৩. যারা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে ইয়াযিদকে লানত দিয়েছেন তাদের মতামতঃ


আল্লামা মানাভি (رحمة الله) বলেন, হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা আমাদের কলজে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, শরীরকে গলিয়ে দেয়। যে তাঁকে হত্যা করেছে, অথবা এতে সম্ভষ্ট হয়েছে, অথবা আদেশ দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের উপর আল্লাহর লানত; আদ জাতি যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, তারাও সেভাবে ধ্বংস হােক।' হাফিজুদ্দিন আল কুরদি আল হানাফি তার ফতােয়ায় বলেন, ইয়াযিদকে লানত দেয়া জায়েয, তবে না দেয়াই উচিত। হাজ্জাজের ক্ষেত্রেও একই কথা।' 


ইমাম কাওয়ামুদ্দিন আস সাফফারি (رحمة الله) বলেন, ইয়াযিদকে লানত দিতে কোনাে দোষ নেই। তবে মুয়াবিয়া রা. কে লানত দেয়া যাবে না।' 


ইবনুল জাওযি (رحمة الله) কে ইয়াযিদ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, 

‘রসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে আবু সুফিয়ানের ঘরে ঢুকবে, সে নিরাপদ। আর আমরা জানি তার বাবা সেই ঘরে ঢুকেছিলেন, ফলে নিরাপদ হয়ে গেছেন। কিন্তু পুত্র তাে সেখানে ঢােকেনি। 


আল মাওলা ইবনুল কামাল (رحمة الله) বলেন, প্রকৃত কথা হলাে, ইয়াযিদকে তার কুফরির কুখ্যাতি, বীভৎসতা ও অপকর্মের জন্য, যেসবের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে তাকে লানত দেয়া জায়েয। তা না হলে কোনাে ফাসিককেও নির্দিষ্ট করে লানত দেয়া যাবে না।


◼ আল্লামা তাফতাযানি (رحمة الله) বলেছেন, 

لا أشك في إسلامه بل في إيمانه لعنه الله عليه وعلى أنصاره وأغوانه 

আমি তার ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ করি না, তবে ইমানের ব্যাপারে করি । তার উপর, তার সহযােগী ও সহায়তাকারীদের উপর আল্লাহর লানত।


◼ একদিন ইবনুল জাওযি (رحمة الله) ওয়াজের মজলিসে চেয়ারে বসে ছিলেন। একজন জিজ্ঞেস করল, এটা বলা কীভাবে সহিহ হতে পারে যে, ইয়াযিদ হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যা করেছে? সে তাে তখন দামেস্কে এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ইরাকে ছিলেন। তখন ইবনুল জাওযি নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ

سهم أصاب وراميه بذي سلم من + بالعراق لقد أبعدت مزماي 

‘ইরাকে যে আছে, তার কাছে তীর লক্ষ্যভেদ করেছে, যে তীর ছোঁড়া হয়েছে যি সালাম নামক জায়গা থেকে । 

তােমার নিশানা তাে বহু দূরের। 

 

◼ এটি শরিফ রাজির ‘ইয়া যাবিয়্যাতাল বান’ নামের একটি বিখ্যাত কবিতার লাইন। কবি এখানে প্রেমিকার সাথে তার ভালােবাসার সম্পর্ককে লক্ষ্যভেদী তীর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই তীর স্থানগত দূরত্ব থাকার পরও হিজাযের যি সালাম থেকে বহু দূরে ইরাকে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। 

(আব্দুর রউফ আল মানাভি, ফাইযুল কাদির শারহুল জামিইস সাগির মিন আহাদিসিল বাশিরি ওয়ান নাযির, বৈরুত, দারুল মারেফাহ, ১৯৭২ খ্রি., খ. ১, পৃ. ২০৫)। 


◼ ইয়াযিদ সম্পর্কে ইমাম যাহাবি (رحمة الله)'র ব্যক্তিগত মূল্যায়ন এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন, 


“সে ছিল আহলে বায়ত বিদ্বেষী (নাসেবি), নির্দয়, কর্কশ, অত্যাচারী; সে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করত, খারাপ কাজ করত। শহিদ হুসাইন (رضي الله عنه)র হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সে খেলাফত শুরু করেছে আর শেষ করেছে হাররার ঘটনা দিয়ে। লােকেরা তাকে ঘৃণা করত। তার বয়সেও সে বরকত পায়নি। হুসাইন (رضي الله عنه)র পর অনেকেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। যেমন মদিনাবাসী তারা শুধু আল্লাহর জন্য তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ইমাম যাহাবি আরও উল্লেখ করেছেন, যিয়াদ আল হারেসি উল্লেখ করেছেন, ইয়াযিদ একবার আমাকে এমন শরাব পান করাল, তেমন স্বাদের শরাব আর কখনাে খাইনি। বললাম, আমিরুল মু'মিনিন! এমন মদ আমি কখনাে পান করিনি। তখন ইয়াযিদ বলল, 


‘এটা মিষ্টি ডালিম, ইস্পাহানের মধু, আহওয়াযের চিনি, তায়েফের আঙ্গুর এবং বারাদার পানি দিয়ে তৈরি। 


◼ ইমাম যাহাবি মুহাম্মদ ইবন আহমদ ইবন মিসমা (رحمة الله)’র সূত্রে বর্ণনা করেছেন, 


‘একবার ইয়াযিদ মাতাল হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করল। এরপর চিৎ হয়ে পড়ে তার মাথা ফেটে গেল।' (ইমাম যাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা, বৈরুত : মুয়াসসাতুর রিসালা, খ. ৪, পৃ. ৩৭)। 

 

◼ ইবন খাল্লিকান (رحمة الله) বলেন,


"বিশিষ্ট শাফেঈ ফকিহ ইলকিয়া হাররাসিকে ইয়াযিদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ইয়াযিদ কোনাে সাহাবি ছিল না। সে জন্ম নিয়েছিল উমর (رضي الله عنه)'র খিলাফতকালে । তার ব্যাপারে সালাফ বা পূর্বসূরি, যেমন ইমাম আহমদ, ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা প্রমুখের পক্ষ থেকে দুটি মত রয়েছে। একটি মত তালউইহ (ইশারায় লানত দেয়া) ও আরেকটি মত তাসরিহ (স্পষ্টভাষায় লানত দেয়া)। আর আমাদের মত কেবল একটিই। তা হলাে, তাসরিহ বা সুস্পষ্টভাবে লানত দেয়া, তালউইহ নয়। আর এটা হবে নাই বা কেন? ইয়াযিদ পাশা খেলত, চিতাবাঘ দিয়ে শিকার করত, সর্বোপরি সে ছিল মদ্যপ।' (ইবন খালিকান, ওয়াফিয়াতুল আইয়ান ফি আনবায়ি আবনায়িয যামান, বৈরুত: দারু সাদির, ১৯৭২ খ্রি., খ. ৩, পৃ. ২৮৭) 


◼ আল্লামা শাওকানি বলেছেন, 


‘কিছু আলেম যেমন কাররামিয়া ও তাদের সমমনা কিছু লােক এ অধ্যায়ের হাদিসগুলাের উপর ভিত্তি করে বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি এমন রায় দিয়েছে যে, মদ্যপ, মাতাল, পবিত্র শরিয়াতের পবিত্র বিধিবিধান ছিন্নকারী ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে রসুলুল্লাহ (ﷺ)এর নাতি হুসাইন (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হােন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করুন) বিদ্রোহী হয়েছেন। আল্লাহ ঐসব লােককে লানত দিন। হায় আল্লাহ! কী বিস্ময়কর তাদের কথা! এগুলাে শুনলে শরীর শিউরে ওঠে, কঠিন প্রস্তরও কেঁপে ওঠে।' (ইমাম মুহাম্মদ ইবন আলি আশ শাওকানি, নাইলুল আওতার, খ. ৭, পৃ. ১৮৬)। 


Top