বিষয় নং-০৮: রাসূল (ﷺ) রওযা মোবারকের নূরানী মাটির সৃষ্টি হাদিসের পর্যালোচনা
❏ এই নিম্নের হাদিসটি থেকে কিছু মুনাফিকগণ রাসূল (ﷺ) কে রওযা মোবারকের নূরানী মাটির দ্বারা সৃষ্টি বলে থাকেন। অথচ উক্ত হাদিসটি একদিকে মাকতু ১৪৭
➥{তাবেয়ীদের নিজের কথাকে মাকতু হাদিস বলা হয়।}
❏ যা মারফূ হযরত জাবের (رضي الله عنه)-এর হাদিসের বিপরীত, অপরদিকে এই সনদটি জাল। সকল উসূলে হাদিসের কিতাবে রয়েছে মাকতু হাদিস যখন মারফূ হাদিসের বিপরীত হবে তা পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত হবে। হাদিসটি হলো:
عَنْ كَعْبِ الْأَحْبَارِ قَالَ: لَمَّا أَرَادَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنْ يَخْلُقَ مُحَمَّدًا أَمَرَ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ، فَأَتَاهُ بِالْقَبْضَةِ الْبَيْضَاءِ الَّتِي هِيَ مَوْضِعُ قَبْرِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعُجِنَتْ بِمَاءِ التَّسْنِيمِ فَغُمِسَتْ فِي أَنْهَارِ الْجَنَّةِ وَطَيَّفَهَا فِي السَّمَاوَاتِ، فَعَرَفَتِ الْمَلَائِكَةُ مُحَمَّدًا صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبْلَ أَنْ يُعْرَفَ آدَمُ،..
-“হযরত কাব আহবার (তাবেঈ) বলেন: যখন আল্লাহ তা’য়ালা তার নবীকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, তখন তিনি হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) কে তাঁর রওজা মোবারক থেকে এক মুষ্টি الْبَيْضَاءِ তথা আলোকময় বস্তু আনতে নির্দেশ দেন। যা রাসূল (ﷺ) এর রওজা মোবারকে রাখা ছিল। তারপর সেখান থেকে মুষ্টি পরিমান অংশ জান্নাতের তাসনীম নহর দিয়ে খামিরা বানানো হয়। আর তা আসমান ও জমীনে তাওয়াফ করানো হয়। আর ফেরেস্থারা তাঁর মর্যাদা বুজতে ও চিনতে পারল আদম (عليه السلام) সৃষ্টি বহু পূর্বে। তারপর নূরে মুহাম্মদী আদম ﷺ এর পৃষ্টদেশে রাখলে তারা তা দেখতে লাগল......।”
(ইমাম ইবনে জাওযী: ‘আল ওয়াফা বি’আহওয়ালিল মুস্তাফা’, হাদিস নং ৮; ইমাম ত্বীবি: শরহে মেসকাত, ১১তম খণ্ড, ১১৩৬ পৃ: ৫৭৩৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৫৭৩৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; ইবনে আসাকির: তারিখে দামেস্ক, ১ম খণ্ড, ৩৪৯ পৃ:; ইমাম ইবনে জাওযী: কিতাবুল মওজুয়াত, ১ম খণ্ড, ২৮১ পৃ:; তারিখুল খামিছ, ১ম খণ্ড, ২১ পৃ:; ইমাম খারকুশী: শারফুল মুস্তফা, ১ম খণ্ড, ৩০০ পৃ:)
পর্যালোচনা:
❏ এ হাদিস দিয়ে অনেকে বলেন যে, রাসূল (ﷺ)-এর দেহ মুবারককে রওজা শরীফের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই নবীজি (ﷺ) রওজা পাকের মাটির তৈরী। অথচ এই হাদিসে কোথাও মাটির কথা উল্লেখ নেই। বরং বলা হয়েছেبِالْقَبْضَةِ الْبَيْضَاءِ অর্থাৎ এক মুষ্টিالْبَيْضَاءِ তথা আলোময় বস্তু আনলেন। উল্লেখ্য যে, ইমাম কাস্তালানী ও ইমাম হালাবী এই হাদিসের মতনকে কিছুটা পরিবর্তন করেছেন। হাদিসটি মূলত ৫ম হিজরীর মুহাদ্দেস ইবনে আসাকির (رحمة الله) এর ‘তারিখে দামেস্ক’ ও ৬ষ্ঠ হিজরীর মোহাদ্দেছ আল্লামা ইবনে জাওযী (رحمة الله) এর ‘আল-ওয়াফা’ এর মধ্যে, ইমাম খারকুশী তার ‘শরফুল মুস্তফা’ এর মধ্যে, আল্লামা দিয়ারবকরী (رحمة الله) তার ‘তারিখুল খামিস’ কিতাবে এভাবেই বর্ণনা করেছেন। যেখানে মাটির খামিরার কথা নেই। তাদের থেকে ইমাম ত্বীবি (رحمة الله), মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) অনুরূপ নকল করেছেন। যারা ইমাম কাস্তালানী ও হালাভীর বহু পূর্বের মুহাদ্দিস ও ইমাম। সুতরাং মূল মতনের কিতাব ও পূর্বের কিতাবের মতন’ই প্রাধান্য পাবে। প্রাচিন ও মূল কিতাবে বিষয়টি রয়েছে “بِالْقَبْضَةِ الْبَيْضَاءِ অর্থাৎ এক মুষ্টিالْبَيْضَاءِ তথা আলোময় বস্তু আনলেন।” আর পরবর্তীতে কেউ কেউ এটা পরিবর্তন করে লিখেছেন أن يأتيه بالطينة -“মাটির খামিরা আনলেন।” মূলত মাটির খামিরার কথাটি সঠিক নয় বরং আলোময় সাদা বস্তুর কথাটি সঠিক।
সর্বোপরি এই হাদিসের কোন প্রকার সনদই নেই। এখন ইহাকে সহীহ্ কিংবা হাসান বা যঈফ বলতে হলে সে হাদিসের তেমন সনদ প্রয়োজন। আর সনদবিহীন কোন কথা হুজ্জাত বা দলিল হবে না।
❏ উক্ত সনদ সর্ম্পকে আল্লামা জুরকানী বলেন,
وتضعيف بعض المتأخرين جدًا له باحتمال أنه من الكتب القديمة وقد بدلت غير مسموع، فإن التضعيف إنما هو من جهة السند
-‘‘উক্ত হাদিসটিকে কতিপয় পরবর্তী ইমামগণ সনদটিকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন, ......আর এ আপত্তিটা হচ্ছে সনদের ব্যাপারে।’’ ১৪৮
➥{ইমাম জুরকানি, শারহুল মাওয়াহেব, ১/৮২ পৃ.}
❏ এরপরে হযরত কা’ব আহবার (رحمة الله) একজন তাবেয়ী, তিনি এই কথা কোন সাহাবী কিংবা রাসূল (ﷺ) এর রেফারেন্স দিয়ে বলেননি বরং নিজের ইজতেহাদের কথা বলেছেন। অপরদিকে তাঁর বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে যা ইমাম যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন যে,
وعن كُتُب أهل الكتاب
-‘‘তিনি আহলে কিতাব থেকে বর্ণনা করতেন।’’
(ইমাম যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, ২/২১৪ পৃ.)
তাই তিনি ইসরাঈলী রেওয়ায়েত বর্ণনার অভিযোগ থাকায় তিনি কোনো সাহাবীর মাধ্যমে বর্ণনা না করলে তা যাচাই বাছাই ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূলে পাক (ﷺ) এর সহীহ্ রেওয়াতের মোকাবেলায় এরূপ মাথা-মুন্ডু বিহীন কথা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে! যদি এর নির্ভরযোগ্য কোন সনদ থাকত তাহলে তাবেয়ীর কথা হিসেবে ইহা ‘মাকতু’ পর্যায়ের রেওয়ায়েত হতো। সকলেই অবগত আছেন কোন আইনী বিষয়ে ‘মাকতু’ রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি ইহা সহীহ্ ও মারফূ রেওয়াতের খেলাফ বা বিপরীত এবং মওদ্বু বা বানোয়াট রেওয়ায়েত।
❏ এবার হযরত কা’ব আহবার (رحمة الله) এর আরেকটি রেওয়াত লক্ষ্য করুন:
أنه لما خلق الله تعالى آدم، ألهمه أن قال: يا رب، لم كنيتني أبا محمد، قال الله تعالى: يا آدم ارفع رأسك، فرفع رأسه فرأى نور محمد في سرادق العرش فقال: يا رب، ما هذا النور؟ قال: هذا نور نبى من ذريتك اسمه فى السماء أحمد، وفى الأرض محمد، لولاه ما خلقتك ولا خلقت سماء ولا أرضا.
-“নিশ্চয় যখন আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হল, তখন হযরত আদম (আ.) আল্লাহ পাকের দরবারে আবেদন করেছিলেন, হে আল্লাহ! আমার উপনাম ‘আবু মুহাম্মদ’ রাখা হল কেনো? আল্লাহ পাক বললেন: হে আদম! তোমার মাথা উপরের দিকে উঠাও। আদম (আ.) মাথা উঠিয়ে দেখলেন তাঁর চোখের সামনে আরশের পর্দায় নূরে মুহাম্মদী ভেসে উঠল। আদম (আ.) আরজ করলেন: হে আল্লাহ! এই নূর মোবারক কার? মহান আল্লাহ বললেন: এই ‘নূর’ হল ঐ নবীর যিনি তোমার বংশধরের একজন, যার আম আসমানে আহমদ এবং জমীনে তাঁর নাম মুহাম্মদ। যদি আমি তাঁকে না বানাতাম তাহলে তোমাকেও বানাতাম না, এমনকি আসমান জমীনও বানাতাম না।”
(ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খণ্ড, ৭০ পৃ:; ইমাম জুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ১ম খণ্ড, ৮৫ পৃ:; জাওয়াহিরুল বিহার, ৩য় খণ্ড, ৩৫২ পৃ:)।
যাকে সৃষ্টি না করলে মাটির জমীন সৃষ্টি করা হত না তিনি কিভাবে ঐ জমীনের মাটির তৈরী হন?! হযরত কাব আহবার (رحمة الله) এর এই রেওয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই নূর ছিলেন। আসমান-যমীন এমনকি হযরত আদম (عليه السلام)ও আমাদের নবী ﷺ এর উসিলায় সৃষ্টি হয়েছে (সুবহানাল্লাহ)।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! ইতোপূর্বের আলোচনা থেকে প্রতিয়মান হলো উক্ত হাদিসটির সনদ জাল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তাই সকলের উচিত মওদ্বু বা জাল রেওয়ায়েত বর্ণনা না করে সে হাদিসটি বর্ণনা করা।