বিষয় নং-০২. কোনো মুহাদ্দিসের উক্তি হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ বলতে কী বুঝায়?


‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ১৮৯ পৃষ্ঠায় লেখক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর কোন প্রমাণ ছাড়াই মুহাদ্দিসদের উক্তি ‘হাদিসটি সহীহ নয়’ বলতে জাল হাদিস বুঝায় বলে উল্লেখ করেছে। তার কাছে আমার প্রশ্ন যে, হাদিস শাস্ত্রের ভূয়া এই নীতিমালা কোন মুহাদ্দীসের? অবশ্যই কোন মুহাদ্দিসের নয়। তা না হলে তিনি কেন উসূল বয়ান করলেন কিন্তু নির্ভরযোগ্য উসূলে হাদিসবিদ মুহাদ্দিসদের অভিমত উল্লেখ করলেন না কেন? এটা দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, এটা কোন হক্কানী মুহাদ্দীসের মন্তব্য নয়; বরং তার নিজের মনগড়া বক্তব্য। অপরদিকে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পাদিত আরেকটি বিভ্রান্তিকর বই ‘প্রচলিত জাল হাদিস’’ এর ৪৯ পৃষ্ঠায় প্রমাণহীনভাবে কোন মুহাদ্দিসদের উক্তি ‘হাদিসটি সহীহ নয়’ বলতে জাল হাদিস বুঝায় বলে বুঝানোর অপচেষ্টা চালিয়েছেন। তাই আমি উক্ত হাদিসের নীতিমালার জন্য অনেক কষ্ট করে তথ্য সংগ্রহ করলাম এবং নিম্নে উপস্থাপন করলাম।


হাদিস তিন প্রকার। ১. সহীহ,  ২. হাসান,  ও ৩. দ্বঈফ। এগুলো হাদিসেরই অন্তর্ভূক্ত। বর্ণনার সূত্রানুসারে এভাবে হাদিস-বিশারদগণ হাদিসের প্রকারভেদ করেছেন। আমাদের দেশে বা বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণীর নামধারী আলিম মনগড়াভাবে হাদিস শাস্ত্রের মূলনীতিকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে হাদিস-ই-দ্বঈফকে হাদিস বলেই স্বীকার করতে রাজি নয়।

অথবা দলীল হিসেবে এ পর্যায়ের হাদিসকে অগ্রহণযোগ্য বলার অপপ্রয়াস চালায়। অথচ হাদিস বিশারদদের মতে দ্বঈফ সনদও হাদিস হিসেবে গণ্য। সনদের দিক দিয়ে দুর্বল হবার কারণে, এ পর্যায়ের হাদিস দিয়ে কোন আমল ওয়াজিব বা সুন্নাত প্রমাণ করা না গেলেও, এমন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত বাক্য সাওয়াবদায়ক হওয়াতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যা সামনে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে। অনুরূপ কোন হাদিসের ব্যাপারে যদি কোন মুহাদ্দিস এ ‘হাদিস সহীহ নয়’ বলে মন্তব্য করেন, তবে এতদভিত্তিতে ওই হাদিসকে অসত্য ও বানোয়াট হাদিস হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ সহীহ না হলে হাসান বা দ্বঈফ পর্যায়েরও হতে পারে।


হাদিস-ই-সহীহ হল হাদিসের বচন ও সূত্রের মধ্যে কোনরূপ ত্র“টিবিচ্যুতির উর্ধ্বে, এমন হাদিস। সুতরাং কোন হাদিস সহীহ নয় বলে মন্তব্যকে পুঁজি করে,  ওই হাদিসকে মিথ্যা হাদিস (মাওদ্বু) বলার সুযোগ নেই। এ নীতিমালাটির নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণের জন্য এবং এ নীতিমালা অপব্যাখ্যাকারীদের জবাবে আমি গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিসদের ভাষ্য নিম্নে তুলে ধরলাম, পাঠকবৃন্দ! পড়ে আপনারাই বিবেচনা করবেন কাদের বক্তব্য সঠিক।


✦ অভিমত নং- ১. বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস, ইমাম, হাফেযুল হাদিস, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানীর (رحمة الله) রচিত “আল ক্বওলুল মুসাদ্দাদ ফিয যুব্বি আন মুসনাদি আহমদ” নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে,   

وَلا يَلْزَمُ مِنْ كَوْنِ الْحَدِيثِ لَمْ يَصِحَّ أَنْ يَكُونَ مَوْضُوعًا -الحديث السابع

-‘‘হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ বললে সেটা মাওদ্বু বা বানোয়াট হাদিস হওয়া অপরিহার্য নয়।’’ (আল ক্বওলুল মুসাদ্দাদ ফিয যুব্বি আন মুসনাদি আহমদ, ১/৩৭ পৃষ্ঠা,  মাকতাবায়ে ইবনে তাইমিয়া,  কায়রু,  মিশর।)


✦ অভিমত নং-২: বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস, হাফেযুল হাদিস, আল্লামা ইমাম আবদুর রহমান জালালুদ্দীন সূয়ূতী (رحمة الله) তার লিখিত “তা‘কিবাত আলাল মাওদ্বুআত’’ গ্রন্থে বলেন-

اكثر ما حكم الذهبى على هذا الحديث انه قال متن ليس بصحيح وهذا صادق بضعفه-التعقبات على الموضوعات باب: بدء الخلق والانبياء. 

-‘‘এ হাদিস সম্পর্কে ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী (رحمة الله) সর্বোপরি এ মন্তব্য করেছেন যে,  হাদিসের বচনগুলো বা (মতন) সহীহ নয়। এ কথা দ্বারা বুঝা যায়,  হাদিসটি দ্বঈফ বা দুর্বল পর্যায়ের (সূত্রের বা বচনের দিক দিয়ে)।’’৬

➥৬. ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি : তা‘কিবাত আলাল মাওদ্বূআত, পৃ-২৪৫


✦ অভিমত নং-৩: বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে লিখেন- 

لَا يَلْزَمُ مِنْ عَدَمِ صِحَّتِهِ نَفْيُ وُجُودِ حُسْنِهِ وَضَعْفِهِ

-‘‘এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই কোনো মুহাদ্দিস ‘হাদিসটি সহীহ নয়’ বললে সেটার দ্বারা হাদিসটি বানোওয়াট হওয়া অপরিহার্য হবে।’’ ৭

➥৭. মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফূআত, পৃ-১/১০৮ পৃ. হাদিস:৮৫, মুয়াস্সাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবানন।


✦ অভিমত নং-৪: উক্ত কিতাবে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তিনি আশুরার দিন সুরমা লাগানোর বিষয়ে একটি বর্ণিত হাদিস সম্পর্কে হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এর উক্তি لَا يُصِحٌ هَذَا الْحَدِيث (এ হাদিস সহীহ নয়) বলে মন্তব্য করার পর লিখেছেন-

لَا يَلْزَمُ مِنْ عَدَمِ صِحَّتِهِ ثُبُوتُ وَضْعِهِ وَغَايَتُهُ أَنَّهُ ضَعِيفٌ

-‘‘আমার (মোল্লা আলী ক্বারী ) কথা হল, এ হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ মানে বানোয়াট বা মাওদ্বু নয়। সর্বশেষ দ্বঈফ বলা যায় মাত্র।’’ ৮

➥৮. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফূআত, ১/৪৭৪ পৃ. মুয়াস্সাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবানন।


✦ অভিমত নং-৫: বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস, ইমাম, হাফেযুল হাদিস, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেন, 

ان لفظ لا يثبت لا يلزم منه ان يكون موضوعات فإن الثابت يشمل الصحيح فقط والضعيف دونه كذا فى تذكرة الموضوعات –المبحث: الثانى فى اقسام الواضعين.

-‘‘কোন হাদিসের ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য (এ হাদিসটি সুদৃঢ় নয়) বললে,  হাদিসটি মাওদ্বু বা বানোওয়াট বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ সাবিত বা প্রমাণিত শব্দ দ্বারা শুধু সহীহ হাদিসই বুঝায় এর নিম্ন পর্যায়ের হাদিসের মধ্যে দ্বঈফও রয়েছে।’’ ৯

➥৯. আল্লামা তাহের পাটনী : তাযকিরাতুল মওদ্বুআত, ৭৫ পৃষ্ঠা


✦ অভিমত নং-৬-৭: শুধু তাই নয় দেওবন্দীদের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি মাওলানা আব্দুল হাই লাখনৌভি লিখেন-

لَا يلْزم من قَول أَحْمد فِي حَدِيث التَّوسعَة أَنه لَا يَصح أَن يكون بَاطِلا

-‘‘ইমাম আহমদ (رحمة الله)‘র উক্তি হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ বলার দ্বারা হাদিসটি বাতিল বা জাল হওয়া অপরিহার্য নয়।’’ ১০

➥১০. আব্দুল হাই লাখনৌভি : আসারুল মারফু‘আ, ১০১ পৃ.


শুধু তাই নয় দেওবন্দী আলেম মাওলানা সরফরায খাঁন সফদর ‘নূর আওর বাশার’ গ্রন্থের ৫৪ পৃষ্ঠায়ও তাঁর এ ইবারতটি সংকলন করেছেন।


✦ অভিমত নং-৮: একটি হাদিস শরীফ এও রয়েছে যে, 

الْبِطِّيخُ قَبْلَ الطَّعَامِ يَغْسِلُ الْبَطْنَ غَسْلًا وَيَذْهَبُ بِالدَّاءِ أَصْلًا-

-‘‘খাওয়ার পূর্বে তরমুজ খেলে তা পেটকে একেবারেই পরিষ্কার করে দেয় এবং রোগ ব্যাধিকে সমূলে দূরীভূত করে দেয়।’’ এ হাদিসের ব্যাপারে ইমাম ইবনে আসাকীর (رحمة الله) বলেছেন,  شَاذٌّ لَا يَصِحُّ (এটি শায, বিরল পর্যায়ের সহীহ নয়) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) আলোচ্য হাদিস সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্য সম্পর্কে লিখেছেন, 

وَهُوَ يُفِيدُ أَنَّهُ غَيْرُ مَوْضُوعٍ كَمَا لَا يَخْفَى–

-‘‘এ কথা স্পষ্ট যে,  ইমাম ইবনে আসাকিরের উলি­খিত মন্তব্য দ্বারা হাদিসটি মাওদ্বু বা বানোওয়াট নয় বলে বুঝা যায়।’’ ১১

➥১১. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফূআহ,  : ১/৪৮৬ পৃষ্ঠা, আলামা আজলূনী : কাশফুল খাফা : ১/২৫৬ পৃ. হা/৯০৮


✦ অভিমত নং-০৯: আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) উল্লেখ করেন-

وَقَالَ ابْنُ الْهُمَّامِ: وَقَوْلُ مَنْ يَقُولُ فِي حَدِيثٍ أَنَّهُ لَمْ يَصِحَّ إِنْ سَلِمَ لَمْ يُقْدَحْ ; لِأَنَّ الْحُجَّةَ لَا تَتَوَقَّفُ عَلَى الصِّحَّةِ، بَلِ الْحَسَنُ كَافٍ– فصل الثانى من باب: ما يجوز من العمل فى الصلاة.

-‘‘ইমাম কামালুদ্দীন মুহাম্মদ বিন হুমাম (رحمة الله) বলেন, কোন হাদিস সম্পর্কে কোন মুহাদ্দিস বলেছেন যে এ ‘হাদিসটি সহীহ (বিশুদ্ধ) নয়’,  তাদের কথা সত্য বলে মান্য করা হলেও কোন অসুবিধা নেই, যেহেতু (শরীয়তের) দলীল বা প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য শুধু (হাদিস) সহীহ বা বিশুদ্ধ হওয়া নির্ভরশীল নয়। সনদ বা সূত্রের দিক দিয়ে ‘হাসান’ হলেও (হাদিসটি শরীয়তের দলীল হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য) যথেষ্ট।’’  ১২

➥১২. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাত: ৩/৭৭ পৃ. হা/১০৮


✦ অভিমত নং-১০: আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) বলেন-

وَقَول أَحْمد إِنَّه حَدِيث لَا يَصح أَي لذاته فَلَا يَنْفِي كَونه حسنا لغيره وَالْحسن لغيره يحْتَج بِهِ كَمَا بَين فِي علم الحَدِيث-  (اَلصواعق المحرقه :  خاتمة الفصل الاول من الباب: الحادى عشر:২২৮)

-‘‘ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله)‘র বক্তব্য হাদিসটি  لَايَصِحٌবিশুদ্ধ নয় এর অর্থ হবে সহীহ লিজাতিহী তথা জাতি বা প্রকৃত অর্থে সহীহ নয় উক্ত হাদিসটি (সনদের দিক দিয়ে) ‘হাসান লিজাতিহী’ বা অন্য সনদে ‘হাসান লিগায়রিহী’ (জাতিগত সহীহ না হওয়া; সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সহীহ’র কারণে নিজে সহীহ হওয়া।) হওয়াকে মানা (নিষেধ) করে না। আর হাসান লিগায়রিহীও (শরিয়তের) প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। যা ইলমে হাদিস তথা হাদিস শাস্ত্র হতে জানা যায়।’’ ১৩

➥১৩. ইবনে হাজার মক্কী : আস-সাওয়ায়েকুল মুহরিকা, ২য় খণ্ড, পৃ-৫৩৬,  মুয়াস্সাতুর রিসালা,  বয়রুত,  লেবানন।

এটাও মনে রাখতে হবে হাসান হাদিসও সহীহ হাদিসেরই প্রকারের অর্ন্তভুক্ত। 


❏ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার বিখ্যাত উসূলে হাদিসের কিাতবে লিখেন-

وهذا القِسمُ مِنَ الْحَسَنِ مشاركٌ للصحيح في الاحتجاج به، وإِنْ كان دُونَهُ، 

-‘‘হাদিসে ‘হাসান’ শরিয়তের দলিল রূপে গ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে সহীহ হাদিসের সাদৃশ্য,  যদিও মরতবায় (কিছুটা) কম।  ১৪

➥১৪. ইবনে হাজার আসকালানী : নুযহাতুল নযর ফি তাওদিহে নুখবাতিল ফিকির, প্রথম খণ্ড,  পৃ ৭৮,  মাতবাআতে সাফির বিল রিয়াদ, সৌদি আরব।


✦ অভিমত নং-১১: আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এ নীতিমালাটিকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেন-

قَوْلَ السَّخَاوِيِّ لَا يَصِحُّ لَا يُنَافِي الضَّعْفَ وَالْحُسْنَ

‘‘ইমাম সাখাভী (رحمة الله)‘র বক্তব্য হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ (তিনি বলেন) তার সহীহ হওয়ার নিষেধ দ্বারা হাদিসটি ‘হাসান’ ও দ্বঈফ হওয়াকে নিষেধ করে না।’’ ১৫

➥১৫. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারূল মারফ‚আ, ১/৩৪৯ পৃ. হা/৫০২, লাখনৌভি, রাফউ ওয়া তাকমীল, ১৯৫ পৃ.


✦ অভিমত নং-১২: শায়খুল মুহাদ্দিসীন, আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) লিখেন,  

حکم عدم صحت کردن بحسب اصطلاح محدشن غرابت ندارد  چہ صحت در حدیث چنانچہ در مقدمہ معلوم ثد در جهه اعلی ست دائرہ آن تنگ تر جمیح احاادیث کہ در کتب مذکوراست  حتی دریں شش کتاب كحا انرا صحاح ستہ گویندہم  باصطلاح الیشان صحیح نیست بالک۔ تسمیہ انہا صحاح باعتِبار تغلیب است (الطريق القويم شرح صراط مستقیم : ۵۰۲خاتمة الكتاب)

-‘‘মুহাদ্দিসীনের পরিভাষায় عدم صحيح বলতে হাদিস গরীব হওয়াকে বুঝায় না। বরং হাদিস সহীহ হওয়া তার উচ্চ স্তরের দরজাকে বুঝায়। যেমন আমি আমার মুকাদ্দামায় উল্লেখ করেছি এবং তাহার পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ। সমস্ত হাদিসের কিতাবে উল্লেখ আছে এমনকি ছয় কিতাব যাহাকে صحاح ست (সিহাহ সিত্তাহ) নামে অভিহিত করা হইয়াছে মুহাদ্দিসিনের পরিভাষায় সহীহ নয়; বরং প্রাধান্য তার দিক দিয়ে সহীহ বলা হয়েছে। মুহাদ্দিসিনের বিস্তারিত বর্ণনায় এই কথাটি দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়েছে এই হাদিস সহীহ নয় এই কথা বলার উদ্দেশ্য উচ্চ স্তরের সহীহ নয়।’’  ১৬

➥১৬. আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, শরহে সিরাতুম মুস্তাকিম, ৫০২ পৃ.


✦ অভিমত নং-১৩: মাওলানা আবদুল হাই লাখনৌভি ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) সুপ্রসিদ্ধ কিতাব (بنتائج الافكار) এর উদ্ধিৃতি দিয়ে লিখেন-

لَا يلْزم من نفي الثُّبُوت ثُبُوت الضعْف لاحْتِمَال ان يُرَاد بالثبوت- الصِّحَّة فَلَا يَنْتَفِي الْحسن

-‘‘হাদিসটি ثبت নয় বা দৃঢ় নয় দ্বারা দ্বঈফ হওয়া অপরিহার্য নয়। বরং এ ধরনের শব্দ দ্বারা এর কোনো স্তরের হওয়ারও সম্ভবনা রাখে। তাই (সহীহ নয়) বলে ‘হাসান’ হওয়াকে নিষেধ করে না।’’ (সিমাউল মাওতা,  পৃ.২৩৪-২৩৫, লাখনৌভি, রাফউ ওয়া তাকমীল, ১৯৭ পৃ.)


✦ অভিমত নং-১৪: আল্লামা জুরকানী (رحمة الله) তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থে লিখেন-

نَفِي الصحة لَا يُنَافِي أَنَّهُ حَسَنٌ كَمَا علم

-‘‘কোনো হাদিসকে মুহাদ্দিসগণ সহীহ হওয়াকে নিষেধ করা দ্বারা হাসান হওয়াকে নিষেধ করে না, যেমনটি ইলমে হাদিস বা হাদিস শাস্ত্রের মূলনীতিমালার কিতাবে রয়েছে।’’ (জুরকানী, শারহুল মাওয়াহেব, ৫/৫৫ পৃ., লাখনৌভি, রাফউ ওয়া তাকমীল, ১৯৭ পৃ.)


✦ অভিমত নং-১৫: 

মাওলানা আবদুল হাই লাখনৌভি উল্লেখ করেন-

وَقَالَ مُحَمَّد بن عبد الْبَاقِي الزّرْقَانِيّ فِي شرح الْمَوَاهِب اللدنية للقسطلاني عِنْد ذكر حَدِيث يطلع الله لَيْلَة النّصْف من شعْبَان فَيغْفر لجَمِيع خلقه الا لمشترك اَوْ مُشَاحِن وَنقل الْقُسْطَلَانِيّ عَن ابْن رَجَب ان ابْن حبان صَححهُ فِيهِ رد على قَول ابْن دحْيَة لم يَصح فِي لَيْلَة نصف شعْبَان شَيْء الا ان يُرِيد نفي الصِّحَّة الاصطلاحية فان حَدِيث معَاذ هَذَا حسن لَا صَحِيح

-‘‘আল্লামা মুহাম্মদ বি আবদুল বাকী জুরকানী (رحمة الله) তার শারহুল মাওয়াহিব গ্রন্থে  শবে বরাত সম্পর্কিত হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (رضي الله عنه)-এর হাদিস যেখানে রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, শবে বরাতে মুশরিক এবং হিংসুক ব্যতিত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। ......প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে দাহিয়াহ (رحمة الله) বলেছেন শবে বরাত সম্পর্কিত ‘কোনো হাদিসই সহীহ নয়’ (আল্লামা জুরকানী বলেন), নিশ্চয়ই সহীহ হওয়া নিষেধ দ্বারা উসূলে হাদিসের পারিভাষায় হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (رضي الله عنه)-এর হাদিসটি ‘হাসান’ হওয়া প্রমাণিত, তবে (সহীহ নয় শব্দ দ্বারা) সহীহ লিজাতিহী নয় (উদ্দেশ্য)।’’ (লাখনৌভি, রাফউ ওয়া তাকমীল, ১৯৭ পৃ., আল্লামা জুরকানী, শারহুল মাওয়াহেব, ১০/৫৬১ পৃ.)

আল্লামা জুরকানী (رحمة الله)-এর এ অভিমত থেকে সুস্পষ্ট বুঝা গেল যে, হাদিসটি সহীহ নয় বলতে ‘হাসান’ হওয়া বুঝায়।


✦ অভিমত নং-১৬: মাওলানা আবদুল হাই লাখনৌভি একটি হাদিসের বিষয়ে ইমাম সামহুদী (رحمة الله)-এর (جَوَاهِر الْعقْدَيْنِ فِي فضل الشرفين) কিতাবের উদ্ধিৃতি দিয়ে তাঁর বক্তব্য লিখেন-

غير صَحِيح وَهُوَ صَالح للاحتجاج بِهِ اذ الْحسن رتبه بَين الصَّحِيح والضعيف

-‘‘মুহাদ্দিসদের উক্তি এ হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ বলা দ্বারা সনদটি সঠিক (এ ধরনের শব্দ দ্বারা মুহাদ্দিসগণ ‘হাসান’ স্তরের বুঝে থাকেন) এবং এর দ্বারা দলিল সাব্যস্ত করা যাবে, বরং তার মর্যাদা হবে ‘হাসান’ যা সহীহ এবং যঈফের মধ্যবর্তী স্থানের মর্যাদার অধিকারী।’’ (লাখনৌভি, রাফউ ওয়া তাকমীল, ১৯৫ পৃ.)


✦ অভিমত নং-১৭: আহলে হাদিসদের অন্যতম আলেম মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল হক আযীমাবাদী (মৃত্যু ১৩২৯ হি.) বলেন,  

لا يلزم من نفى الثبوت ثبوت الضعف لاحتمال ان يراد بالثبوت الصحة فلا ينتقى الحسن وعلى التنزل لا يلزم من نفى الثبوت عن كل فرد (اى عن صحيح والحسن) تيه عن المجموع (اى الصحيح والحسن والضعيف) انتهى كلامه رسالة غنية الالمعى مع طبرانى ٢/١٥٨ مطبوعه دار الكتب العلمية بيروت- 

-‘‘হাদিসটি দৃঢ় নয় বা সহীহ নয় বক্তব্য দ্বারা হাদিসটি দুর্বল হওয়া অপরিহার্য নয়। তাই হাদিসটি ثبت বা দৃঢ় এর দ্বারা সহীহ (উচ্চ পর্যায়ের বিশুদ্ধ) বুঝানো হয়েছে, তাই বলে ‘হাসান’ হওয়াকে নিষেধ করে না। তারপর আর একটু নিচে গেলেও ثبت নয় শব্দ দ্বারা একক সহীহ অথবা হাসান হওয়াকে নিষেধ করা হয় বলে,  সহীহ,  হাসান,  দ্বঈফ (সবগুলোকে) নিষেধ করা হয় নি।’’


✦ অভিমত নং-১৮: দেওবন্দীদের শাইখুল হাদিস তকী উদ্দিন নদভী সাহবে তার ‘ফান্ন আসমাউর রিযাল’ গ্রন্থে বলেন-

جب كسى حديث كے بارے ميں "لا يصح" يا "لا يثبت" كها جاتى تو اس سے يه لازم  نهيں اتا كه وه حديث موضوع  هے يا  ضعيف هے ، ملا على قارى رحمة الله   عليه فرماتے هيں كه عدم ثبوت سے حديث كا موضوع هونا لازم نهيں اتا- حافظ  ابن حجر عسقلانى رحمة الله عليه فرماتے هيں حديث كو "لا يصح" كهنے  سے اس كا موضوع هونا لازم نهيں اتا- ممكن هے وه  حديث حسن ياحسن لغيره هو- كذا فن  اسماء الرجال- صفحة৭৬  

-‘‘কোন মুহাদ্দিসের বক্তব্য হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ অথবা ‘দৃঢ় নয়’ বক্তব্য দ্বারা হাদিসটি মওদ্বু বা জাল অথবা দ্বঈফ হওয়া অপরিহার্য নয়। কমপক্ষে সর্বনিম্ন দুর্বল বলা যেতে পারে। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন হাদিসটি সহীহ নয় (সহীহ হওয়াকে নিষেধ) বলতে মওদ্বু বা জাল হওয়া অপরিহার্য নয়। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন,  হাদিসটি لا يصح অর্থাৎ ‘সহীহ নয়’ কারও বক্তব্য দ্বারা মওদ্বু বা জাল হওয়া অপরিহার্য নয়। কমপক্ষে “হাসান” লিগাইরিহী হাদিস বলা যেতে পারে।’’(৭৬ পৃ.)


✦ অভিমত নং-১৯: প্রসিদ্ধ একটি হাদিস আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। 

أَنَا مَدِينَةُ الْعِلْمِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا-

-“আমি ইলমের শহর আর আলী তার দরজা।’’


উক্ত হাদিসটি সম্পর্কে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন, 

وَسُئِلَ عَنْهُ الْحَافِظُ الْعَسْقَلَانِيُّ فَأَجَابَ بِأَنَّهُ حَسَنٌ لَا صَحِيحٌ كَمَا قَالَ الْحَاكِمُ وَلَا مَوْضُوعٌ-

-‘‘ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) কে উক্ত হাদিস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,  উক্ত হাদিসটি সহীহ নয়, ‘হাসান’ পর্যায়ের হাদিস। ইমাম হাকিম (رحمة الله) বলেন হাদিসটি জাল বা বানোওয়াট নয়।’’ ১৭

➥১৭. মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফূআহ : ১/১১৮ পৃ. হাদিস:৭১, মোবারকপুরী : তুহফাতুল আহওয়াজি : ১০/২২৬ পৃ. হা/৩৭২৩, আজলূনী : কাশফুল খাফা, ১/১৮৪-৮৫ পৃ. হা/৬১৮, ইমাম সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা : ১২১ পৃ. হা/১৮৯, মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাতুল মাফাতিহ : ১১/২৫৩, হা/৬০৯৬


তাই সুস্পষ্ট বুঝা যায় হাদিসটি সহীহ নয় বলতে “হাসান” হওয়াকে বুঝায়। 


✦ অভিমত নং-২০: একটি হাদিস أَنَا مَدِينَةُ الْعِلْمِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا- উক্ত হাদিস সম্পর্কে ইমাম আজলূনী ও মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন-

قَالَ فِي الدُّرر نَقْلًا وَقَالَ الْحَافِظُ أَبُو سَعِيدٍ الْعَلَائِيُّ الصَّوَابُ أَنَّهُ حَسَنٌ بِاعْتِبَارِ طُرُقِهِ لَا صَحِيحٌ وَلَا ضَعِيفٌ

-‘‘ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (رحمة الله) তার ‘আদ-দুররুল মুনতাসিরাহ ফি আহাদিসিল মুশতাহিরাহ’ এ ইমাম আবুল সাঈদ আ’লায়ী (رحمة الله) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, উক্ত হাদিসটি একাধিক তরীকায় বর্ণিত হওয়ার কারণে ‘হাসান’ হাদিস,  তাই হাদিসটি সহীহও নয় এবং দ্বঈফও নয়।’’ ১৮

➥১৮. আল্লামা আজলূনী : কাশফুল খাফা : ১/২০৪ : হা/৬১৮, মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফূআহ : ১/১১৯ পৃ. হাদিস:৭১


দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেল হাদিসটি ‘সহীহ নয়’ বলতে ‘হাসান’ পর্যায়ের হাদিস বুঝায়, মাওদ্বু নয়।

মোটকথা, হাদিস মাওদ্বু বা বানোয়াট বুঝানোর জন্য তারা হাদিসটি بَاطِل (বাতিল),  كذب (মিথ্যা),  مَوْضُوع (বানোয়াট), مُفْتَرَى (সত্যায়নযোগ্য নয় ও مُخْتَلَقٌ (মনগড়া বানানো) ইত্যাদি শব্দ বলতেন। সহীহ হওয়াকে অস্বীকার করা মানে বিশুদ্ধ সনদ হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ের নয় বরং কিছুটা ত্র“টিপূর্ণ পন্থায় বর্ণিত হাদিস। 


আলোচ্য বক্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে, হাদিস বুঝাতে হলে শুধু বাহ্যিক শব্দ ও অনুবাদ বুঝা যথেষ্ট নয়, এক্ষেত্রে হাদিস বিশারদগণের পরিভাষা,  তাঁদের উপস্থাপনা পদ্ধতি বাচনভঙ্গি, সূত্র বর্ণনার নিয়ম-কানুন,  গ্রহণীয়-বর্জনীয় হওয়ার হুকুম ব্যক্তকরণ পদ্বতি ইত্যাদি বুঝাও পূর্বশর্ত। কিতাব থেকে অনুবাদ পড়ে হাদিস বুঝা আদৌ সম্ভব নয়।

শুধু অনুবাদ বুঝা নয়, হাদিসের মর্মার্থ বুঝাই হল মূল জিনিস। কোন হাদিস সহীহ নয় মানে মাথা গরম করে জাল বলা যাবে না। হাদিস সহীহ নয় মানে হাদিস বিশারদগণের পরিভাষায়,  তিন প্রকারের হাদিসের মধ্যে সহীহ ছাড়া তো ‘হাসান’ ও দ্বঈফ পর্যায়ের দুটি প্রকারের মধ্যে যে কোন একটিও তো হতে পারে। ন্যূনতম দ্বঈফ বা দুর্বল সনদ বিশিষ্ট হতে পারে। 


মওদ্বু বা বানোয়াট হলে সরাসরি বলা হতো هذا حديث موضوع তথা উক্ত হাদিসটি মাওদ্বু বা জাল। 

মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য কোন হাদিস প্রসঙ্গে ‘সহীহ নয়’ বললে, তার অর্থ এটা নয় যে, হাদিসটি ভুল বা বাতিল। বরং তাদের পরিভাষা মোতাবেক এর অর্থ হলো, হাদিসটি সহীহ পর্যায়ের হাদিসের মতো সনদ বিশিষ্ট নয়। কারণ “সহীহ” হাদিসের কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, ঐ বৈশিষ্ট্য গুলো যাতে বিদ্যমান তা-ই ‘সহীহ’। সে পর্যায়ের হাদিস খুঁজতে গেলে ‘সিহাহ সিত্তাহ’ বা হাদিসের বিখ্যাত ছয়টি হাদিসের কিতাব ইত্যাদি থেকে খুঁজতে হয়। তবে ছয়টি ব্যতীত আরো সহীহ হাদিসের অনেক কিতাব রয়েছে।

এগুলোর মধ্যেও কোন কোন গ্রন্থে কিছু কিছু হাদিসকে সহীহ বলার ক্ষেত্রে দ্বিমত দেখা যায়। কারণ, যারা বিরোধীতা করেন তারা কোন কোন হাদিসকে “হাসান” পর্যায়ের কিংবা স্থান বিশেষে দ্বঈফও বলেছেন। স্বয়ং গ্রন্থকারও ঐ মুষ্টিমেয় কিছু হাদিসকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। ঐ কিছু বাদ দিয়ে বাকী সব হাদিস ‘সহীহ’ হবার কারণে ঐ গ্রন্থগুলোকে ‘সহীহ’ বলা হয়। তবে এ কথা নিশ্চিত যে,  ঐ সব কিতাবে কোন মওদ্বু বা বানোয়াট হাদিস নেই। তাই বলে দ্বঈফ বা দুর্বল হাদিসকে হাদিস নয় বলার কোন সুযোগ নেই। সে অনুসারে আমল করলে নিঃসন্দেহে সাওয়াব পাওয়া যাবে।

Top