বিষয় নং-৬: আবদুল মুস্তফা এবং গোলামে নবী নাম রাখা:
দেওবন্দীরা বলে, আব্দুল মুস্তফা, আবদুন নবী, গোলাম রসুল, গোলাম নবী ইত্যাদি নাম রাখা শিরক। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীগণ বলে এ নামগুলো রাখা বৈধ এবং বরকতের কারণ। কেননা আল্লাহ তা‘য়ালা কুরআনে পাকে বলেন-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ
-“বলুন হে রাসূল (ﷺ)! হে আমার ওই সমস্ত বান্দারা যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো? আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হয়ো না।” (২৭ পারা, তৃতীয় রুকু, সূরা যুমূর, আয়াত নং- ৫৩)
দেওবন্দীদের বুযুর্গ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (رحمة الله) এই আয়াতে কারিমা সামনে রেখে বলেন, কেননা হুযুর (ﷺ)’র হলেন আল্লাহর সাথে মিলানো ওয়ালা, সেজন্য ইমদাদুল্লাহকে ইবাদুর রাসূল বলা যায়। যেমন, আল্লাহ তা‘য়ালা ইরশাদ করেন-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ
এই আয়াতে মুতাকালিম জমিরটির মারজা বা উদ্দেশ্য হল রাসূলে কারিম (ﷺ)। (ইমদাদুল মুশতাক, ৯৩ পৃষ্ঠা)
মওলবী আশরাফ আলী থানবী:
মওলবী আশরাফ আলী থানবীও এর উপর লেখেন যে, করীনাও এই অর্থের চাহিদা রাখে। পূর্বে বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। এর মারজা যদি আল্লাহ হতেন তবে مِنْ رَحْمَتِى তথা আমার রহমত হতে বলা হত, যাতে (عِبَادِي) তথা আমার বান্দার সাথে সাদৃশ্য হয়। (ইমদাদুল মুশতাক, ১৩ পৃষ্ঠা)
আলা হযরত আজীমুল বরকত ইমাম আহমদ রেযা খান ফাজেলে বেরলভী (رحمة الله) বলেন,
يا عبادى كہ كے ہم کو شاه نے ۞ اپنا بنده كرليا پهر تجہ كو كيا
‘‘ইবাদী,তে সম্বোধনে আমাদের নবি
নিজ বান্দা করে নিলে তবে তোমার কী?’’
সায়্যিদুনা উমর ফারুক (رضي الله عنه)৮৯’র আকিদা:
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (رضي الله عنه) ও নিজেকে আবদুল মুস্তফা বলেছেন, যেমন, রেওয়ায়েতে এসেছে-
عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، قَالَ: لَمَّا وَلِيَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ ؓ، خَطَبَ النَّاسَ عَلَى مِنْبَرِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ ، فَحَمِدَ اللَّهَ، وَأَثْنَى عَلَيْهِ، ثُمَّ قَالَ: أَيُّهَا النَّاسُ: إِنِّي وَاللَّهِ قَدْ عَلِمْتُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تُؤْنِسُونَ مِنِّي شِدَّةً وَغِلَظًا، وَذَلِكَ أَنِّي كُنْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ، وَكُنْتُ عَبْدَهُ وَخَادِمَهُ
-‘‘হযরত উমর ( যখন খলিফা নিযুক্ত হলেন তখন তিনি রাসূলে পাক (ﷺ)’র মিম্বরে আরোহণ করে মানুষের সম্মূখে বললেন খোতবা দান করেন। আল্লাহর প্রশংসা করার পর বলেন, হে লোক সকল! আমি জেনেছি যে, আপনারা আমাকে খুব বেশি ভালবাসতেন। এটা এ জন্য যে আমি রাসূল (ﷺ)’র সাথে ছিলাম। আমি তার বান্দা এবং তার খাদেম।’’ ৯০
টিকা━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
৮৯.
❏ হযরত উমর (رضي الله عنه)’র শানে রাসূলে করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন,
إِنَّ اللَّهَ جَعَلَ الحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ وَقَلْبِهِ.
-“হযরত উমর (رضي الله عنه)’র জবান এবং অন্তরে আল্লাহ তা‘য়ালা সত্য প্রকাশ করেছেন।’’
(ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, ৬/৫৮পৃষ্ঠা, হা/৩৬৮২, ইমাম আবু নুয়াইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া, প্রথম খণ্ড, ৪২ পৃষ্ঠা, ইমাম মহিবুদ্দীন তবারী, রিয়াদুন নাযারা ফি মানাকিবে আশারা, ২/২৯৮ পৃ., ইবনুল কাইয়্যুম, ইলামুল মুয়াক্কিইন, দ্বিতীয় খণ্ড, ২৫৭ পৃষ্ঠা, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, কানুযুল উম্মাল, ১১/৫৭৩ পৃ. হা/৩২৭১৪, ইমাম তাবরানী, মু‘জামুল আওসাত, হা/২৮৯, ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ৩/৯৩ পৃ. হা/৪৫০১, তিনি বলেন, হাদিসটি সহীহ মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ, যাহাবী তাঁর সাথে একমত পোষণ করেছেন। ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ, ৯/১৪৪ পৃ. হা/৫১৪৫, ইমাম আসেম, আস-সুন্নাহ, ২/৫৮১ পৃ. হা/১২৪৭, মুসনাদে বায্যার, ১৪/১২২ পৃ. হা/৭৬২১, সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬৮৮৯)
❏ রাসূলে পাক (ﷺ) আরো ইরশাদ করেন,
عُمَرُ مَعِي وَأَنَا مَعَ عُمَرَ، وَالْحَقُّ بَعْدِي مَعَ عُمَرَ حَيْثُ كَانَ
-“উমর আমার সাথে আমি ওমরের সাথে, আমার পর সত্য ওমরের সাথেই থাকবে। তিনি যেখানে থাকুক না কেন?’’
(ইমাম সুয়ূতি, জামেউস সগীর, দ্বিতীয় খণ্ড, ৬৬ পৃষ্ঠা, হা/৮২৪৪, ইবনে হাজার মক্কী, আস-সাওয়ায়িকুল মুহরিকা, ৯৭ পৃ., ইমাম তাবরানী, মু‘জামুল আওসাত, ৩/১০৪ পৃ. হা/২৬২৯, ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী, ফাযায়েলে খুলাফায়ে রাশেদীন, ১/৩৯ পৃ. হা/১১, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, কানুযুল উম্মাল, ১১/৫৭৭ পৃ. হা/৩২৭৩৫, ইমাম সুয়ূতি, জামেউল আহাদিস, ১৪/৩১৪ পৃ. হা/১৪৩৭৬)
❏ হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)সহ আরও অনেক সাহাবী বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ سِرَاجُ أَهْلِ الْجَنَّةِ
-‘‘হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, হযরত উমর (رضي الله عنه) জান্নাতবাসীদের প্রদীপ স্বরূপ।’’
(ইমাম আহমদ, ফাযায়েলুস সাহাবা, ১/৪২৮ পৃ. হা/৬৭৭, ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী, ফাযায়েলে খুলাফায়ে রাশেদীন, হা/৫৭, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৫৭৭ পৃ. হা/৩২৭৩৪, ইমাম সুয়ূতি, জামেউল আহাদিস, ১৪/৩১৩ পৃ. হা/১৪৩৭৫)
❏ ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (رحمة الله) সংকলন করেন-
عَنْ مَالِكٍ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، حَدَّثَنِي سَعِيدُ بْنُ الْمُسَيِّبِ، حَدَّثَنِي أَبُو هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ سِرَاجُ أَهْلِ الْجَنَّةِ
-‘‘হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, হযরত উমর (رضي الله عنه) জান্নাতবাসীদের প্রদীপ স্বরূপ।’’
(ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৬/৩৩৩ পৃ. এবং ফাযায়েলে খুলাফায়ে রাশেদীন, ৭০ পৃ. হা/৫৬, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৫৭৭ পৃ. হা/৩২৭৩৪, ইমাম সুয়ূতি, জামেউল আহাদিস, ১৪/৩১৩ পৃ. হা/১৪৩৭৫)
(ফক্বীর মুহাম্মদ জিয়াউল্লাহ কাদেরী)
৯০.
ক. ইমাম ইবনে আসাকীর, তারিখে দামেস্ক, ৪৪/২৬৪ পৃ. ক্রমিক. ৯৮০৭
খ. মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, কানুযুল উম্মাল, ৫/৬৮১ পৃ. হা/১৪১৮৪
গ. আল্লামা কামালুদ্দীন দামিরী, হায়াতুল হাইওয়ান, প্রথম খণ্ড, ১৮৭ পৃষ্ঠা
ঘ. আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ, ইযালাতুল খাফা, দ্বিতীয় খণ্ড, ৬৩ পৃষ্ঠা
ঙ. ইমাম ইসমাঈল ইসমাঈল ইস্পহানী, সিরু সালফে সালেহীন, ১/১২৭ পৃ.
চ. ইমাম মহিবুদ্দীন তবারী, রিয়াদুন নাযারা ফি মানাকিবে আশারা, ২/৩১৫ পৃ.
━━━━━━━━━━━o━━━━━━━━━
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আপনারা দেখলেন যে, হযরত সায়্যিদুনা উমর (رضي الله عنه)’র আকিদা, যাঁর সম্পর্কে রাসূলে কারিম (ﷺ) ইরশাদ করেন-
وفر ذلك الشيطان من ظل عمر
-“ওমরের ছায়ার কারণে শয়তান দূরীভূত হয়।” (কামালুদ্দীন ইবনে আদীম (ওফাত. ৬৬০ হি.), বাগীয়াতুল তলাব ফি তারিখে হালব, ৫/২৩৫৭ পৃ.)
এই মর্যাদাবান উমর (رضي الله عنه) কে দেওবন্দীরাও রাসূল (ﷺ) মিম্বারে বসে জুম’আর দিন স্বরণ করেন। মিম্বারে এবং মেহেরাবের সৌন্দর্য ইসলামের ইজ্জত হযরত উমর (رضي الله عنه) মিম্বারে বসে হাজার হাজার সাহাবা তাবেয়ীনদের সামনে যেখানে হযরত উসমান (رضي الله عنه) এবং হযরত আলী (رضي الله عنه) উপস্থিত ছিলেন। হামদ ও ছানা বর্ণনা করার পর নিজ খিলাফতের আদিষ্ট হয়ে বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) বান্দা এবং খাদেম।
সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه) গণের মধ্যে কেউ এটা বলে আপত্তি করেন নি যে, হে উমর (رضي الله عنه)! আপনি শিরক করছেন। সায়্যিদুনা উমর (رضي الله عنه) সাহাবী এবং তাবেয়ীগণের উপস্থিতিতে মিম্বারে রাসূলের বসে নিজে নিজেকে আবদুল মুস্তফা এবং আবদুন নবী বলা এবং সাহাবায়ে কেরামগণ (রা:) কোন আপত্তি না করাই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه), তাবেয়ীন এজাম (رضي الله عنه) এবং উপস্থিত সকলের আকিদাও এটা ছিল। এরূপ নাম এবং নিসবতকে তাঁরা শিরক মনে করেননি বরং এরূপ আকিদা পোষণকারীকে মুমিনে কামিল মনে করেছেন।
রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেন-
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ
-“আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতকে তোমরা আকড়ে ধর।” ৯১
৯১. খতিব তিবরিযি, মিশকাত শরীফ, ১/৫৮ পৃ. হা/১৬৫, তিরমিযী শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড, ৯২ পৃষ্ঠা, সুনানে ইবনে মাজাহ, ১/২৮ পৃষ্ঠা, হা/৪২, সুনানে আবি দাউদ, ৪/২০০ পৃ. হা/৪৬০৭, সুনানে দারেমী, ১/২২৮ পৃ. হা/৯৬, মুসনদে আহমদ, ২৮/৩৭৩ পৃষ্ঠা, হা/১৭১৪৪, ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, প্রথম খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা, হা/৩২৯
সুতরাং রাসূলে পাক (ﷺ)’র উক্ত ইরশাদ এবং হযরত উমর (رضي الله عنه), হযরত উসমান (رضي الله عنه), হযরত আলী (رضي الله عنه) এবং অপরাপর সাহাবীদের সামনে নিজে নিজেকে ‘আবদুল মুস্তফা’, ‘আবদুন নবী’ স্বীকার করাকে সামনে রেখেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের হাযারাতগণ আবদুল মুস্তফা এবং আবদুন নবী নাম রাখেন।
আ‘লা হযরত আজিমুল বরকত ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ আহমদ রেযা খাঁন (رحمة الله) যে, সীল ব্যবহার করতে তাতেও লেখা ছিল “আবদুল মুস্তফা মুহাম্মদ আহমদ রেযা খান বেরলভী।”
আল্লামা আবুন্নুর মুহাম্মদ বশীর সাহেব কুটলই এজন্যই বলেন-
مير سے عبد المصطفى احمد رضا تيرا القلم
دشمنان مصطفے كے واسطے شمشير ہے
‘‘মম ‘আবদুল মোস্তাফা আহমদ রেযার লেখনির্ভর
দুশমনে নববীর গ্রীবাদেশে শানিত খঞ্জর।’’
বর্তমান সময়ের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম ইমাম আল্লামা আজহারী যার মূল নাম সদরুশ শরীয়া আল্লামা আমজাদ আলী (رحمة الله), তিনি তাঁর নাম আবদুল মুস্তফা রেখেছেন। দেওবন্দীরা এই নামকে শিরক বলে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জাম‘আত এই নাম রাখেন। হযরত উমর (رضي الله عنه) নিজে নিজেকে আবদুল মুস্তফা, আবদুন্নবী বলার কারণে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হল যে, এ নামকে যারা শিরক বলে তারা দেওবন্দী, আহলে সুন্নাত ওয়াল জাম‘আত নয়।