দ্বিতীয় অধ্যায়
নবীগণের নিষ্পাপ হওয়া সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তি সমূহ এবং এসবের জবাব
আপত্তি সমূহের বিস্তারিত জবাবের আগে ভূমিকা স্বরূপ মোটামুটি একটি জবাব নবীগণ নিষ্পাপ হওয়াটা নিশ্চিত ও সর্বসম্মত বিষয়। যেসব হাদীছ দ্বারা নবীগণের গুনাহ প্রমাণ করা হয়, যদি সে সব হাদীছ মুতওয়াতির ও সুস্পষ্ট না হয়, বরং হাদীচে মশহুর বা হাদীছে আহাদ হয়ে থাকে, কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না, যদিওবা তা বিশুদ্ধ হয়ে থাকে।
❏ তাফসীরে কবীরে সূরা ইউসুফের তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে- যে সব হাদীছ আম্বিয়া কিরামের বিপক্ষে, সে সব গ্রহণীয় নয়। নবীকে গুনাহগার সাব্যস্ত করার চেয়ে বর্ণনাকারীকে ভ্রান্ত বলাটা অনেক সহজ। এবং সে সব কুরআনী আয়াত ও হাদীছে মুতওয়াতির, যে গুলোর দ্বারা নবীগণের মিথ্যা বলা বা অন্য কোন গুনাহ প্রমাণিত হয়, সে সব হাদীছ বা আয়াতের অবশ্যই তাবিল (ব্যাখ্যা) করতে হবে; সে সবের বাহ্যিক অর্থ কখনও হতে পারে না বা এ সব ঘটনা নবুয়াতের আগের বলে ধরে নিতে হবে।
❏ তাফসীরাতে আগমদীয়ায় لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ আয়াতের ব্যাখ্যা ৫৬৯ প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে -৫৭০
واذا تقرر هذا فما نقل عن الانبياء مما يشعر بكذب او معصية فما كان منقولا بطريق الاحاد فمردود و ما كان منقول بطريق التواتر فمصروف عن ظاهره ان امكان و الا فمحمول على ترك الاولى او كونه قبل البعثت
-‘‘এ ইবারতের অর্থ তাই, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে) ‘মুদারেজুন নাবুয়াত’ কিতাবের প্রথম খণ্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-এ ধরনের আয়াত মুতশাবিহাত আয়াতের মত, তাই এ সব ক্ষেত্রে নীরব থাকা বাঞ্ছনয়ি। দেখুন, আল্লাহ তা’আলা কুদ্দুস, গণী, আলীম, কাদিরে মতলক ইত্যাদি পরিপূর্ণ গুণে গুণান্বিত হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সর্বসম্মত অভিমত রয়েছে, কিন্তু কতেক আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এর বিপরীত প্রতিভাত হয়।
➥569. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১২৪
➥570. আল্লামা মোল্লা জিওন, তাফসিরে আহমদিয়া, পৃষ্ঠা-৩৩।
❏ যেমন- আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ
-‘‘ওরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয় এবং আল্লাহ তাদেরকে।’’৫৭১
➥571. সূরা নিসা, আয়াত নং-১৪২।
❏ অন্যত্র ইরশাদ ফরমান-
مَكَرُوا مَكْرَهُمْ
-‘‘তারা ফন্দি করেছিল এবং আল্লাহও ফন্দি করেছেন।’’৫৭২
➥572. সূরা ইবরাহিম, আয়াত নং-৪৬।
❏ আর এক জায়গার ইরশাদ ফরমান-
فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ
-‘‘তোমরা যে দিকে মুখ কর, সে দিকেই আল্লাহর মুখ আছে।’’ ৫৭৩
➥573. সূূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১১৫।
❏ আরও ইরশাদ ফরমান-
يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ
-‘‘তোমাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত।’’ ৫৭৪
➥574. সূরা ফাতহ, আয়াত নং-১০।
❏ ইরশাদ ফরমান-
ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
-‘‘অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন।’’ ৫৭৫
➥575. সূরা রা’দ, আয়াত নং-২।
আল্লাহ তা’আলা হাত, মুখ, ধোকা, ফন্দি ইত্যাদি থেকে পাক-পবিত্র, কিন্তু উপরোক্ত আয়াতে বাহ্যতঃ সে সব প্রমাণিত হয়। সুতরাং সে সব আয়াতের তাবিল অবশ্য কর্তব্য। এর আসল অর্থ আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া চাই। এসব আয়াত দ্বারা যদি কেউ আল্লাহকে কলঙ্কিত মনে করে, সে বেঈমান। অনুরূপ যদি কেউ কতেক আয়াতের বাহ্যিক অর্থ করে আম্বিয়া কিরামকে ফাসিক বা মুশরিক মনে করে, সে ধর্মদ্রোহী। এ একটি উত্তরই ইন্শাআল্লাহ সমস্ত আপত্তির গোড়া কেটে দেবে। তবুও আমি আরও কিছু বিস্তারিতভাবে আপত্তি সমূহের উত্তর দিচ্ছি।
১নং আপত্তিঃ
ইবলিস হযরত আদমকে সিজ্দা না করে খোদার নাফরমানী করেছে। হযরত আদম (عليه السلام)ও গুনদুম খেয়ে একই অপরাধ করেছেন। উভয়কে একই রকম শাস্তিও দেয়া হয়েছে, ইবলিসকে ফিরিশতাদের জামাত ও বেহেশ্ত থেকে বহিঙ্কার করা হয়েছে এবং আদম (عليه السلام) কেও দুনিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আদম (عليه السلام) পরে তওবা করে ক্ষমা পেয়েছেন, কিন্তু ইবলিস তওবা করেনি। তাই বোঝা গেল যে আদম (عليه السلام) নিষ্পাপ ছিলেন না।
উত্তরঃ
শয়তান আদমকে সিজ্দা না করে গুনাহগারও হয়েছিল এবং শাস্তিও পেয়েছে। কিন্তু হযরত আদমের গুনদুম খাওয়ার মধ্যে কোন অপরাধ ছিল না এবং তাঁকে কোন শাস্তিও দেয়া হয়নি। কেননা শয়তান সুস্পষ্টভাবে সিজ্দা করতে অস্বীকার করেছে, বরং খোদার নির্দেশকে ভুল মনে করে খোদার সাথে তর্ক করার দুঃসাহস দেখিয়েছে-
خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ
-‘‘তুমি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করছে আর ওকে সৃষ্টি করেছে মাটি দ্বারা।’’ ৫৭৬
➥576. সূূূূরা ছোয়াদ, আয়াত নং-৭৬।
শাস্তিস্বরূপ আল্লাহর তরফ থেকে ইরশাদ হলো-
قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ (৭৭) وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِي إِلَى يَوْمِ الدِّينِ
-‘‘তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কারণ তুমি অভিশপ্ত, এবং কিয়ামত পর্যন্ত তোমার প্রতি লানত রইল।’’ ৫৭৭
➥577. সূরা ছোয়াদ, আয়াত নং-৭৭-৭৮।
দুনিয়াটা শয়তানের জন্য ‘কালা পানি’ পাঠিয়ে দেয়ার মত শাস্তি। সে কিয়ামত পর্যন্ত এখানে লাঞ্চনা, গঞ্জনা, ও ‘লা হওলা’ এর বেত্রাঘাত ভোগ করবে। অথচ আদম (عليه السلام) সম্পর্কে কুরআন করীম বার বার ঘোষণা করেছেন- ‘তিনি ভুলে গিয়েছিলেন’ ‘গুনাহের কোন ধারণাও করেননি’ ইত্যাদি।
❏ যেমন কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান-
فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا
-‘‘তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, আমি তাঁকে অটল পাইনি।’’৫৭৮
➥578. সূরা ত্বোহা, আয়াত নং-১১৫।
❏ অন্যত্র ফরমান-
فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ
-‘‘অতঃপর শয়তান তাঁদেরকে ধোঁকা দিয়েছে।’’ ৫৭৯
➥579. সূূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৩৬।
❏ আর এক জায়গায় ইরশাদ করা হয়েছে-
فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ
-‘‘শয়তান তাঁদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়েছে।’’ ৫৮০
➥580. সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-২০।
মোট কথা হলো এ ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী শয়তানকে করা হয়েছে। আর তাঁদের বেলায় বলা হয়েছে ধোঁকা খেয়েছেনম ভুল করেছেন। ধোঁকাটা হচ্ছে- আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে বলেছিলেন-ওই বৃক্ষের কাছে যেও না’। শয়তান তাঁদেরকে ধোঁকা দেয়ার মানসে বলেছিল আপনাদেরকেতো ওদিকে যেতে নিষেধ করেছে, কিন্তু ফল খেতেতো আর বারণ করেনি। ঠিক আছে, আমি এনে দিচ্ছি, আপনারা খেয়ে নিন।’ মিথ্যা কসম খেয়ে আরও বললো এ ফল খুবই উপকারী এবং আমি একজন আপনার একান্ত শুভাকাঙ্খী। হযরত আদম (عليه السلام) মনে করেছিলেন যে খোদার নামে কেউ মিথ্যা কসম খেতে পারে না বা উপরোক্ত لاتقربا কে হালকা নিষেধাজ্ঞা সূচক নির্দেশ মনে করেছেন। এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ আমার তফ্সীরে নঈমীর প্রথম পারায় উক্ত আয়াতের তফসীর দেখুন। এ পর্যন্ত যা বললাম, তাতে উভয়ের কার্যক্রমের পার্থক্যটা প্রতিভাত হলো। এবার আলোকপাত করতে হয় দুনিয়াতে অবতরণের রহস্য নিয়ে। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পৃথিবীতে খিলাফতের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন।
❏ যেমন কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান -৫৮১
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
বেহেশতের মধ্যে তাঁকে কিছু দিনের জন্য রাখা হয়েছিল;
➥581. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৩০।
এ জন্য যে তিনি যেন তথাকার ঘরবাড়ী, বাগবাগিচা ইত্যাদি দেখে অনুরূপ যাতে পৃথিবীতে আবাদ করতে পারেন। তাই বেহেশ্তটা তাঁর জন্য ছিল ট্রেনিং সেন্টারের মত, যেথায় কোন শিক্ষানবীশকে সব সময়ের জন্য রাখা হয় না। আর তাঁকে কাঁদায়ে পাঠানো হয়েছিল এ জন্য যে ফিরিশ্তাগণ এ কান্না ছাড়া বাকী সব রকমের ইবাদত করেছেন। এ ক্রন্দনের বদৌলতেই মানুষ ফিরিশ্তা থেকে আফযল হলো। আসলে খোদার প্রেমে বান্দাকে কাঁদানোই উদ্দেশ্য ছিল; বেহেশ্তটা ছিল একটা উপলক্ষ মাত্র। অনেক সময় আল্লাহর প্রিয়জনদের ভুল নেক বান্দাদের জন্য কল্যাণ কর হয়ে থাকে।
درد دل كے واسطے پيدا كيا انسان كو
ورنه طاعت كے لئے كچه كم نه تهے كرو بياں
اے خيال يار كيا كر ناتها او ركيا كرديا
تو توپرده ميں رها اور مجه كور سوا كرديا
-‘‘ব্যথিত হৃদয়ের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, নতুবা খোদার বন্দেগীর জন্য মখলুকের অভাব নেই। ওগো, কি করার ছিল আর তুমি কি করে দিয়েছ? তুমিতো পর্দার অন্তরালে রয়েছ; আর এদিকে আমাকে নাজেহাল করেছ।’’
এ ভেদ তিনিই বুঝবেন যিনি প্রেমানন্দ সম্পর্কে অবগত।
❏ দেখুন, আল্লাহ তা’আলা শয়তানকে বলেছেন-
قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا
এখান থেকে বের হয়ে যাও।’’ ৫৮২
➥582. সূরা আ‘রাফ, আয়াত নং-১৮।
❏ আর আদম (عليه السلام) এর বেলায় বলা হয়েছে-
اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا
তোমরা সকলে এখান থেকে অবতরণ কর।’’ ৫৮৩
➥583. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৩৮।
❏ এরপর বলা হয়েছে- তোমরা মাত্র কিছু দিনের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ করছ, পুনরায় তোমাদের কোটি কোটি সন্তান সহকারে এখানে ফিরে আসবে। বুযুর্গানে কিরাম বলেন আদম (عليه السلام)কে বেহেশত থেকে বের করা হয়নি বরং আমরাই তাঁকে ওখান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি কেননা তাঁর পৌরুষে কাফির ফাসিক সবার রূহ ছিল। এবং সে গুলো বেহেশ্তের অনুপযোগী ছিল। তাই নির্দেশ দেয়া হলো ওহে আদম (عليه السلام), পৃথিবীতে গিয়ে ওসব দুষ্ট আত্মাকে ওখানে রেখে এসো। (মিরকাতের الايمان بالقدر অধ্যায়ে ও রূহুল বয়ানের فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
২। পৃথিবীতে শয়তানের আগমন বিদেশ গমনের মতো কিন্তু আদম (عليه السلام) এর জন্য বিদেশ নয়, কেননা আদম হচ্ছে শরীর ও রুহের সমষ্টির নাম এবং পৃথিবীর মাটি দ্বারা যেহেতু তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু পৃথিবীটা তাঁর মরীরের দেশ আর রুহের জগতটা (বেহেশত) তাঁর আত্মার দেশ। সুতরাং জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আগমন আর ইন্তিকালের পর পৃথিবী থেকে জান্নাতে গমন কোনটাই তাঁর জন্য বিদেশ নয়। কিন্তু শয়তান যেহেতু অগ্নির সৃষ্টি সেহেতু পৃথিবীটা তার জন্য বিদেশ সদৃশ।
৩। পৃথিবীতে আগমনটা যদি আদমের জন্য শাস্তি স্বরূপ হতো, তাহলে কখনও তাঁকে খলীফা মনোনীত করা হতো না, তাঁর মস্তকে কখনও নবুয়াতের মুকুট স্থাপন করা হতো না এবং তাঁর বংশে আম্বিয়া, আওলিয়া বিশেষ করে সৈয়্যদুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভার হতো না। অপরাধী ক্ষমাপ্রাপ্ত হলে জেলখানা থেকে মুক্তি পায়। আবার অনেক সময় শাহী দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে নানাভাবে পুরষ্কৃত করা হয়। কিন্তু তা কখনও জেলখানায় রেখে করা হয় না। আসলে বড়দের বাহ্যিক ভুলত্রুটি অনেক সময় ছোটদের জন্য আর্শীবাদে পরিণত হয়। যেমন পৃথিবীর সমস্ত নিয়ামত সেই আদি ভুলের মাশুল। মজার ব্যাপার হালো আদম (عليه السلام) এর জন্য গুনদুম খাওয়াটা অপরাধ সাব্যস্ত হলো অথচ তাঁর সন্তানদের জন্য এটা অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে মনোনীত হলো।
২নং আপত্তিঃ হযরত আদম ও হাওয়া (عليه السلام) তাঁদের এক সন্তানের নাম আবদুল হারিছ রেখেছিলেন। অথছ হারিছ হচ্ছে শয়তানের নাম। এ প্রসঙ্গে কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান:
فَلَمَّا آتَاهُمَا صَالِحًا جَعَلَا لَهُ شُرَكَاءَ
-‘‘যখন তিনি তাদেরকে এক নেক বান্দা দান করেন, তারা একে আল্লাহর শরীক বানিয়েছে।’’ ৫৮৪
➥584. সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-১৯০।
এতে বোঝা গেল যে আদম (عليه السلام) এর এ কাজ শিরক ছিল। তাই প্রমাণিত হলো যে নবীগণ শিরকও করে থাকেন। হাকিমের বর্ণনা মতে এ আয়াতে আদম-হাওয়াকে বোঝানো হয়েছে।
উত্তরঃ
❏ এ ধরনের কলঙ্ক থেকে হযরত (عليه السلام) একেবারে পূত-পবিত্র। আপত্তিকাররী এ আয়াত দ্বারা ধোঁকা দিতে চেয়েছে। তাফসীর কারকদের মধ্যে অনেকেই উপরোক্ত আয়াতে جَعَلَا ক্রিয়া পদের কর্তা কুসাই ও তার স্ত্রী বলে মত প্রকাশ করেছেন। কেননা -৫৮৫
خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا
আয়াতের অর্থ হচ্ছে: ওহে কুরাইশ, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে একটি আত্মা অর্থাৎ কুসাই থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই কুসাইর স্ত্রীকে তার স্বজাতি থেকে সৃষ্টি করেছেন। ওর স্ত্রী আল্লাহর কাছে পুত্র প্রার্থনা করায় সে রাগ করে এর নাম আবদুল হারিছ রেখেছিল। (তফসীরে খাযায়েনুল ইরফান ইত্যাদি দেখুন)
➥585. সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-১৮৯।
❏ এ ধরণের অর্থে কোন আপত্তি নেই। আবার অনেকেই বলেছেন যে, جَعَلَا ক্রিয়ার মধ্যে مضاف (সম্বন্ধপদ) উহ্য রয়েছে এবং এর কর্তা হচ্ছে আদম-হাওয়ার সন্তান সন্ততি অর্থাৎ আদম ও হাওয়ার কতেক সন্তান র্শিক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। (রুহুল বয়ান, মদারেক ইত্যাদি তাফসীর দেখুন) এ কারণেই এর আগে বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে ➥586.সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-১৯০।
فَتَعَالَى اللَّهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
যদি এ ক্রিয়া পদের কর্তা আদম ও হাওয়া হতেন, তাহলে يُشْرِكُونَ অর্থাৎ দু’বচনের শব্দ প্রয়োগ করতেন, অধিকন্তু যেখানে একটি মামুলি ভুলের অর্থাৎ গুনদুম খাওয়ায় অসন্তোষের কারণ হয়ে গিয়েছিল, সেখানে র্শিক করার কারণে কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা অথচ কোন কিছু হলো না। হাকিমের এ বর্ণনাটা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তাঁর দলীলটা হচ্ছে একক রেওয়ায়েত। পক্ষান্তরে নবীগণ নিস্পাপ হওয়াটা হলো সুনিশ্চিত ও চূড়ান্ত অভিমত।
৩নং আপত্তিঃ
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى
আদম (عليه السلام) আল্লাহর নাফরমানী করলো, ফলে ভ্রমে পতিত হলো।’’ ৫৮৭
➥587. সূরা ত্বোহা, আয়াত নং-১২১।
এর থেকে আদম (عليه السلام) এর গুনাহ ও গুমরাহী উভয়টা বোঝা গেল।
উত্তরঃ
এখানে অপ্রকৃত অর্থে ভুলকে পাপ বলা হয়েছে এবং غَوي শব্দের অর্থ গুমরাহী নং বরং বিফল হওয়া অর্থাৎ চিরজীবন লাভের জন্য তিনি গুনদুম খেয়েছিলেন, কিন্তু তা হয়নি বরং গুনদুমের দ্বারা উপকারের পরিবর্তে অপকার হলো অর্থাৎ স্বীয় উদ্দেশ্য সাধন হলো না। এ আয়াত প্রসঙ্গে তফসীরে রূহুল বয়ানে উল্লেখিত আছে যে, যখন আল্লাহ তাআলা তাঁদের ভুলে যাওয়ার কথাটাই বার বার উল্লেখ করেছেন, তখন উক্ত আয়াতের عَصَى শব্দ থেকে গুনাহ প্রমাণ করা মানে খোদার কালামে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা।
৪নং আপত্তিঃ
❏ হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) চাঁদ সূর্য এমন কি তারকারাজিকে খোদা বলেছেন। যেমন তিনি قَالَ هَذَا رَبِّي -‘‘এটা আমার খোদা।’’ ৫৮৮
➥588. সূরা আনআম, আয়াত, নং- ৭৭
এ রকম বলাটা সুস্পষ্ট র্শিক। তাই প্রতীয়মান হলো যে তিনি প্রথমে র্শিক করেছিলেন। পরে তওবা করেছেন।
উত্তরঃ
❏ এর উত্তর ভূমিকাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) স্বীয় কওমকে প্রশ্নাকারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা কি আমার খোদা?
অতঃপর নিজেই দলীল সহকারে এর জবাব দিয়েছেন-
قَالَ لَا أُحِبُّ الْآفِلِينَ
-‘‘অস্তগামী বস্তু সমূহকে আমি পছন্দ করি না।’’ ৫৮৯
➥589. সূরা আনআম, আয়াত, নং- ৭৬
❏ কেননা এর আগে ইরশাদ করা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوقِنِينَ
-‘‘এভাবে হযরত ইব্রাহীমকে সৌরজগত ও বিশ্বজগত পরিচালনা ব্যবস্থা দেখিয়েছি, যাতে তিনি বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হন।’’ ৫৯০
➥590. সূরা আন’আম, আয়াত নং-৭৫।
❏ অতঃপর চাঁদ দেখার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এবং এর পর বলেছেন:
وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ
-‘‘আমার এ সব যুক্তি প্রমাণ হযরত ইব্রাহীমকে তাঁর কওমের মুকাবেলায় দিয়েছিলাম।’’ ৫৯১
➥591. সূরা আন’আম, আয়াত নং-৮৩।
এ সাজানো কথামালা থেকে জানা গেলে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ভূমণ্ডলের পরিচালন অবলোকন করে মন্তব্য করলেন। অতঃপর তারকারাজির গতিবিধি দেখে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা এর প্রশংসা করলেন। যদি তাঁর এ সব বক্তব্য র্শিক হতো, তাহলে প্রশংসা করা হলো কেন? বরং অসন্তুষ্ট হওয়ারই কথা ছিল।
৫নং আপত্তিঃ
হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) তিনবার মিথ্যা বলেছেন:
১। তিনি সুস্থ ছিলেন, কিন্তু কওমকে বলেছেন- إِنِّي سَقِيمٌ-‘‘আমি অসুস্থ।’’ ৫৯২
➥592. সূরা সাফ্ফাত, আয়াত নং-৮৯।
২। তিনি নিজে মূর্তি সমূহ ভেঙ্গেছেন, কিন্তু তাঁর সম্প্রদায় যখন জিজ্ঞাসা করলো, তখন বলেন-
بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا
-‘‘সেই বড় মূর্তিটা এ কাজ করেছে।’’ ৫৯৩
➥593. সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং-৬৩।
৩। নিজের স্ত্রী হযরত সারা (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেছেন- هذه اختى -‘‘ইনি আমার বোন।’’ মিথ্যা বলা নিঃসন্দেহে গুনাহ। সুতরাং তিনি নিষ্পাপ নন।
উত্তরঃ এর কয়েকটি উত্তর রয়েছে।
এক, বেগতিক অবস্থায় যখন নিজের জানের ঝুঁকি থাকে, তখন মিথ্যা বলা গুনাহ নয় বরং এ রকম বেগতিক অবস্থায় মুখ দিয়ে কুফরী শব্দ উচ্চারণ করারও অনুমতি রয়েছে।
যে সব অবস্থায় তিনি এ রকম কথা বলেছিলেন, তখন হয়তো জীবনের ঝুঁকি ছিল অথবা মান-সম্মানের প্রশ্ন ছিল। তখনই বোন বলেছিলেন, যখন সেই জালিম বাদশাহ তাঁর কাছ থেকে হযরত সারা (رضي الله عنه) কে জোর জবরদস্তি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল এবং অন্যান্য সময়ও জীবনের ঝুঁকি ছিল। যেমন বলেছিলেন بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ সুতরাং এ ধরনের বলাতে গুনাহ হতে পারে না।
দুই, ওসব কথা মধ্যে কোনটাই মিথ্যা ছিল না বরং একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন, যাকে তাওরিয়া বলা হয়। প্রয়োজন বোধে তাওরিয়া জায়েয। যেমনঃ
❏ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম জনৈকা বৃদ্ধা সাহাবীকে বলেছিলেন কোন বৃদ্ধা বেহেশ্তে যাবে না।
❏ এক ব্যক্তি তাঁর (ﷺ) কাছে একটি উট চেয়েছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন- তোমাকে উটের বাচুর দেব। জনৈক সাহাবার চোখের উপর হাত রেখে তিনি (ﷺ) বলেছিলেন-এ গোলামকে কে ক্রয় করবে? ইত্যাদি (মিশ্কাত শরীফ المزاح অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
❏ তদ্রুপ হযরত সারা (رضي الله عنه)কে বোন বলা অর্থ বংশগত বোন নয়, এর দ্বারা দ্বীনি বোন বোঝানো হয়েছিল।
❏ যেমন হযরত দাউদ (عليه السلام) এর সমীপে দু’জন ফিরিশতা বাদী-বিবাদীর আকৃতি ধারণ করে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং আরয করেছিলেন- ইনি আমার ভাই, তার কাছে ৯৯টি গাভী আছে। ৫৯৪
➥594. সূরা ছোয়াদ, আয়াত নং-২৩।
এখানে ভাই ও গাভী শব্দদ্বয় রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ রকম إِنِّي سَقِيمٌ এর দ্বারা তাঁর ভবিষ্যত রোগাক্রান্ত হওয়ার কথা বোঝানো হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে ➥595.সূরা যুমার, আয়াত নং-৩০
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ বা سَقِيمٌ শব্দ দ্বারা মানসিক রোগের কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমার মন তোমাদের দ্বারা সন্তুষ্ট নয়। অনুরূপ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ বাক্যে كَبِيرُ শব্দ দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে বোঝানো হয়েছে এবং এর দ্বারা ওই দিকে ইশারা করা হয়েছে। কেননা কাফিরগণ আল্লাহ তা’আলাকে বড় খোদা এবং মূর্তিদেরকে ছোট খোদা মনে করে। তাই তিনি বলেছেন- এ কাজ সেই করেছেন, যাকে তোমরা বড় খোদা মনে কর। নবীর কাজকে খোদার কাজ বলা যায়। অথচ ওরা মনে করেছেন তিনি তাদের বড় মূর্তির কথা বলেছেন। অথবা তিনি শব্দটা সন্দেহ বোধক ভাবে বলেছেন অর্থাৎ বড় দেবতা হয়তো ভেঙ্গেছে। সন্দেহ বোধক শব্দ থেকে সত্য মিথ্যা বলার অবকাশ নেই। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা এ সব ঘটনা বর্ণনা করার পর হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) এর প্রতি কোনরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করেননি, বরং এসব তাঁর মনঃপুত হওয়ার সনদ দিয়েছেন।
❏ যেমন মূর্তি ভাঙ্গার বর্ণনার আগে ইরশাদ ফরমান ➥596. সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং-৫১।
وَلَقَدْ آتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ
এতে বোঝা গেল তাঁর এ কাজ সঠিক এবং পথপ্রদর্শক মূলক ছিল অথচ মিথ্যা কখনও সঠিক পথ হতে পারে না।
❏ অসুখের কথা বর্ণনা করার সময় ইরশাদ করেছেন ➥597. সূরা সাফ্ফাত, আয়াত নং-৮৪-৮৫।
إِذْ جَاءَ رَبَّهُ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ (৮৪) إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَاذَا تَعْبُدُونَ
এর দ্বারা বোঝা গেল যে তাঁর এ ধরনের কথা সঠিক মানসিকতার পরিচায়ক কিন্তু মিথ্যা কখনও তা হতে পারে না।
৬নং আপত্তিঃ হযরত দাউদ (رضي الله عنه) পরস্ত্রী অর্থাৎ উরিয়ার স্ত্রীকে কু-নযরে দেখেছিলেন, যার বর্ণনা সূরা ছোয়াদে রয়েছে। এ ধরনের আচরণ নিশ্চই অপরাধ।
উত্তরঃ
❏ ঐতিহাসিকগণ দাউদ (عليه السلام) এর কাহিনীর মধ্যে অনেক কিছু পরিবর্ধন করেছেন। তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন কি হাদীছ আহাদের মধ্যে যা বর্ণিত আছে, তাও অগ্রাহ্য। এ জন্য হযরত আলী (رضي الله عنه) ঘোষণা করেছিলেন-যে কেউ দাউদ (عليه السلام) এর কাহিনী গল্প গুজবের মত বর্ণনা করবে, আমি তাকে ১৬০ দোর্রা বেত্রাঘাত করবো। অর্থাৎ অপবাদের শাস্তি হচ্ছে ৮০ দোর্রা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হবে। (তাফসীরে রূহুল বয়ানে সূরা ছোয়াদে দাউদ (عليه السلام) এর কাহিনী দ্রষ্টব্য)
❏ আসল ঘটনা হচ্ছে উরিয়া নামক জনৈক ব্যক্তি একটি মহিলাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিল। হযরত দাউদ (عليه السلام)ও সেই প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং মহিলাটি দাউদ (عليه السلام) এর সাথেই বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। ওই লোকটির সাথে কোন বিবাহ হয়নি।
❏ যেমন- তাফসীরাতে আহমদীয়াতে- لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আছে-
وعن داود بكونه اقداما على الفعل المشروع وهو نكاح المخطوبة لاوريا لانظره منكوحته
কিন্তু যেহেতু এ বৈধ কাজ থেকেও নবুয়াতের শান অনেক উর্ধ্বে ও মহৎ, এ জন্যে আল্লাহ তা’আলা তাঁর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য করে একটি সাজানো মুকদ্দমা নিয়ে দু’জন ফিরিশ্তাকে তাঁর সমীপে পাঠিয়েছেন। মুকদ্দমাটি হচ্ছে তাদের মধ্যে একজনের কাছে ৯৯টি বকরী এবং অপর জনের কাছে একটি মাত্র বকরী আছে। কিন্তু ৯৯ টি বকরীর মালিক ঐ একটিও নিয়ে নিতে চায় এবং তাঁরা নিজেরাই বাদী বিবাদীর অভিনয় করে তাঁর থেকে বায় নিয়ে তাঁকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুবহান্নাল্লাহ, আল্লাহর কি শান! তার দরবারে কত সম্মান যে কী সুন্দরভাবে ওদেরকে ঘটনাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। (উল্লেখ্য যে এর আগে দাউদ (عليه السلام) এর আরও ৯৯ জন স্ত্রী ছিলেন) উক্ত ঘটনার দ্বারা তার শানই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এ বদনসব ধর্মদ্রোহীরা তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটিয়েছে। আল্লাহ পানাহ দিন।
৭নং আপত্তিঃ
হযরত ইউসুফ (عليه السلام) আযীয মিসিরের স্ত্রী জুলেখার সাথে পাপাচারের ইচ্ছে করেছিলেন। যেমন- আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন ➥598. সূূূরা ইউসুুফ, আয়াত নং-২৪।
وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ
অর্থাৎ জুলেখার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যদি না তিনি তাঁর প্রতিপালকের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতেন, জানি না কি অঘটন ঘটে যেত। দেখুন, এটা কত বড় গুনাহ ছিল, যা হযরত ইউসুফ (عليه السلام) থেকে প্রকাশ পেয়েছে।
উত্তরঃ হযরত ইউসুফ (عليه السلام) পাপাসক্ত তো দূরের কথা, এর কল্পনা থেকেও তিনি পবিত্র ছিলেন। যে বলে যে তিনি এ রকম উদ্দেশ্য করেছিলেন, সে কাফির।
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানে সেই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে ➥599. ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৩৮।
فمن نسب الى الأنبياء الفواحش كالعزم على الزنى ونحوه الذي يقوله الحشوية فى يوسف كفر لانه شتم لهم كذا فى القنية
আপত্তিতে উল্লেখিত আয়াতের দু’ধরনের তাফসীর করা হয়েছে-এক وَلَقَدْ পর্যন্ত পড়ে বিরতি দিন এবং هَمَّ থেকে পৃথক আয়াত শুরু করুন। তখন আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে জুলেখা ইউসুফ (عليه السلام) এর প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং তিনিও আসক্ত হতেন, যদি খোদার নিদর্শন না দেখতেন। এখন আর কোন আপত্তি রইলো না। আকলী বলুন বা নকলী বলুন, সবদিক থেকে সঠিক অর্থ হয়েছে।
❏ তাফসীরে খাযেনের মতে এর আসল ইবারত হচ্ছে ➥600. সূূূরা ইউসুুফ, আয়াত নং-২৪।
لَوْلا أَنْ رَأى بُرْهانَ رَبِّهِ
❏ তাফসীরে মাদারিক শরীফে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আছে-
ومن حق القارىء إذا قدر خروجه من حكم القسم وجعله كلاماً برأسه أن يقف على به ويبتدىء بقوله وهم بها
-‘‘ক্বারীদের উচিৎ به এর পর বিরতি দেয়া এবং وهم بها থেকে আয়াত শুরু করা।
➥601. ইমাম নাসাফী, তাফসীরে মাদারেক, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬০১।
❏ কিয়াসও তাই বলে, কেননা কুরআন করীম এ জায়গায় জুলেখার সব রকমের প্রস্তুতির বর্ণনা করেছেন ➥602. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৩।
وَغَلَّقَتِ الْأَبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ
সে তাঁকে সব রকমভাবে মোহিত করার চেষ্টা করেছে। তাঁকে কাছে ডেকেছে এবং দরজাও বন্ধ করেছিল।
❏ কিন্তু হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর অনিচ্ছা, ঘৃণা ও নিষ্পাপের কথাও সাথে সাথে বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ
-‘‘আল্লাহর দোহাই, সে আমার মুরব্বি, আমার প্রতি তার অনেক ইহসান রয়েছে। এ ধরনের আচরণ অন্যায় এবং অন্যায়কারী কখনও কামিয়াব হয় না।’’ ৬০৩
➥603. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৩।
❏ এর পর আরও বর্ণিত আছে ➥604. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৪।
كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ
এ আয়াতে الْفَحْشَاءَ এর দ্বারা যেনা এবং سُّوءَ এর দ্বারা যেনার উদ্দেশ্য করা বোঝানো হয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো যে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যেনার ধারণা থেকেও পবিত্র রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত জুলেখাও স্বীকার করেছে-
الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَا رَاوَدْتُهُ عَنْ نَفْسِهِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ
-আমিই তাঁকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলাম। তিনি সত্যবাদী।’’ ৬০৫
➥605. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৫১।
❏ এমনটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর দ্বারাও তাঁর নির্দোষিতা ও জুলেখার পঙ্কিলতার সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে ➥606. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৬।
وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِنْ أَهْلِهَا
❏ আযীয মিসিরও তাই বলেছেন ➥607. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৯।
يُوسُفُ أَعْرِضْ عَنْ هَذَا وَاسْتَغْفِرِي لِذَنْبِكِ إِنَّكِ كُنْتِ مِنَ الْخَاطِئِينَ
ওহে জুলেখা, তুমি পাপী, তুমি স্বীয় গুনাহ থেকে তওবা কর। দেখুন, দুগ্ধ পোষ্য শিশু, আযীয মিসির, স্বয়ং জুলেখা, এমনকি আল্লাহ তা’আলাও তাঁর নিষ্পাপ হওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যদি জুলেখার মত তিনিও পাপাসক্ত হতেন, তাহলে তিনিও দোষী সাব্যস্ত হতেন এবং এসব সাক্ষ্য মিথ্যা পরিণত হতো। আর যদি এতটুকুই হতো যে জুলেখাই পাপের সূচনা করেছিল। পরে তিনিও জড়িত হয়ে পড়েছেন। যদি ইউসুফ (عليه السلام) অবৈধ কাজ করার খেয়াল করতেন, তাহলে তাঁর তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার কথা নিশ্চয় বর্ণিত হতো।
❏ যেমন- তাফসীরে মদারেকে আছে ➥608. ইমাম নাসাফী, তাফসিরে মাদারেক, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৪।
ولأنه لو وجد منا ذلك لذكرت توبته واستغفاره
আসলে উপরোক্ত আয়াতের যথার্থ অর্থ হচ্ছে যে তিনিও (যেনার) মনস্থ করতেন, যদি খোদার নিদর্শন না দেখতেন। তাফসীরে কবীরে উল্লেখিত আছে যে لولا এর জবাব এর আগে উল্লেখিত বলেও ধরে নেয়া যায়। যেমন- উক্ত আয়াতের আগে বর্ণিত আছে ➥609. সূরা কাসাস, আয়াত নং-১০।
إِنْ كَادَتْ لَتُبْدِي بِهِ لَوْلَا أَنْ رَبَطْنَا عَلَى قَلْبِهَا
(তাফসীরে কবীরে ➥610. সূূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৪।
وَلَقَدْ هَمَّتْ এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
উক্ত আয়াতের অপর ব্যাখ্যা হলো به তে ওয়াক্ফ না করে بها পর্যন্ত একই বাক্য মনে করতে হবে এবং আয়াতের অর্থ দাড়াবে- নিশ্চয় জুলেখা ইউসুফ (عليه السلام) এর প্রতি আসক্ত এবং ইউসুফ (عليه السلام) জুলেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আয়াতে উল্লেখিত هم শব্দদ্বয়ের অর্থের মধ্যে নিশ্চয় পার্থক্য রয়েছে هَمَّتْ بِهِ দ্বারা যেনার খেয়াল বোঝানো হয়েছে এবং هَمَّ بِهَا দ্বারা হৃদয়ের অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে কোন ইচ্ছে শক্তি প্রকাশ পায় না। অর্থাৎ জুলেখা ইউসুফ (عليه السلام)কে কামনা করেছিল এবং ইউসুফ (عليه السلام) এর মনে অনিয়ন্ত্রিত সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, যা কোন অপরাধ বা গুনাহ নয়। যেমন- রোযায় ঠাণ্ডা পানি দেখলে মনে তৃষ্ণা জাগে, কিন্তু পান করার ইচ্ছেমতো দুরের কথা, কল্পনাও করা হয় না, কেবল শীতল পানি ভাল লাগে। যদি উভয় শব্দ একই অর্থবোধক হতো, তাহলে একই শব্দ দু’বার বলা হতো না। বরং
وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ
উভয়ে মনস্থ করেছিলেন।’’ ➥611. সূূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৪। বললেই যথেষ্ট হতো। দেখুন ➥612. সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-৫৪।
وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ
আয়াতে প্রথম مكر শব্দের অর্থ এক রকম এবং দ্বিতীয় مكر শব্দের ভাবার্থ অন্যরকম।
❏ তাফসীরে খাযেনে বর্ণিত আছে-
قال الإمام فخر الدين الرازي: إن يوسف عليه الصلاة والسلام كان بريئا من العمل الباطل والهم المحرم
-‘‘ইমাম ফখরউদ্দিন (رحمة الله) বলেছেন যে নিশ্চয় হযরত ইউসুফ (عليه السلام) খারাপ ধারণা ও অসৎ কাজ থেকে পবিত্র ছিলেন।’’ ৬১৩
➥613. ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, ২/৫২২
লক্ষ্যণীয় যে জুলেকা দরজার পাশে আযীয মিসিরকে দেখে ইউসুফ (عليه السلام) এর নামে যেনার অভিযোগ করেননি, বরং বলেছেন যে ইউসুফ (عليه السلام) যেনার উদ্দেশ্য করেছিলেন,
❏ যেমন- কুরআনে উল্লেখিত আছে-
قَالَتْ مَا جَزَاءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوءًا إِلَّا أَنْ يُسْجَنَ
-‘‘যে তোমার স্ত্রীর সাথে অবৈধ কাজ করার উদ্দেশ্য করে, তার জেল ব্যতীত অন্য কি শাস্তি হতে পারে?’’ ৬১৪
➥614. সূূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৫।
❏ এর প্রতিবাদে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) বলেছিলেন-
هِيَ رَاوَدَتْنِي عَنْ نَفْسِي
-‘‘অসৎ কাজের উদ্দেশ্য সেই করেছিল।’’ ৬১৫
➥615. সূূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৬।
দুগ্ধপোষ্য শিশুও ওর সাফাই গাওয়াকে ফাঁস করে দিয়েছিল। আযীয মিসির নিজেই হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর জামা ছেড়া দেখে বলেছিলেন انه من كيد كن মিসরের মহিলারাও জুলেখার অভিযোগকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছিল। এমন কি শেষ পর্যন্ত জুলেখা নিজেও তার দোষ স্বীকার করেছিল। তাই, যদি هَمَّ بِهَا এর অর্থ ইউসুফ (عليه السلام) যেনার উদ্দেশ্য করেছিলেন- এ রকম করা হয়, তাহলে বলতেই হয় যে আল্লাহ তা’আলা জুলেখার কথাকেই সত্যায়ন করেছেন এবং অন্যান্যদের বক্তব্যকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু এ ধরনের ভাবার্থ আসল বক্তব্যের বিপরীত। এ বর্ণনাটা যেন স্মরণ থাকে। ইন্শা আল্লাহ অনেক কাজে আসবে।
৮নং আপত্তিঃ
হযরত মুসা (عليه السلام) একজন কিব্তিকে জ্যান্ত মেরে ফেলেছিলেন। এবং বলেছেন-
هَذَا مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ
-‘‘এটা শয়তানী কাজ।’’ ৬১৬
➥616. সূরা কাসাস, আয়াত নং-১৫।
বোঝা গেল যে, তিনি জুলুমপূর্বক হত্যা করেছেন, যা বড় অপরাধ।
উত্তরঃ হত্যা করার উদ্দেশ্য মুসা (عليه السلام) এর ছিল না বরং জালিম কিব্তি থেকে মজলুম ইস্রাঈলীকে রক্ষা করাটাই উদ্দেশ্য ছিল। যখন কিব্তি লোকটাকে ছেড়ে দিচ্ছিল না, তখন তিনি (عليه السلام) ওকে হটিয়ে দেয়ার অভিপ্রায়ে একটি থাপ্পড় মেরে ছিলেন। কিন্তু নবুয়াতের বলে বলীয়ান উক্ত থাপ্পড় সে বরদাস্ত করতে পারেনি, যার ফলে মারা যায়। তাই এ হত্যাটা ছিল অনিচ্ছাকৃত বা ভুল বশতঃ এবং নবীদের ভুল হতে পারে। অধিকন্তু, এ ঘটনাটা নবুয়াত প্রাপ্তির আগে ঘটেছিল। যেমন রূহুল বয়ানে বর্ণিত আছে كان هذا قبل النبوة আর সেই কিবতিটা সংগ্রামী কাফির ছিল যাকে হত্যা করা অপরাধ ছিল না। তিনিতো মাত্র একজন কিব্তিকে হত্যা করেছেন; কিছুদিন পর সমস্ত কিব্তিকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। তবে তিনি (عليه السلام) যে এ কাজকে শয়তানী কাজ বলেছেন, এটা হচ্ছে তাঁর আজেযী ও একান্ত অনুতপ্ত ভাবের প্রকাশ মাত্র। কেননা আগাম কাজকেও তিনি অপরাধ মনে করেছেন। অর্থাৎ এ কাজটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে হয়ে গেল। কিব্তিদের ধ্বংসের সময় সেও ধ্বংস হয়ে যেত। فَغَفَرَلَهُ এবং إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي শব্দদ্বয় দ্বারা ধোঁকায় পতিত হয়ো না। এ শব্দগুলো ভুল ক্রটির বেলায়ও প্রযোজ্য হয়। অথবা উক্ত আয়াত দ্বারা কিব্তির জুলুমকে বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ এ জুলুম শয়তানী কাজ।
৯নং আপত্তিঃ
আল্লাহ তা’আলা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছেন-
وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى
-‘‘আপনি পথভ্রষ্ট ছিলেন, পরে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন।’’৬১৭
➥617. সূরা দ্বোহা, আয়াত নং-৭।
বোঝা গেল যে তিনি প্রথমে পথভ্রষ্ট ছিলেন, পরে হিদায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন।
উত্তরঃ যে এ আয়াতে উল্লেখিত ضَالٌّ এর অর্থ গুমরাহ বলে, সে নিজেই গুমরাহ। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى
-‘‘তোমাদের মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম না কখনও গুমরাহ হয়েছে, না বিপথগামী।’’ ৬১৮
➥618. সূূূরা নাজম, আয়াত নং-২।
উক্ত আয়াতে ضَالٌّ এর অর্থ খোদার প্রেমে বিভোর এবং هداى অর্থ সলুকের পদমর্যাদা। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা আপনাকে তাঁর প্রেমে বিভোর পেয়েছেন, তাই আপনাকে সলুকের মর্যাদা দান করেছেন। হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইয়েরা হযরত ইয়াকুব (عليه السلام) এর কাছে আরয করেছিল -৬১৯
➥619. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৯৫।
إِنَّكَ لَفِي ضَلَالِكَ الْقَدِيمِ
এখানে ضَالٌّ এর অর্থ হচ্ছে প্রেমে বিভোর। হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী স্বীয় ‘মুদারেজুন নাবুয়াত’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন- আরবীতে ওই ধরনের উচ্চ বৃক্ষকে ضَالٌّ বলে, যার দ্বারা পথহারা লোক পথের সন্ধান পায়। অর্থাৎ ওহে মাহবুব, আল্লাহ তা’আলা আপনাকে সুউচ্চ বৃক্ষের মত পথের দিশারী হিসেবে পেয়েছেন, যাকে আরশ ফরশ সব জায়গা থেকে দেখা যায়। সুতরাং আপনার ওসীলায় সবাইকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে। [এখানে هداى ক্রিয়ার কর্ম সাধারণ লোক, নবী (আ.) নয়] এ রকম আরও অনেক অর্থ করা হয়েছে।
১০ নং আপত্তিঃ
✦ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-
لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ
-‘‘যাতে আল্লাহ তা’আলা আপনার আগে পরে গুনাহ মাফ করে।’’ ৬২০
➥620. সূূরা ফাতহ, আয়াত নং-২।
এতে বোঝা গেল তিনি পাপী ছিলেন। হুযূর (ﷺ)ও প্রায় সময় তাঁর নিজের জন্য মাগফিরাতের দুআ করতেন। যদি তিনি গুনাহগার না হতেন, তাহলে এ মাগফিরাত কি জন্য কামনা করতেন?
উত্তরঃ এ আয়াতের কয়েকটি উত্তর রয়েছে-
এক, এখানে মাগফিরাত বলতে নিষ্পাপ এবং হিফাজত বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা যেন আপনাকে সবসময় গুনাহ থেকে পবিত্র রাখে।
✦ যেমন- রূহুল বয়ানে উল্লেখিত আছে ➥621. ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, ৯/৯
المراد بالمغفرة الحفظ والعصمة ازلا وابدا فيكون المعنى ليحفظك الله ويعصمك من الذنب المتقدم والمتأخر
‘‘দুই, ذَنْبِكَ শব্দের মধ্যে একটি مُضَافْ উহ্য আছে অর্থাৎ আপনার উম্মতের গুনাহ, যা لَكَ বলার দ্বারা বোঝা গেল। অর্থাৎ আপনার ওসীলায় যেন উম্মতের গুনাহ মাফ করে। যদি তাঁর (ﷺ) নিজের গুনাহ বোঝানো হতো, তাহলে لَكَ বলার কি প্রয়োজন ছিল।’’ (রূহুল বয়ান ও খাযেন দ্রষ্টব্য)
তিন, এ আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াতে করা হয়েছে, যেমন ➥622. সূরা নিসা, আয়াত নং-৭৪।
وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا
কোন সময় অপরাধের কথা অপরাধীকে লক্ষ্য করে বলা হয়, আবার কোন সময় অপরাধীর জিম্মাদারকে লক্ষ্য করে বলা হয়, যেমন মামলায় কোন সময় অপরাধী, আবার কোন সময় উকীলকে লক্ষ্য করে অপরাধের কথা বলা হয়। উকীল বলে থাকে এটা আমার মামলা, আমি এর জিম্মাদার। এখানেও সেই দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে- আপনার উম্মতের গুনাহ, যার শাফায়াতের জিম্মাদার হলেন আপনি।
১১ নং আপত্তিঃ
✦ আল্লাহ তা’আলা হুযূর (ﷺ)কে লক্ষ্য করে ইরশাদ ফরমান:
وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا
-‘‘যদি আমি আপনাকে অটল না রাখতাম, তাহলে কাফিরদের প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা ছিল।’’৬২৩
➥623. সূূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত নং-৭৪।
এর দ্বারা বোঝা গেল যে হুযূর (ﷺ) কাফিরদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা প্রতিরোধ করেছেন। আর কাফিরদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ারও গুনাহ।
উত্তরঃ এর কয়েকটি উত্তর রয়েছে। এক, এ আয়াতটা শর্ত ও জযা নিয়ে গঠিত শর্তযুক্ত পদ, যেথায় উল্লেখিত ঘটনাদ্বয় হওয়াতো দুরের কথা, সম্ভাবনা মনে করারও কোন প্রয়োজন নেই।
✦ যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র এরশাদ করেছেন-
قُلْ إِنْ كَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ فَأَنَا أَوَّلُ الْعَابِدِينَ
-‘‘যদি আল্লাহর কোন ছেলে হতো, আমি এর প্রথম পূজারী হতাম।’’ ৬২৪
➥624. সূূরা যুখরূফ, আয়াত নং-৮১।
কিন্তু না খোদার ছেলে হওয়া সম্ভব, এবং না নবী (ﷺ) কর্তৃক এর পূজা করা সম্ভব। উপরোক্ত আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক হুযূর আলাইহিস সালামের হিফাজত না করা যেমন অকল্পনীয়, তেমন হুযূর আলাইহিস সালাম কর্তৃক ওদের প্রতি ঝুঁকে পড়াটাও অকল্পনীয়।
✦ দুই, এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যদি আমি আপনাকে প্রথম থেকে নিষ্পাপ ও অটল না রাখতাম তাহলে আপনি ওদের প্রতি প্রায় ঝুঁকে পড়তেন, কেননা ওদের ধোঁকা ও চালাকী খুবই মারাত্মক ছিল। অর্থাৎ যেহেতু আপনি নিষ্পাপ, সেহেতু কাফিরদের প্রতি ঝুঁকে পড়েননি, এমনকি ঝুঁকার উপক্রমও হননি। এর দ্বারা তাঁর (ﷺ) নিষ্পাপ হওয়া প্রমাণিত হলো। (খাযেন, মাদারেক, রূহুল বয়ানে দেখুন)।
তিন, একেতঃ হুযূর আলাইহিস সালামের স্বভাব চরিত্র নির্মল, দ্বিতীয়তঃ তিনি নাবুয়াতপ্রাপ্ত ও খোদার পক্ষ থেকে নিষ্পাপ বলে ঘোষিত। উপরোক্ত আয়াতের দ্বারা বোঝা যায় যে নাবুয়াত ও নিষ্পাপতার প্রতি লক্ষ্য না করলেও তাঁর নির্মল স্বভাব চরিত্র দোষ ও গুনাহ থেকে এমন মুক্ত যেথায় ওসব নিস্ক্রিয়। কেননা তাঁর রূহানী শক্তি মানবীয় শক্তির উপর জয়ী। অর্থাৎ আমি আপনাকে নিষ্পাপ না করলেও আপনি কাফিরদের সাথে মিশতেন না, তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়তেন না। অবশ্য কিছুটা প্রভাবিত হতেন। কিন্তু যখন আপনার পূত স্বভাবের প্রতি খোদার এ রহমত হলো অর্থাৎ আপনাকে নিষ্পাপও করা হলো এবং আপনার পবিত্র শিরে নবুয়াতের মুকুটও পরিধান করানো হলো, তখন আর কোন রকমের দোষ ক্রটির অবকাশ রইলো না। তাফসীরে রুহুল বয়ানে তাই বর্ণিত হয়েছে ➥625. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, ৫/১৯০
قال بعض الكبار انما سماه قليلا لان روحانية النبي عليه السلام كانت فى اصل الخلقة غالبة على بشريته إذ لم يكن حينئذ لروحه شىء يحجب عن الله فالمعنى لولا التثبيت وقوة النبوة ونور الهداية واثر نظر العناية لقد كدت تركن
১২ নং আপত্তিঃ
✦ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ
-‘‘‘হে নবী (ﷺ) আপনি জানতেন না কিতাব কি জিনিস এবং ঈমান কি’।’’৬২৬
➥626. সূরা আশ্-শূরা, আয়াত নং-৫২।
এতে প্রমাণিত হয় হুযূর (ﷺ) জন্মগত আরিফ বিল্লাহ ছিলেন না। কেননা তাঁর কাছে ঈমানের খবরও ছিল না।
উত্তরঃ এর কয়েকটি উত্তর রয়েছে। এক, এখানে তাঁর জ্ঞানকে অস্বীকার করা হয়নি, বরং মনগড়া ও অনুমান থেকে জানাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
✦ পূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে-
وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ
-‘‘অর্থাৎ আমি আপনার প্রতি স্বীয় মেহরবানীতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি। আপনি নিজে জানতেন না। অর্থাৎ আপনার এ জ্ঞানের উৎস হচ্ছে খোদার ওহী, নিছক মনগড়া ও অনুমান ভিত্তিক জ্ঞান নয়। ৬২৭
➥627. সূরা আশ্-শূরা, আয়াত নং-৫২।
দুই, এ আয়াতে যা বলা হয়েছে, তা তাঁর জন্মগত অবস্থার কথা নয়, বরং নুরে মুহাম্মদীর জন্মের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ আলমে আরওয়াহে (রূহের জগতে) আপনাকে সাদাসিধে ভাবে সৃষ্টি করেছিলাম। অতঃপর আপনাকে যাবতীয় জ্ঞানে ভূষিত করে এবং নাবুয়তের তাজ পরিধান করায়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছি। আপনি রূহের জগতেও নবী ছিলেন।
✦ তিনি (ﷺ) নিজেই বলেন-
كُنْتُ نَبِيًّا وَآدَمُ بَيْنَ الْمَاءِ
-‘‘আমি ওই সময় নবী ছিলাম, যখন আদম (عليه السلام) মাটি-পানিতে মিশ্রিত ছিলেন।’’ ৬২৮
➥628. এ বিষয়ে আমার লিখিত “প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন” ১ম খণ্ডের ......... পৃষ্ঠায় দেখুন।
তিন, এর দ্বারা ঈমান ও কুরআনের বিশ্লেষণ পূর্ণ আহকামকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ওহী প্রাপ্তির আগে তিনি (ﷺ) ইসলামী আহকাম সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবগত ছিলেন না। উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাফসীরে রুহুল বয়ানে বর্ণিত আছে ➥629. ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৩৪৭, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
اى الايمان بتفاصيل ما فى تضاعيف الكتاب
✦ আরও উল্লেখিত আছে-
لانه عليه السلام أفضل من يحيى وعيسى عليهما السلام وقد اوتى كل الحكم والعلم صبيا
-‘‘নবী (ﷺ) ইয়াহিয়া (عليه السلام) ও ঈসা (عليه السلام) থেকে আফযল এবং তাঁদেরকেতো শৈশবাবস্থায় ইলম ও হিকমত দান করা হয়েছিল। তাহলে এটা কিভাবে বলা যায় যে তিনি (ﷺ) শৈশবাবস্থায় জ্ঞান শূন্য ছিলেন? ৬৩০
➥630. ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৩৪৭, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
১৩নং আপত্তিঃ
✦ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-
فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ
-‘‘শয়তান হযরত আদম ও হাওয়া (عليه السلام)কে প্রতারিত করেছে।’’ ৬৩১
➥631. সূূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৩৬।
এতে বোঝা গেল শয়তানের চালবাজি নবীদের সাথেও চলে। তাহলে এটা কিভাবে বলা সম্ভব যে শয়তান তাঁদের কাছে পৌঁছতে পারে না?
উত্তরঃ আমি বলেছি যে শয়তান তাঁদেরকে গুমরাহ করতে পারে না এবং তাঁদের দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গুনাহ করাতে পারে না।
✦ শয়তান নিজেই বলেছিল-
وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ (৩৯) إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
-‘‘আমি ওদের সবাইকে বিপথগামী করব, তবে ওদের মধ্যে তোমার নির্বাচিত বান্দাদেরকে নয়।’’ ৬৩২
➥632. সূূরা হিজর, আয়াত নং-৩৯-৪০।
এ আয়াতে উল্লেখিত আছে فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ সুতরাং গুমরাহী এক জিনিস আর প্রতারণা করা অন্য জিনিস।
১৪নং আপত্তিঃ
হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইদেরকে অনেকে নবী মনে করেন। অথচ তাঁরা বড় গুনাহ করেছেন। যেমন নিরাপরাধ ভাইকে বিক্রি করে মূল্য ভোগ করা এবং আপন পিতার কাছে মিথ্যা বলে তাঁকে চলিশ বছর পর্যন্ত কাঁদানো জঘন্য অপরাধ নয় কি? তবু তাঁরা নবী হয়েছেন। তাই বোঝা গেল যে নবীগণ নিষ্পাপ হওয়া আবশ্যক নয়।
উত্তরঃ জমহুর উলামায়ে কিরাম তাঁদেরকে নবী মনে করেন না। অবশ্য আলিমদের একটি গ্র“প কিছু দুর্বল প্রমাণাদি দ্বারা তাঁদের নবুয়াত প্রাপ্তি সম্পর্কে ধারণা করে থাকেন। এ জন্য আমি সূচনায় উল্লেখ করেছি যে, নবুয়াতের আগে আম্বিয়া কিরাম বদআকীদা থেকে পবিত্র হওয়া সম্পর্কে সর্বসম্মত অভিমত রয়েছে এবং কবীরা গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়াটাও জমহুর উলামাদের অভিমত। নবুয়াতের পরেও কবীরা গুনাহ থেকে পাক হওয়া সম্পর্কে সর্বসম্মত অভিমত রয়েছে। তাঁদের নবুয়াত সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট আয়াত বা সাহাবায়ে কিরামের উক্তি পাওয়া যায় না।
✦ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান -৬৩৩
وَيُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَعَلَى آلِ يَعْقُوبَ
এ আয়াতে নিয়ামত দ্বারা নুবয়াত বোঝানো হয়নি এবং আলে ইয়াকুব দ্বারা তাঁর ঔরশজাত সকল সন্তানকেও বোঝানো হয়নি।
➥633. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৬।
✦ আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে বলছেন- ➥634. সূূরা মায়েদা, আয়াত নং-৩।
وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي
✦ কেউ কেউ বলেছেন যে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমায়েছেন ➥635. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১৩৬।
وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ
ইয়াকুব (عليه السلام) এর বার জন ছেলে ছিলেন। এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, সবাই ওহী প্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু এটাও দুর্বল অভিমত। কেননা أُنْزِلَ ক্রিয়া দ্বারা বিনা মাধ্যম ওহী প্রাপ্তির কথা বোঝায় না আর أَسْبَاطِ শব্দ ইয়াকুব (عليه السلام) এর সন্তানদের উপাধি বলে কোন প্রমাণ নেই।
✦ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান ➥636. সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-৮৪।
قُلْ آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ
এর ভাবার্থ এ নয় যে আমাদের সবার প্রতি ওহী নাযিল হয়েছে এবং আমরা সবাই নবী আর أَسْبَاطِ হচ্ছে নবী ঈস্রাইলের চারটি গোত্রের গোত্রীয় নাম এবং বাস্তবিকই তাঁদের মধ্যে নবীর আবির্ভাবও ঘটেছে।
✦ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান -৬৩৭
وَقَطَّعْنَاهُمُ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أَسْبَاطًا أُمَمًا
➥637. সূরা আ‘রাফ, আয়াত নং-১৬০।
✦ তাফসীরে রূহুল মায়ানীতে
إِنَّ الشَّيْطَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوٌّ مُبِينٌ
এর ব্যাখ্যা ৬৩৮
➥638. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৫।
✦ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে ➥639. ইমাম মাহমুদ আলূসী বাগদাদী, তাফসিরে রুহুল মা‘য়ানী, ৬/৩৭৫ পৃ:
فالذي عليه الأكثرون سلفا وخلفا أنهم لم يكونوا أنبياء أصلا، أما السلف فلم ينقل عن الصحابة منهم أنه قال بنبوتهم
অনুরূপ তাফসীরে রুহুল বয়ান ও অন্যান্য তাফসীরে তাঁদের নবুয়াত প্রাপ্তিকে অপ্রমাণ করা হয়েছে। অবশ্য তওবার পর তাঁরা আল্লাহর ওলী বরং নবীর সাহাবার পদমর্যাদা লাভ করেছেন। হযরত ইউসুফ (عليه السلام) স্বপ্নে তাঁদেরকে তারকারাজির মত দেখেছেন।
✦ কেননা তাঁরা নবীর সাহাবী ছিলেন। হুযূর (ﷺ) ইরশাদ ফরমান-
أَصْحَابِي كَالنُّجُومِ بِأَيِّهِمُ اقْتَدَيْتُمُ اهْتَدَيْتُمْ
আমার সাহাবীগণ তারকারাজির মত।’’ ৬৪০
➥640. খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ৩/১৬৯৬ পৃ: হা/৬০১৮, পরিচ্ছেদ: بَاب مَنَاقِب الصَّحَابَة , ইমাম ইবনুল আব্দুল বার, জামিউল বায়ানুল ইলমি ওয়া ফাদ্বলিহী, হা/, এ হাদিসের বিষয়ে বিস্তারিত বাতিলদের জবাব জানতে আমার লিখিত ‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’ ১ম খন্ডের......পৃষ্ঠায় দেখুন।
অধিকন্তু তাঁদের ওসব পাপ কেবল ইয়াকুব (عليه السلام) এর স্নেহ লাভের জন্যই করা হয়েছিল। পরে তাঁরা ইয়াকুব (عليه السلام) ও ইউসুফ (عليه السلام) থেকে মাফ চেয়ে নিয়েছিলেন। আর তাঁরা উভয়ে ওদের ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য দুআ করেছিলেন। সুতরাং তাঁরা সবাই ক্ষমাপ্রাপ্ত। তাঁদের শানে বেআদবী করা বড় পাপ। কাবিল জনৈক মহিলার সাথে প্রেম নিবেদন করে অপরাধ করেছিল। পরে এর জন্য আদম (عليه السلام) থেকে ক্ষমা লাভ করেনি, যার ফলে সে বেঈমানই রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা ঈমানদার ছিলেন।
১৫ নং আপত্তিঃ
কুরআন করীম থেকে প্রমাণিত আছে যে জুলেখা যেনার মনস্থ করেছিলেন, যা বড় অপরাধ। অথচ আপনি বলেছেন যে নবীর স্ত্রী ব্যভিচারিনী হয় না। তাহলে জুলেখা কিভাবে ইউসুফ (عليه السلام) এর স্ত্রী হতে পারে? কেননা সে ব্যভিচারিনী ছিল। সুতরাং মানতেই হবে যে হয়তো তাঁর বিবাহ হয়নি বা এ নীতি ভুল।
বিঃ দ্রঃ গুজরাটের কতেক মূর্খ দেওবন্দী জুলেখাকে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করে তাঁর শানে যা- তা মন্তব্য করেছে।
উত্তরঃ হযরত জুলেখা ইউসুফ (عليه السلام) এর সম্মানিতা স্ত্রী। তাঁর স্ত্রী হওয়া সম্পর্কে মুসলিম ও বুখারী শরীফের হাদীছ এবং প্রায় তাফসীর থেকে প্রমাণিত আছে। তাঁর থেকে ইউসুফ (عليه السلام) এর সন্তানাদিও জন্ম হয়েছে। তাফসীরে খাযেন, তাফসীরে কবীর মাদারেক, মায়ালেমুত্তানযীল ইত্যাদিতে এর বিশ্লেষণ রয়েছে। জুলেখা কখনও ব্যভিচারিনী ছিল না। এবং যেনার মত কোন গুনাহও তাঁর থেকে প্রকাশ পায়নি। হযরত ইউসুফের প্রেমে বিভোর অবস্থায় জুলেখার মনে সহবাসের ধারণা জেগে ছিল। হযরত ইউসুফের সৌন্দর্য তাঁকে পাগল করেছিল এবং সেই অবস্থায় এ রকম ধারণা করেছিলেন। যদি মিসরের মহিলারা ক্ষণিকের জন্য তাঁর অপূর্ব সুন্দর আকৃতি দেখে বিভোর হয়ে নিজেদের হাত কেটে ফেলতে পারে, তাহলে তাঁর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে জুলেখার ধৈর্যচ্যুতি ঘটার মধ্যে আশ্চর্যের কি আছে? অবশ্য পরে সে সব গুনাহ থেকে তওবাও করেছেন। এটাও লক্ষণীয় যে জুলেখা কেবল ইউসুফ (عليه السلام) এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, অন্য কারো প্রতি নয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সার্বিকভাবে নিরাপদ রেখেছিলেন। আমি নবীগণের স্ত্রীদেরকে যেনা ও অন্যান্য অশ্লীলতা থেকে মুক্ত বলেছি কিন্তু নিষ্পাপ বলিনি। জুলেখা ও পাপের জন্য তওবা করেছিলেন।
✦ এবং আরয করেছিলেন-
الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَا رَاوَدْتُهُ عَنْ نَفْسِهِ
জুলেখা নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করলো এবং অপরাধ স্বীকার মানে তওবা করা। ৬৪১
➥641. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৫১।
এ জন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁর গুনাহের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এর জন্য অসন্তোষ কিংবা শাস্তির কথা কিছু উল্লেখ করেননি। যাতে বোঝা যায় যে তাঁর গুনাহ মাফ করা হয়েছে। এখন তাঁর গুনাহকে অশোভনীয়ভাবে উল্লেখ করাটা জঘন্য পাপ। তাঁর থেকে যেনা বা অশ্লীলতা কখনও প্রকাশ পায়নি। জানিনা দেওবন্দীরা কোন শয়তানের ধোঁকায় পড়েছে যে তারা প্রায় সময় আম্বিয়া কিরামের মান সম্মানের প্রতি আঘাত হানে। জুলেখা হচ্ছেন ইউসুফ (عليه السلام) এর ঘরণী। তাঁর অপবাদ মানে নবীরই অপবাদ। আল্লাহ তাদেরকে শুভবুদ্ধি দান করুক।
উপসংহারঃ স্মরণ রাখা দরকার যে খোদা তা’আলা নবীদের সৃষ্টিকর্তা। তাঁরা হচ্ছেন তাঁর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তা’আলা যে ভাবে ইচ্ছে তাঁদের দোষ গুনাহ বর্ণনা করুক এবং তাঁরাও যেভাবে পছন্দ সে ভাবে স্বীয় প্রার্থনা বা বন্দেগী প্রকাশ করুক, কিন্তু তাতে আমাদের নাক গলানোর কোন অধিকার নেই। তাঁদের দোষ তালাশ করে বা তাঁদের শানে বেআদবী করে নিজের আমলকে মলিন করতে যাব কেন? আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকেতো তাঁদের ইয্যত সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন। দেখুন,
✦ ইউসুফ (عليه السلام) মিসরের বাজারে বাহ্যতঃ বিক্রি হয়েছিলেন, যার জন্য মিসরবাসী তাকে আযীয মিসিরের কেনা গোলাম মনে করতেন। আল্লাহ তা’আলা এ কালিমাকে দূরীভূত করার জন্য সাত বছর মেয়াদী দুর্ভিক্ষ দিয়ে ছিলেন। প্রথম বছর সবাই তাঁর কাছে টাকা পয়সা দিয়ে খাদ্য শস্য ক্রয় করেছিল, দ্বিতীয় বছর সোনা চাঁদি দিয়ে, তৃতীয় বছর গরু-ছাগল দিয়ে, চতুর্থ বছর নিজেদের দাসদাসী দিয়ে, পঞ্চম বছর নিজেদের ঘর-বাড়ী ও জায়গা জমি দিয়ে, ষষ্ঠ বছর নিজেদের ছেলে-মেয়ে দিয়ে তাঁর থেকে খাদ্য শস্য সংগ্রহ করেছিলেন। সপ্তম বছর মিসরবাসী নিজেরাই ইউছুফ (عليه السلام) এর কাছে বিক্রি হয়েছে এবং আরয করেছে- আমরা আপনার দাসদাসীতে পরিণত হলাম, আপনি আমাদেরকে খাদ্য শস্য প্রদান করুন। তখন তিনি তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেন। (মাদারেক, রূহুল বয়ান ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)
✦ এ রকম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি কেবল এ জন্যই করা হলো যে, যখন সমগ্র মিসরবাসী ইউসুফ (عليه السلام) এর দাসে পরিণত হলো, তখন তাঁকে কে বলবে ‘কেনা গোলাম’? এতে বোঝা গেল যে একজন নবীর মান সম্মান অটল রাখার জন্য সমগ্র জগত বাসীকে মছিবতে ফেলতে পারে। হযরত উমর (رضي الله عنه) এর যুগে জনৈক ইমাম সব সময় নামাযে সূরা আবাসা পাঠ করতো। (সুরাটিতে বাহ্যতঃ হুযূর (ﷺ)কে ভর্ৎসনা করা হয়েছে মনে হয়।) যখন তিনি জানতে পারলেন, তখন ওকে হত্যা করালেন। (তাফসীরে রূহুল বয়ানে সূরা আবাসার তাফসীর দেখুন।)
আমার রচিত ‘শানে হাবিবুর রহমান’ কিতাবে এ সূরার সুন্দর তাফসীর করা হয়েছে, যেথায় প্রমাণ করা হয়েছে যে ওটা আসলে প্রশংসাগীতি। আল্লাহ তা’আলা দেওবন্দীদের হিদায়েত করুক। ওরা নবীদের শানে বেআদবী করার দুঃসাহস দেখিয়েছে।
وَصَلَّى اَللهُ تَعَالٰى عَلٰى خَيْرِ خَلْقِهِ وَنُوْرِ عَرْشِهِ سَيْدِنَا وَمَوْلَنَا مُحَمَّدٍ وَعَلٰى اٰلِهِ وَاَصْحَابِهِ اَجْمَعِيْنَ
তারাবীহের নামায প্রসঙ্গে আলোকপাত