِ وَمِنَ الْمَلَئِكَةِ
-‘‘তাশাহহুদ পাঠের সময় নামাযীর যেন এ নিয়ত না হয় যে, তিনি শুধুমাত্র মিরাজের অলৌকিক ঘটনাটি স্মরণ করে, সে সময় মহাপ্রভু আল্লাহ, হুজুর (ﷺ) ও ফিরিশতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত কথোপকথন এর বাক্যগুলোই আওড়িয়ে যাচ্ছেন। বরং তার নিয়ত হবে কথাগুলো যেন তিনি নিজেই বলছেন।’’
{ক. ইমাম ইবনে আবেদীন শামীঃ রুদ্দুল মুখতারঃ ১/৪৭৬
খ. ফতোয়ায়ে আলমগীরীঃ ১/৭৩ পৃ.}
স্বনামখ্যাত ফকীহগণের উপরোলিখিত ইবারতসমূহ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ‘হাযির-নাযির’ জ্ঞান করা বা বলা ‘কুফর’ নয়, আর তাশাহহুদ’ পাঠের সময় হুজুর (ﷺ)কে ‘হাযির-নাযির’ জেনেই সালাম আরয করা চাই। এ তাশাহহুদ প্রসঙ্গে ফকীহগণের আরও অনেক বক্তব্য পেশ করা হবে।
❏ সুপ্রসিদ্ধ ‘মজমাউন বরকাত’ গ্রন্থে শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (رحمة الله) বলেছেনঃ
وى عليه السلام بر احوال واعمال امت مطلع است بر مقر بان اوز حاضرين گاه خود مفيض وخاضر وناظر است
-‘‘হুজুর (ﷺ) নিজ উম্মতের যাবতীয় অবস্থা ও আমল সম্পর্কে অবগত এবং তাঁর মহান দরবারে উপস্থিত সকলেই ফয়েয প্রদানকারী ও ‘হাযির-নাযির’।’’
❏ শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (رحمة الله) سلوك اقرب السبل بالتوجه الى سيد الرسل নামক পুস্তিকায় বলেনঃ
باچنديں اختلاف وكيرت مذاهب كه در علماء امت هست يك كس رادريں مسئله خلافى نيست كه آں حضرت عليه السلام بحقيقت حيات بے شائبه مجاز وتوهم تايل دائم وباقي است وبر اعمال امت حاضر وناظر است ومر طالبان حقيقت راومتو جهان انحضرت رامفيض ومربى (ادخال اسان)
-‘‘উলামায়ে উম্মতের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শ ও বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, হুজুর (ﷺ) প্রকৃত জীবনেই (কোনরূপ রূপক ও ব্যবহারিক অর্থে যে জীবন, তা নয়) স্থায়ীভাবে বিরাজমান ও বহাল তবীয়তে আছেন। তিনি উম্মতের বিশিষ্ট কর্মকান্ড সম্পর্কে জ্ঞাত ও সেগুলোর প্রত্যক্ষদর্শীরূপে বিদ্যমান তথা ‘হাযির-নাযির’। তিনি হাকীকত অন্বেষণকারী ও মহান দরবারে নবুয়াতের শরণাপন্নদের ফয়েযদাতা ও মুরুব্বীরূপে বিদ্যমান আছেন।’’
{শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীঃ মাকতুবাতে বর হাশিয়া আখবারুল আখিয়ারঃ পৃ. ১৫৫}
❏ শাইখ মুহাদ্দিছ দেহলবী (رحمة الله) ‘শরহে ফুতুহুল গায়ব’ গ্রন্থের ৩৩৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ
اما انبياء عليهم اسلام بحيات حقيقي دنيا وى حى وباقى ومتصرف انددريں جاسخن نيست
-‘‘নবীগণ (আলাইহিস সালাম) পার্থিব প্রকৃত জীবনেই জীবিত, শাশ্বত জীবন সহকারে বিদ্যমান ও কর্মতৎপর আছেন। এব্যাপারে কারো দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই।’’
❏ মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘মিরকাত’ এর
بَابُ مَا يُقَالُ عِنْدَ مَنْ حَضَرَهُ الْمَوْتُ শীর্ষক অধ্যায়ের শেষে উলেখিত আছেঃ
وَلَا تَبَاعُدَ مِنَ الْأَوْلِيَاءِ حَيْثُ طُوِيَتْ لَهُمُ الْأَرْضُ، وَحَصَلَ لَهُمْ أَبْدَانٌ مُكْتَسَبَةٌ مُتَعَدِّدَةٌ، وَجَدُوهَا فِي أَمَاكِنَ مُخْتَلِفَةٍ فِي آنٍ وَاحِدٍ
-‘‘ওলীগণ একই মুহুর্তে কয়েক জায়গায় বিচরণ করতে পারে। একই সময়ে তাঁরা একাধিক শরীরের অধিকারীও হতে পারেন।’’
{মোল্লা আলী ক্বারীঃ মিরকাতঃ ৪/১১৫}
❏ ‘শিফা’ শরীফে আছেঃ
إِنْ لَمْ يَكُنْ فِي الْبَيْتِ أَحَدٌ فَقُلْ السَّلَامُ عَلَى النَّبِيِّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ
-‘‘যে ঘরে কেউ থাকে না, সে ঘরে (প্রবেশ করার সময়) বলবেন ‘হে নবী! আপনার প্রতি সালাম; আপনার উপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক!’’
{ইমাম কাযী আয়াজঃ শিফা শরীফঃ ২/৪৩ পৃ.}
❏ এ উক্তির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বনামখ্যাত মোল্লা ‘আলী কারী (رحمة الله) ‘শরহে শিফা’ গ্রন্থে বলেছেনঃ
لِاَنَّ رُوْحَ النَّبِىِّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ حَاضِرٌُ فِيْ بُيُوْتِ اَهْلِ الاِسْلاَمِ
-‘‘কেননা, নবী আলাইহিস সালাম এর পবিত্র রূহ মুসলমানদের ঘরে ঘরে বিদ্যমান আছেন।’’
{মোল্লা আলী ক্বারীঃ শরহে শিফাঃ ৩/৪৬৪ পৃ.}
(এ বিষয়ে বিস্তারিত এবং আরও হাদিস জানতে আমার লিখিত ‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’ ১ম খণ্ডের ১৪৮-১৫৯পৃষ্ঠা দেখুন, আশা করি সঠিক বিষয়টি পাঠকবৃন্দ্রের বুঝে আসবে।)
❏ শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (رحمة الله) স্বরচিত ‘মাদারেজুন নবুয়াত’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
ذكر كن اور اودرود بفرست بروے عليه السلام وباش در حال ذكر گويا حاضر است پيش تو در حالت حيات ومى بينى تو اورا متادب باجلال وتعظيم وهيبت وحياو بدانكه وے عليه السلام مى بيند وحى شنود كلام تراز ير اكه وے عليه السلام متصف است بصفات اله ويكے از صفت الهى انست كه انا جليس من ذكرنى
-‘‘হুজুর (ﷺ)কে স্মরণ করুন, তাঁর প্রতি দরুদ পেশ করুন, তাঁর যিকির করার সময় এমনভাবে অবস্থান করুন, যেন তিনি আপনার সামনে জীবিতাবস্থায় উপস্থিত আছেন, আর আপনি তাঁকে দেখছেন। আদব, মর্যাদা ও শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ন রেখে ভীত ও লজ্জিত থাকুন এবং এ ধারণা পোষণ করবেন যে, হুযুর পুর নুর আলাইহিস সালাম আপনাকে দেখছেন; আপনার কথাবার্তা শুনছেন। কেননা তিনি খোদার গুণাবলীতে গুণান্বিত। আল্লাহর একটি গুণ হচ্ছে ‘আমি (আল্লাহ) আমার স্মরণকারীর সঙ্গে সহাবস্থান করি।’
{শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীঃ মাদারিজুন নবুয়তঃ ২/৬২১ পৃ.}
❏ ইমাম ইবনুল হাজ্জ مدخل গ্রন্থে ও ইমাম কুস্তালানী (রঃ) مواهب গ্রন্থের ২য় খন্ডের ৩৮৭ পৃষ্ঠায় ২য় পরিচ্ছেদে زيارة قبره شريف শীর্ষক বর্ণনায় লিখেছেনঃ
وَقَدْ قَالَ عُلَمَاءُنَا لَا فَرْقَ بَيْنَ مَوْتِهِ وَحَيَاتِهِ أَعْنِي فِي مُشَاهَدَتِهِ لِأُمَّتِهِ وَمَعْرِفَتِهِ بِأَحْوَالِهِمْ وَنِيَّاتِهِمْ وَعَزَائِمِهِمْ وَخَوَاطِرِهِمْ، وَذَلِكَ عِنْدَهُ جَلِيٌّ لَا خَفَاءَ فِيهِ
-‘‘আমাদের সুবিখ্যাত উলামায়ে কিরাম বলেন যে, হুজুর (ﷺ) জীবন ও ওফাতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি নিজ উম্মতকে দেখেন, তাদের অবস্থা, নিয়ত, ইচ্ছা ও মনের কথা ইত্যাদি জানেন। এগুলো তাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে সুস্পষ্ট, কোনরূপ অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতার অবকাশ নেই এখানে।’’
{ক. ইমাম ইবনুল হাজ্জঃ আল-মাদখালঃ ১/২ ৫২ পৃ.
খ. ইমাম কুস্তালানীঃ মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়াঃ ৪/৫৮০ পৃ. মাকসুদঃ ১০, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ}
❏ মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘মিরকাতে’ মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) বলেনঃ
وَقَالَ الْغَزَالِي سَلِّمْ عَلَيْهِ اِذَا دَخَلْتَ فِي الْمَسْجِدِ فَاِنَّهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَحْضُرُ فِي الْمَسْجِدِ
-‘‘ইমাম গায্যালী (رحمة الله) বলেছেন, আপনি যখন মসজিদে প্রবেশ করবেন, তখন হুজুর (ﷺ)কে সশ্রদ্ধ সালাম দিবেন। কারণ তিনি মসজিদসমূহে বিদ্যমান আছেন।’’
{মোল্লা আলী ক্বারীঃ মেরকাতঃ প্রথম খন্ড কিতাবুল মাসাজিদ}
❏ ইমাম কাযী আরায (رحمة الله) প্রণীত শিফা শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘নসীমুর রিয়ায’ এর ৩য় খন্ডের শেষে উলেখিত আছেঃ
اَلْاَنْبِيَاءُ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ مِنْ جِهَةِ الْاَجْسَامِ وَالظَّوَاهِرِ مَعَ الْبَشَرِ وَبَوَ اطِنُهُمْ وَقَوَاهُمُ الرًُّوْحَانِيَّةُ مَلْكِيَّةٌُ وَلِذَا تَرَى مَشَارِقَ الْارْضَ وَمَغَارِبَهَا تَسْمَعُ اَطِيْطَ السَّمَاءِ وَتَشُمُّ رَائِحَةَ جِبْرَا ئِيْلَ اِذااَرَادَالنُّزُوْلَ اِلَيْهِمْ
-‘‘আম্বিয়ায়ে কিরাম (আলাইহিস সালাম) শারীরিক ও বাহ্যিক দিক থেকে মানবীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন, তবে আভ্যন্তরীণ ও রূহানী শক্তির দিক থেকে ফিরিশতাদের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ কারণেই তাঁরা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত সমূহ দেখতে পান, আসমানের চিড়চিড় আওয়াজ শোনেন এবং হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) তাঁদের নিকট অবতরণের ইচ্ছা পোষণ করতেই তাঁর সুঘ্রাণ পেয়ে যান।’’
{আল্লামা শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজীঃ নাসীমুর রিয়াদ}
❏ সুপ্রসিদ্ধ ‘দালায়েলুল খায়রাত’ নামক গ্রন্থের ভূমিকায় উলেখিত আছেঃ
وَقِيْلَ لِرَسُوْلِ للهِ اَرَ ءيْتَ صَلَوَةَ المُصَلِّيْنَ عَلَيْكَ مِمَّنْ غَابَ عَنْكَ وَمَنْ يَّاتِىْ بَعْدَكَ مَاحَالُهُمَاعِنْدَكَ فَقَالَ اَسْمَعُ صَلَوةَ اَهْلِ مُحَبَّتِىْ وَاَعْرِ فُهُمْ وَتُعْرَضُ عَليَّ صَلَوةَ غَيْرِهِمْ عَرْضًا
-‘‘হুজুর (ﷺ)কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলঃ আপনার থেকে দূরে অবস্থানকারী ও পরবর্তীকালে ধরাধামে আগমনকারীদের দরূদ পাঠ আপনার দৃষ্টিতে কি রকম হবে? ইরশাদ করেনঃ আন্তরিক, অকৃত্রিম ভালবাসা সহকারে দরূদ পাঠকারীদের দরূদ আমি নিজেই শুনি এবং তাদেরকেও চিনি। আর যাদের অন্তরে আমার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা নেই, তাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়।’’
{ক. ইমাম শাযুলীঃ দালায়েলুল খায়রাতঃ ১৫পৃ.
খ. ইমাম ফাসর্ীঃ মাতালিউল মুস্ররাতঃ ৫৬ পৃ.
গ. শায়খ ইউসূফ নাবহানীঃ জাওয়াহিরুল বিহার}
❏ ইমাম কাযী আরায (رحمة الله) এর ‘শিফা শরীফের’ ২য় খন্ডে আছেঃ
وَعَنْ عَلْقَمَةَ : إِذَا دَخَلْتُ الْمَسْجِدَ أَقُولُ: السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ
-‘‘হযরত ‘আলকামা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, “যখন আমি মসজিদে প্রবেশ করি, তখন বলি ‘হে নবী। (ﷺ) আপনার প্রতি সালাম এবং আপনার উপর আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।’’
{ক. মোল্লা আলী ক্বারীঃ শরহে শিফাঃ ২
খ. ইমাম সাখাভীঃ আল-কওলুল বকাঃ ১৮৫ পৃ.
গ. ইমাম কাজী আয়াজঃ শিফা শরীফঃ ২/৪৩ পৃ.}
❏ এ হাদীছটির সমর্থন পাওয়া যায় সুবিখ্যাত ‘আবু দাউদ’ ও ‘ইবনে মাজা’ হাদীছ গ্রন্থদ্বয়ের باب الدعاء عند دخول المسجد শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছ থেকেও।
‘মাদারেজুন নবুওয়াত’ গ্রন্থের ৪৫০ পৃষ্ঠায় ২য় খন্ডের ৪র্থ ভাগের حيات انبياء শীর্ষক পরিচ্ছেদে উলেখিত আছেঃ
اگر بعد ازاں گويند كه حق تعالي جسدشريف راحالتے وقدرتے بخشيده است كه درهر مكانے كه خواهد تشريف بخشد خواه بثال بمثالے خوه بعينيه خواه بر آسمان خواه برز مين خواه درقبر ياغيروعے صورتے داردبا جو دثبوت نسبت – خاص بقبردر همه حال
অর্থাৎ- এরপর যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তা’আলা হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র শরীরে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করছেন ও এমন এক শক্তি দান করেছেন যে, রাসূল (ﷺ) যেখানে ইচ্ছা করেন সেখানে স্বশরীরের বা অনুরূপ কোন শরীর ধারণ করে অনায়াসে গমন করতে পারেন, কবরের মধ্যে হোক বা আসমানের উপর হোক, এ ধরনের কথা সঠিক ও বাস্তবসম্মত। তবে, সর্বাবস্থায় কবরের সাথে বিশেষ সম্পর্ক বজায় থাকে।
❏ শাইখ শিহাবুদ্দিন সুহরাওয়ার্দী (رحمة الله) রচিত সুপ্রসিদ্ধ ‘আওয়ারিফুল মা আরিফ’ গ্রন্থের অনুবাদ গ্রন্থ ‘মিসবাহুল হিদায়েত’ এর ১৬৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেঃ
پس بايد كه بنده همچناكه حق سبحانه راپيوسته بر جميع احوال خود ظاهرا وباطنا واقف ومطلع ليند رسول الله عليه السلام رانيز ظاهر وباطن حاضر داند تامطا لعه صورت تعظيم ووقار اوهمواره به محا فظت اداب حضرتش دليل بود وانه مخالفت وى سراواعلاناشرم دارد و هيچ دقيقه ازدقائق اداب صحبت اوفرونه گزارد
অতএব, বান্দা যেমন আল্লাহ তা’আলাকে সর্বাবস্থায় গুপ্ত ও ব্যক্ত, যাবতীয় বিষয়ে অবহিত জ্ঞান করে থাকে, হুজুর (ﷺ)কেও তদ্রূপ জাহিরী ও ‘বাতিনী’ উভয় দিক থেকে ‘হাযির’ জ্ঞান করা বাঞ্ছনীয়; যাতে তাঁর আকৃতি বা ‘সুরত’ দেখার ধারণা, হার-হামিশা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও তাঁর দরবারের আদব রক্ষার দলীলরূপে পরিগণিত হয়, বাহ্যিক ও আব্যন্তরীণ দিক থেকে তাঁর বিরুদ্ধাচরণে লজ্জাবোধ হয় এবং তাঁর পবিত্র সহচর্যের আদব রক্ষা করার গৌরব লাভের সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।
সুপ্রসিদ্ধ ফিক্হ শাস্ত্র বিশারদ ও উলামায়ে উম্মত এর উপরোক্ত উক্তিসমূহ থেকে হুজুর (ﷺ) এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল। এখন আমি আপনাদেরকে জানাতে চাই, একজন নামাযীর নামায পড়ার সময় হুজুর (ﷺ) সম্পর্কে অন্তরে কি ধারণা পোষণ করা উচিত। এ প্রসঙ্গে আমি অত্র পরিচ্ছেদের প্রারম্ভে সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘দুররুল মুখতার’ ও ‘শামী’ থেকে উদ্ধৃতি পেশ করছি। অন্যান বুজুর্গানে দ্বীনের আরও কিছু বক্তব্য শুনন এবং নিজ নিজ ঈমানকে তাজা করুন।
❏ ‘আশিআতুল লুমআত’ গ্রন্থের কিতাবুস সালাত’ এর ‘তাশাহুদ’ অধ্যায়ে ও মাদারেজুন নবুয়াত’ গ্রন্থ ১ম খন্ডের ১৩৫ পৃষ্ঠায় ৫ম অধ্যায়ে ‘হুজুর (ﷺ)- এর ফযায়েল এর বর্ণনা প্রসেঙ্গ শাইখ আবদুর হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (رحمة الله) বলেছেনঃ
وبعضے عر فاگفته اند كه ايں خطاب بهت سريان حقيقت محمد يه است در ذرائر مو جودات وافاد ممكنات پس انحضرت در ذات مصلياں موجود وحاضر است پس مصلي رابايد كه ازيں معنى اگاه باشد وازيں شهودغافل نه بوتا انوار قرب واسرار معرفت منور وفائز گردد
অর্থাৎ- কোন কোন ‘আরিফ’ ব্যক্তি বলেছেন ‘তাশাহুদে’ ‘আসসালামু আলাইকুম আইয়ুহাননবী’ বলে নবী (ﷺ) কে সম্বোধন করাার রীতির এ জন্যই প্রচলন করা হয়েছে যে, ‘হাকীকতে মুহাম্মদীয়া’ (মুহাম্মদ (ﷺ) এর মৌল সত্ত্বা) সৃষ্টিকূলের অণু-পরমাণুতে, এমনকি সম্ভবপর প্রত্যেক কিছুতেই ব্যাপৃত। সুতরাং, হুজুর (ﷺ) নামাযীগণের সত্ত্বার মধ্যে বিদ্যমান ও ‘হাযির’ আছেন। নামাযীর এ বিষয়ে সচেতন হওয়া, বা এ বিষয়ের প্রতি অমনোযোগী না হওয়াই বাঞ্ছনীয়, যাতে নামাযী নৈকট্যের নূর লাভে ও মা’রেফাতের গুপ্ত রহস্যাবলী উন্মোচনে সফলকাম হতে পারে।
❏ সুবিখ্যাত ‘ইহয়াউল উলুম গ্রন্থ ১ম খন্ডের ৪র্থ অধ্যায়ের ৩য় পরিচ্ছেদে নামাযের বাতনী শর্তাবলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম গায্যালী (رحمة الله) বলেনঃ
وَاَحْضِرْ فِىْ قَلْبِكَ النَّبِيَّ عَلَيْهِ الس!َّلاَمُ وَشَخْصَهُ الْكَرِيْمُ وَقُلْ السَّلاَمُ عَلَيْكَ اَيُّهَاا لنَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرْ كَاتُهُ
অর্থাৎ- নবী আলাইহিস সালাম তথা তাঁর পবিত্র সত্ত্বাকে নিজ অন্তরে ‘হাযির’ জ্ঞান করবেন ও বলবেন ‘আসসালামু আলাইকা আইয়ুহাননবীউ ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’। (হে নবী! আপনার উপর শান্তি, রহমত ও বরকতের অমৃতধারা বর্ষিত হোক।)
❏ ‘মিরকাত গ্রন্থের ‘তাশাহুদ’ শীর্ষক অধ্যায়েও এরকম উক্তি বর্ণিত আছে مسك الختام নামক গ্রন্থের ২৪৩ পৃষ্ঠায়ও ওহাবী মতাবলম্বী নবাব সিদ্দিক হাসান খাঁন ভূপালী সে একই কথা লিখেছেন, যা’ আমি ইতোপূর্বে ‘আশিআতুল লুম ‘আত’ এর বরাত দিয়ে ‘তাশাহুদ’ প্রসঙ্গে লিখেছি যে, নামাযীর তাশাহুদ পাঠের সময় হুজুর (ﷺ)কে ‘হাযির-নাযির’ জেনেই সালাম করা চাই। তিনি উক্ত গ্রন্থে নিম্নোলিখিত দু’টি পংক্তি সংযোজন করেছেনঃ
درر اه عشق مر حلئه قرب وبعد نيست
مي بينمت عيان ودعامي فر ستمت
অর্থাৎ- প্রেমের রাস্তায় দূরের বা কাছের কোন ঠিকানা নেই। আমি তোমাকে দেখি ও দুআ করি।
❏ আল্লামা শাইখ মুজাদ্দিদ (رحمة الله) বলেনঃ
وَخُوْطِبَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَاَنَّهُ اِشَارَةٌُ اِلَي اَنَّهُ تَعَالَي يَكْشِفُ لَهُ عَنِ الْمُصَلِّيْنَ مِنْ اَمَّتِهِ حَتَّي يَكُوْنَ كَالْحَاضِرِ يَشْهَدُ لَهُمْ بِالْعَقْلِ اَعْمَالَهُمْ وَلِيَكَوْنَ تَذَكَّرُ حُضُوْرِهِ سَبَبًا لِمَزِيْدِ الْخََشُوْ عِ وَالْخُضُوْعِ
-‘‘নামাযে হুজুর (ﷺ)কে সম্বোধন করা হয়েছে। এটা যেন এ কথারই ইঙ্গিত বহ যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর হাবীবের উম্মতদের মধ্যে নামাযীদের অবস্থা রাসূল (ﷺ) কাছে এমনভাবে উদ্ভাসিত করেছেন যেন তিনি তাদের মধ্যে উপস্থিত থেকেই সব কিছু দেখতে পাচ্ছেন, তাদের আমলসমূহ অনুধাবন করছেন। এ সম্বোধনের আরও একটি কারণ হচ্ছে তাঁর এ উপস্থিতির ধারণা অন্তরে অতিমাত্রায় বিনয় ও নম্রতার ভাব সৃষ্টি করে।’’
{শহিখ মুজাদ্দিদে আল-ফেসানীঃ আল-মকতুবাত শরীফ}
‘হাযির-নাযির’ এর এ মাসআলার সহিত ফিকাহ শাস্ত্রের কয়েকটি মাসায়েলের সমাধানও সম্পৃক্ত। যেমন ফকীহগণের বলেন, স্বামী যদি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে থাকে, আর স্ত্রী রয়েছে পশ্চিম প্রান্তে। এমতাবস্থায় স্ত্রী একটি সন্তান প্রসব করল এবং স্বামী সেই শিশুটি তার বলে দাবী করল। তা’হলে শিশুটি তারই সাব্যস্ত হবে। কারণ স্বামী আল্লাহর ওলী হতে পারেন এবং কেরামতের বদৌলতে স্ত্রীর কাছে পৌঁছতে পারেন।
❏ ‘ফত্ওয়ায়ে শামী’ ২য় খন্ডের ثبوت النسب অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
ফত্ওয়ায়ে শামী, ৩য় খন্ডের المر تدين অধ্যায়ে ‘কারামাতে আওলিয়া’ বিষয়ক বর্ণনায় উলেখিত আছেঃ
وَطَيُّ الْمَسَافَةِ مِنْهُ لِقَوْلِهِ - عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ -زُوِيَتْ لِي الْأَرْضُ... وَيَدُلُّ لَهُ مَا قَالُوا فِيمَنْ كَانَ بِالْمَشْرِقِ وَتَزَوَّجَ امْرَأَةً بِالْمَغْرِبِ فَأَتَتْ بِوَلَدٍ يَلْحَقُهُ فَتَأَمَّلْ. وَفِي التَّتَارْخَانِيَّة أَنَّ هَذِهِ الْمَسْأَلَةَ تُؤَيِّدُ الْجَوَازَ
-‘‘এ দূরত্ব অতিক্রম করাটা সে একই কেরামতের অন্তভুর্ক্ত। এটা এজন্য সম্ভবপর যে, হুজুর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমার জন্য পৃথিবীকে সঙ্কুচিত করে দেয়া হয়েছিল।”
এতে ফকীহগণের নিম্নোক্ত মাসআলাটির সমাধান হয়ে যায়। মাসআলাটি হলঃ পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে অবস্থানকারী কোন ব্যক্তি যদি পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থানকারী কোন মহিলাকে বিবাহ করেন এবং সে স্ত্রীর সন্তান ভূমিষ্ট হয়, তাহলে শিশুটি উক্ত স্বামীর বলে গণ্য হবে। ‘তাতারখানিয়া’ নামক গ্রন্থে আছে যে, এ মাসআলাটি ‘কেরামত’ এর বৈধতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।’’
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামীঃ ফতোয়ায়ে শামীঃ মুরতাদঃ ৪/২৬০ পৃ. প্রাগুক্ত।}
❏ সে একই জায়গায় ‘শামী’তে আরও উলেখিত আছেঃ
قَالَ: وَالْإِنْصَافُ مَا ذَكَرَهُ الْإِمَامُ النَّسَفِيُّ حِينَ سُئِلَ عَنْ مَا يُحْكَى أَنَّ الْكَعْبَةَ كَانَتْ تَزُورُ وَاحِدًا مِنْ الْأَوْلِيَاءِ هَلْ يَجُوزُ الْقَوْلُ بِهِ؟ فَقَالَ: نَقْضُ الْعَادَةِ عَلَى سَبِيلِ الْكَرَامَةِ لِأَهْلِ الْوِلَايَةِ جَائِزٌ عِنْدَ أَهْلِ السُّنَّةِ
-‘‘সেটাই যা’ ইমাম নাসাফী (رحمة الله) একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কথিত আছে যে কা’বা শরীফ কোন এক ওলীর সহিত সাক্ষাত করার জন্য গমনাগমন করে একথা বলাটা ‘জায়েয’ হবে কিনা? এর উত্তরে তিনি বলেছেন, আওলিয়া কিরামের দ্বারা ‘কেরামত’ হিসেবে অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম ধর্মী কার্যাবলী সম্পাদন আহলে সুন্নাতের’ মতে জায়েয।’’
{ইবনে আবেদীন শামীঃ ফতোয়ায়ে শামীঃ ৩/৫৫১ পৃ. প্রাগুক্ত}
এ উদ্ধৃতি থেকে জানা গেল যে, পবিত্র কা’বা মুয়াজ্জমাও আওলিয়া কিরামের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে ঘুরাঘুরি করে থাকে।
❏ তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ সূরা মুলক এর শেষে উলেখিত আছেঃ
قَالَ الْاِمَامُ الْغَزَّالِى وَالرَّسُوْلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَهُ الْخِيَارُ فِيْ طَوَافِ الْعَالَمِ مَعَ اَرْوَاحِ الصَّحَابَةِ لَقَدْرَاَهُ كَثِيْرٌُ مِنَ الْاَوْلِيَآءِ
-‘‘ইমাম গাযযালী বলেছেন, সাহাবায়ে কিরামের রুহের এবং হুজুর (ﷺ) এর জগতে পরিভ্রমনের ইখতিয়ার আছে বিধায় অনেক আওলিয়া কিরাম তাদেরকে দেখেছেন।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১০/১১৪ পৃ.}
أَنْبَاءُ الْأَذْكِيَاءِ بِحَيَاةِ الْأَنْبِيَاءِ নামক গ্রন্থের ৭ পৃষ্ঠায় আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী (رحمة الله) বলেনঃ
النَّظَرِ فِي أَعْمَالِ أُمَّتِهِ وَالِاسْتِغْفَارِ لَهُمْ مِنَ السَّيِّئَاتِ، وَالدُّعَاءِ بِكَشْفِ الْبَلَاءِ وَالتَّرَدُّدِ فِي أَقْطَارِ الْأَرْضِ لِحُلُولِ الْبَرَكَةِ فِيهَا، وَحُضُورِ جِنَازَةِ مَنْ مَاتَ مِنْ صَالِحِ أُمَّتِهِ، فَإِنَّ هَذِهِ الْأُمُورَ مِنْ جُمْلَةِ أَشْغَالِهِ فِي الْبَرْزَخِ كَمَا وَرَدَتْ بِذَلِكَ الْأَحَادِيثُ وَالْآثَارُ
❏ ‘‘উম্মতের বিবিধ কর্মকান্ডের প্রতি দৃষ্টি রাখা, তাদের পাপরাশি ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদেরকে বালা মসিবত থেকে রক্ষা করার জন্য দু’আ করা, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত আনাগোনা করা ও বরকত দান করা এবং নিজ উম্মতের কোন নেক বান্দার ওফাত হলে তাঁর জানাযাতে অংশগ্রহণ এগুলোই হচ্ছে হুজুর (ﷺ) এর সখের কাজ। কোন কোন হাদীছ থেকেও এসব কথার সমর্থন পাওয়া যায়।’’
{ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ আল-হাভীলিলি ফাতওয়াঃ ২/১৮৪-১৮৫ পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়া, বয়রুত।}
❏ ইমাম গাযযালী (রহ:) المنقذمن الضلال নামক গ্রন্থে বলেছেনঃ
মক গ্রন্থে বলেছেনঃ
ارباب قلوب مشاهده مى كنند دربيدارى انبياء وملائكه راو هم كلام مى شوند بايشا ں
-‘‘ঐশী নূরে আলোকিত অন্তর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জাগ্রত অবস্থায় নবী ও ফিরিশতাগণকে দেখতে পান, তাঁদের সাথে কথাবার্তাও বলেন।’’
❏ ইমাম সয়ুতী (رحمة الله) শরহে সুদুর গ্রন্থে বলেনঃ
اِنِ اعْتَقَدَ النَّاسُ اَنَّ رَوْحَهُ وَمِثَالَهُ فِىْ وَقْتِ قِرَاءَةِ الْمَوْلِدِ وَخَتْمِ رَمْضَانَ وَقِرَآءةِ الْقِصَائِدِ يَحْضُرُ جَازَ
-‘‘যদি কেউ বিশ্বাস পোষন করে যে, হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র রূহ ও তাঁর জিসমে মিছালী’ মীলাদ পাঠের সময়, রমযানে খতমে কুরআনের সময় এবং না’ত পাঠ করার সময় উপস্থিত হন, তবে এ বিশ্বাস পোষণ করা ‘জায়েয’।’’
{ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ শরহুস সুদুর}
❏ মওলবী আবদুল হাই (লাখনৌভি) সাহেব তাঁর রচিত تراويح الجنان بتشر يح حكم شرب الدخان নামক রিসালায় লিখেছেনঃ জনৈক ব্যক্তি না’ত পাঠ করতো এবং হুক্কাও পান করতো। সে একদিন স্বপ্নে দেখল যে, নবী করীম আলাইহিস সালাম তাকে বলছেন “যখন তুমি মীলাদ শরীফ পাঠ কর, তখন আমি মাহফিলে উপস্থিত হই। কিন্তু যখনই হুক্কা আনা হয়, তখন আমি কালবিলম্ব না করে মাহফিল থেকে ফিরে যাই।”
এসব উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হল যে, জগতের অণু-পরমাণুর প্রতিও হুজুর (ﷺ)- এর সার্বক্ষণিক দৃষ্টি নিবন্ধ রয়েছে। আর, নামায, তিলাওয়াতে কুরআন, মাহফিলে মীলাদ শরীফ ও না’ত পাঠের মাহফিলে বিশেষ করে পুণ্যাত্মাদের নামাযে জানাযায় স্বশরীরে তিনি তশরীফ আনয়ন করে থাকেন।
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ান ২৬ পারা ‘সূরা ফাতাহ’ এর اِنَّا اَرْ سَلْنَكَ شَاهِدًا আয়াত এর ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ
فَاِنَّهُ لَمَّ كَانَ اَوَّلَ مَخْلُوْقِ خَلَقَهُ للهُ كَانَ شَاهِدًا بِوَحْدَانِيَةِ الْحَقِّ وَشَاهِدًابِمَا اُخْرِجَ مِنَ الْعَدَمِ اِلَى الْوُجُوْدِ مِنَ الْاَرْوَاحِ وَالنَّفَوْسِ وَالاَجْرَامِ وَالْاَرْكَانِ وَالْاَجْسَادِ وَالْمَعَادِنِ وَالْنّضبَاتِ وَالْحَيْوَانِ واَلْمَلَكِ وَالْجِنِّ وَاَلشَّيْطَنِ وَالْاِنْسَانِ وَغَيْرِ ذَلِكَ لِئَلاَّ يَشُذَّ عَنْهُ مَايَمْكِنُ لِلْمَخْلُوْقِ مِنْ اَسْرَارِ اَفْعَا لِهِ وَعَجَا ئِبِهِ
-‘‘যেহেতু হুজুর (ﷺ) আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি, সেহেতু তিনিই আল্লাহর একত্বের সাক্ষী, সে সব বস্তুরও অবলোকনকারী, যেগুলি অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বের সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে এসেছে। যেমন মানবাত্মা, জীবাত্মা শারীরিক কাঠামো, খনিজ পদার্থ, বৃক্ষরাজি, পশু পক্ষী, ফিরিশতা, মানুষ ইত্যাদি। সুতরাং, খোদা-তা’আলার সেসব গুপ্ত ভেদ ও বিস্ময়কর ব্যাপারগুলোও যেগুলির রহস্য উন্মোচন অন্য কোন মাখলুকের জন্য সম্ভবপর নয়, তাঁর কাছে রহস্যাবৃত ও অনুদঘাটিত থাকার কোন অবকাশ থাকে না।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৯/২৩ পৃ.}
❏ সে একই জায়গায় আরও কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর বলা হয়েছেঃ
فَشَاهَدَ خَلْقُهُ وَمَا جَرَاىْ عَلَيْهِ مِنَ الْاِكْرَامِ وَالْاِخْرَاجِ مِنَ الْجِنَّةِ بِسَبَبِ الْمُخَالِفَةِ وَمَاتَابَ اللهُ عَلَيْهِ اِلَى اَخِرِ مَاجَرَى اللهُ عَلَيْهِ وَشَاَهَدَ خَلْقَ اِبْلِيْسَ وَمَا جَرَى عَلَيْهِ
-‘‘তিনি দেখেছেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টি, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, ভুলের কারণে বেহেশত থেকে তাঁর অপসারণ এবং পরে তাঁর তওবা গৃহীত হওয়ার যাবতীয় ঘটনাবলী। শেষ পর্যন্ত সেই আদম আলাইহিস সালামকে কেন্দ্র করে যা কিছু আবর্তিত হয়েছে, সবই রাসূল (ﷺ) দেখেছেন। তিনি আরো দেখেছেন- শয়তানের সৃষ্টি ও যা’ কিছু তাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৯/২৩ পৃ.}
এ থেকে বোঝা গেল যে, দৃশ্যমান জগতে রাসূল (ﷺ) অভিব্যক্তির পূর্বেই প্রত্যেক ব্যক্তি ও বস্তুর যাবতীয় অবস্থা তিনি অবলোকন করেছেন।
❏ আরও কিছু দূর অগ্রসর হয়ে উক্ত ‘রূহুল বয়ানের’ স্বনামধন্য লেখক সে একই বর্ণনায় আরও বলেছেনঃ
قاَلَ بَعْضُ الْكِبَارِ اِنَّ مَعَ كُلِّ سَعِيْدٍ رَفِيقَهُ مِنْ رُّوحِ النَّبِىّ عَلَيهِ السَّلاَمُ هَىَ الرَّقِيْبَ وَالْنَبَاتِ عَلَيْهِ وَلَمَّ قَبِضَ الرُّوْحُ المُحَمَّدِىَّ عَنْ اَدَمَ الَّذِىْ كَانَ بِهِ دَائِمًا لا يضِلُّ وَلاَ يَنْسَى جَرَى عَليه مَاجَرَى مِنَ النِّسْيَانِ وَمَا يَتْبَعُهُ
-‘‘কোন কোন বুযুর্গানে দ্বীন বলেন প্রত্যেক পুণ্যাত্মার সাথে হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র রূহ অবস্থান করে। رقيب عن يد শব্দদ্বয় দ্বারা ইহাই বোঝানো হয়েছে যে সময় রূহে মুহাম্মদীর স্থায়ী তাওজ্জুহ হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে অন্যত্র সরে গেল তখনই তিনি ভুল করে বসলেন এবং তার ফলশ্রুতিতে যা হবার তা’ই হয়েছে। একটি হাদীছে উলেখিত আছে যে, যখন কোন ব্যবিচারকারী অবৈধ যৌন মিলনে লিপ্ত হয়, তখন তার নিকট থেকে ঈমান বের হয়ে যায়।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৯/২৩-২৪ পৃ.}
❏ উক্ত তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ জায়গায় বলা হয়েছে, এখানে ঈমান বলতে হুযুর পাকের দৃষ্টিকেই বোঝানো হয়েছে’। অর্থাৎ যে মুমিনবান্দা কোন ভাল কাজ করেন, তা হুজুর (ﷺ) এর কৃপা দৃষ্টির বরকতেই সম্পন্ন করেন। যে পাপ কাজ করে, হুযুরের দৃষ্টি অপসারণের ফলশ্রুতিতে সেই পাপ কর্ম সংঘটিত হয়ে থাকে।
এ থেকে হুজুর (ﷺ) এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার বিষয়টি সুন্দরভাবে প্রতিভাত হল।
❏ ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) স্বরচিত ‘কাসিদায়ে নু’মান’ নামক প্রশংসা মূলক কাব্যগ্রন্থে বলেছেনঃ
وَاِذَا سَمِعْتُ فَعَنْكَ قَوْلاًَ طَيِّبًا – وَاِذَا نَظَرْتُ فَلاَاَرْى اِلاَّكَ
-‘‘প্রিয়নবী (ﷺ) কে সম্বোধন করে বলছেন, হে নবী! যখনই আমি কিছু শুনি, শুধু আপনার প্রশংসাই শুনি; আর যখন কোনদিকে তাকাই, তখন আপনি ছাড়া আর কিছুই আমার দৃষ্টিগোচর হয় না।’’
{ইমাম আযম আবু হানিফাঃ কাসীদায়ে নুমানঃ ৪৫ পৃ.}
ইমাম সাহেব (رحمة الله) কুফাতে অবস্থান করে চারিদিকে হুজুর (ﷺ)কে দেখতে পান।