ইসলাম ও নারী শিক্ষা
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আদর্শ সমাজ বিনির্মানে পুরুষ শিক্ষার পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ সমাজের অর্ধেক হচ্ছে নারী। এদেরকে অন্ধকারে রেখে সমাজ উন্নতি লাভ করতে পারে না।
নারী আমাদের মাতৃজাতি। জগতের মহামানব, সাধক-তাপসকুলের জননী, নবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়াদের গর্ভধারিনী। পৃথিবীর বিখ্যাত সব বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক সকলেই মায়ের কোলে লালিত। মায়ের কোলই সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষাগার, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করেছেন-
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
প্রত্যেক মুসলমানের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয। কোনো বর্ণনায় আছে- مسلمة অর্থাৎ নারী-পুরুষ উভয়ের উপর জ্ঞানার্জন আবশ্যক। ২৫৪
২৫৪.ইমাম বায়হাকী র (৪৫৮ হি.), শোয়াবুল ঈমান, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৩৪
ইসলামে নারীদের জন্য জ্ঞানার্জন কেবল অধিকার বলেনি বরং একান্ত ফরয করে দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদেরকে জ্ঞানার্জনের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি ও সরবরাহ করাটা পরিবার, গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
মহানবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অন্ধকারে নিমজ্জিত নারীদের মাঝে জ্ঞান-সূর্যের উদয় ঘটালেন। তিনি মানব সমাজকে নারী জাতির শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন- “যার নিকট তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনটি বোন রয়েছে, অতঃপর তাদের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের আদব শিক্ষা দিয়েছে আর তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করেছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
অন্য হাদিসে তিনি আরো ইরশাদ করেন- “যদি কারো অধীনে কোনো দাসী থাকে এবং সে তাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে, উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়, অতঃপর তাকে মুক্ত করে দিয়ে নিজ স্ত্রী রূপে গ্রহণ করে, তবে তার জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে। ২৫৫
২৫৫.ইমাম বুখারী র (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, পৃ. ২০, হাদিস নং ৯৭
নারীকে একটি নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ পরিবেশের সুযোগ করে দিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিদ্যা-বুদ্ধি ও স্বাভাব চরিত্রে সুগঠিত করে সমাজকে একটা যোগ্যতর কন্যা ও আদর্শ মা উপহার দেওয়া সম্ভব।
একজন আদর্শ নারী (মা) দ্বারা একটি আদর্শ পরিবার এবং আদর্শ পরিবার দ্বারা একটি আদর্শ সমাজ গঠিত হয়। আর আদর্শ সমাজ দ্বারা আদর্শ জাতি গঠিত হয়। তাই নেপোলিয়ন বলেছিলেন “আমাকে একটি আদর্শ মা দাও, আমি তোমাকে একটি আদর্শ জাতি উপহার দেবো।” আর এরূপ আদর্শ নারী গঠিত হবে ইসলামী জ্ঞানার্জন দ্বারা।
মু’মিন জননী হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) ছিলেন একাধারে একজন মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুফাস্সির, সাহিত্যিক, কবি ও মুজতাহিদ। তিনি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাত জনের অন্যতম ছিলেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রেও পারদর্শী ছিলেন। বড় বড় সাহাবায়ে কিরাম তাঁর কাছ থেকে জটিল বিষয়ের সমাধান নিতেন। অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর কাছ থেকে হাদিসসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। নবী করিম (ﷺ) তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন- “এ হুমায়রা (হযরত আয়িশা (رضي الله عنه)’র ডাক নাম) থেকে তোমার দ্বীনের অর্ধেক গ্রহণ করো।” এ হাদিস ও উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে নারীর শিক্ষা গ্রহণের সাথে সাথে তাদের শিক্ষাদানেরও অধিকার স্বীকৃত।
নারী যেহেতু সমাজের অর্ধেক অংশ। তাদের বাদ দিয়ে সমাজ ও দেশের উন্নয়ন কোনোমতে সম্ভব নয়। তাই একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মানে দরকার নারীদের সুশিক্ষিত করে তোলা। শিক্ষা ও অগ্রগতির ধারাকে কেবল এক অংশের মাঝে সীমিত রাখলে বাকী অর্ধাংশ পঙ্গু, বিকল ও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তা সমাজের সার্বিক কল্যাণের পথ ব্যাহত করবে। এ কারণেই ইসলাম নারী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।
নারীর জন্য নিরাপদ শিক্ষালয়
নারীর শিক্ষা যেমন আবশ্যকীয় তেমনি নারীর জন্য নিরাপদজনক পৃথক শিক্ষালয় প্রয়োজন। তবে প্রাইমারী ও ইবতিদায়ী তথা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলে মেয়ে সহপাঠ সম্ভব। এর উপরে গেলে পৃথক ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। কারণ নারী-পুরুষের সম্পর্কটা হচ্ছে লৌহ ও চুম্বকের ন্যায়। লোহা চম্বুকের কাছে আসলেই আকর্ষণ করবে। এটাকে কোনো শক্তি প্রতিরোধ করতে পারবেনা। এই সত্যটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এভাবে নারীদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারীরাও নারী হওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ শিক্ষক-কর্মচারীরাও তো মানুষ-কোনো ফেরেশতা নয়। যেখানে হারূত-মারূত ফেরেশতাদ্বয় পর্যন্ত কুরআনের বর্ণনা মতে নারীর ফাঁদে পড়ে কিয়ামত পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করছে, সেখানে মানুষের কী গ্যারান্টি। সুতরাং এক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তে কোনো অযুহাতই গ্রহণযোগ্য হবে না। মোট কথা হলো পুরুষের জন্য পুরুষ শিক্ষক এবং নারীর জন্য নারী শিক্ষক জরুরী। এর ব্যত্যয় ঘটলে সেখানে অঘটন ঘটবে নিশ্চিত।