আল্-কোরআনের ইজাযের ব্যাপারে যারা সমালােচনা করেন,তাদের কিছু সন্দেহ ও অভিযােগের পর্যালােচনা:
প্রথমতঃ আল-কোরআন ই’জায হওয়ার জন্য জরুরী যে, তা ঐ ব্যক্তির জন্য স্পষ্ট বা প্রকাশ্য হবে যে, তা থেকে দলীল পেশ করবে। আর এ ব্যাপারে তােমাদের মতানৈক্য এটাই প্রমাণ করে যে, তা ঐ ব্যক্তির জন্য স্পষ্ট নয়। এরূপ অভিযােগের জবাব হলাে : যদিও কোন কারণবশঃ আল-কোরআনের কোন কোন স্থানে মতানৈক্য অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু আসলে কোরআনের মধ্যে কোনরূপ মতানৈক্য ও অস্পষ্টতা নেই। কারণ, এটা স্পষ্ট যে, গােটা কোরআনুল কারীম যে ভাষার অলঙ্কারে ও বিশেষ-ভংগীতে গায়েবের খরবসহ নাযিল হয়েছে এবং ইলম ও আমলের দিক থেকে যেরূপ হিকমাতে পরিপূর্ণ, তা অপূর্ব ও চিরবিস্ময়কর। তাছাড়া আল-কোরআনের ই’জায হওয়ার ব্যাপারে ইতিপূর্বে যা কিছু আলােচিত হয়েছে, এসব দিক গভীরভাবে পর্যালােচনা করলে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় যে, কোরআনুল কারীম মু'জিযা।
আল-কোরআনে আপাততঃ যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়, তা দৃষ্টিভংগীর পার্থক্যের ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। অথবা যারা এ ব্যাপারে মত পার্থক্য করেছেন, তাদের জ্ঞানের সীমিত পরিধির কারণে করেছেন। কথাটা এরূপ নয় যে, বিবৃত কোন কারণ সমূহের বিশেষ কোন কারণে যদি আল-কোরআন মুজিযা না হয়, তবে এর দ্বারা এরূপ মনে করা সঙ্গত হবে না যে, গােটা কোরআন-ই মুজিযা নয়। কাজেই একটি বিশেষ কারণের দ্বারা আল কোরআনকে মু'জিযা নয়, এরূপ ধারণা করা আদৌ উচিত হবে না। যেমন এরূপ বহু ভাষা অলঙ্কারবিদ আছেন, যিনি গদ্য ও পদ্য সাহিত্যে সমান দক্ষ; কিন্তু এছাড়া ভাষার অন্যান্য অঙ্গনে তিনি পারদর্শী নন। কাজেই, এক্ষেত্রে যেমন বলা যায় না, তিনি সর্বক্ষেত্রে সমান পারদর্শী হবেন; তেমনি একথা বলা উচিত হবেনা যে, যা একজনের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য-তা অন্যান্য সকলের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা সঙ্গত হবে।
এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলাে : তােমাদের কথায় এরূপ বুঝা যায় যে, কেবল আল-কোরআনের সমষ্টি মু'জিযা; কিন্তু এর কোন কোন ছােট সূরা মু'জিযা নয়। এরূপ ধারণা বাস্তবতার পরিপন্থী। কেননা আগেই আলােচনা করা হয়েছে যে, আল-কোরআনের একটা ছােট সূরাও মু'জিযা, যারা মুকাবিলা করতে তৎকালীন কবি সাহিত্যিকরা অক্ষম ছিল।
এ বক্তব্যের জবাবে যদি তােমরা বল : জবাব দাতার জওয়াবে জানা গেল। যে, আল-কোরআন তার মধ্যে বর্ণিত সমস্ত ই’জাযের কারণে-মু'জিযা এবং তার
প্রত্যেকটি সূরা-ই’জাযের কোন একটি অনির্দিষ্ট কারণের জন্য মু'জিযা। এর জবাবে আমি বলবাে : এমতাবস্থায় অভিযােগকারীর অভিযােগ দূরীভূত হবেনা; কেননা, তার ধারণা হলাে-ই’জাযের জন্য এটি জরুরী যে, তা স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হতে হবে। আর এরূপ হলে ই'জাযের কারণ স্পষ্ট থাকে না। যেমন তুমি তা নিজেই অনুধাবন করতে পার।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ থেকে হিফাযাত করুন, যারা এরূপ ধারণা করে যে, আল-কোরআন স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নয়। যারা বিশেষ কোন মত ও পথের অনুসারী না হয়ে, ইনসাফের সাথে আল কোরআনকে পর্যালােচনা করবে, তারা স্পষ্টতঃ জানতে পারবে যে; এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা করা প্রকাশ্য গােমরাহী ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাদের দ্বিতীয় অভিযােগ হলাে : সাহাবায়ে কিরাম আল-কোরআনের কোন কোন অংশ নিয়ে মতভেদ ও মতানৈক্য করেছেন। এমনকি হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন : সূরা ফাতিহা এবং মুআববেযাতায়েন”
(সূরা ফালাক এবং সূরা নাসকে এক সংগে মুআ বোতায়েন বলা হয়। ) আল কোরআনের অংশ নয়; যদিও এগুলি আল্-কোরআনের মশহুর সূরাগুলাের অন্যতম। যদি এ সূরাগুলির বালাগাত' বা ভাষার অলঙ্কার ই’জাযের স্তরে পৌছতাে, তবে এগুলি, যা কোরআন নয়-তা থেকে আলাদা হতাে, এবং তারা (সাহাবীগণ) এ ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করতেন না।
এর জবাব হলাে : সাহাবীদের মতভেদ আল-
কোরআনের এমন কিছু সূরার ব্যাপারে যা, খবরে ‘আহাদ (যে হাদীসের সনদের বর্ণনার কোন এক পর্যায়ে রাবী বা বর্ণনাকারী মাত্র একজন থাকে, তাকে ‘খবরে আহাদ' বলে।) দ্বারা বর্ণিত; এবং ‘খবরে আহাদ' যন বা ধারণার সৃষ্টি করে। কিন্তু গােটা বা সমস্ত কোরআন ‘তাওয়াতুর’(যে হাদীসের সনদের বর্ণনার প্রতিটি পর্যায়ে অসংখ্য রাবী বিদ্যামান, তাকে ‘খবরে মুতাওয়াতির বা তাওয়াতুর বলে।) এর দ্বারা বর্ণিত; যা ‘ইয়াকীন' বা দৃঢ় বিশ্বাসকারী। সুতরাং এ খবরে আহাদ' আদৌ গ্রহণযােগ্য নয়।
উপরন্তু আমরা একথাও বলতে পারি যে, তারাতাে এ ব্যাপারে মতভেদ করেননি যে, এ কোরআন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়নি; আর এ ব্যাপারেও তারা মতানৈক্য করেননি যে, আল-কোরআনের এসব সূরা ই’জাযের স্তরেও পৌছতে পারেননি। বরং তারা কেবল এ ব্যাপারে মতপার্থক্য করেছেন যে, এ সূরাগুলি কি কোরআনের অংশ বা অংশ নয় তা নিয়ে। আর এ বিষয়টি আমাদের আলােচ্য বিষয়বস্তুতে কোনরূপ বিরূপ প্রভাব ফেলতে সক্ষম নয়।
তাদের তৃতীয় অভিযােগ হলাে : যখন আল-কোরআন সংগ্রহ ও সংকলন করা হয় তখন এমন কোন ব্যক্তি-যিনি বিশ্বস্ততার দিক দিয়ে তাদের কাছে মাশহুর বা প্রসিদ্ধ ছিলেন না, তিনি যখন কোন আয়াত নিয়ে আসতেন, তখন তাকে কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য বা কসম ব্যতিরেকে-কোরআনের মধ্যে গ্রহণ করা হতাে না। যদি আল-কোরআনের বালাগাত' বা ভাষার অলঙ্কার ইজাযের স্তরে উন্নীত হতাে, তবে তাকে তার দ্বারা চিনে নিত এবং কোরআনের মধ্যে শামিল করে নিত; এমতাবস্থায় বিশ্বস্ত হওয়া, সাক্ষী পেশ করা বা কসম করার কোন প্রয়ােজন পড়তাে না।
এর জবাব হলাে : তাদের এ মতানৈক্য ছিল আল-কোরআনে আয়াতের স্থান নির্ধারণ এবং কোন আয়াত আগের বা কোন্ আয়াত পরের-সে সম্পর্কিত।
ঐ আয়াত যে আল-কোরআনের নয়, তা নিয়ে তাদের কোনরূপ মত পার্থক্য , ছিল না। কেননা, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় কোরআন পাঠ করতেন; তাই, যখন কেউ কোন আয়াত নিয়ে আসতাে, তখন তা যে আল-কোরআনেরই অংশ তা নিশ্চিত ছিল; তবে সাক্ষী পেশ বা কসম করার ব্যাপারটি ছিল কেবলমাত্র বর্ণনা ধারার অক্ষুন্নতার কারণে। কাজেই, জানা গেল যে, এ ব্যাপারে কোন সমস্যাই নেই। তাছাড়া, একটি বা দুটি আয়াত যদি মু'জিযা না হয়, তা আমাদের কাছে কোন সমস্যার ব্যাপার নয় কেননা; আল কোরআনের জন্য ই'জায হওয়া জরুরী এবং অতীব প্রয়ােজন; তাই সেটা একটি ক্ষুদ্রাকৃতি সূরার আকারেই হােক, বা কোন সূরার কম থেকে কম তিন আয়াতই হােক।
তাদের চতুর্থ অভিযােগ হলাে : প্রত্যেক শিল্পের একটি নির্ধারিত সীমা পরিসীমা আছে। যার উন্নতি সেখানে গিয়ে থেমে যায় এবং সে সীমা আর অতিক্রম করতে সক্ষম হয় না। আর প্রত্যেক যুগে এমন একজন লােকের অস্তিত্বের প্রয়ােজন, যিনি যুগের সব কিছুর উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম। সুতরাং সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, সম্ভবতঃ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সমকালীন লােকদের মাঝে সব চাইতে শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ছিলেন, এবং তিনি এমন কালাম বা কথা পেশ করেন, যার মুকাবিলা করতে তাঁর যুগের লােকেরা অক্ষম ছিল। যদি তাঁর এ কালাম মু'জিযা হয়, তবে মনে করা যেতে পারে যে, যে এ ধরনের কিছু পেশ করবে, যদ্দরুন সে তার সমকালীন লােকদের মাঝে সে শিল্পে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত হবে, তবে তাও মু'জিযা হয়ে যাবে। আর এটা প্রকাশ্য যে, এরূপ ধারণ করা বাতুলতা বই কিছুই নয়।
এর জবাব হলাে : স্মরণ রাখা দরকার যে, প্রত্যেক যুগে মু'জিযা এমন ব্যক্তি থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যিনি তা দিয়ে তার সমকালীন যুগের লােকদের উপর বিজয়ী হয়েছেন। যদিও সে যুগের লোকের উন্নতির এমন চরম শিখরে আরোহণ করেছিল, যে পর্যন্ত পৌঁছানো কোন মানুষরে পক্ষে সম্ভব ছিল। কিন্তু যখন তারা দেখলো যে , তারা যে শিল্পের স্বর্ণ-শিখরে আরোহণ করেছেন, নবী রাসূলগণ যা নিয়ে আগমন করছেনে, তা তাদের শিল্প চাতুর্যের সীমা-সরহদ পর্যায়ে আরো উপরের স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তখন তারা বিশ্বাস করে নেয় যে ,এটা আল্লাহ সুবহানুহুর তরফ থেকে এসেছে।আর যদি এরূপ না হতো, তব কাওমের কাছে নবীর মু'জিযা প্রতিষ্ঠিত হতো নয়।
যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, হযরত মূসা (আ.)-এর সময় যাদুর চর্চা ও রেওয়াজ সব চাইতে বেশি ছিল । আর জাদুকররা এ কথা ভালভাবেই জানতো যে , যাদু ভেলকীবাজী ও নযরবন্দী ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই, যখন তারা দেখলো যে, হযরত মূসা (আ.)-এর হাতের লাঠি সাপে পরিণত হলো এবং তাদের যাদুর তৈরি সব হাতিয়ারগুলো গিলে ফেলল, তখন তারা বুঝতো পারলো যে ,এটা যাদু নয় এবং মানুষরে শক্তির বাইরে অন্য কোন শক্তি। যার ফলশ্রুতিতে তারা মূসা (আ.)-এর উপরে ঈমান আনে। কিন্তু ফেরাউন এ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলে যে , মূসা তাদের বড় উস্তাদ, যার থেকে এরা যাদু শিখেছিল।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এ উদাহারণ প্রযোজ্য। হযরত ঈসা (আ.)-এর যুগের প্রাধান্য ছিল । আর এ বিদ্যায় সে যুগের লোকেরা চরম উন্নতিসাধন করেছিল। কিন্তু তারা জানতো যে , মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধকে চক্ষু দান করা এবং কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করা চিকিৎসা বিদ্যার দ্বারা সম্ভব নয়; বরং এসব আল্লাহ তা'আলার পক্ষে সম্ভব। কাজেই হযরত ঈসা (আ.) যখন মৃতকে জীবিত করে দেখান , জন্মান্ধকে চক্ষুমান করে তোলেন এবং কুষ্ঠরোগগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করেন , তখন তারা তার উপর ঈমান আনে। তবে যারা স্বভাবগত খোদাদ্রোহী ছিল, তারা এসব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তাদের স্বভাবজাত গোমরাহী ও
কুফরীতে লিপ্ত থাকে।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে 'বালাগাত' বা। ভাষার অলঙ্কার অত্যন্ত উঁচু স্তরে উন্নীত হয়েছিল । আর সে কারণে তারা পরস্পর একজন অন্যজনের উপর ‘ফখর' বা গৌরব করতো। এমনকি তারা, তাদের সময়ে রচিত 'সাতটি কাসীদা' (একে আরবীতে “সাব্উল-মুআল্লাকা"বা সাতটি ঝুলন্ত গীতি কবিতা বলা হয়। আজও সারা বিশ্বের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে , যেখানে আরবী ভাষার চর্চা হয়, সেখানে এ গ্রন্থটি পাঠ্য পুস্তক হিসেবে পড়ানো হয়। (অনুবাদক))বা গীতিকাব্য কাবা ঘরের দেওয়ালে সাথে লটকে রেখেছিল; আর এর উদ্দেশ্য ছিল অন্যকে এর অনুরূপ কবিতা রচনার জন্য চ্যালেঞ্জ করা। পূর্ববর্তী ইতিহাস গ্রন্থে এর স্বপক্ষে দলিল বিদ্যমান আছে ।
অতঃপর হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে জিনিস -অর্থাৎ আল-কোরআন নিয়ে আসলেন , যার মুকাবিলা করতে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক অপারগ হলো। যদিও এ ব্যাপারে তারা অনেক ঝগড়া ও মতানৈক্য সৃষ্টি করেছিল, এমনকি তার নুবূওতকেও অস্বীকার করেছিল; ফলে , তাদের মাঝে কেউ কেউ কুফরীর উপর মৃত্যুবরণ করেছিল। পক্ষান্তরে , অন্যরা তার নুবুওতের সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে মুসলমান হয়েছিল । আর তাদের মাঝে এমন কিছু লোকও ছিল যারা ইসলামকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করা সত্ত্বেও লাঞ্ছিত ও অপমানিত অবস্থায় মুসলমান হয়েছিল ; যেমন মুনাফিকরা আরো তাদের মাঝে এমন কিছু লোক ছিল , আল-কোরআনের মুকাবিলা এমন অদ্ভুত ভংগিতে করেছিল, যা দেখলে জ্ঞানীগণের পক্ষে হাস্যসম্বরন করা কঠিন । যেমন তারা এরূপ ভাষার আল-কোরআনের বিরোধিতা করেছিল :
والزارعات زرعا فالحاصدات حصدا والطاحنات طحنا والطابخات
طبخا فالاكلات اكلا.
এছাড়া তাদের মাঝে এমন একদল ছিল যারা আল-কোরআনের বিরোধিতার জন্য রক্তপাত ও শোণিত পান করতেও কুণ্ঠিত হয়নি । এমনকি এজন্য তারা তাদের অতি প্রিয় জান মাল, সন্তান-সন্ততিকেও ধ্বংস ও হালাকাতের মধ্যে নিক্ষেপ করছিল। অবশেষে এ সত্য বাস্তবায়িত ও প্রতিষ্ঠিত হয় যে , আল-কোরআন কোন মানুষের রচিত গ্রন্থ নয়; বরং তা আল্লাহ সুবহানুহুর তরফ থেকে নাযিল কৃত।
তাদের পঞ্চম অভিযােগ হলাে : আল-কোরআনের শব্দ ও অর্থের মধ্যে বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। অথচ কোরআনে এরূপ আছে যে :
وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِنۡدِ غَيۡرِ الله لَوَجَدُوۡا فِيۡهِ اخۡتِلَافًا كَثِيۡرًا.
অর্থাৎ “যদি এই কোরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর তরফ থেকে হতো, তবে তারা এতে অনেক মতানৈক্য দেখতে পেতো। (সূরা নিসা , ৪; আয়াত : ৮২)
শব্দগত দিক দিয়ে পার্থক্যের উদারহরণ হলাে :
كَالۡعِهۡنِ الۡمَنۡفُوۡشِ
সূরা আল-কারিআ, ১০১; আয়াত : ৫।
এর স্থলে
كَالصوف لمنفوش ;
فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِكۡرِالّٰلهِ
(সূরা জুময়া', ৬২; আয়াত : ৯।)
এর স্থলে
فامضوا الی ذكرالّٰله ;
فَهِیَ كَالۡحِجَارَةِ
সূরা বাকারা, ২; আয়াত ৭৪।
এর স্থলে
فكَانت كالحجارة :
ضُرِبَتۡ عَلَيۡهِمُ الذِّلَّةُ وَالۡمَسۡكَنَةُ
সূরা বাকারা, ২; আয়াত : ৬১।
এর স্থলে
ضربت عليهم المسكنة والذلة
আর অর্থের দিক দিয়ে পার্থক্যের উদাহারণ হলাে : رَبَّنَا بَاعِدۡ بَيئن اَسۡفَارِنَا (সূরা সাবা, ৩৪; আয়াত : ১৯।)
এর স্থলে رَبَّنَا بَاعِدۡ بَيئن اَسۡفَارِنَا প্রথম অংশে بَاعدۡ শব্দটি صيغة امر এবং رب সম্বোধন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয় অংশে بَاعَدۡ শব্দটি صيغة مَاضی এবং ر ب শব্দটি পেশযুক্ত হওয়ার কারণে অর্থের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে। এমতাবস্থায় প্রথম অংশটি دعا এবং দ্বিতীয় অংশটি خبر অর্থ প্রকাশ করেছে।
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো: هَلۡ يَسۡتَطِيۡعُ ربُّكَ (সূরা মায়েদা , ৫; আয়াত : ১১২।) এর স্থলে
هَلۡ تَسۡتَطِيۡعُ ربُّكَ প্রথম অংশে يَسۡتَطِيۡعُ শব্দটি صيغت غيب এবং ر ب শব্দটি পেশ যুক্ত : যার অর্থ হলো: তোমার রব কি এরুপ করতে সক্ষম? আর দ্বিতীয় অংশে تستطيع শব্দটি صيغت حاضر যার অর্থ হলো : হযরত ঈসা (আ:) - এর অবস্থা জিজ্ঞাসা করা হয়েছে।
এর জবাব হলো : খবরে আহাদের ভিত্তিতে যা বর্ণিত হয়েছে তা মুরদুদ বা পরিত্যক্ত, আর যা 'খবরে মুতাওয়াতের' এর ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে , তা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে বর্ণিত । যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন ; انزل القران علی سبعت احرف অর্থাৎ “আল-কোরআন সাত হরফে নাযিল করা হয়েছে ,এর প্রত্যেকটি যথষ্টে এবং পরিপূর্ণ । সুতরাং জানা গেল যে, আল-কোরআনের শব্দ ও অর্থের মধ্যে বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হলেও তাতে তার ই'জায হওয়ার ব্যাপারে কোন সংশয় ও সন্দেহের অবকাশ নেই ।
তাদের ষষ্ঠ অভিযোগ হলাে : আল কোরআনে 'লেহান' সুর এবং অকারণে শব্দের ‘তকরার' বা পুনরুক্তি আছে , যা নোহয়েত অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার। লোহনের উদাহারণ হলাে : اِنۡ هٰذَانِ لَسَاحِرَنِ অর্থাৎ “এরা উভয়ই যাদুকর। (আল-কোরআন, সূরা ত্বাহা, ২০ আয়াত : ৬৩।) আর লাফযী তাকরার বা একই শব্দের বার-বার পুনরুক্তির উদাহরণ হলাে সূরা রহমানের এ আয়াতটি;যথা : فَبِاَیِّ اٰلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ
অর্থাৎ, “হে জিন্ ও ইহসান' তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ নিয়ামতকে অস্বীকার কর? (দেখুন সূরা রাহমান, আল্-কোরআন।) আর 'মা'নুবী' বা তাৎপর্যপূর্ণ এবং মৌলিক পুনরুক্তির উদাহারণ হলাে : হযরত মূসা (আ.) এবং হযরত ঈসা (আ.) এর ঘটনা এগুলাে নিহায়েত বাহুল্যতা বৈ - কিছুই নয়, যা পরিত্যাজ্য ।
১. প্রথমে অভিযোগের জবাব হলাে: اِنۡ هٰذَانِ لَسَاحِرَنِ এ ব্যাপারে কথিত আছে যে, এটা আল - কোরআনের যারা 'কাতিব' বা লেখক ছিলেন তাদের ক্রটি।
কেননা ,আবু আমর اِنۡ هٰذَانِ পড়েছেন , এবং এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে , تثنيه বা দ্বি-বচন সূচক শব্দের الف অবশিষ্ট রাখা আরব ভাষা-ভাষীদের সাহিত্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য । যেমন এ কবিতাটি (অর্থাৎ সে রমণীর পিতা এবং তার পিতার-পিতা বা পিতামহ, সম্মানের স্বর্ণ-শিখরে আরোহন করেছিল ।)
: اَنّ اَبَاهَا وَ اَبَا اَبَاهَا لَقدۡ بَلَغَ فِی الۡمَجۡدِ غَايَتَاهَا 'আহলে - মদীনা' বা মদীনা বাসী এবং 'আহলে - ইরাক' বা ইরাকের অধিবাসীরা এসব স্থানে এ ভাষাতেই পাঠ করেছেন । আর কেউ কেউ এরূপও বলেছেন যে এটা কেবল اِنۡ هٰذَانِ শব্দের জন্য খাস, এখানে ن অক্ষরটি কেবল বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং অক্ষরটিকে তার স্বীয় অবস্থানে অবশিষ্ট রাখা হয়েছে এবং এখানে কোনরূপ পরিবর্তন করা হয়নি । যেমন الذين শব্দের মধ্যে এরূপ করা হয়েছে যে, সেখানে মূল الذی/ শব্দের শেষে কেবল ن অক্ষরটি বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ی অক্ষরটি তিন অবস্থায় (অর্থাৎ জের যবর পেশ) স্বীয় অবস্থায় অবস্থিত থাকে । আর এটা এজন্য যে , هذا শব্দটির = معرف (معرب আরবী ভাষায় গৃহীত ভিন্ন ভাষার শব্দ।) ও مبنی (معرب মূল আরবী ভাষার শব্দ।) এর ‘তাছনীয়া' বা দ্বিবচনের মধ্যে এবং الذی শব্দের معرب ও مبنی এর মাঝে মতানৈক্য আছে । তাছাড়া, এরূপও একটা বক্তব্য আছে যে ,এখানে ضمير شان ( ضمير شان এমন অব্যয় যা নিশ্চিতের সাথে কোন অবস্থা প্রকাশ করে ।) গুপ্ত আছে । যদি ব্যাপারটি সেরূপই হয়ে থাকে, তবে ل অক্ষরটি مبتدا (উদ্দেশ্য সূচক।) হয়েছে এবং এরূপ হওয়া কোন দোষনীয় ব্যাপার নয় যদিও এরূপ খুব কমই হয়ে থাকে ।
২. আর দ্বিতীয় অভিযোগের জবাব হলাে : শব্দের ও মৌলিক পুনরুক্তির মধ্যে অনেক উপকার নিহিত আছে যথা : (ক) এর দ্বারা বিষয়টি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে, আধিক্যতার সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় (খ) এর দ্বারা এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে , একই অর্থে এরূপ বাক্যে প্রকাশ করার শক্তি হাসিল হয় যার ايجاز বা সংক্ষিপ্ত ও اطناب বা দীর্ঘের মধ্যে পার্থক্য আছে ; আর এটা বালাগাতের একটি অন্যতম নিয়ম ; (গ) একটি কিসসা বা ঘটনা অনেক সময় বহু বিষয়ের সমষ্টি যুক্ত হয়ে থাকে ; তাই কোন কোন সময় কিসসাটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য থাকে - বিশেষ কোন ব্যাপার; কিন্তু সেই সাথে অন্যান্য প্রসংগও বর্ণিত হয়। আর কখনাে এর বিপরীত অবস্থাও হয়ে থাকে ।
এখন অবশিষ্ট রইলো অন্যান্য মু'জিযার প্রসংগ। যেমন : চন্দ্র দ্বি-খণ্ডিত হওয়া, জড় পদার্থের কথাবার্তা বলা এবং আন্দোলিত হয়ে নবী কারীম (সা.) এর নিকট আসা, জীব-জন্তুর কথা-বার্তা বলা, সামান্য খাদ্য দিয়ে বহু লোককে পেট পুরে খাওয়ানো ,আঙ্গুলের মাথা দিয়ে পানির ফোয়ারা বের হওয়া, গায়েবের খবর দেওয়া ইত্যাদি । আর এ ধরনের ঘটনা এত বেশী বর্ণিত আছে যে ,এ সীমিত পরিসরে তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও এসব মু'জিযার সবগুলি বর্ণনার দিক দিয়ে 'মুতাওয়াতির' নয়, তবুও এসব মু'জিযার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতভাবে বর্ণনা পরস্পরার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত । যেমন প্রতিষ্ঠিত হযরত আলী (রা.)-এর বীরত্ব-বাহাদুরী এবং হাতিম তাইয়ের (রহ.) সাখাওত বা দানের ঔদার্যতা। এসব ঘটনা বর্ণনা পরস্পরায় আমাদের কাছে পৌঁছেছে।কাজেই 'ইছবাতে নুবূওত' বা নুবুওতের-প্রমাণ প্রসঙ্গে উপরোক্ত আলোচনা আমাদের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করি ।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের 'ইছবাতে -নুবুওতের' পক্ষে আরো দলীল, মু'তাযিলা সম্প্রদায়ের আলিম জাহিয' এবং আমাদের মধ্যে থেকে ইমাম গাযযালী (রা.) যা পছন্দ করেছেন , তা উল্লেখযোগ্য । তাহলে : পূর্বোক্ত আলোচনায় দেখা গিয়েছে যে নুবুওত প্রাপ্তির আগে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থা, দাওয়াত পেশ করাকালীন অবস্থা, তাঁর মহান চরিত্র , বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত এবং এমন স্থানে অকুতোভয় দৃঢ় অবস্থান, যেখানে বড়-বড় বাহাদুররা হতচকিত হয়ে পড়ে এসব গুণাবলী ও কার্যাবলী দ্বারা তাঁর নুবুওতকে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে নিঃসন্দেহে দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে ।
উপরোক্ত বক্তব্যটি ব্যাখ্যাকারে এভাবে পেশ করা যেতে পারে যে ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের কোন কাজে এবং দুনিয়ার কোন ব্যাপারে-কোন দিন মিথ্যা বলনেনি। যদি তিনি এসব ক্ষেত্রে একবারও মিথ্যার আশ্রয় নিতেন, তবে তার শত্রুরা এ ব্যাপারটি ফলাও করে প্রচার করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতো।তাছাড়া তিনি নুবুওতের আগে এবং নুবুওতের পরে কোন দিন কোন অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হননি। এছাড়া তিনি ছিলেন বিশিষ্ট বাগী। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন : اتيت جوامع اكلم অর্থাৎ আমাকে সংক্ষেপে অধিক বস্তু পেশের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।( হাদীস শরীফ) বস্তুত তিনি ছিলেন “উম্মী এবং রিসালাতের দায়িত্ব মানুষের কাছে পৌছাতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন
ধরনের জুলুম-অত্যাচার, নির্যাতন -নিপীড়ন বরদত করেছিলেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছিলেন : ما او ذی نبی ما اوذيت অর্থাৎ “আমাকে যেরূপ কষ্ট দেওয়া হয়েছে , পূর্ববর্তী অন্য কোন নবীকে সেরূপ কষ্ট দেওয়া হয়নি। (হাদীস শরীফ।) আর এসব বিপদাপদ তিনি দৃঢ়তার সাথে ধৈর্য সহকারে মুকাবিলা করেন।
অবশেষে ,যখন তিনি শত্রুদের উপর বিজয়ী হন এবং লোকদের জান ও মালের উপর স্বীয় হুকুম ও আধিপত্য খাটানোর মত অবস্থায় উপনীত হন; তখন তার আগের অবস্থা ও স্বভাবের মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন সূচিত হয়নি , বরং তাঁর পবিত্র জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি এক সুমধুর আখলাক ও চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন । আর তিনি ছিলেন তাঁর উম্মতের জন্য চরম বন্ধু। যেমন আল্লাহ তা'লার এরশাদ : فَلَا تَذۡهَبۡ نَفُسُكَ عَلَيۡهِمۡ حَسَرَاةٍ অর্থাৎ আপনি দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হয়ে নিজের জীবন তাদের জন্য বিনাশ করবেন না।(সূরা ফাতির, ৩৫; আয়াত :৮)
فَلَعَلَّكَ بَاخعٌ نَّفۡسَكَ عَلٰی اٰثَارِهِمۡ অর্থাৎ মনে হয় আপনি তাদের চিন্তায় নিজের জীবনকে হালাক করে দিবেন (সূরা কাহফ, ১৮; আয়াত : ৬)।
তাছাড়া হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন খুবই দানশীল, সখী। যে কারণে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে এর থেকে বিরত থাকার জন্য ধমকের সুরে বলছেন : ولَا تَبۡسُطۡهَا كُلَّ الۡبَسۡطِ অর্থাৎ আপনি আপনার হাতকে দানের ক্ষেত্রে অধিক সম্প্রসারিত করবেন না। (সূরা বনী-ইসরাঈল, ১৭; আয়াত : ২৯)।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়ার ধন-সম্পদের প্রতি আদৌ কোন আকর্ষণ ছিল না। যেমন কথিত আছে যে , কুরায়েশ সর্দাররা তাকে তার দাওয়াতের কাজ থেকে বিরত থাকার উদ্দেশ্যে এরূপ প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে ,“তোমাকে আমরা আমাদের নেতা বানিয়ে নেব, অনেক ধন-সম্পদ দেব এবং ভোগের জন্য দেব সুন্দরী নারীদের ; তুমি তোমার দ্বীন প্রচারের এ খেয়াল পরিহার কর। কিন্তু তিনি পার্থিব এসব আপাতঃ মধুর ভোগ-বিলাস সামগ্রী ও সম্মানের দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেননি ; বরং তিনি ফকীর-মিসকীন ও গরীব অর্থহীনদের অধিক ভালবাসতেন এবং তাদের সাথে অবস্থান করাকে শ্রেয় মনষে করতেন । পক্ষান্তরে ; তিনি বিত্তবান ও ধনী ব্যক্তিদের সাহচর্য এড়িয়ে চলার চষ্টো করতনে এবং যতদূর সম্ভব তাদের প্রভাব থেকে নিজেকে দূর সরিয়ে রাখতনে।
তাছাড়া, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দুশমনদেরকে আদৌ ভয় করতেন না যদিও তা হতাে খুবই ভীত শঙ্কুল স্থান যেমন উদাহরণ স্বরূপ ওহোদ ও আহযাবের যুদ্ধের দিনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে ।এসব ঘটনা তাঁর ‘মজবুত দিলল' ও ‘বাতিনী কুওত' বা আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় বহন করে । যদি আল্লাহ তা'আলার পানাহ ও হিফাযত এর উপর তাঁর আস্থা না থাকতো, যেমন আল্লাহর ওয়াদা : وَالّلٰهُ يَعۡصِمُكَ مِنَ النَّاسِ অর্থাৎ আল্লাহ আপনাকে মানুষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করবেন। (সূরা মায়েদা , ৫; আয়াত : ৬৭)।
তবে আদৌ তাঁর পক্ষে এরূপ দৃঢ়তা প্রদর্শন সম্ভব হতো না। বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর এরূপ অবস্থানে কোনদিন কোনরূপ ব্যতায় পরিলক্ষিত হয়নি । যদিও সেখানে বিভিন্ন রূপ প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এসব দৃঢ়তা তাঁর নবী সুলভ আচরণের পক্ষে নিঃসন্দেহে মস্তবড় দলীল।
বস্তুত যদি কেউ উল্লেখিত এসব কাজ কর্ম ও বিষায়দি সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবষেণা করে , তবে সে জানতে পারবে যে , এর প্রত্যেকটি কাজ আলাদা আলাদাভাবে নুবুওতের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা কোন ব্যক্তির , অন্যান্যদের থেকে বিশেষ কোন কারণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ায় তিনি যে নবী, তা বুঝা যায় না। কিন্তু উপরে যে সব গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের কথা আলোচিত হয়েছে তা সম্মিলিত ভাবে একমাত্র নবীগণের চরিত্রের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কাজেই, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে উপরোক্ত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চরিত্র একাধারে সন্নিবেশিত থাকাই তাঁর নবী হওয়ার জন্য সব চাইতে বড় দলীল।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নুবুওতের স্বপক্ষে ইমাম রাযী (রহ.) যে প্রমাণ পেশ করেছেন, তাও প্রণিধান যোগ্য । যেমন তিনি বলনে : হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক কাওমের সামনে তার নুবুওতের দাবী পেশ করেন , যাদের কাছে পূর্ববর্তী কোন আসমানী কিতাব আসেনি , আর তাদের মধ্যে হিকমত বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাও ছিল না। বরং তারা ছিল সত্য প্রত্যাখ্যানকারী; যেমন -আরবের মুশরিকরা ছিল -মূর্তি পূজক, গোমরাহ; অহেতুক মিথ্যা কথা রটনাকারী-ইয়াহুদী; দুই খোদার ইবাদতকারী এবং যাদের নিকাহ করা হারাম, তাদের বিবাহকারী গোষ্ঠী -মজুস্ বা অগ্নি -উপাসক; এবং তিন খোদার দাবীদার-নাসারারা।
তিনি এদের সামনে তাঁর নুবুওতের দাবী পেশ করে বলেন : আমি তোমাদের কাছে স্পষ্ট কিতাব এবং হিকমতসহ প্রেরিত হয়েছি , যাতে উত্তম চরিত্রের আদর্শ তোমাদের সামনে পেশ করতে পারি ।সত্য-আকীদা দ্বারা লোকদের জ্ঞান-শক্তিকে বৃদ্ধি করতে পারি , নেক-আমল দিয়ে তাদের কাজের শক্তিকে সঞ্জীবিত করতে পারি এবং জ্ঞানীদেরকে ঈমান ও আমলে -সালেহ বা নেক-আমল দিয়ে আলোকিত করতে পারি।
বস্তুত তিনি এরূপই করেন এবং এর দ্বারা স্বীয় দ্বীনকে অন্যান্য দ্বীনের উপর বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করেন । যেমন আল্লাহ তা'আলা এর ওয়াদা করছিলেন যার ফলশ্রুতিতে , সে সব অসম্পূর্ণ ক্রটিযুক্ত ধর্মগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবাস্তব ও অসংলগ্ন কথাবার্তা দূরীভূত হয় এবং তাওহীদের সূর্য ও পবিত্রতার চন্দ্র পৃথিবীর আকাশে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর এ-ই হলাে নুবূওতের অর্থ।
কেননা , তিনি-ই নবী, যিনি মানুষের মানবতাকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে পৌছে দেন এবং তাদের দিলের সে সব গােপন -ব্যাধির চিকিৎসা করেন , যা অধিকাংশ মানুষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে । আর শরীরের রোগ ও অসুস্থতা ভাল করার জন্য যেমন শরীর-বিদ্যায় পারদর্শী ডাক্তারের প্রয়োজন তেমনি দিল বা আত্মার রোগ নিরাময় এর জন্য এমন একজন বিজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন, যিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ । আর বাস্তব অভিজ্ঞতায় স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে ,মানুষের দিলের এ ব্যাধি ও যুলমত বা অন্ধকারকে বিদূরিত করার জন্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের প্রভাব ছিল পরিপূর্ণ ও সূদুর প্রসারী। কাজেই , এর দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে , তিনি ছিলেন সমস্ত নবী ও রাসূল গণের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ।
উল্লেখ্য যে ,'মাতালিবে-আলীয়া' গ্রন্থে ইমাম রাযী (রহ) বর্ণনা করেছেন যে , নুবুওতের হাকীকত সম্পর্কে আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি তা সব-ই
'স্পষ্ট দলীল' স্বরূপ।
আর আমরা এ-ও বলেছি যে ,নুবুওতের মর্যাদা ও যোগ্যতা, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যা হাসিল করেছিলেন তা অন্য কোন নবী রাসূলগণের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি ।কাজেই , তিনি নবী-রাসূলগণের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ , সর্বোত্তম।
অপর দিকে , মু'জিযার দ্বারা নুবূওতকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারটি , “নিশ্চিত দলীল" দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। আর এ দলীল নুবুওতকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে 'হুকামা' বা জ্ঞানীদের তরীকা বা নিয়ম -নীতির অধিক নিকটবর্তী কেননা , এর মুখ্য উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ হলাে : মানুষ তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে এমন এক ব্যক্তির মুখাপেক্ষী , যাকে আল্লাহ তা'আয়ালার পক্ষ থেকে সাহায্য সহানুভূতি দেওয়া হয়; আর তিনি তাদের জন্য এমন 'কানুন' বা বিধান প্রণয়ন করেন , যা তাদের দো-জাহানের মঙ্গল ও কল্যাণে আসে।
[এ দ্বিতীয় অধ্যায়টি দার্শনিকদের সমালােচনার উদ্দেশ্যে তাদের অপূর্ণ ও অবাস্তব জ্ঞান সম্পর্কে কটাক্ষ করে এবং তাদের রচিত গ্রন্থাদি পাঠে যে ক্ষতি হয়, সেদিকে আলােকপাত করে -লিখিত হয়েছে]।