প্রথম অধ্যায়


ইলমে গায়বের প্রমাণ সম্বলিত বর্ণনাঃ-


এ অধ্যায়টি ছয়টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। প্রথম পরিচ্ছেদে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা অদৃশ্য জ্ঞান প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বিভিন্ন হাদীছের দ্বারা উহার প্রমাণাদি উপস্থাপিত করা হয়েছে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে হাদীছের ব্যাখ্যাকারকদের ব্যাখ্যা দ্বারা গায়বের সমর্থনে উলামায়ে উম্মত ও ফিকহ শাস্ত্রবিদদের উক্তিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদে স্বয়ং অদৃশ্য জ্ঞানের অস্বীকারকারীদের রচিত গ্রন্থাবলী থেকে উহা প্রমাণ করা হয়েছে, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে যুক্তিগত প্রমাণাদি ও আওলিয়া কিরামের ইলমে গায়ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।



প্রথম পরিচ্ছেদ


কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণঃ- 


 

(১) وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ


-‘‘এবং আল্লাহ তা‘য়ালা হযরত আদম (عليه السلام) কে সমস্ত কিছুর নাম শিখিয়ে দিলেন। অতঃপর সে সমস্ত বস্তু ফিরিশতাদের কাছে উপস্থাপন করলেন।’’ 

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ৩১, পারাঃ ১}

      

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে-


وَمَعْنَى تَعْلِمِيهِ اَسْمَاءِ الْمُسَمِّيَاتِ اَنَّهُ تَعَالَى اَرَاهُ اَلاَجْنَاسَ الَّتِىْ خَلَقَهُا وَعَلَّمَهُ اَنَّ هَذَا اِسْمُهُ فَرَسٌُ وَهَذَا اِسْمُهُ بَعِيْرٌُ وَهَذَا اِسْهُمُ كَذَا، وَعَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ عَلَّمَهُ اِسْمَ كُلِّ شَئْىٍ حَتًّى الْقَصْعَةَ وَالْمَغْرَفَةَ


‘‘হযরত আদম (عليه السلام) কে সমস্ত বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাঁর সৃষ্ট সব কিছুর দেখিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন যে এটার নাম ঘোড়া, এটার নাম উট এবং ওটার নাম অমুক। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁকে প্রত্যেক কিছুর নাম শিখিয়ে দিয়েছেন, এমন কি পেয়ালা ও কাঠের চামচের নাম পর্যন্ত।’’। 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৪৫ পৃ.}


❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একই কথা বলা হয়েছে তবে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে-


وَقِيْلَ عَلَّمَ اَدَمَ اَسْمَاءَ الْمَلَئِكَة وَقِيْلَ اَسْمَاَءَ ذُرِّيَّتِهِ وَقِيْلَ عَلَمَّهُ اللَّغَاتَ كُلَّهَا


(কারো মতে আদম (عليه السلام) কে সমস্ত ফিরিশতাদের নাম, কারো মতে তাঁর সন্তান-সন্ততিদের নাম, আবার কারো মতে সমস্ত ভাষা শিখানো হয়েছিল)।

 (তাফসীরে খাযেনঃ ১/৪২ পৃ.)


❏উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে কবীরে লেখা হয়েছে,


قَوْلُهُ اَىْ عَلَّمَهُ صِفَاتَ الْاَشْيَاءِ وَنَعُوْتَهَا َ.... وَهُوَ الْمَشْهُورُ أَنَّ الْمُرَادَ أَسْمَاءُ كُلِّ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ أَجْنَاسِ الْمُحْدَثَاتِ مِنْ جَمِيعِ اللُّغَاتِ الْمُخْتَلِفَةِ الَّتِي يَتَكَلَّمُ بِهَا وَلَدُ آدَمَ الْيَوْمَ مِنَ الْعَرَبِيَّةِ وَالْفَارِسِيَّةِ وَالرُّومِيَّةِ وَغَيْرِهَ


-‘‘আদম (عليه السلام) কে সমস্ত বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও অবস্থাদি শিক্ষা দিয়েছেন। একথাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, সৃষ্টবস্তু দ্বারা বোঝানো হয়েছে অচিরন্তন প্রত্যেক বস্তুর নাম সমূহ, যেগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত হবে ও যে নামগুলো আজ পর্যন্ত আদম সন্তান-সন্ততিগণ আরবী, ফার্সী, রুমী ইত্যাদি ভাষায় ব্যবহার করে আসছে।’’

{ইমাম রাজীঃ তাফসীরে তাফসীরে কাবীরঃ ১/৩৯৮পৃ. দারু ইহইয়াউত্-তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪২০হিজরী}


❏তাফসীরে আবু সাউদে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


وَقِيْلَ اَسْمَاءَ مَاكَانَ وَمَا يَكُوْنُ وَقِيْلَ اَسْمَاءِ خَلْقِهِ مِنَ الْمَعْقُوْلاَتِ وَالْمَحْسُوَسَاتِ وَالْمُتَخَيَّلاَتِ وَالْمُوْهُوْمَاتِ وَاَلْهَمَهُ مَعْرَفَةَ ذَوَاتِ الاْشَيْآَءِ وَاَسْمَاءِ هَاخَوَاصَهَا وَمَعَارِفَهَا اُصُوْلَ الْعِلْمِ وَقَوَانِيْنَ الصَّنْعَاتِ وَتَفَاصِيْلَ اَلاَتِهَا وَكَيْفِيَّةً اِسْتِعْمَالَاتِهَا


-‘‘কারো মতে আদম (عليه السلام) কে অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত বিষয়ের নাম শিখিয়েছেন। আর কেউ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে তাঁকে সমগ্র সৃষ্টির নাম শিখিয়েছিলেন। ইন্দ্রিয়াতীত, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য, কাল্পনিক ও খেয়ালী সবকিছুই শিক্ষা দিয়েছিলেন, সব কিছুর সত্ত্বা, নাম, বৈশিষ্ট্য, পরিচিত জ্ঞান বা বিদ্যার নিয়মাবলী, পেশা ও কারিগরী নীতিমালা এবং সংশি­ষ্ট যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জামের বিস্তারিত বর্ণনা ও সেগুলোর ব্যবহার প্রণালী আদম (عليه السلام) কে অবহিত করেছিলেন।’’ 

{.ইমাম আবুস সাউদঃ তাফসীরে আবুস সাউদঃ ১/৮৪ পৃ.}

      

❏তাফসীরে রুহুল বয়ানে আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,


وَعَلَّمَهُ اَحْوَالَهَا وَمَا يَتَعَلَّقَ بِهَا مَنَ الْمَنَافِعِ الدِّيْنِيَّةِ وَالدُّنْيَوِيَّةِ وَعَلَّمَ اَسْمَاءَ الْمَلاَ ئِكَةِ وَاَسْمَاءَ. ذُّرِّيَتِهِ وَاَسْمَاءَ الْحَيْوَانَاتِ وَالْجَمَادَاتَ وَصَنْعَةَ كُلَّ شَئِّىٍ وَاسْمَاِءَ الْمُدْنِ وَالْقُرَىَ وَاَسْمَاءَ الطَّيْرِ وَالشَّجَرِ وَمَا يَكُوْنُ وَاَسْمَاَءَ كُلِّ شَئِّى يَخْلُقَهَا اِلَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاَسْمَاء الْمَطْعُوْمَاتِ وَاْلمَشْرُوْبَاتِ وَكُلِّ نَعِيْمِ فِى الجَنَّةِ وَاَسْمَاَءُ كُلِّ شَيِّئٍ وَفِى الْخَبْرِ عَلْمَهُ سَبْعَ مِاَئةِ اَلَّفِ لَغَاتٍ


-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) সমস্ত জিনিসের অবস্থাদি শিখিয়েছেন এবং এগুলোর অন্তর্নিহিত, ধর্মীয়, পার্থিব উপকারিতার কথা বলে দিয়েছেন। তাঁকে ফিরিশতাদের নাম, তাঁর বংশধর, জীব জন্তু ও প্রাণীবাচক বস্তু সমূহের নাম শিক্ষা দিয়েছেন, প্রত্যেক জিনিস তৈরী করার পদ্ধতি, সমস্ত শহর ও গ্রামের নাম, সমস্ত পাখী বৃক্ষরাজির নাম যা হয়েছে এবং যা হবে সবকিছুর নাম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি হবে, সবকিছুর নাম, যাবতীয় আহার্য দ্রব্য সামগ্রীর নাম, বেহেশতের প্রত্যেক নিয়ামতের নাম-মোট কথা প্রত্যেক কিছুর নাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন। হাদীছ শরীফে আছে যে আদম (عليه السلام) কে সাত লাখ ভাষা শিখিয়েছেন।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/১৩৬ পৃ.}


উপরোক্ত তাফসীর সমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, যা কিছু হয়েছে ও যা কিছু হবে, সমস্ত কিছুর সম্পূর্ণ জ্ঞান হযরত (আদম (عليه السلام) কে দান করা হয়েছে। তাঁকে বিভিন্ন ভাষাজ্ঞান দান করেছেন, বিভিন্ন জিনিসের উপকারিতা ও অপকারিতা, তৈরী করার পদ্ধতি, যন্ত্রপাতির ব্যবহার সবকিছু দেখিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাদের অঁাকা মওলা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান ভান্ডার দেখুন। সত্যি কথা এই যে হযরত আদম (عليه السلام) এর এ ব্যাপক জ্ঞান নবী করিম عليه السلام'র জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোটা তুল্য বা ময়দানের এক কণা সদৃশ।


❏শাইখ ইবনে আরবী তদ্বীয় “ফুতুহাতে মক্কীয়া” গ্রন্থে দশম অধ্যায়ে বলেছেন,


اَوَّلَ نَائِبٍ كَانَ لَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَخَلِيْفَتُهُ اَدَمَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ


-‘‘হযরত (ﷺ)এর প্রথম খলীফা ও প্রতিনিধি হলেন হযরত আদম (عليه السلام)। এতে বোঝা গেল যে, হযরত আদম (عليه السلام) হলেন হুজুর (ﷺ) এর  খলীফা।’’ 


‘খলীফা’ হচ্ছেন তিনিই, যিনি আসল বা প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ করেন। হুজুর (ﷺ) এর  জন্মের আগেকার সমস্ত নবী (عليه السلام) তাঁরই প্রতিনিধি ছিলেন। একথাটি মৌলভী কাসেম নানুতবী ছাহেবও তদীয় ‘তাহজীরুন নাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, যার বর্ণনা পরে করা হবে। এহলো প্রতিনিধির ব্যাপক জ্ঞানের অবস্থা।


❏ইমাম কাযী আয়াযের (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এর ‘শিফা শরীফ’ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘নাসিমুর রিয়াদ্ব’ এ উল্লে­খিত আছে,


اِنَّهَ عَلَيْهِ السَّلَامُ عُرِضَتُ عَلَيْهِ الْخَلَائِقِ مِن لَّدْنِ اَدَمَ اِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ فَعَرَ فَهُمْ كُلَّهُمْ كَمَا عَلَّمَ اَدَمَ الْاَسْمَاءَ كُلَّهَا


-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) থেকে আরম্ভ করে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশজাত আওলাদকে হুজুর (ﷺ) এর  সম্মুখে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁদের সবাইকে চিনেছিলেন, যেমনিভাবে হযরত আদম (عليه السلام) কে সবকিছুর নাম শিখানো হয়েছিল।’’ 

{ইমাম শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজীঃ নাসিমুর রিয়াদ্ধঃ ২/২০৮ পৃ.}    


❏এ ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) সবাইকে জানেন, সকলকে চিনেন।



(২) وَيَكُوْنَ الرَّسُوْلَ عَلَيْكُمْ شَهِيْدًا


-‘‘এ রসূল তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সাক্ষী হবেন।’’ 

{সূরাঃ বাকারাঃ আয়াতঃ ১৪৩, পারাঃ ২}

      

❏এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘তাফসীরে আযীযীতে’ লিখা হয়েছে,

رسول عليه السلام مطلع است بنور نبوت بردين هر متدين بدين خود كه در كدام درجه از دين من رسيده وحقيقت ايمان اوچيست وحجابے كه بداں ازترقى محجوب مانده است كدام است چس ادمى شناسد گناهان شمارا ودرجات ايمان شمارا واعمال بدونيك شمارا واخلاق ونفاق شمارا لهذا شهادت اودردنيا بحكم شرع درحق امت مقبول واجب العمل است


-‘‘হুজুর (ﷺ) স্বীয় নবুয়তের আলোতে প্রত্যেক ধর্ম পরায়ন ব্যক্তির ধর্মের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। কোন ব্যক্তি ধর্মের কোন স্তরে পৌঁছেছেন, তার ঈমানের হাকীকত কি এবং তাঁর পরলৌকিক উন্নতির পথে

অন্তরায় কি, এসব কিছুই তিনি জানেন। সুতরাং, হুজুর (ﷺ) তোমাদের পাপরাশি, তোমাদের ঈমানের স্তরসমূহ, তোমাদের ভালমন্দ কার্যাবলী এবং তোমাদের বিশুদ্ধ চিত্ততা ও কপটতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। এ জন্যই তো পৃথিবীতে উম্মতের পক্ষে বা বিপক্ষে তার সাক্ষ্য শরীয়তের বিধানমতে গ্রহণীয় এবং অব্যশ্য পালনীয়।’’ 

{শায়খ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভীঃ তাফসীরে আযিযীঃ ১/৫১৮ পৃ.}


❏‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


هَذَا مَبْنِىَّ عَلَى تَضْمِيْنِ الشَّهِيَدِ مَعْنَىِ الرَّقِيْبِ وَالْمَطَلِّعِ وَالْوَجْهُ فِىْ اِعْتِبَارِ تَضْمِيْنِ الشَّهِيْدِ الْاِشَارَةُ اِلَى اَنَّ التَّعْدِيْلَ وَالتَّزْكِيَةَ اِنَّمَا يَكُوْنَ عَنْ خُبْرَةٍ وَمَرَ اقَبَةٍ بِحّالِ الشَّاهِدِ وَمَعْنَى شَهَادَةِ الرَّسُوْلِ عَلَيْهِمْ اِطَّلاَعُهَ رُتُبَةَ كُلِّ مُتَدَيْنٍ بَدِيْنِهِ فَهُوَ يَعْرِفُ دَنَوْبَهُمْ وَحَقِيْقَةَ اِيْمَانِهِمْ وَاَعْمَالِهُمْ وَحَسَنَاتِهِمْ وَسَيِّئاَتِهِمْ وَاِخْلَاصِهُمْ وِنِفَاقِهُمْ وَغَيْرِ ذَالِكَ بِنُوْرِ الْحَقِّ وَاُمَّتَهُ يَعْرِ فُوْنَ ذَالِكَ مِنْ سَائِرِ الْاُمَمِ بِنُوْرِهِ عَلَيْهِ السَّلَامُ


-‘‘এটা এ কারণেই যে, আয়াতে উল্লে­খিত (شهيد) শব্দটি রক্ষণাবেক্ষণকারী ও ওয়াকিফহাল কথাটাও অন্তভুর্ক্ত করে এবং এ অর্থ দ্বারা একথারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কোন ব্যক্তির যথার্থতা ও দূষণীয়তার সাক্ষ্য প্রদান তখনই সম্ভবপর হবে, যখনই সাক্ষী উক্ত ব্যক্তির যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে সম্যকরূপে ওয়াকিফহাল হয়। হুজুর (ﷺ) এর  পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি প্রত্যেক ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত। সুতরাং, বোঝা যায় যে, হুজুর (ﷺ) মুসলমানদের গুণাহ সমূহ, তাদের ইসলামের হাকীকত, তাদের ভালমন্দ কার্যাবলী, তাদের আন্তরিকতা ও কপটতা ইত্যাদিকে সত্যের আলোর বদৌলতে অবলোকন করেন। হুজুর (ﷺ) এর  উম্মতের নিকটও তাঁর নুরের ওসীলায় অন্যান্য সমস্ত উম্মতগণের অবস্থাও কিয়ামতের ময়দানে সম্পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/১৩৬ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


 ثُمَّ يُؤْتَى بِمَحَمَّدٍ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَيُسْئَلُهُ عَنْ حَالِ اُمَّتِهِ فَيُزْكِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِصِدْقِهِمْ


-‘‘অতঃপর কিয়ামতের দিন হুজুর (ﷺ)কে আহ্বান করা হবে। এরপর আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে তাঁর উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। তখন তিনি তাঁদের পবিত্রতা ও সত্যতার সাক্ষ্য দিবেন।’’ 

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/৮৭ পৃ}


❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ ২য় পারার সূরায়ে বাকারার’ এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হইয়াছে,


فَيُؤْ تَى بِمُحَمَّدٍ فَيُسْئَلُ عَنْ حَالِ أمَّتِهِ فَيُزَ كِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِعَدَ الَتِهِمْ. وَيُزُ كِّيْهِمْ وَيَعْلَمُ بِعَدَا لَتِكُمْ


-‘‘অতঃপর হুযুর (সাল্লাল্লাহু عليه السلامকে) আহ্বান করা হবে, তাঁর উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তিনি স্বীয় উম্মতের সাফাই বর্ণনা করবেন এবং তাদের ন্যায়পরায়ণ ও যথার্থ হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। সুতরাং হুজুর (ﷺ) আপনাদের যথার্থতা সম্পর্কে অবগত আছেন।’’ 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১.৮৮ পৃ.}


এ আয়াত ও তাফসীর সমূহে এটাই বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরামের (عليه السلام) উম্মতগণ আল্লাহর দরবারে আরয করবে, হে আল্লাহ! আমাদের কাছে তোমার কোন নবী আগমন করেন নি।’ পক্ষান্তরে, ঐ সমস্ত উম্মতের নবীগণ আরয করবেন, ‘হে খোদা! আমরা তাদের কাছে গিয়েছি, তোমার নির্দেশাবলী তাদের কাছে পৌঁছিয়েছি, কিন্তু তারা গ্রহণ করেনি।’ 

আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবীগণকে বলা হবে, ‘যেহেতু তোমরা বাদী, সেহেতু তোমাদের দাবীর সমর্থনে কোন সাক্ষী উপস্থাপন কর। তাঁরা তখন তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে হুজুর (ﷺ) এর  উম্মতকে পেশ করবেন। তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন ‘হে আল্লাহ! তোমার নবীগণ সত্যবাদী, তাঁরা তোমার নির্দেশাবলী স্ব স্ব উম্মতের কাছে পৌঁছিয়েছিলেন।


এখানে দুটি বিষয়ের তাৎপর্য বিশে­ষণ করা দরকার। প্রথমতঃ মুসলমানগণ সাক্ষ্য দেয়ার উপযুক্ত কিনা। (ফাসিক, ফাজির ও কাফিরদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। একমাত্র পরহেযগার মুসলমানদের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য।) দ্বিতীয়তঃ এ সমস্ত লোকগণ তাঁদের পূর্বেকার নবীগণের জামানা দেখেন নি। তবুও তারা কিভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন? মুসলমানরা আরয করবেনঃ ‘হে খোদা! আমাদেরকে তোমার হাবীব মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন যে, আগেকার নবীগণ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এটা শুনেই আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’ তখন হুযুর লাইহিস সালামকে আহ্বান করা হবে।

তিনি (ﷺ) দুটি বিষয়ের সাক্ষ্য দিবেন। একটি হলো এ সমস্ত লোকগণ এমন পাপিষ্ট বা কাফির নয় যে তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং তাঁরা পরহেযগার মুসলমান। অন্যটি হলো তিনি (ﷺ) বলবেন, হ্যাঁ, আমিই তাদেরকে বলেছিলাম যে, আগেকার নবীগণ নিজ নিজ উম্মতের কাছে খোদার ফরমান পৌঁছিয়েছিলেন। অতঃপর ঐ সব নবীগণের পক্ষে রায় দেয়া হবে। 



এ বর্ণনা থেকে নিম্নোলে­খিত কয়েকটি বিষয় জানা গেলঃ-


একঃ- হুজুর (ﷺ) কিয়ামত পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠে আগমণকারী মুসলমানদের ঈমান, আমল, রোযা, নামায ও নিয়ত সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত। নচেৎ তাদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়া কিভাবে সম্ভব? কোন মুসলমানের অবস্থা তাঁর দৃষ্টি বহির্ভূত হতেই পারে না। হযরত নূহ (عليه السلام) তাঁর কওমের ভবিষ্যৎ বংশধরদের অবস্থা জেনে আবেদন করেছিলেন, ‘হে খোদা! এদের বংশোদ্ভূত লোকগণও পাপিষ্ট ও কাফির হবে। সুতরাং, তুমি তাদেরকে ডুবিয়ে দাও।’ হযরত খিযির (عليه السلام) যে শিশুটিকে হত্যা করেছিলেন, তার ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে অবগতি লাভ করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, যদি সে জীবিত থাকে তবে অবাধ্য হবে। তাহলে হুজুর (ﷺ) এর  কাছে আরো অবস্থা কিভাবে গোপন থাকতে পারে?


দুইঃ- পূর্ববর্তী নবীগণ ও তাঁদের উম্মতগণের অবস্থা হুজুর (ﷺ) নূরে নবুওয়তের বদৌলতে অবলোকন করেছিলেন এবং তাঁর (ﷺ) সাক্ষ্যটা ছিল একজন প্রত্যক্ষদশর্ীয় সাক্ষ্য। যদি তাঁর (ﷺ) সাক্ষ্য শ্রুত বিষয়ের সাক্ষ্য হতো, তাহলে এ ধরনের সাক্ষ্য মুসলমানেরাতো আগেই দিয়েছে। শ্রুত বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহনের সর্বশেষ পর্যায়ে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেয়া হয়।


তিনঃ- এ থেকে আরও বোঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা নবী যে সত্যবাদী, তা জানা সত্ত্বেও সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে রায় দেন। অনুরূপ যদি হুজুর (ﷺ), বিচার কার্য তদন্ত করেন এবং সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করেন, তখন এ কথা বলা যাবে না যে, হুজুর (ﷺ) সে বিষয়ে অবগত নন। দায়েরকৃত মুকাদ্দমায় এটাই নিয়ম। 

(এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে হলে আমার রচিত কিতাব শানে হাবীবুর রহমান, দেখুন) এ সাক্ষ্যের উল্লেখ পরবর্তী আয়াতের মধ্যেও রয়েছে


 

(৩) وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا


-‘‘হে মাহবুব (ﷺ) আমি আপনাকে এদের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে আনব।’’ 

{সূরা নিসাঃ আয়াতঃ ৪১, পারাঃ ৫}

      

❏‘তাফসীরে নিশাপুরীতে’ এ আয়াতের তাফসীরে উল্লে­খিত আছে,


لِاَنًَّ رُوْحَهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ شَاهِدٌُ عَلَى جَمِيْعِ الْاَرْوَاحِ وُالْقُلُوْبِ وَالنَّفُوْسِ بِقَوْلِهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اَوَّلُ مَاخَلَقَ اللهُ نُوْرِىْ


-‘‘এটা এ কারণে যে, হুজুর (ﷺ) এর  রূহ মুবারক সমস্ত রূহ, দিল ও সত্ত্বা সমূহকে দেখতে পান। কেননা তিনিই বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা সর্ব প্রথম যা সৃষ্টি করেছেন, তা হলো আমার নূর।’’ 

{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীরঃ ৮/৬৬ পৃ.}

      

❏এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রূহুল বয়ানে আছে,


وَاعْلَمْ اَنَّهُ يُعْرَضُ عَلَى النَّبِىْ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اَعْمَالُ اُمَّتِهِ غَدَوْةً وَعَشِيَّةً فَيَعْرِ فُهُمْ بِسِيْمَاهُمْ اَعْمَالَهُمْ فَلِذَالِكَ يَشْهَدُ عَلَيْهِمْ


-‘‘হুজুর (ﷺ) এর  কাছে তাঁর উম্মতের আমলসমূহ সকাল বিকাল পেশ হয়। তাই তিনি উম্মতকে তাদের চিহ্ন দৃষ্টে চিনেন ও তাদের কার্যাবলী সম্পর্কেও অবগত হন। এ জন্য তিনি (ﷺ) তাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিবেন।’’

 {আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/২৫৭ পৃ.}

       

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খ করা হয়েছেঃ


اَىْ شَاهِدًا عَلَى مَنْ اَمَنَ بِالْايِمَانِ وَعَلَى مَنْ كَفَرَ بِا لْكُفْرِ وَعَلَى مَنْ نَافَقَ بِالنِّفَاقِ


-‘‘হুজুর (ﷺ) মুমিনদের জন্য তাদের ঈমানের, কাফিরদের জন্য তাদের কুফরীর ও মুনাফিকদের জন্য তাদের মুনাফেকীর সাক্ষী।’’ 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/২৫৩ পৃ.}

     

এ আয়াত ও তাফসীর সমূহ দ্বারা বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আদিকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত লোকের কুফর, ঈমান, কপটতা আমল ইত্যাদি সব কিছুই জানেন। এ জন্যই তো তিনি সকলের জন্য সাক্ষী একেইতো বলে ‘ইলমে গায়ব’ বা অদৃশ্য জ্ঞান।



(৪) مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ


-‘‘কে সে, যে তার কাছে তার অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করবে? তিনি তাদের পূর্বাপর সবকিছুই জানেন।’’ 

{সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ২৫৫}

   

❏‘তাফসীরে নিশাপুরীতে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


يَعْلَمُ مُحَمَّدٌُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنْ اَوَّلِيَّاتِ اَلاَمْرِ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنْ اَحْوَالِ الْقِيَامَةِ


-‘‘হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আগেকার অবস্থাাদি জানেন এবং সৃষ্টির পরে কিয়ামতের যে ভয়াবহ অবস্থাদি সংঘটিত হবে, তা’ও তিনি জানেন।’’ 

{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীঃ প্রথম পারাঃ ২৫৫ নং আয়াত এর ব্যাখ্যা।}

      

এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাফসীরে রূহুল বয়ানে ❏আছে,


يَعْلَمُ مُحَمَّدٌُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنَ الْاُمُوْرِ الْاَوَّلِيَّاتِ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ وَمَا خَلفَهُمِ مِنْ اَحْوَالِ الْقِيَامَةِ وَفَزَعِ الْخَلَقِ وَغَضَبِ الرَّبِّ


-‘‘হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আগের অবস্থা জানেন। সৃষ্টির পূর্বাপর যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত। কিয়ামতের অবস্থা, সৃষ্টিকূলের ভয়ভীতি, আল্লাহর গজব ইত্যাদির প্রকৃতি সম্পর্কেও সম্যকরূপে অবগত।’’  

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্বীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/৪৩ পৃ.}


এ আয়াত ও তাফসীর সমূহ দ্বারা বোঝা গেল যে, ‘আয়াতুল কুরসী’র মধ্যে مَنْ ذَالَّذِىْ থেকে اِلاَّ بِمَا شَآءَ পর্যন্ত হুজুর (ﷺ) এর  তিনটি গুণের কথাই বিধৃত হয়েছে। বাকী অবশিষ্ট গুণাবলী আল্লাহর সহিত সম্পৃক্ত। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট বিনা অনুমতিতে কেউ সুপারিশ করতে পারে না। যিনি সুপারিশ করার অনুমতি প্রাপ্ত, তিনি হলেন প্রিয় নবী হুজুর (ﷺ)। সুপারিশকারীকে পাপীগণের পরিণাম ও অবস্থা সম্পর্কে অবশ্যই অবগত হতে হয়, যাতে অনুপযুক্তদের জন্য সুপারিশ করা না হয়, আর সুপারিশের উপযুক্ত ব্যক্তিগণ যেন সুপারিশ থেকে বঞ্চিত না হয়। যেমন কোন ডাক্তারের আরোগ্য ও দুরারোগ্য ব্যাধি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা একান্ত দরকার। 


❏এ জন্য বলা হয়েছে, 


يَعْلَمُ مَا بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ


যাকে আমি (আল্লাহ) সুপারিশকারী মোতায়েন করেছি, তাকে সব কিছুর জ্ঞানও দান করেছি, কেননা ‘শাফায়াতে ‘কুবরা’ বা সুমহান সুপারিশের জন্য অদৃশ্য জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।


এ থেকে বোঝা গেল যে, যারা বলে যে হুজুর (ﷺ) কিয়ামতের মাঠে মুনাফিকদেরকে চিনবেন না, বা হুজুর (ﷺ) নিজেই জানেন না তাঁর কি পরিণতি হবে; ইহা তাদের নিছক ভুল ধারণা ও ধর্মহীনতা মাত্র। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলোচনা হবে।


(৫) وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ


-‘‘তারা তাঁর জ্ঞান ভান্ডার থেকে কিছুই পায় না, তবে তিনি যতটুকু ইচ্ছে করেন।’’ 

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৫৫}

      

❏‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লে­খ আছে,


يَحْتَمِلُ اَنْ تَكُوْنَ الْهَاءُ كِنَايَةً عَنهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَعْنِىْ هُوَ شَاهِدٌُ عَلَى اَحْوَالِ هِمْ يَعْلَمُ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنْ سِيَرِهِمْ وَمَعَا مَلاَ تِهِمْ وَقَصَصِهَمْ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنْ اُمُوْرِ الْاَخِرَةِ وَاَحْوَالِ اَهْلِ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ وَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ شَيْئًا مِّنْ مَعْلُوْمَاتِهِ اِلَّا بِمَاشَآءَ مِنْ مَعْلُوْ مَاتِهِ عِلْمُ الْاَوْلِيَاءِ مِنْ عِلْمِ ألْاَنْبِيَآَء بِمَنْزِ لَةِ قَطْرَةٍ مِنْ سَبْعَةِ اَبْحُرٍ وَعِلْمُ الْاَنْبِيَآءِ مِنْ عِلمِ نَبِيِّنَا عَلَيْهِ السَّلاَمُ بِهَذِهِ الْمَنْزِ لَةِ وَعِلْمُ نَبِيِّنَا مِنْ عِلْمِ الْحَقِّ سُبْحَانَهُ بِهَذَ الْمَنْزَِلَةِ فَكُلُّ رَسُوْلٍ وَنَبِىٍّ وَوَلِىِّ اَخِذُوْنَ بِقَدْرِ الْقَابِلِيًَّةِ وَالْاِسْتِعْدَادِ مِمَّا لِدَيْهِ وَلَيْسَ لِاَحَدٍانْ يَعْدُفْهُ اَوْيَتَقَدَّمَ عَلَيْهِ


-‘‘এও হতে পারে যে উক্ত আয়াতের عَلَيْهِ শব্দের هِ (‘হি’) সর্বনাম দ্বারা হুজুর (ﷺ) এর  প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) মানুষের অবস্থা অবলোকন করেন, তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের চরিত্র, তাদের আচরণ তাদের ঘটনা প্রবাহ ও তাদের বিগত অবস্থাও তিনি জানেন। পরকালের হাল-হাকিকত ও বেহেশতী জাহান্নামী লোকদের অবস্থা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিফহাল। ওই সমস্ত লোক হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান ভান্ডারের কিছুই জানতে পারেন না, তবে ততটুকু জানতে পারেন, যতটুকু তিনি (ﷺ) চান। আম্বিয়া কিরামের (عليه السلام) জ্ঞানের সামনে আল্লাহর ওলীগণের জ্ঞান হলো সাত সমুদ্রের এক ফোটার সমতুল্য, আর হুযুর আলাইহি সালামের জ্ঞানের সামনে অন্যান্য আম্বিয়া কিরামের (عليه السلام) জ্ঞানও তদ্রুপ। অতএব প্রত্যেক নবী, রসূল ও ওলী নিজ নিজ ধারণ ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুসারে হুজুর (ﷺ) এর  নিকট থেকে আহরণ করেন। হুজুর (ﷺ) কে ডিঙিয়ে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/২৫৭ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খিত আছে,


يَعْنِىْ اَنْ يَطَّلِعَهُمْ عَلَيْهِ وَهُمُ الْاَنْبِيَاءُ وَالرُّسُلُ وَلِيَكُوْنَ مَا يُطْلِعَهُمْ عَلْيِه مِنْ عِلْمِ غَيْبِهِ دَلِيْلاً عَلَى نَبُوَّتِهِمْ كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فَلاَ يُظْهِرْ عَلَى غَيْبِهِ اَحَدًا اِلَّامَنِ ارْتَضَى مَنَ رَّسُوْلٍ


-‘‘আল্লাহ তা’আলা যাদেরকে তার জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত করেন, তাঁরা হচ্ছেন নবী ও রাসূল, যা’তে তাঁদের অদৃশ্য জ্ঞান নবুয়তের দলীলরূপে পরিগণিত হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, তাঁর বিশেষ অদৃশ্য বিষয় কারও নিকট প্রকাশ করেন না, একমাত্র তাঁর সে রাসূলের নিকট প্রকাশ করেন, যাঁর উপর তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট।” 

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/১৯০ পৃ.}


❏‘তাফসীরে মা’আলিমুত তানযীলে’ উক্ত আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লে­খিত আছে,


يَعْنِىْ لاَ يُحِيْطُوْنَ بِشَئٍ مِنْ عِلْمِ الْغَيْبِ اِلاَّبِمَاشَآءَمِمَّا اَخْبَرَبِهِ اِلرُّسُلُ


-‘‘এ সকল লোক অদৃশ্য জ্ঞানকে বেষ্টন বা আয়ত্ত্ব করতে পারে না। শুধু ততটুকুই তারা লাভ করে, যতটুকু রাসূলগণ তাদের নিকট পরিবেশন করেছেন।’’ 

{ইমাম বগভীঃ মা’আলিমুত তানযীলঃ ১/২৩৯ পৃ.}

      

এ আয়াত ও ব্যাখ্যাসমূহ  থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, উল্লে­খিত আয়াতে হয়তো আল্লাহর জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞান কারো কাছে নেই, তবে তিনি যাকে জ্ঞানদানের ইচ্ছা করেন, তিনিই অদৃশ্য জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা নবীগণ (عليه السلام) কে ইলমে গায়ব দান করেছেন এবং তাঁদের ওসীলায় কোন কোন মুমিন বান্দাকেও দিয়েছেন। অতএব মুমিন বান্দাগণও খোদা প্রদত্ত ইলমে গায়ব লাভ করেছেন। কি পরিমাণ (ইলমে গায়ব) দেয়া হয়েছে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে করা হবে।


অথবা, উল্লে­খিত আয়াতে হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান কেউ লাভ করতে পারে না, অবশ্য তিনি যাকে দিতে চান, দান করেন। অতএব আদম (عليه السلام) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যার যতটুকু জ্ঞান অর্জিত হয়েছে বা হবে, উহা হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান সমূহের এক ফোটার সমতুল্য। যার মধ্যে হযরত আদম (عليه السلام), ফিরিশতা ও অন্যান্য সৃষ্ট জীবের জ্ঞানও অন্তভুর্ক্ত। হযরত আদম (عليه السلام) এর জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে عَلَّمَ اَدَمَ الْاَشْمَاءَ আয়াতে বিশদভাবে আলোচনা করেছি।


 


(৬) وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ


-‘‘হে সাধারণ লোকগণ, এটা আল্লাহর শান নয় যে তোমাদের ইলমে গায়ব দান করবেন। তবে হ্যাঁ, রাসূলগণের মধ্যে যাকে তিনি ইচ্ছা করেন, তাকে এ অদৃশ্য জ্ঞানদানের জন্য মনোনীত করেন।’’ 

{সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ১৭৯, পারাঃ ৪}

      

❏‘তাফসীরে বায়যাবী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খ করা হয়েছে,


وَمَاكَانَ اللهُ لِيُوْتِىَ اُحَدَكُمْ عِلْمَ الْغَيْبِ فَيَطَّلِعُ عَلَى مَافِىْ الْقُلُوْبِ مِنْ كُفْرٍ وَّاِيْمَانٍ وَلَكِنْ اللهَ يَجْتَبِىْ لِرَسَالَتِهِ مِنْ يَّشَاءُ فَيُوْحِىَ اللهُ وَيَخْبِرَهُ بِبَعْضِ الْمُغَيِّبَاتِ اَوْيُنْصِبُ لَهُ مَايَدُلُّ عَلَيْهِ


-‘‘আল্লাহ তা’আলা তোমাদের মধ্যে কাউকে এমন ইলমে গায়ব প্রদান করেন না, যাতে তোমরা ঈমান ও কুফর, যা মনে মনে পোষণ করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে অবগত হতে পারে। কিন্তু তিনি তাঁর রাসূলগণের মধ্যে যাঁদেরকে ইচ্ছে করেন, তাঁদেরকে মনোনীত করেন, তাঁদের উপর প্রত্যাদেশ করেন, তাঁদেরকেই আংশিক গায়ব সম্পর্কে অবহিত করেন, অথবা তাঁদের জন্য এমন কিছু প্রমাণাদি উপস্থাপন করেন, যা’ গায়বের পথ নির্দেশ করে থাকে।’’ 

{ইমাম কাজী নাসিরুদ্দীন বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভীঃ ১/৩০৮ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ আছে,


لَكِنَّ اللهَ يَصْطَفِىْ وَبَخْتَارُ مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يُّشَاءُ فَيُطْلِعُهُ عَلَى بَعْضِ عِلْمِ الْغَيْبِ


-‘‘কিন্তু আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছে করেন মনোনীত করেন, আংশিক ইলমে গায়ব সম্পর্কে তাঁদেরকেই অবহিত করেন।’’ 

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/৩০৮ পৃ.}


❏‘তাফসীরে কাবীরে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


فَاَمَّا مَعْرَفَةُ ذَلِكَ عَلَى سَبِيْلِ الْاِعْلاَمِ مِنَ الْغَيْبِ فَهُوَ مِنْ خَوَاصِّ الْاَنْبِيَاءِ


-‘‘খোদা প্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞানের ফলশ্রুতি স্বরূপ সে সমস্ত অদৃশ্য বিষয়াদি জেনে নেয়া নবীগণ (ﷺ) এরই বৈশিষ্ট্য।’’ 


❏জুমুলে উল্লে­খিত আছে,


اَلْمَعْنَى لَكِنَّ اللهَ يَجْتَبِىْ اَنْ يَصْطَفِىَ مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَّشَاءُ فَيُطْلِعُهُ عَلَى الْغَيْبِ


-‘‘আয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণের মধ্যে যাঁকে ইচ্ছে করেন, মনোনীত করেন। অতঃপর তাঁকে গায়ব সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন।’’  

{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৯/১১১ পৃ.}

      

❏তাফসীরে জালালাইনে উল্লে­খিত আছে,


{وَمَا كَانَ اللَّه لِيُطْلِعكُمْ عَلَى الْغَيْب} فَتَعْرِفُوا الْمُنَافِق مِنْ غَيْره قَبْل التَّمْيِيز {وَلَكِنَّ اللَّه يَجْتَبِي} يَخْتَار {مِنْ رُسُله مَنْ يَشَاء} فَيُطْلِعهُ عَلَى غَيْبه كَمَا أَطْلَعَ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى حَال الْمُنَافِقِينَ


-‘‘আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে গায়ব সম্পর্কে অবহিত করবেন না, যা’তে মুনাফিকদেরকে আল্লাহ কতর্ৃক পৃথকীকরণের পূর্বেই তোমরা চিনতে না পার, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা যাকে ইচ্ছে করেন, তাঁকে মনোনীত করেন, তাঁর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন যেমন নবী করীম (ﷺ)কে মুনাফিকদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন।’’ 

{ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ তাফসীরে জালালাইনঃ ৯২ পৃ.}

 

❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ আছে,


فَاِنَّ غَيْبَ الْحَقَائِقِ وَالْاَحْوَالِ لاَ يَنْكَشِفُ بِلاَ وَاسِطَةِ الرَّسُوْلِ


-‘‘কেননা, রাসূল (ﷺ) এররহস্যাবৃত অবস্থাও মৌলতত্ত্ব প্রকাশ করা হয় না। 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/১৬২ পৃ.}


এ আয়াত ও ব্যাখ্যাসমূহ থেকে বোঝা গেল যে, খোদার খাস ইলমে গায়ব রাসূলের নিকট প্রকাশিত হয়। কোন কোন তাফসীরকারক, যে ইলমে গায়বের কিয়দংশের কথা বলেছেন, এ ‘কিয়দংশ’ কথাটি দ্বারা আল্লাহর অসীম জ্ঞানের তুলনায় নবীর অদৃশ্য জ্ঞানকে ‘কিঞ্চিত পরিমাণ’ বলা হয়েছে। কেননা সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে যা কিছু ঘটছে ও যা ঘটবে, এর সম্পূর্ণ জ্ঞানও আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় আংশিক বা যৎসামান্যই বটে।


 

(৭) وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا


-‘‘এবং আপনাকে শিখিয়ে দিয়েছেন, যা’ আপনি জানতেন না। আপনার উপর আল্লাহর এটি একটি বড় মেহেরবাণী।’’ 

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১১৩}

      

❏তাফসীরে জালালাইনে এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হয়েছে,


اَىْ مِنَ اْلاَحْكَامِ وَالْغَيْبِ 


-‘‘যা’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতেন না, তা হচ্ছে ধর্মের অনুশাসন ও অদৃশ্য বিষয়াদি।’’ 

{ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ তাফসীরে জালালাইনঃ ৯৭পৃ.}

  

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ আছে,


اَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَاَطْلَعَكَ عَلَى اَسْرَارِ هِمَا وَوَافَقَكَ عَلَى حَقَائِقِهِمَا


-‘‘আল্লাহ তা’আলা আপনার উপর কুরআন ও হিকমত (জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন) অবতীর্ণ করেছেন, উহাদের গুপ্ত ভেদসমূহ উদ্ভাসিত করেছেন এবং উহাদের হাকীকত সমূহ সম্পর্কেও আপনাকে অবহিত করেছেন।’’ 

{ইমাম খাযেন, তাফসীরে খাযেন}

   

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ উল্লে­খিত আছে,


يَعْنِىْ مِنْ اَحْكَامِ الشَّرْعِ وَاُمَوْرِ الدِّيْنَ وَقِيْلَ عَلَّمَكَ مِنْ عِلْمِ الْغَيْبِ مَالَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَقِيْلَ مَعْنَاهُ عَلَّمَكَ مِنْ خَفِيَّاتِ الْاُمُوْرِ وَاَطْلَعَكَ عَلَى ضَمَائِرِ الْقُلُوْبِ وَعَلَّمَكَ مِنْ اَحْوَالِ الْمُنَافِقِيْنَ وَكَيْدِهِمْ


-‘‘শরীয়তের আহকাম ও ধর্মীয় বিষয়াদি আপনাকে শিখিয়েছেন। বলা হয়েছে যে, আপনাকে ইলমে গায়বের আওতাভুক্ত সে সমস্ত বিষয়াদিও শিখিয়েছেন, যা’ আপনি জানতেন না। আরও বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলো আপনাকে রহস্যাবৃত, গোপণীয় বিষয়সমূহ শিখিয়েছেন, অন্তরের লুকায়িত বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন, মুনাফিকদের ধোকাবাজি ও বাওতাবাজি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/২৮২ পৃ.} 

 

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ আরও আছে,


مِنْ اُمَوْرِ الدِّيْنِ وَالشَّرَ ائِعِ اَوْمِنْ خَفِيَّاتِ الْاُمُوْرِ وَضَمَاِئرِ القُلُوْبِ


-‘‘দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়সমূহ শিখিয়েছেন আপনাকে এবং গোপনীয় বিষয়াদি ও মানুষের অন্তরের গোপণীয় ভেদ ইত্যাদিও শিখিয়ে দিয়েছেন।’’ 

 { ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/২৮২ পৃ.}


❏তাফসীরে হুসাইনী এ আয়াতের ব্যাখ্যা বাহরুল হাকায়েক’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে,


اں علم ماكان ومايكون هست كه حق سبحانه درشب اسرا بداں حضرت عطافرمود، چنانچه درحديث معراج هست كه من درزير عرش بودم قطره درخلق من ريختند فَعَلِمْتُ مَا كَانَ وَمَا يَكُوْنَ


এটা হচ্ছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান, যা’ আল্লাহ তা’আলা হুজুর (ﷺ)কে পবিত্র মি’রাজের রজনীতে দান করেছিলেন। এ মর্মে মেরাজের হাদীছে উল্লে­খিত আছে, আমি আরশের নিচে ছিলাম, তখন একটি ফোটা আমার কণ্ঠনালীতে ঢেলে দেওয়া হল, এরপর আমি অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনাবলীর জ্ঞান লাভ করলাম। 

{আল্লামা মঈনুদ্দীন কাশেফীঃ তাফসীরে হুসাইনীঃ ১/১৯২ পৃ.}

      

❏‘জামেউল বয়ান’ তাফসীর গ্রন্থে আছে-


قَبْلَ نُزُوْلِ ذَلِكَ مِنْ خَفِّيَاتِ الْاُمُوْرِ


-‘‘আপনাকে সে সমস্ত বিষয় আল্লাহ বলে দিয়েছেন, যা’ কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার আগে আপনার জানা ছিল না।’’ 

{ইমাম ত্ববারীঃ জামিউল বয়ানঃ ৫/২৭০ পৃ.}

      

এ আয়াত ও বর্ণিত ব্যাখ্যা সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ)কে অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল। আরবী ভাষায় مَا শব্দটি ব্যাপকতা প্রকাশের নিমিত্তে ব্যবহৃত হয়। তাই উক্ত আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, শরীয়তের বিধি বিধান, দুনিয়ার সমস্ত ঘটনাবলীর, মানুষের ঈমানী অবস্থা ইত্যাদি, যা’ কিছু তাঁর জানা ছিল না, তাঁকে সম্যকরূপে অবগত করান হয়। “কেবলমাত্র ‘ধর্মীয় বিধানাবলীর’ জ্ঞান দান করা হয়েছিল” আয়াতের এরূপ সীমিত অর্থ গ্রহণ করা মনগড়া ভাবার্থ গ্রহণ করার নামান্তর, যা’ কুরআন, হাদীছ ও উম্মতের আকীদার পরিপন্থী। এ সম্বন্ধে সামনে আলোচনা হবে। 




(৮) مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ 


আমি এ কিতাবে (কুরআনে) কিছু বাদ দিইনি।

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৩৮}

      

❏ইমাম খাযেন এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-


اِنَّ الْقُرْاَنَ مُشْتَمِلٌُ عَلَى جَمِنْعِ الْاَحْوَالِ


কুরআন করীমে সমস্ত অবস্থার বিবরণ রয়েছে। 

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ২/১১১ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে আনওয়ারুত তানযীলে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


يَعْنِى اللَّوْحَ الْمَحْفُوْظَ فَاِنَّهُ مَشْتَمِلُّ عَلَى مَايَجْزِىْ فِىْ الْعَالَمِ مِنْ جَلِيْلٍ وَّدَقِيْقٍ لَمْ يُهْمَلْ فِيْهِ اَمْرُ حَيْوَانٍ وَلاَ جَمَادٍ


-‘‘কিতাব’ শব্দ দ্বারা লওহে মাহফুজকেই নির্দেশ করা হয়েছে। কেননা, এ লওহে মাহফুজে জগতের সমস্ত কিছুই উল্লে­খিত, প্রত্যেক প্রকাশ্য, সূক্ষ্ম বিষয় বা বস্তু, এমনকি, কোন জীব জন্ত বা জড় পদার্থের কথাও বাদ দেয়া হয়নি।’’ 

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ২/১১১ পৃ.}


❏‘তাফসীরে আরায়েসুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,


اَىْ مَافَرَّطْنَا فِى الْكِتَابِ ذِكْرَ اَحَدٍ مِنَ الْخَلْقِ لَكِنْ لاَ يَبْصُرُ ذِكْرَهُ فِى الْكِتَابِ اِلاَ الْمُؤْيَّدُوْنَ بِاَنْوَارٍ الْمَعْرِفَةِ


অর্থাৎ- এ ‘কিতাবে’ সৃষ্টিকূলের কোন কিছুরই কথা বাদ রাখা হয়নি, কিন্তু মারেফতের আলোকে মদদপুষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া তা’ কারো দৃষ্টি গোচর হয় না।


❏প্রখ্যাত সূফী ইমাম শা’রানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ‘তবকাতে কুবরার’ মধ্যে লিখেছেন (ইদখালুস সেনান’ গ্রন্তের ৫৫ পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত।)


وَلَوْ فَتَحَ اللهُ عَنْ قُلُوْبِكُمْ اَقْفَالَ السُّدَدِ لاَطُّلَعْتُمْ عَلَى مَافِى الْقُرْاَنِ مِنَ الْعُلُوْمِ وَاسْتَغْنَيَمْ عَنِ النَّظْرِ فِىْ سِوَاهُ فَاِنَّ فِيْ جَمِيْعِ مَارُقِمَ فِىْ صَفْحَاتِ الْوُجُوْدِ قَالَ اللهُ تَعَالَى مَافَرَّطْنَافِى الْكِتَابِ مِنْ شَئٍّ


-‘‘যদি আল্লাহ তা’আলা তোমাদের হৃদয়ের তালাবদ্ধ প্রকোষ্টের তালা খুলে দেন, তাহলে তোমরা কুরআনের জ্ঞান-ভান্ডারের সন্ধান পাবে এবং কুরআন ভিন্ন অন্য কিছুর মুখাপেক্ষী হতে হবে না। কেননা কুরআনের মধ্যে অস্তিত্ববান সব কিছুই বিধৃত আছে। আল্লাহ তা’আলা ফরমান, এমন কিছু নেই, যা আমি কুরআনে বর্ণনা করিনি।’’


এ আয়াত ও এর বর্ণিত তাফসীর সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, ‘কিতাবের’ মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত অবস্থার কথা বিদ্যমান আছে। ‘কিতাব’ বলতে কুরআন বা লওহে মাহফুজকে বোঝানো হয়েছে। কুরআন হোক বা লওহে মাহফুজ হোক, উভয়ের জ্ঞান হুজুর (ﷺ) এর  আছে। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলোচনা হবে। ফলস্বরূপ, দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় বিষয় হুজুর (ﷺ) এর  জানা আছে। কেননা কুরআন ও লওহে মাহফুজ সমস্ত জ্ঞানের আধার, উভয়টি সম্পর্কে হুযুর পুর-নুর (ﷺ) ওয়াকিবহলা।



(৯) وَلاَرَطَبٍ وَّلاَ يَابِسٍ اِلاَّفِىْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ.


-‘‘এবং শুষ্ক ও আর্দ্র এমন কিছুই নেই, যা উজ্জ্বল ‘কিতাবে’ লিপিবদ্ধ হয়নি।’’ 

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৫৯, পারাঃ ৭}

      

❏‘তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ উক্ত আয়াতের তাফসীর এভাবে করা হয়েছে,


هُوَ اللَّوْحُ الْمَحْفُوْظُ فَقَدْ ضَبَطَ اللهُ فِيْهِ جَمِيْعَ الْمَقْدُوْرَاتِ الْكَوْنِيَّةِ لِفَوَائِدِ تَرْجِعُ اِلَى الْعِبَادِ يَعْرِ فُهَا الْعُلَمَاءُ بِاللهِ


-‘‘উজ্জ্বল কিতাব’ দ্বারা লওহে মাহফুজের কথাই বলা হয়েছে। এতে আল্লাহ তা’আলা বান্দার কল্যাণার্থে সম্ভাব্য সকল বিষয় একত্রিত করেছেন। উলামায়ে রব্বানীই এসব বিষয়ে অবগত।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বয়ানঃ ৩/৫৭ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে কাবীরে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


وَفَائِدَةُ هَذَا الْكِتَابِ أُمُورٌ: أَحَدُهَا: أَنَّهُ تَعَالَى إِنَّمَا كَتَبَ هَذِهِ الْأَحْوَالَ فِي اللَّوْحِ الْمَحْفُوظِ لِتَقِفَ الْمَلَائِكَةُ عَلَى نَفَاذِ عِلْمِ اللَّه تَعَالَى فِي الْمَعْلُومَاتِ وأنه لا يغيب عنه مما في السموات وَالْأَرْضِ شَيْءٌ. فَيَكُونُ فِي ذَلِكَ عِبْرَةٌ تَامَّةٌ كَامِلَةٌ لِلْمَلَائِكَةِ الْمُوَكَّلِينَ بِاللَّوْحِ الْمَحْفُوظِ لِأَنَّهُمْ يُقَابِلُونَ بِهِ مَا يَحْدُثُ فِي صَحِيفَةِ هَذَا الْعَالَمِ فَيَجِدُونَهُ مُوَافِقًا لَهُ


-‘‘(লওহে মাহফুজে) এ ধরনের লিখার পিছনে কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমতঃ আল্লাহ তা’আলা ওই সমস্ত বিষয়াদি লওহে মাহফুজে এ জন্য লিখেছেন, যা’তে ফিরিশতাগণ সর্বাবস্থায় খোদার ইলম জারী হওয়া সম্পর্কে অবগত হন। সুতরাং এটা লওহে মাহফুজের দায়িত্বে নিয়োজতি ফিরিশতাগণের জন্য পুরোপুরি শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে পরিণত হয়। কেননা তাঁরা জগতে নিয়ত ঘটমান নতুন নতুন বিষয়কে ওই লিখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেনও লওহে মাহফুজের লিখার অনুরূপ সবকিছু সংঘটিত হতে দেখতে পান।’’ 

{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৫/১২ পৃ.}

      

❏তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা হয়েছে,


وَالثَّاِنِى اَنَّ الْمُرَادَ بِالْكِتَابِ الْمُبِيْنَ هُوَ اللَّوْحُ الْمَحْفُوْظُ لِاَنَّ اللهُ كَتَبَ فِيْهِ عِلْمَ مَايَكُوْنَ وَمَاقَدْ كَانَ قَبْلَ اَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَتِ وَالْاَرْضَ وَفَائِدَةُ اِحْصَاءِ الْاَشْيَآءِ كُلِّهَا فِىْ هَذَا الْكِتَابِ لِتَقِفَ الْمَلَئِكَةُ عَلَى اِنْفَاذِ عِلْمِهِ


-‘‘দ্বিতীয় অর্থে كِتَبٌُ مُبِيْنَ বলতে লওহে মাহফুজকে বোঝানো হয়েছে। কেননা যা কিছু হবে এবং আসমান যমীন সৃষ্টির পূর্বে যা কিছু হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা সব কিছুর বিবরণ এতে লিখে দিয়েছেন। এসব কিছু লিখার উপকারিতা হলো ফিরিশতাগণ তাঁর (আল্লাহর) জ্ঞান জারী করার বিষয়ে অবগতি লাভ করতে সক্ষম হন। 

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ২/১১৯ পৃ.}


❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খ করা হয়েছে وَهُوَ عِلْمُ اللهِ اَوِالْلَوْحِ অর্থাৎ- আয়াতে উল্লে­খিত ‘উজ্জ্বল কিতাব’ দ্বারা খোদার জ্ঞান বা লওহে মাহফুজকে নির্দেশ করা হয়েছে।  

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৩৬৩ পৃ.}

 

❏‘তাফসীরে তানভীরুল মিক্কাস ফি তাফসীরে ইবনে আব্বাসে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খিত আছে,


كُلُّ ذَلِكَ فِى اللَّوْحِ الْمُحْفُوْظِ مُبِيْنٌُ مِقْدَارُهَا وَوَقْتُهَا


-‘‘এসব বিষয় লওহে মাহফুজে উল্লে­খিত আছে। অর্থাৎ সে সব কিছুর পরিমাণ ও সময় উল্লে­খিত আছে।’’ 

{ইবনে আব্বাস, তাফসীরে ইবনে আব্বাসঃ ১/১৪২ পৃষ্ঠা.}

      

উল্লে­খিত আয়াত ও এর তাফসীর সমূহ থেকে প্রতীয়মান হলো যে, লওহে মাহফুজে কঠিন, তরল, উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট প্রত্যেক কিছুর উল্লে­খিত আছে। এ লওহে মাহফুজ সম্পর্কে ফিরিশতা ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ সম্যকরূপে অবগত। যেহেতু এসব হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত, সেহেতু, এ সমস্ত জ্ঞান হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা মাত্র।



(১০) نَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًالِكُلِّ شَئٍى


-‘‘হে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা প্রত্যেক কিছুর সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত।’’ 

{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৮৯, পারাঃ ১৪}

      

❏‘তাফসীরে হুসাইনী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খিত আছে,


نزلنا فر ستاديم، عليك الكتاب برتوقر ان بتبيانالكل شئ بيان روشن برائے همه چيز ازامورين ودنيا تفصيل واجمال


-‘‘আমি আপনার কাছে দ্বীন-দুনিয়ার প্রত্যেক বিষয়ের বিস্তারিত ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় ভরপুর কুরআন অবতীর্ণ করেছি। 

{আল্লামা মঈনুদ্দীন কাশেফীঃ তাফসীরে হুসাইনীঃ সূরা নাহলঃ ৮৯}

      

❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের তাফসীরে উল্লে­খিত আছে-


يَتَعَلَّقُ بِاْمُوْرِ الدِّيْنِ مِنْ ذَلِكَ اَحْوَالُ الْاُمَمِ وَاَنْبِيَاءِهِمْ


-‘‘ধর্মীয় বিষয় সমূহের সহিত সম্পৃক্ত বিবরণের জন্য (কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে)। এতে উম্মত ও তাদের নবীগণের অবস্থাও অন্তভুর্ক্ত।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৫/৮৫ পৃ.}

      

❏তাফসীরে ‘ইতকানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খিত আছে,


قَالَ الْمُجَاهِدُ يَوْمًا مَامِنْ شَيْئٍ فِى الْعَالَمٍ اِلَّاهُوَفِىْ كِتَابِ اللهِ فَقِيْلَ لَهُ فَاَيْنَ ذِكْرُ الْخَانَاتِ فَقَالَ فِىْ قَوْلِهِ لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌُ اَنْ تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ مَسْكُوْنَةٍ فِيْهَا مَتَاعٌُ لَّكُمْ


-‘‘একদিন হযরত মুজাহিদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেছিলেন, জগতে এমন কোন জিনিস নেই, যার উল্লে­খ কুরআনে নেই। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ সরাইখানা সমূহের উল্লে­খ কোথায় আছে? 


তখন তিনি বললেন,


 لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنُاحً اَنْ تَدْخُلُوْ بُيُوْتًا غَيْرَ مَسْكُوْنَةٍ 


এ আয়াতেই উহাদের উল্লে­খ আছে। আয়াতটির অর্থ হলোঃ যেসব ঘরে কেউ থাকে না, অথচ যেখানে তোমাদের আসবাবপত্র, সাজসরঞ্জাম রাখা হয়, সে সমস্ত ঘরে প্রবেশ করলে তোমাদের কোন গুনাহ হবে না।’

{আল্লামা ইমাম জালালুদ্ধীন সূয়তীঃ আল-ইতকানঃ ২/১৬০ পৃ.}

      

এ আয়াত ও এর ব্যাখ্যা সমূহ থেকে এ কথাই বোঝা গেল যে, কুরআনের মধ্যে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট প্রত্যেক কিছুর উল্লে­খ আছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর মাহবুব (ﷺ)কে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন।


সুতরাং সমস্ত কিছুই হযরত মুস্তাফা (ﷺ)র জ্ঞানের আওতাধীন।



(১১) وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لَا رَيْبَ فِيهِ


-‘‘এবং লওহে মাহফুজে যা কিছু লিখা আছে, কুরআনে তার বিস্তৃতি বিবরণ রয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই।’’ 

{সূরাঃ ইউনূস, আয়াতঃ ৩৭, পারাঃ ১১}


❏তাফসীরে ‘জালালাইনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


تَفْصِيْلَ الْكِتَابِ يُبُيَّنُ مَاكَتَبَ اللهُ تَعَالَى ِمَن اْلَاْحَكاِم َوَغْيِرهَا


-‘‘ইহা বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত গ্রন্থ। এতে আল্লাহ তা’আলার লিখিত বিধানাবলী ও অপরাপর বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।’’  

{আল্লামা জালালুদ্ধীন সূয়তীঃ তাফসীরে জালালাইনঃ ২৭২ পৃ.}


❏‘জুমুলে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আছে,


اَىْ فِى اللَّوْحِ الْمَحْفُوْظِ.


-‘‘লওহে মাহফুজে সবকিছুই বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে।


❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


اَىْ وَتَفْصِيْلَ مَا حُقِّقَ وَاُثْبِتَ مِنَ الْحَقَائِقِ وَالشَّرَائِعِ وَفِى التَّاوِيْلاَتِ النَّجْمِيَّةِ اَىْ تَقْصِيْلَ الْجُمْلَةِ الَّتِىْ هِىَ الْمُقَدَّرُ الْمَكْتُوْبُ فِى الْكِتَبِ الَّذِىء لاَ يَتَطَرَّقُ اِلَيْهِ الْمَحْوُ وَاْلاَثْبَاتُ لاِنَّهُ اَزَلِىُّ وَاَبَدِىٌُّ


-‘‘এ কুরআন হচ্ছে শরীয়ত ও হাকীকতের প্রমাণিত বিষয়সমূহের বিশে­ষণ। ‘তাবীলাতে নজ্মিয়া’তে উল্লে­খিত আছে যে, কুরআনে সে সমস্ত বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে, যা’ অদৃষ্টে আছে, এবং যা’ সেই কিতাবে (লওহে মাহফুজ) লিপিবদ্ধ রয়েছে, যেখানে কোনরূপ রদবদলের অবকাশ নেই। কেননা এটা অনাদি ও অনন্ত।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৪/৬৪ পৃ.}     


উপরোক্ত আয়াত ও ব্যাখ্যাসমূহ থেকে প্রমাণিত হলো যে, কুরআন শরীফে শরীয়তের অনুশাসন সমূহ ও সমস্ত জ্ঞান মওজুদ আছে। এ আয়াত থেকে আরও বোঝা গেল যে, কুরআন শরীফে পুরা লওহে মাহফুজের বিস্তারিত বিবরণ আছে। আর লওহে মাহফুজ হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের আকর। 


❏কুরআনেই উল্লে­খিত আছে,


وَلاَ رَطَبٍ وَّلاَ يَابِسٍ اِلاَّفِىْ كِتَابٍ مُّبِيْنِ


❏এবং কুরআনে আরও এরশাদ করা হয়েছে, 


اَلَرً حْمَنُ عَلَّمَ الْقُرْاَنَ 


সুতরাং, লওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ সমস্ত কিছুর জ্ঞান হুযুর পুর-নুর (ﷺ)এর রয়েছে। কেননা, কুরআন হচ্ছে লওহে মাহফুজেরই বিবরণ সম্বলিত গ্রন্থ।



(১২) مَا كانَ حَدِيثاً يُفْتَرى وَلكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ


-‘‘এ কোন বানোওয়াট কথা নয়, এতে রয়েছে আল্লাহর আগের উক্তি সমূহের সত্যায়ন ও প্রত্যেক বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা।’’ 

{সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ১১১, পারাঃ ১৩}      


❏তাফসীরে ‘খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে,


يَعْنِىْ فِىْ هَذَا الْقُرْآَنِ الْمُنَزَّلِ عَلَيْكَ يَامُحَمَّدُ تَفْصِيْلُ كُلِّ شَيْئٍى تَحْتَاجُ اِلَيْهِ مِنَ الْحَلاَلِ وَالْحَرَامِ وَالْحُدُوْدِ وَالْاَحَكَامِ وَالْقَصَصِ وَالْمَوَا عِظِ وَآلاَمَثَالِ وَغَيْرِ ذَلِكَ مِمَّا يَحْتَاجُ اِلَيْهِ الْعِبَادُ فِىْ اَمْرِ دِيْنِهِمْ وَدُنْيَاهُمْ


-‘‘(হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনার নিকট অবতীর্ণ এ কুরআনে রয়েছে সবকিছুর বিশদ বিবরণ, হালাল-হারাম, শাস্তি বিধান, আহকাম, কাহিনী সমূহ, উপাদেশাবলী ও উদাহরণসমূহ, মোট কথা, যা’ কিছু আপনার প্রয়োজন হয় আর এগুলো ছাড়াও ধর্মীয় ও পার্থিব কর্মকান্ডে বান্দাদের যে সমস্ত বিষয়াদি প্রয়োজন হয়, সবকিছুর বিবরণ ওই কুরআনেই পাওয়া যাবে।’’ 

{ইমাম খাযেনঃ লুবাবুত তাভীলঃ ২/৫৬২ পৃ.

      

❏তাফসীরে ‘হুসাইনী’ তে আছে,


وَتَقْصِيْلُ كُلِّ شَيْئٍ، وبيان همه چيزهاكه محتاج بلشد دردين ودنيا


-‘‘দ্বীন-দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সবকিছুর বর্ণনা এ কুরআনের মধ্যে আছে।’’  

{ইমাম বগভীঃ মা’আলেমুত তানযীলঃ ৪/২৬৭ পৃ.}


❏ইবনে সুরাকা প্রণীত ‘কিতাবুল ই’জাযে আছে, 


مَامِنْ شَيْئٍ فِى الْعَالَمِ اِلَّاهُوَ فِىْ كِتَابِ اللهِ تَعَالَى


-‘‘জগতে এমন কোন কিছু নেই, যা’ কুরআনের মধ্যে নেই।’’


 

(১৩)اَلرَّحْمَنُ. عَلَّمَ الْقُرْاَنَ. خَلَقَ الْاِنْسَانَ. عَلَّمَهُ الْبَيَانَ


-‘‘দয়াবান আল্লাহ তা’আলা স্বীয় মাহবুবকে কুরআন শিখিয়েছেন, মানবতার প্রাণতুল্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে সৃষ্টির পূর্বাপর সব কিছুর তাৎপর্য বাতলে দিয়েছেন। 

{সূরা  রাহমান, আয়াতঃ ১-৪}

      

❏তাফসীরে ‘মাআলেমুত-তানযীল’ ও ‘হুসাইনী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে নিম্নরূপ,


خَلَقَ الْاِنْسَانَ اَىْ مُحَمَّدً عَلَيْهِ السَّلاَمُ عَلَمَّهُ الْبَيَانَ. يَعْنِىْ بَيَانَ مَاكَانَ وَمَا يَكُوْنَ


-‘‘আল্লাহ তা’আলা মানবজাতি তথা মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত বিষয়ের বর্ণনা শিক্ষা দিয়েছেন।’’ 

{মোল্লা মুঈন কাশেফীঃ তাফসীরে হুসাইনীঃ সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ১১১}

      

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


قِيْلَ اَرَادَ بِالْاِنْسَانِ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ يَعْنِىْ بَيَانَ مَاكَانَ وَمَايَكُوْنَ لِانَّهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ نَبِّى عَنَ خَبْرِ الْاُوَّلِيَنَ وَالْاَخِرِيْنَ وَعَنْ يَوْمِ الدِّيْنِ


-‘‘বলা হয়েছে যে, (উক্ত আয়াতে) ‘ইনসান’ বলতে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে বোঝানো হয়েছে। তাঁকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব বিষয়ের বিবরণ শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কেননা, তঁাকে পূর্ববতী ও পরবর্তীদের ও কিয়ামতের দিন সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।’’ 

{ইমাম খাযিনঃ তাফসীরে খাযিনঃ ৪/২০৮ পৃ.}

      

❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


وَعَلَّمَ نَبِيَّنَا عَلَيْهِ السَّلاَم الْقُرْاَنَ وَاَسْرَارَ الْاُلُوْهِيَةِ كَمَا قَالَ وَعَلَّمْكَ مَالَمْ تَكُنَ تَعْلَمُ


-‘‘আল্লাহ তা’আলা আমাদের নবী (ﷺ)কে কুরআন ও স্বীয় প্রভুত্বের রহস্যাবলীর জ্ঞান দান করেছেন, যেমন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা ফরমায়েছেন, وَعَلَّمَكَ مَاَلَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ সে সব বিষয় আপনাকে শিখিয়েছেন, যা আপনি জানতেন না।’’ 

{আল্লামা ঈসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৯/২৮৯পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}

      

❏তাফসীরে ‘মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


اَلْاِنْسَانُ اَىِ الْجِنْسَ اَوْاَدَمَ اَوْ مُحَمَّدًا عَلَيْهِ السَّلاَمُ


-‘‘ইনসান বলতে মানবজাতি বা আদম (عليه السلام) বা হুজুর (ﷺ)কে বোঝানো হয়েছে।’’ 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ২/২৬৫ পৃ.}

      

❏তাফসীরে ‘মা’আলিমুত তানযীলে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


وَقِيْلَ اَلْاِنْسَانُ هَهُنَا مُحَمَّدً عَلَيْهِ السَّلاَمُ وَبَيْانُهُ عَلَّمَكَ مَالَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ


-‘‘বলা হয়েছে যে, এ আয়াতে اِنْسَانُ ‘ইনসান’ বলতে হুজুর (ﷺ)কে বোঝানো হয়েছে এবং بَيَانُ ‘বয়ান’ বলতে এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে, তাঁকে (প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ঐ সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান দান করা হয়েছে, যা তিনি জানতেন না।’’ 

{ইমাম বগভীঃ মা’আলিমুত তানযীলঃ ৪/২৬৭ পৃ.}

      

❏তাফসীরে হুসাইনী’তে আয়াতের তাফসীর বলা হয়েছে,


ياوجود محمد رابيا موزا نيددے


-‘‘অথবা একথা বোঝানো হয়েছে যে, মহান আল্লাহ হুজুর (ﷺ) এর  সত্ত্বাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে যা কিছু হয়েছে বা হবে সে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন।’’ 

{মোল্লা মুঈন কাশেফীঃ তাফসীরে হুসাইনীঃ সূরাঃ রাহমানের ১-৪ আয়াতের ব্যাখ্যা দেখুন।}


উল্লে­খিত আয়াত ও উহাদের তাফসীর সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, কুরআনের মধ্যে সবকিছু আছে এবং এর পরিপূর্ণ জ্ঞান হুজুর (ﷺ)কে প্রদান করা হয়েছে।



(১৪) مَااَنْتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُوْنٍ


-‘‘আপনি আপনার প্রভুর মেহেরবাণীতে উম্মাদ নন।’’ 

{সূরাঃ কালাম, আয়াতঃ ২, পারাঃ ২৯}

      

❏তাফসীর ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


بِمَسْتُوْرٍ عِلْمًا كَانَ فِى الْاَزَلِ وَمَا سَيَكُوْنُ اِلَى اْلَاَبِد لِاَنَّ الْجُنَّ هُوَ الشَّتَرُ بَلَّ اَنْتَ عَالِمٌُ بِمَا كَانَ وَخَبِيْرٌُ بِمَا سَيَكُوْنُ


-‘‘আপনার দৃষ্টি থেকে সে সমস্ত বিষয় লুকায়িত নয়, যা’ সৃষ্টির আদিকালে ছিল, ও যা কিছু অনন্তকাল পর্যন্ত হতে থাকবে। কেননা, جُن শব্দের অর্থ হলে লকুায়িত থাকা। সুতরাং, সারমর্ম হচ্ছে, যা কিছু হয়েছে সে সব কিছু সম্পর্কেতো আপনি জানেনই, যা কিছু অনাগত ভবিষ্যতে হবে সে ব্যাপারেও আপতি অবগত আছেন।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৯/৩৪০-৩৪১}

      

এ আয়াত ও তাফসীর থেকে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর সামগ্রিক ও অনন্তকাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ইলমে গায়বের বিষয়টি প্রমাণিত হলো।



(১৫) وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ


-‘‘এবং হে মাহবুব আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা বলবে আমরাতো কৌতুক ও খেল-তামাশা করেছিলাম।’’ 

{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৬৫, পারাঃ ১০}

      

❏তাফসীরে ‘দুররে মনসুর’ ও ‘তাবরী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লে­খিত আছে,


عَنْ اِبْنِ عَبَّاس اَنَّهُ قَالَ فِىْ قَوْلِهِ تَعَالَي وَلَئِنْ سَالْتَهُمْ. الخ قَالَ رَجُلٌُ مِنَ الْمُنَا فِقِيْنَ يُحَدِّثُنَا مُحَمَّدٌُ اَنَّ نَاقَةُ فُلاَنٍ بِوَادٍ فُلاَنٍ وَمَايُدْرِيْهِ بِالْغَيْبِ


-‘‘হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) থেকে এ আয়াত وَلَئِنْ سَالْتَهُمْ الخ অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বর্ণিত আছে যে, জনৈক মুনাফিক বলে ছিল যে, হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সংবাদ দিচ্ছেন অমুক ব্যক্তির উষ্ট্রী অমুক জঙ্গলে আটকা পড়েছে। অদৃশ্য বিষয় তাঁর কীই বা জানা আছে?  

{ইমাম সূয়তীঃ তাফসীরে দুররে মানসূরঃ ৩/৪৫৬ পৃ.}

      

এ আয়াত ও তাফসীর থেকে একথাই জানা গেল যে, হুজুর (ﷺ) এর  অদৃশ্য জ্ঞানকে অস্বীকার করা মুনাফিকদেরই কাজ। সেটাকে কুরআন ‘কুফর’ বলে আখ্যায়িত করেছে।




(১৬) عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا  إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ 


-‘‘(আল্লাহ পাক) তাঁর মনোনীত রাসূলগণ ছাড়া কাউকেও তাঁর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন না।’’ 

{সূরাঃ জ্বিন, আয়াতঃ ২৬, পারাঃ ২৯}

      

❏‘তাফসীরে কবীরে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


اَىْ وَقْتَ وَقُوْعِ الْقِيَمَةِ مِنَ الْغَيْبِ الَّذِىْ لَايُظْهِرُهُ اللهُ لِاَحَدٍ فَاِنْ قِيْلَ فَاِذَا اَحْمَلْتُمْ ذَلِكَ عَلَى الْقِيَمَةِ فَكَيْفَ قاَلَ اِلَّامَنِ ارْتَضَى مِنْ رَّسُوْلٍ مَعَ اَنَّهُ لَايُظْهِرُ هذَا الْغَيْبَ لِاَحَدٍ قُلْنَا يَّظْهِرَهُ عِنْدَ قَرِيْبِ الْقِيَمَةِ


-‘‘কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট সময়ের প্রশ্নটি ঐ সমস্ত অদৃশ্য বিষয়ের অন্তভুর্ক্ত, যা’ আল্লাহ তা’আলা কারো কাছে প্রকাশ করেন নি। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, আপনি এখানে ‘গায়বকে’ কিয়ামত’ অর্থে ব্যবহার করেছেন, যদি তাই হয়, তাহলে আল্লাহ তা’আলা কিভাবে ইরশাদ করলেন, اِلاَّمَنِ ارْتَضَى مِنْ رَّسُوْلٍ (কিন্তু মনোনীত রাসূলগণের নিকট ব্যক্ত করেন) অথচ (আপনার কথা মত) এ গায়বটি কারো কাছে প্রকাশ করা হয় না। এর উত্তরে আমি বলবো যে, আয়াতের মর্মকথা হচ্ছে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে আল্লাহ পাক উক্ত অদৃশ্য বিষয়টি প্রকাশ করবেন।’’ 

{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ১০/৬৭৮ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে আযীযী’র ১৭৩ পৃষ্ঠায় উল্লে­খ করা হয়েছে,


انچه به نسبت همه مخلوقات غائب است غائب مطلق است مثل وقت امدن قيامت واحكام تكونييه وشرعيه بارى تعالى ودرهر روز وهرشريعت ومثل خقائق ذات وصفات او تعالى على سبيل التفصيل ايں قسم راغيب خاص اوتعالى نيز مى نامند فلايظهر على غيبه احدا پس مطلع نمى كند برغيب خاص خود هيچكس رامگر كسى راكه پسند مى كند واں كس رسول باشد خواه ازجنس ملك وخواه ازجنس بشر مثل حضرت محمد مصطفے عليه السلام اورا اظهار بعضےز غيوب خاصه خود مي فرمائد


-‘‘যে বিষয় সৃষ্টিকূলের অজ্ঞাত বা দৃষ্টি বহির্ভূত, উহা ‘গায়ব মুতলাক’ নামে পরিচিত। যেমন কিয়ামতের সঠিক সময়, প্রত্যেক শরীয়তের বিধিসমূহ সৃষ্টিকূলের দৈনন্দিন শৃংখল বিধানের রহস্যময় বিষয়সমূহ, আল্লাহ তা’আলার ‘খাস গায়ব’ বলা হয়, তিনি তাঁর খাস গায়ব কারো কাছে প্রকাশ করেন না, তবে তিনি রাসূলগণের মধ্যে যাকে পছন্দ করেন, (তিনি ফিরিশতার রাসূল হোন বা মানবজাতির রাসূল হোন) তাঁকে অবহিত করে থাকেন। যেমন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (ﷺ)র কাছে তার বিশেষ অদৃশ্য বিষয়াদির কিয়দংশ প্রকাশ করে থাকেন।’’ 

{শায়খ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলভীঃ তাফসীরে আযীযীঃ ৫/১৭৩ পৃ.}


❏তাফসীরে ‘খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় করা হয়েছে,


اِلاَّمَنْ يَّصْطَفِيْهِ لِرِسَالَتِهِ وَنُعَوَّّتِهِ فَيُظْهِرُ عَلَى مَنْ يَّشَاءُ مِنَ الْغَيْبِ حَتَّى يَسْتَدِلَّ عَلَى نُبَوَّتِهِ بِمَا يُخْبِرُ بِهِ مِنَ الْمُغِيْبَاتِ فَيَكُوْنُ ذَلِكَ مٌُعْجِزَةٌُلَهُ


-‘‘যাদেরকে (আল্লাহ পাক) নবুয়াত বা রিসালাতের জন্য মনোনীত করেন, তাঁদের মধ্যে হতে যাকে ইচ্ছা করেন, তার কাছে এ অদৃৃশ্য বিষয় ব্যক্ত করেন, যাতে তাঁর অদৃশ্য বিষয়াদির সংবাদ প্রদান তাঁর নবুয়তের সমর্থনে সর্ব সাধারণের নিকট প্রমাণ স্বরূপ গৃহীত হয়। এটাই তাঁর মুজিযারূপে পরিণত হয়।’’ 

{ইমাম খাযিনঃ লুবাবুত তা’ভীলঃ ৪/৩১৯ পৃ.}

      

❏উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রূহুল বয়ানে আছে,


قَالَ اِبْنُ الشَّيْخُ اِنَّّهُ تَعَالَى لاَيُطْلِعُ عَلَى الْغَيْبِ الَّذِىْ يَخْتَصُّ بِهِ تَعَالَى عِلْمُهُ اِلاَّلِمُرْ تَضَى الَّذِىْ يَكًوْنُ رَسُوْلًا وَمَالاَ يَخْتَصُّ بِهِ يُطْلِعُ عَلَيْهِ غَيْرَ الرًَّسُوْلِ


অর্থাৎ- ইবন শাইখ বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা তার পছন্দনীয় রাসূল ছাড়া কাউকে তাঁর খাস গায়ব সম্পর্কে অবহিত করেন না। তবে তার বিশেষ অদৃশ্য বিষয়াদি ছাড়া অন্যান্য অদৃশ্য বিষয়াদি রাসূল নন এমন ব্যক্তিদেরকেও অবহিত করেন। 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১০/২৩৬ পৃ.}

      

এ আয়াত ও এর তাফসীরসমূহ থেকে প্রমাণিত হলো যে, মহান আল্লাহ তা’আলার খাস ইলমে গায়ব, এমন কি কিয়ামত কখন হবে সে জ্ঞানও হুযুর পুর-নুর (ﷺ) কে দান করা হয়েছে। এখন এমন কি জিনিষ আছে, যা’ হযরত মুস্তাফা (ﷺ)র জানার বাকী রইল?



(১৭) فَاَوْحَى اِلَى عَبْدِهِ مَااَوْحَى


-‘‘তিনি (আল্লাহ) তাঁর প্রিয় বান্দার প্রতি যা কিছু ওহী করার ছিল, তা ওহী করলেন।’’ 

{সূরাঃ নজম, আয়াতঃ ১০, পারাঃ ২৭}


❏সুবিখ্যাত ‘মাদারিজন-নবুয়ত’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ‘আল্লাহর দর্শন’ শীর্ষক পরিচ্ছেদ উল্লে­খিত আছে,


فاوحى الآية : بتمام علوم ومعارف وحقائق وبشار ات وارشادات اخبار واثار وكرامات وكمالات دراحيطئه ايں ابهام داخل است وهمه راشامل وكثرت و عظمت اوست كه بهم اورد وبيان نه كرد اشارات بانكه جز علم علام الغيوب و رسول محبوب به اں محيط نتواند شد مگرآنچه آں حضرت بيان كرده


-‘‘মহা প্রভু আল্লাহ হুজুর (ﷺ) এর  পবিত্র মিরাজের রজনীতে যে সমস্ত জ্ঞান, মারিফাত, শুভ সংবাদ ইঙ্গিত, বিবিধ তথ্য, বুযুর্গী, মান সম্মান, পূর্ণতা ইত্যাদি ওহী করেছিলেন, সবই এ অস্পষ্ট বর্ণনায় (যা আয়াতের ما اوحى বাক্যাংশে বর্ণিত হয়েছে) অন্তভুর্ক্ত আছে। ঐ সমস্ত বিষয়াদির অত্যধিক ও মাহাত্ম্যের কারণে সেগুলোকে অস্পষ্টরূপ উল্লে­খ করেছেন; সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ব্যক্ত করেন নি। এতে একথার প্রতিও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, ওই সমস্ত অদৃশ্য জ্ঞান সমূহ খোদা তা’আলা ও তার মাহবুব عليه السلام ব্যতীত অন্য কেউ পরিবেষ্টন করতে পারে না। তবে হ্যাঁ, যতটুকু হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রকাশ করেছেন, ততটুকু জানা গেছে।’’ 

{শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীঃ মাদারেজুন নবুয়াতঃ ১/১৭০ (ফার্সী)}

      

এ আয়াত এর ব্যাখ্যা থেকে বোঝা গেল যে, মি‘রাজ হুজুর (ﷺ)কে সে সমস্ত জ্ঞান দান করা হয়েছিল, যা, যে কারো জন্যে বর্ণনাতীত ও কল্পনাতীত। ماكان ومايكون (যা কিছু হয়েছে ও হবে) এ কথটি শুধু বর্ণনার সুবিধার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ এর চেয়ে ঢের বেশী জ্ঞান তাঁকে দান করা হয়েছে।



(১৮) وَمَا هُوَعَلَى الْغَيْبِ بِضَنِيْنٍ


-‘‘এ নবী (ﷺ) গায়ব প্রকাশের ক্ষেত্রে কৃপণ নন।’’ 


এ কথা বলা তখনই সম্ভবপর, যখন হুজুর (ﷺ) গায়বী ইলমের অধিকারী হয়ে জনগণের কাছে তা ব্যক্ত করেন।

{সূরাঃ তাকভীর, আয়াতঃ ২৪।}

      

❏‘মা’আলিমুত তানযীল’ নামক তাফসীর গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে,


عَلَى الْغَيْبِ وَخَبْرِ السَّمَاءِ وَمَااُطَّلِعَ عَلَيْهِ مِنَ الْاَخْبَارِ وَاالْقَصَصِ بِضَنِيْنَ اَىْ بِبَخِيْلٍ يَقُوْلُ اِنَّهُ يَاتِيْهِ عِلْمُ الغَيْبِ فَلاَ يَبْخَلُ بِهِ عَلَيْكُمْ بَلْ يُعَلّضمَكُمْ وَيُخْبِرُ كُمْ وَلاَيِكْتُمُهُ كَمَا يَكْتُمُ الكَاهِنُ

.

-‘‘হুজুর (ﷺ) অদৃশ্য বিষয়, আসমানী খবর ও কাহিনী সমূহ প্রকাশ করার ব্যাপারে কৃপণ নন। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন, তবে উহা তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কোনরূপ কার্পণ্য করেন না, বরং তোমাদেরকে জানিয়ে দেন ও উহাদের সংবাদ দেন। গণক ও ভবিষ্যতবেত্তারা যে রূপ খবর গোপন করে রাখেন। সেরূপ তিনি গোপন করেন না।’’ 

{ইমাম বগভীঃ মা’আলিমুত তানযীলঃ ৪/৪২২ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের তাফসীরে উল্লে­খিত আছে,


يَقُوْلُ اِنَّهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَأتِيْهِ عِلْمُ الْغَيْبِ فَلاَ يَبْخَلُ بِهِ عَلَيْكُمْ بِلْ يُعَلِّمُكُمْ.


-‘‘এ আয়াতে একথাই বোঝানো হয়েছে যে হুজুর (ﷺ) এর  কাছে অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ আসে। তিনি উহা তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করেন না, বরং তোমাদেরকে জানিয়ে দেন।’’ 

{ইমাম খাযেনঃ লুবাবুত তা’ভীলঃ ৪/৩৫৭ পৃ.}


এ আয়াত ও এর তাফসীরের ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) লোকদেরকে ইলমে গায়ব শিক্ষা দেন। বলা বাহুল্য যে, যিনি জানেন, তিনিই তো শিখিয়ে থাকেন।



(১৯) وَعَلَّمْنَهُ مِنْ لَّدُنَّا عِلْمًا


-‘‘আমি (আল্লাহ) তাঁকে (হযরত খিযির عليه السلامকে) আমার ইলমে লাদুনী দান করেছি।’’ 

{সূরাঃ কাহাফ, আয়াতঃ ৬৫, পারাঃ ১৫}

      

❏‘তাফসীরে বায়যাবীতে’ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


اَىْ مِمَّا يَخْتَصًّ نَبَاءُهُ لاَيَعْلَمُ اِلاَّ بِتَوْفِيْقِنَا وَهُوَ عِلْمُ الْغَيْبِ.


-‘‘হযরত খিযির عليه السلامকে এমন বিষয়াদির জ্ঞান দান করেছি, যেগুলো সম্পর্কে শুধু আমিই অবগত, যা আমি না বললে কেউ জানতে পারে না। এটাইতো ইলমে গায়ব। 

{ইমাম বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভীঃ ৩/৫১০ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে ইবনে জারীরে’ সায়্যেদুনা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে,


{قَالَ إِنَّكَ لَنْ تَسْتَطِيعَ مَعِيَ صَبْرًا} [الكهف-٦٧] وَكَانَ رَجُلًا يعلم عِلْمَ الْغَيْبِ، قَدْ عُلِّمَ ذَلِك  ..


-‘‘হযরত খিযির (عليه السلام) হযরত মুসা (عليه السلام) কে বলেছিলেন ‘আপনি আমার সঙ্গে অবস্থান করলে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না।’

(সুরা কাহাফ-৬৭) 


হযরত খিযির (عليه السلام) ইলমে গায়বের অধিকারী ছিলেন বলেই এ কথাটি পূর্বে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।’’

{ইমাম ত্ববারীঃ জমিউল বায়ান তাফসীরুল কোরআনঃ ১৫/৩২৭ পৃ.}

      

❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


هُوَ عِلْمُ الْغُيُوْبِ وَالْاِخْبَارُ غَنْهَا بِاِذْنِهِ تَعَالىَ كَمَا ذَهَبَ اِلَيْهِ اِبْنِ عَبَّاسٍ


-‘‘হযরত খিযির (عليه السلام) কে যে ইলমে লদুনী শিখানো হয়েছিল, উহাই ইলমে গায়ব। এবং গায়বের খবর পরিবেশন খোদার ইচ্ছানুযায়ী হয়ে থাকে। হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) এ মতই পোষণ করেছেন।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৫/৩২১ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে বলা হয়েছে,


يَعْنِى الْاِخْبَارُ بِالْغُيُوْبِ وَقِيْلَ الْعِلْمُ الَّدُنِىْ مَاحَصَلَهُ لِلْعَبْدِ بِطَرِيْقِ آلالْهَامِ

.

-‘‘হযরত খিযির (عليه السلام) কে অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, ইলমে লদুনী হলো এমন এক বিশেষ জ্ঞান, যা’ বান্দা ইলহামের মাধ্যমে অর্জন করেন।’’ 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ২/২২ পৃ.}

      

❏ইমাম খাযেন (রহ.) {ওফাত.৭৪১হি.} তার ‘তাফসীরে খাযেনে’ লিখেছেন,


اَىْ عِلْمَ الْبَاطِنِ اِلْهَامًا 


-‘‘হযরত খিযির عليه السلامকে আমি ইলহামের মাধ্যমে বাতেনী ইলম দান করেছি।’’ 


এ আয়াত ও তাফসীরের ইবারত সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত খিযির (عليه السلام) কে ইলমে গায়ব দান করেছিলেন। এ থেকে হুজুর (ﷺ)কে ইলম গায়ব দান করার বিষয়টি অপরিহার্যরূপে স্বীকৃত হয়। কেননা, খোদার সৃষ্টিকূলের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞানী; আর হযরত খিযির (عليه السلام) ও সৃষ্টিকূরের অন্তভুর্ক্ত।

{ইমাম খাযেন, তাফসীরে খাযেনের ৩/১৭১পৃ.দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪১৫হি.। ইমাম খাযেনের অনূরুপ ব্যাখ্যা ইমাম বগভী (رحمة الله) দিয়েছেন- أَيْ عِلْمَ الْبَاطِنِ إِلْهَامًا -‘‘খিযির (আ.)কে আমি ইলহামের মাধ্যমে বাতেনী ইলম দান করেছি । (তথ্য সুত্রঃ তাফসীরে মা‘লিমুত তানযিল, ৩/২০৫পৃ. দারু ইহইয়াউত্-তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪২০হি.। অষ্টম হিজরী শতকের একজন তাফসীর কারক আবু হাফস সিরাজুদ্দীন হাম্বলী দামেস্কী নু‘মানী (ওফাত.৭৭৫ হি.) তার প্রসিদ্ধ তাফসীর ‘আল-লুবাব ফি উলূমিল কিতাবের’ ১২তম খন্ডের ৫৩০পৃষ্ঠায় যা দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন হতে ১৪১৯হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনিও ব্যাখ্যা করেছেন- أَيْ عِلْمَ الْبَاطِنِ إِلْهَامًا -‘‘খিযির (আ.)কে আমি ইলহামের মাধ্যমে বাতেনী ইলম দান করেছি।’’ অনূরুপ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন ইমাম ই‘যাবী (ওফাত.৯০৫হি.) তার তাফসীরে ইযাবীর ২/৪৫১পৃষ্ঠায় যা দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন হতে ১৪২৫ হিজরীতে প্রকাশিত। নিবেদক-শহিদুল্লাহ বাহাদুর।}

      


(২০) وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ


-‘‘আমি এরূপেই হযরত ইব্রাহীম عليه السلامকে ভূ-মন্ডল ও নভোমন্ডলে পরিব্যাপ্ত আমার বাদশাহী অবলোকন করাই।’’ 

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৭৫, পারাঃ ৭}


❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ রূপ,


اُقِيْمَ عَلَى صَخْرَةٍ وَكُشِفَ لَهُ عَنِ السَّمَوَتِ حَتَّى رَاُى الْعَرْشَ وَالْكُرْسىِ َّومَاَفىِ السَّمَوَتِ وَكُشِفَ لَهُ عَنِ الْاَرْضِ حَتَّى نَظًَّرَ اِلَى اَسْفَلِ الْاَرْضِينَ وَرَائ مَافِيْهَا مِنَ الْعَجَائِبِ.


-‘হযরত ইব্রাহীম عليه السلامকে একটি প্রস্তর খন্ডের উপর দাঁড় করানো হয়েছিল এবং তাঁর জন্য আসমান খুলে দেয়া হয়েছিল। তখন তিনি আসমান সমূহে বিরাজমান সবকিছুই, এমনকি আরশ ও কুরসি পর্যন্ত অবলোকন করেছিলেন। অনুরুপভাবে যমীনকেও তাঁর দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন তিনি যমীনের সর্বনিম্নস্তর পর্যন্ত ও যমীনের স্তর সমূহে বিদ্যমান বিস্ময়কর সবকিছুই স্বচক্ষে দেখেছিলেন।’’ 

{ইমাম খাযেনঃ লুবাবুত তা’ভীলঃ ২/১২ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খিত আছে,


قَالَ مُجَاهِدٌُ فُرِجَتْ لَهُ السَّمَوَتُ السَّبْعُ فَنَظَرَ اِلَى مَافِيْهِنَّ حَتَّى اَنْتَهَى نَظَرَ اِلَى الْعَرْشِ وَفُرِجَتْ لَهُ الْاَرْضُوْنَ السُّبْعُ حَتَّى نَّظَرُه اِلَى مَافِيْهِ

.

-‘‘হযরত মুজাহিদ (رضى الله تعالي عنه) বলেছেন, হযরত ইব্রাহীম عليه السلامর নিকট সপ্ত আসমান উন্মুক্ত করা হয়েছিল। তখন তিনি আসমান সমূহের মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছুই দেখতে পান, এমনকি আরশ পর্যন্ত তার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। অনুরূপভাবে তাঁর নিকট সপ্ত যমীন উন্মুক্ত করা হয়। তখন তিনি যমীনের স্তর সমূহের বিদ্যমান সবকিছুই দেখতে পান।’’ 

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারেকঃ ১/৩৭৩ পৃ.}

      


❏‘তাফসীরে হুসাইনীতে’ আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


عجائب وبدائع آسمانها وزمين ها ازذروئه عرش تاتحت الثرى بروۓ منكشف ساخته.


-‘‘আমি হযরত ইব্রাহীম عليه السلامকে আসমান যমীনের অদ্ভুত ও বিস্ময়কর সবকিছুই দেখিয়ে দিয়েছি। তাঁর নিকট আরশের সুউচ্চ স্তর থেকে ‘তাখত-আছ-ছরা’ পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছি।’’

{ইমাম হাতেম, তাফসীরে ইবনে হাতেম, ৩/১৩২৭পৃ. হাদিসঃ ৭৫০২, ইমাম ত্ববারীঃ জামিউল বায়ানঃ ২/২৪৭ পৃ.}

      

❏‘তাফসীরে ইবন জারীর ইবন আবী হাতেমে’, এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা হয়েছে হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) বলেছেন,


فَإِنَّهُ جُلِّيَ لَهُ الأَمْرُ سِرُّهُ وَعَلَانِيَتُهُ، فَلَمْ يخفف عَلَيْهِ شَيْءٌ مِنْ أَعْمَالِ الْخَلائِقِ،.


-‘‘হযরত ইব্রাহীম عليه السلامর কাছে প্রকাশ্য ও গোপনীয় সবকিছুই উদ্ভাসিত হয়েছিল। সুতরাং, সে সময় সৃষ্টিকূরের কোন আমলই তাঁর নিকট গোপন ছিল না।’’ 


❏‘তাফসীরে কাবীরে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খিত আছে,


اِنَّ اللهَ شَقَّ لَهُ السَّمَوَاتِ حَتَّى رَاُىَ الْعَرْشَ وَالْكُرْسِىَّ وَاِلَى حَيْثُ يَنْتَهَى اِلَيْهِ فَوْقِيَّةُ الْعَالَمِ الْجِسْمَانِىْ وَرَاىَ مَافِى السَّمَوَتِ مِنَ العَجَائِبِ وَالْبَدَائِعِ وَرَاَّىَ مَاَّفِىْ بَطْنِ اْلاَرْضِ مِنَ الْعَجَائِبِ وَالْغَرَائِبِ.


-‘‘আল্লাহ তা’আলা হযরত ইব্রাহীম عليه السلامের জন্য আসমান সমূহকে বিদীর্ণ করে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি আরশ-কুরসী, এমনকি স্থূল জগতের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত দেখেছিলেন। আসমান সমূহে বিরাজমান সব কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, যমীনের তলদেশে বিদ্যমান উদ্ভুত ও বিস্ময় উদ্যেককর সবকিছুই সুস্পষ্টরূপে তাঁর নিকট প্রতিভাদ হয়েছিল।’’ 

{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কাবীরঃ ৫/৩৫}


এ আয়াত ও উল্লে­খিত তাফসীরের ইবারত সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, আরশ থেকে ‘তাখত-অছ-ছরা’ পর্যন্ত সমস্ত কিছুই হযরত ইব্রাহীম عليه السلامকে দেখানো হয়েছিল এবং সৃষ্টিকূলের বিবিধ আমল সম্পর্কেও তাঁকে অবগত করানো হয়েছিল। হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান তাঁর তুলনায় অনেক বেশী বিধায় একথা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করতে হয় যে, এ ব্যাপক জ্ঞান হুজুর (ﷺ)কেও দান করা হয়েছে।


স্মরণ রাখা দরকার যে, আরশের জ্ঞান বলতে লওহে মাহফুজও তাঁর আওতাভুক্ত হয়ে পড়ে। আর লওহে মাহফুজে কি কি লিখা আছে সে সম্পর্কে আমি আগে আলোচনা করেছি। সুতরাং, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবকিছুর জ্ঞান হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) এরও ছিল, আর হযরত ইব্রাহীম ও হযরত আদম (عليه السلام) এর জ্ঞান হচ্ছে হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোঁটার সমতুল্য।




(২১) لَا يَأْتِيكُمَا طَعَامٌ تُرْزَقَانِهِ إِلَّا نَبَّأْتُكُمَا بِتَأْوِيلِهِ


❏হযরত ইউসুফ (عليه السلام) বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের কাছে খাবার আসার আগে এর বিবরণ বলে দিতে পারবো।’’ 

{সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ৩৭, পারাঃ ১২}


❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ান’ ‘কবীর’ ও ‘খাযেনে’ এর তাফসীরে উল্লে­খিত আছে ‘আমি তোমাদেরকে বিগত ও অনাগত দিনের খাওয়া-দাওয়ার যাবতীয় অবস্থা বলে দিতে পারি। বলতে পারি খাদ্যশস্য কোথা হতে আসলো এবং এখন কোথায় যাবে। ‘তাফসীরে কাবীরে’ আরও উল্লে­খ করেছে, ‘আমি বলতে পারি, এ খাবার গ্রহণের ফলে উপকার হবে, না ক্ষতি হবে। এ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে তিনিই বলতে পারেন, যিনি প্রতিটি অণু-পরমাণুর খবর রাখেন।


তিনি হযরত ইউসুফ(عليه السلام) আরও বলেন, ذَلِكُمَا مِمَّا عَلَّمْنِىْ رَبِّىْ অর্থাৎ- এটা আমার জ্ঞানের কিয়দাংশ মাত্র। 

{সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ৩৭, পারাঃ ১২}

  

 তাহলে এখন বলুন, হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞানের পরিধি কতটুকু বিস্তৃত। হযরত ইউসুফ عليه السلام এর জ্ঞান হচ্ছে হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান সমুদ্রের এক বিন্দু মাত্র।


❏হযরত ঈসা (عليه السلام) ফরমান,


وَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ.


-‘‘তোমরা নিজ নিজ ঘরে যা কিছু খাও এবং যা কিছু সঞ্চিত রাখ, আমি তোমাদেরকে বলে দিতে পারি।’’ 

{সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ৪৯, পারাঃ ৩}

  

দেখুন, ঘরের মধ্যে আহার করা হল, ঘরের মধ্যে জমা করা হল, সেখানে হযরত ঈসা (عليه السلام) উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু বাহির থেকে তিনি এর সংবাদ দিচ্ছেন। একেই বলে ইলমে গায়ব।


উপসংহারঃ বিরুদ্ধবাদীগণ এসব দলীল-প্রমাণাদির কোন উত্তর দিতে পারেন না। তারা কেবল প্রত্যুত্তরে এ কথাই বলেন যে যেই সব আয়াতে كُلاُّ شَيْئٍ উল্লে­খিত আছে বা  مَالَمْ تَعْلَمْবলা হয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধি বিধানের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে, অন্য কোন কিছুর জ্ঞান বোঝানো হয়নি। এর সমর্থনে তারা নিম্নলিখিত দলীলাদি উপস্থাপন করেন,


(১) كُلاُّ شَيْئٍ বলতে সীমাহীনতা বোঝায় এবং বিষয়ের জ্ঞান খোদা ছাড়া অন্য কারো আয়ত্ত্বে থাকা তর্কশাস্ত্রে ‘শৃংখল পরস্পরের অসীমতা’ অনুসারে সম্পূর্ণরূপে বাতিল বলে গণ্য। (যুক্তিশাস্ত্রের ‘তাসালসুল ’ নামক দলীল দ্রষ্টব্য।)


(২) অনেক তাফসীরকারকগণ كُلاُّ شَيْئٍ এর ব্যাখ্যা করেছেনঃ مِنْ اُمُوْرُ  الدِّيْنِ (অর্থাৎ ধর্মীয় বিষয়াদি) যেমন তাফসীরে জালালাইনে ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থে এরূপ ব্যাখ্যাই প্রদান করা হয়েছে।


(৩) কুরআন শরীফের অনেক জায়গায় كُلاُّ شَيْئٍ বলা হয়েছে। কিন্তু উহার দ্বারা ‘কিয়দংশ’ বা ‘কিয়ৎ পরিমাণ’ই বোঝানো হয়েছে। যেমন রাণী বিলকিস সম্পর্কে وَأُوتِيَتْ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ -‘‘বিলকিসকে সব কিছুই দেয়া হয়েছে।’’  

{সূরাঃ আন-নামল, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ১৯}

  

বলা হয়েছে অথচ বিলকিসকে প্রদত্ত বস্তু বা বিষয়ের কিছু বা কিঞ্চিত পরিমাণই দেয়া হয়েছিল।


কিন্তু এগুলো কোন দলীলই নয়। নিছক ভুল ধারণা ও ধোকা মাত্র। এগুলোর উত্তর নিম্নে দেয়া গেল।


আরবী ভাষায় كُلٌُ  ও مَا শব্দদ্বয় ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কুরআন শরীফের প্রত্যেকটি শব্দ অকাট্য। এতে মনগড়া কোন শর্ত জুড়ে দিয়ে শব্দকে সীমিত অর্থে প্রয়োগ করা জায়েয নয়। কুরআন শরীফের ব্যাপকতা নির্দেশক শব্দগুলোকে ‘হাদীছে আহাদ’ দ্বারাও সীমিত অর্থে গ্রহণ করা যায় না। এমতাবস্থায় নিজস্ব কোন যুক্তি বা রায়ের ভিত্তিতে সীমিত অর্থে প্রয়োগের প্রশ্নই উঠে না।

   

(১) كُلاُّ شَيْئٍ বলতে সীমাহীন বোঝা যায় না বরং এ দ্বারা সীমাবদ্ধতাই বোঝা যায়। 


❏তাফসীরে কবীরে وَاَحْصَى كُلَّ شَئٍ عَدَدًا এর ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


قَلْنَا لاَشَكَّ اِنْ اَحْصَاءَ الْعَدَدِ اِنَّمَا يَكُوْنُ فِى الْمُتَّنَاهِىْ فَاَمَّا لَفْظَةُ كُلٌُ شَيْئٍ فَاِنَّهَا لاَتَدُلُّ عَلَى كَوْنِه غَيْرَ مُتْنَا هِىْ لِاَنَّ الْشَئَ عِنْدَنَا هُوَالْمَوْ جُوْدَا وَالْمَوْ جُوْدَاتُ مُتَنَا هِيَةٌُ فِى الْعَدَدِ.


-‘‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে সংখ্যা দ্বারা গণনার বিষয়টি সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই সম্ভবপর। কিন্তুكُلاُّ شَيْئٍ  (প্রত্যেক জিনিস) শব্দ দ্বারা ঐ বস্তুর সীমাহীনতার অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমাদের মতে شَيْئٍ জিনিস) বলতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, শুধু তা’ই বোঝায় এবং যাবতীয় অস্তিত্ববান বস্তু সীমাবদ্ধতার গন্ডীতে আবদ্ধ।’’ 

{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে ফকীরঃ সূরাঃ জ্বিন, আয়াতঃ ২৮ এর ব্যাখ্যা।}

  

❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ একই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে,


وَهَذَهِ الْاَيَةُ مِمَّا يَسْتَدَلُّ بِهِ عَلَى اَنَّ الْمَعْدُوْمَ لَيْسَ بِشَيْئٍ لاَنَّهُ لَوْ كَانَ شَيْئًا لَكَانَتِ الْاَشَيُاء غَيْرَ مُتَنَاهِيَةٍ وَكَوْنُهُ اَحْصَى عَدَدًهَا يَقْتَضِىْ كَوْنَهَا مُتَنَاهِيَةً لِاَنُّ اِحْصَاءَ الْعَدَدِ اِنَّمَا يَكُوْنُ فِى آلْمُتَنَاهِىْ.


-‘‘এ আয়াত দ্বারা এ কথাটির বড় প্রমাণ মেলে যে, যা’ কিছু অস্তিত্বহীন উহা شَيْئٍ ‘বস্তু’ বলে গণ্য নয়। কেননা যদি এটা বস্তু (অস্তিত্ববান) বলে গণ্য হয়, তাহলে অস্তিত্ববান সবকিছুই সীমাহীন হয়ে যায়। অথচ বস্তুসমূহ গণনা বা শুমারীর আওতাভুক্ত এবং যা’ কিছু গণনার আওতায় আসে, উহা কেবল সীমাবদ্ধতার পর্যায়ভুক্ত হতে পারে। 

{ইসমাঈল হাক্কী, তাফসীরে রুহুল বায়ান, ১০/২০৩পৃ.দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন}

  

(২) তাফসীরকারকদের মধ্যে অনেকেই كُلاُّ شَيْئٍ বলতে কেবল শরীয়তের আহাকামকে ধরে নিয়েছেন বটে, কিন্তু আবার অনেকেই আহকামকে বা সামগ্রীক ইলমে গায়বের প্রতি নির্দেশ করেছেন। চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী যখন কিছু প্রমাণ ইতিবাচক ও আর কিছু নেতিবাচক হয়, তখন ইতিবাচক প্রমাণগুলিই গৃহীত হয়।


❏সুবিখ্যাত ‘নুরুল আনোয়ার’ গ্রন্থে تَعَارُضْ (অসঙ্গতি বা বিরোধ) শীর্ষক আলোচনায় উল্লে­খিত আছে- 

وَالْمُثْبِتُ اَوْلَى مِنَ النَّافِىْ  

অর্থাৎ- স্বীকৃতি জ্ঞাপক প্রমাণ অস্বীকৃতি নির্দেশক প্রমাণ হতে অপেক্ষাকৃত উত্তম। যে সমস্ত তাফসীরের উদ্ধৃতি আমি ইতিপূর্বে উল্লে­খ করেছি, সেগুলোতে যেহেতু বেশীরভাগ প্রমাণই স্বীকৃতি সূচক, কাজেই উহাই গ্রহণযোগ্য। অধিকন্তু স্বয়ং হাদীছ এ সুপ্রসিদ্ধ উলামায়ে উম্মতের উক্তিসমূহ দ্বারা এর তাফসীর করে আমি দেখাবো যে এমন কোন অণুপরমাণু নেই, যা’ হুযুর পুর-নুর (ﷺ) এর জ্ঞানানুভূতিতে আসেনি, এবং আমি এ গ্রন্থেরই ‘পেশ কালাম’ শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লে­খ করেছি যে, কুরআনের হাদীছে ভিত্তিক তাফসীর অন্যান্য তাফসীর সমূহ থেকে উন্নত। সুতরাং হাদীছের সমর্থনপুষ্ট তাফসীরই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে।


এও উল্লে­খ্য যে, যে সকল তাফসীরকারক كُلاُّ شَيْئٍ এর তাফসীরে ‘আহকামে দ্বীনকে’ বোঝাতে চেয়েছেন, তারাওতো অন্যান্য বিষয় বা বস্তুর সম্পকর্ীয় জ্ঞানের অস্বীকৃতির কথা বলেন নি। সুতরাং, আপনারা অস্বীকৃতির কথা কোথা থেকে আবিষ্কার করলেন? কোন বিষয়ের উল্লে­খ না করলে যে সে বিষয়ের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়, একথা বলেন কিভাবে? 


❏কুরআন শরীফে আছে,

تَقِيْكَمُ الْحَرَّ 

তোমাদের কাপড় তোমাদেরকে উত্তাপ থেকে রক্ষা করে। এরূপ উক্তি থেকে কি একথা বোঝা যাবে যে, কাপড় আমাদেরকে শীত থেকে রক্ষা করে না? একথাতো কুরআনে উল্লে­খ করা হয়নি। অধিকন্তু, ‘দ্বীন’ বললেও সবকিছুকেই বোঝায়। জগতে এমন কি বিষয় আছে, যার উপর দ্বীনের আহকাম হালাল হারাম ইত্যাদি প্রযোজ্য হয় না? ঐ সকল মুফাস্সিরতো এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন যে দ্বীনি ইলম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, একথা বললে সব কিছুর জ্ঞানকে বোঝানো হয়।


(৩) বিলকীস ও অন্যান্যাদের কাহিনীতে যে كُلاُّ شَيْئٍ বলা হয়েছে, সেখানে এমন আলামত বা লক্ষণ মওজুত আছে, যা’র ফলে একথা পরিষ্কারূপে প্রতীয়মান হয় যে, كُلاُّ شَيْئٍ দ্বারা রাজত্বের কাজ কারবার সম্পকর্ীয় প্রত্যেক কিছুই বোঝানো হয়েছে। সেখানে উক্ত শব্দ দ্বারা এর ব্যবহারিক অর্থের দিকে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে এমন কি লক্ষণ আছে, যে কারণে শব্দের আসল অর্থ বাদ দিয়ে তার ব্যবহারিক অর্থই গ্রহণ করা যাবে?

আরও লক্ষ্যণীয় যে, কুরআন করীম সেখানে ‘হুদহুদ’ পাখীর উক্তিকে নকল করেছে মাত্র। হুদহুদ বলেছিল, وَأُوتِيَتْ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ -‘বিলকিসকে প্রত্যেক কিছুই দেয়া হয়েছে।’  

{সূরাঃ আন-নামল, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ১৯}

  

স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এ খবর দেন নি। হুদহুদের ধারণা ছিল যে বিলকিস সারা দুনিয়ার সবকিছুই পেয়ে গেছেন। কিন্তু এখানে মুস্তাফা عليه السلامের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলেছেন, تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْئٍ (প্রত্যেক কিছুর সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত)। হুদহুদ ভুল বলতে পারে কিন্তু আল্লাহর কালামতো ভুল হতে পারে না। হুদহুদতো আরও বলেছিল وَلَهَا عَرْشً عَظِيْمٌُ (তাঁর এক বিরাট আরশ আছে) তাহলে বিলকিসের সিংহাসন কি আরশ আযীমই ছিল? বস্তুতঃ কুরআনের অন্যান্য আয়াত থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, كُلاُّ شَيْئٍ দ্বারা এখানে জগতের সবকিছুকেই বোঝানো হয়েছে। 


❏কুরআনেই ইরশাদ হয়েছে,


وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ.


-‘‘আর্দ্র শুষ্ক এমন কোন জিনিস নেই, যা’ লওহে মাহফুজে বা কুরআনে করীমে নেই।’’ 

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৫৯, পারাঃ ৭}


এছাড়া সামনে উল্লে­খিত বিভিন্ন হাদীছ, উলামা ও মুহাদ্দিছীনের উক্তি থেকেও এ কথার জোরালো সমর্থন পাওয়া যাবে যে জগতের প্রত্যেক কিছুর জ্ঞান হুযুর পুর-নুর (ﷺ) কে দান করা হয়েছিল।


আমি ইনশা আল্লাহ ‘হাযির-নাযির’ শিরোনামের আলোচনায় বর্ণনা করবো যে মৃত্যুর ফিরিশতা হযরত আযরাইল (عليه السلام) এর সামনে সারা জগৎটাই যেন একটা থালার মত। আর ইবলীস এক পলকে সারা পৃথিবী ঘুরে আসে। এ কথা দেওবন্দীগণও স্বীকার করেন যে আমাদের নবী (ﷺ) এর জ্ঞান সৃষ্টিকূলের সামগ্রিক জ্ঞান থেকে বেশী। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, হুজুর (ﷺ) এর  সমগ্র সৃষ্টির জ্ঞান রয়েছে। আমি ‘পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান’ علوم خمسه শীর্ষক আলোচনায় হযরত আদম (عليه السلام) ও তাক্বলীদ লিখায় নিয়োজিত ফিরিশতার জ্ঞান সম্পর্কে আলোকপাত করবো, যা’ দ্বারা বোঝা যাবে যে গুরুত্বপূর্ণ ‘পঞ্চ বিষয়ের’ জ্ঞান তাদেরও রয়েছে। যেহেতু হুজুর (ﷺ) সমস্ত সৃষ্টিকূল থেকে বেশী জ্ঞানী, কাজেই, হুযুর আলাইহসি সালাম যে এসব বিষয়ের জ্ঞান বরং তার চেয়ে অধিক জ্ঞানের অধিকারী একথা মেনে নিতে হবে বৈ কি। আমাদের দাবী সর্বাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত।


 

وَلِلَّهِ الْحَمْدُ (আল্লাহ যাবতীয় প্রশংসার অধিকারী)

Top