❏ হাদিস :বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার পর নবীজী (ﷺ) কে সালাম দেয়ার ধরণ সম্পর্কে ধোঁকা



ওই বর্ণনায় আছে,

فَلَمَّا قُبِضَ، قُلْنَا: السَّلَامُ عَلَى النَّبِيِّ

“অতঃপর তিনি বেসালপ্রাপ্ত হলে আমরা পাঠ করি ‘আস্ সালামু আ’লান্ নাবিই’, অর্থাৎ, নবী পাক (ﷺ)-এর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।[৩৩]


আফসোস, নিশ্চয় হাদীস ও এজমা’কে লঙ্ঘন করাই গোমরাহীর মূল।

উপরন্তু, (ﷺ) হতে এমন প্রামাণিক বর্ণনাসমূহ বিদ্যমান, যেগুলো জ্ঞাত করে যে আমাদের আমলনামা তাঁর সামনে রওযা-এ-আক্বদসে পেশ করা হয়, যেমনিভাবে তাঁর কাছে পেশ করা হয় আমাদের সালাত ও সালাম। এমন কিছু ফেরেশতা সম্পর্কে আরো প্রামাণিক বর্ণনাসমূহ আছে, যাঁরা উম্মতের কেউ নবী করীম (ﷺ)-এর প্রতি সালাত-সালাম পেশ করলে তা হুযূর (ﷺ)-এর রওযা শরীফে পৌঁছে দেন। এ ছাড়াও ’তাওয়াতুর’ (দ্ব্যর্থহীন ক্বুরআনের আয়াত ও হাদীসের মতো ভিন্ন ভিন্ন সূত্র দ্বারা সমর্থিত একটি সার্বিক অর্থ) ও এজমা’ প্রমাণ করে যে (ﷺ) তাঁর মোবারক রওযায় (বরযখ) জীবনে জিন্দা। আর তাঁর পবিত্র শরীর মোবারকেরও ক্ষয় নেই। এতো সবের পরে মহানবী (ﷺ)-এর শাফাআত প্রার্থনাকালে তাঁকে সম্বোধন করা যাবে না, এই দাবি কেউ কীভাবে উত্থাপন করার দুঃসাহস দেখাতে পারে? এটা কি তাশাহহুদে তাঁকে সম্বোধনের চেয়ে ভিন্নতর কোনো কিছু?


দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আলবানী অযৌক্তিকতায় একগুঁয়ে এবং তিনি গোমরাহীতেও নিমজ্জিত, ঠিক যেমনিভাবে তার অন্ধ অনুসারীরাও একগুঁয়ে ও পথভ্রষ্ট।


এই হলো আমার কৃত আলবানীর রদ। আর হামদী সালাফীর বিষয়ে বলবো, তাকে আলাদাভাবে খণ্ডনের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা তিনি স্রেফ আলবানীরই প্রতিধ্বনি করেন।


এখানে আরেকটি বিষয় আমার বলা উচিত যে, হাদীসের প্রামাণিকতা বা দুর্বলতার ব্যাপারে আলবানীর ওপর নির্ভর করা যায় না; কারণ তিনি মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে নিয়মিত নানা ধরনের অপকৌশল প্রয়োগ করে থাকেন, আর উলামাবৃন্দের কথাকে বিকৃত করে তাঁদের মতামত বর্ণনায় তিনি নিজ আস্থার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করাকে মোটেও ঘৃণা করেন না। অধিকন্তু, তিনি এজমা’র বিরোধিতা করা এবং বিনা দালিলিক প্রমাণে নস্ তথা ধর্মশাস্ত্রলিপির রহিতকরণের (‘নাসখ’-এর) দাবি উত্থাপন করার হঠকারিতা-ও দেখিয়েছেন। ফেক্বাহ-শাস্ত্রের মৌলনীতি ও এস্তেম্বাত তথা শরঈ আইন-কানুন বের করার নিয়ম সম্পর্কে তার অজ্ঞতার কারণেই তিনি এই সীমালঙ্ঘন করেছেন।


আলবানী দাবি করেন যে, শাফায়াত প্রথা নিষেধ করে এবং মহানবী (ﷺ)-এর মোবারক নাম উচ্চারণের সময় ‘সাইয়্যেদিনা’ লক্বব/খেতাবটি ব্যবহারে মানুষকে বারণ করে, আর বেসালপ্রাপ্ত পুণ্যাত্মাবৃন্দের খাতিরে ক্বুরআন মজীদ পাঠে বাধা দিয়ে তিনি বেদআত তথা ধর্মে প্রবর্তিত নতুন প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। তবে প্রকৃত ঘটনা হলো, আল্লাহ যে বিষয়ের অনুমতি দিয়েছেন তা নিষেধ করে এবং আশ’আরীদের [৩৪]ও সূফীবৃন্দের প্রতি [৩৫] গালমন্দ করে তিনি নিজেই আসল বেদআত সংঘটন করেছেন। 


তথ্যসূত্রঃ



[৩৪] নোট: আশ’আরী (আল-আশআ’ইরা) হচ্ছে সেই মুতাকাল্লিমীন তথা ধর্মতাত্ত্বিকদের মাযহাব, যাঁরা মু’তাযেলা ও আরবীয় দার্শনিকদের মতো পথভ্রষ্ট দলগুলোর প্রবর্তিত বিভ্রান্তি হতে রক্ষাকল্পে যৌক্তিক দৃষ্টিকােণ থেকে ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসকে সমর্থনের উদ্দেশ্যে বিকাশ লাভ করেন। এঁরা ক্বুরআন ও সুন্নাহকে প্রশ্নাতীতভাবে সত্য এবং এই দুটো উৎসের কর্তৃত্বকে চূড়ান্ত জ্ঞান করতেন। এতদসত্ত্বেও তাঁরা মনে করতেন ক্বুরআন ও সুন্নাহের শিক্ষা যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নুসূস্ তথা পবিত্র ধর্মশাস্ত্রলিপিগুলোর সঠিক উপলব্ধি এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ও অগ্রাধিকারের কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁরা যুক্তি প্রয়োগ করতেন। আশ’আরীবৃন্দ অাল্লাহতা’লার নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করতেন; কেননা সেটা যুক্তি দাবি করে এবং মোহকামাহ (প্রকাশ্য আদেশ) ও কাতে’ঈ (স্পষ্ট) ধর্মশাস্ত্রীয় দলিলাদি প্রচার করে। আশ’আরীবৃন্দ অভিমত ব্যক্ত করেন যে আল্লাহ একাই চির অস্তিত্বশীল সত্তা। তাঁর এই অস্তিত্ব অত্যাবশ্যক বলে জ্ঞাত এই কারণে যে এ বিশ্বজগত, যেটা অপরূপ সুন্দর এক বিস্ময়কর ও মস্তিষ্ক-ধাঁধানো নিখুঁত সৃষ্টিকর্ম, সেটার জন্যে প্রয়োজন এক উৎসমূল তথা স্রষ্টার, যিনি সমস্ত অস্তিত্বশীল সত্তার প্রধান কারণ হওয়া সত্ত্বেও নিজে সকল কারণের উর্ধ্বে অবস্থান করছেন। বাকি সব কিছু তাঁরই সাপেক্ষে হয়তো অস্তিত্বশীল, আবার হয়তো অনস্তিত্বশীল-ও। তাঁর অস্তিত্ব অত্যাবশ্যক হয়ে তিনি সকল ধরনের পরিবর্তনের অতীত; অনাদি ও অনন্ত; অথচ প্রতিটি বস্তুরই আরম্ভ আছে, আর সেটা পরিবর্তন ও লয়প্রাপ্তি সাপেক্ষ। অধিকন্তু, অবশ্য অস্তিত্বশীল এই সত্তা তাঁর পবিত্র যাত (সত্তা) ও গুণাবলী উভয় ক্ষেত্রেই অনন্য। কোনো সৃষ্টি-ই তাঁর (যাতী) সিফাত তথা সত্তাগত বৈশিষ্ট্যাবলীর কোনোটির শরীকদার নয়, আর তিনিও কোনো সৃষ্টির গুণাবলীর কোনোটি দ্বারা গুণান্বিত নন। ফলে তিনি দেহবিশিষ্ট নন, অণুকণার অংশ দ্বারাও গঠিত নন; তাঁর কোনো দিক বা সীমা যেমন নেই, তেমনি স্থান বা কাল দ্বারাও তিনি আবদ্ধ নন। তিনি আমাদের কল্পনারও অতীত। তিনি এ জগতের (অভ্যন্তরে) যেমন নন, তেমনি এর বাইরেও নন; পৃথিবীর সাথে যেমন সংশ্লিষ্ট তিনি নন, তেমনি পৃথকও নন। যদিও তিনি অস্তিত্বশীল, আর তাঁর এই অস্তিত্ব অত্যাবশ্যক, তবুও আমরা তাঁর অস্তিত্বের প্রকৃতি উপলব্ধি করতে অক্ষম।

[৩৫] নোট: সূফীবৃন্দ হলেন সেই পুণ্যাত্মা, যাঁরা অভ্যন্তরে তথা অন্তরের গভীরে শরীয়তকে অনুসরণ করেন, যার দরুন তার প্রভাব বাইরে দৃশ্যমান হয়; উপরন্তু তাঁরা শরীয়তকে বাহ্যিকভাবেও অনুসরণ করেন, যার দরুন তার প্রভাব অন্তস্তলে দৃশ্যমান হয়। এটাই হচ্ছে শায়খ শরীফ আল-জুরজা’নী কর্তৃক নিজ ‘আল-তা’রিফাত’ গ্রন্থে প্রদত্ত সূফীবাদের সংজ্ঞা। এটা এমন এক বিদ্যা যার উদ্দেশ্য আত্মার পরিশুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের পুনর্গঠন, যাতে সূফী/দরবেশবৃন্দ আল্লাহর অস্তিত্বের প্রকৃত সচেতনতার মাঝে বেঁচে থাকেন, আর মহান প্রভু তাঁদের যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তাতে শৈথিল্যের মধ্যে তাঁদের যেন তিনি না পান, আর তিনি তাঁদের যা বারণ করেছেন, তাতেও লিপ্ত না পান। এই দিক থেকে সূফীবাদ একটি বৈধ ইসলামী বিদ্যা। বরঞ্চ এটা একটা উচ্চতর বিদ্যা। এতদসত্ত্বেও এই জ্ঞান আক্বায়েদ (আক্বীদা-বিশ্বাস), ফেক্বাহ, উসূলে ফেক্বাহ, ক্বুরআনের তাফসীর, হাদীসের নীতিমালা, আরবী ব্যাকরণ, বালাগ্বাত (আরবী ভাষাতত্ত্ব)-এর মতো অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের পরিপূরক এবং সেগুলোর ওপর নির্ভরশীল-ও। যদি সূফীবাদ বৈধর্মিক বিবৃদ্ধি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেও, তবুও তা তার বৈধ ও মহৎ বিদ্যা হওয়াকে রহিত করেনি, ঠিক যেমনিভাবে ইহুদী ও খৃষ্টানদের মিথ্যে লোক-বিদ্যার বিবৃদ্ধি ক্বুরআন মজীদের তাফসীরকে বৈধ ও মহৎ বিদ্যা হওয়া থেকে রহিত করেনি। তাফসীরবিদ ইমামবৃন্দ যেমন ভেজাল বস্তু ওই বিদ্যাশাস্ত্র হতে দূর করে সেটাকে পরিশুদ্ধ এবং সেটার সঠিক/নির্ভুল নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করেছেন, ঠিক তেমনি সূফীবাদের ইমামবৃন্দ-ও এই শাস্ত্রকে অবৈধ বস্তু হতে পরিশুদ্ধ করেছেন। শায়খ আবদুল ক্বাদির আল-জিলানী (رحمة الله) হতে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন, “আমি আমার সময়কার ভণ্ড সূফীদের থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”।

Top