বিষয় নং-১১: দাঁড়ির এক মুষ্টির অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলা:
বর্তমানকালে ভুল বশত নিম্নের হাদিস দ্বারা কেউ কেউ এক মুষ্টির অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলা সুন্নাত বলে চালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। কারণ এই হাদিসের কোন ভিত্তিই নেই। ইমাম তিরমিযি (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-
حَدَّثَنَا هَنَّادٌ، قَالَ: حَدَّثَنَا عُمَرُ بْنُ هَارُونَ، عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَأْخُذُ مِنْ لِحْيَتِهِ مِنْ عَرْضِهَا وَطُولِهَا. هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ.
-‘‘হযরত আমর ইবনে শুয়াইব (رحمة الله) তার পিতা থেকে তিনি তার পিতামহ থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (ﷺ) দাঁড়ি মোবারকের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ কিছু কেটে ফেলতেন। ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদিসটি গরীব।’’ ৩৯
➥৩৯. ইমাম তিরমিযীঃ আস-সুনানঃ ৪/২০০পৃ, হা/২৭০০, ইমাম বাগভী, শরহে সুন্নাহ, ১২/১০৮পৃঃ
সনদ পর্যালোচনা:
প্রথমত. উক্ত হাদিসটি গরীব যা দলীলের যোগ্যতা রাখে না। শুধু তাই নয়, এই হাদিসের প্রধান রাবীর ভিত্তি সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী তিনি নিজেই বলেন-
وَسَمِعْتُ مُحَمَّدَ بْنَ إِسْمَاعِيلَ، يَقُولُ: عُمَرُ بْنُ هَارُونَ مُقَارِبُ الحَدِيثِ لاَ أَعْرِفُ لَهُ حَدِيثًا لَيْسَ لَهُ أَصْلٌ، أَوْ قَالَ، يَنْفَرِدُ بِهِ، إِلاَّ هَذَا الحَدِيثَ-
-‘‘আমি ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাঈ (বুখারী) কে বলতে শুনেছি, রাবী ‘উমর ইবনে হারুন’ হলেন মুকারিবুল হাদিস (কোন রকম চলনসই রাবী)। তার বর্ণিত যত হাদিস আমি জেনেছি সবগুলোরই ভিত্তি পাওয়া যায়, কিন্তু তার এই হাদিসটির কোনরূপ ভিত্তি পাওয়া যায় না, তিনি এটি একক বর্ণনাকারী, সে ছাড়া আর কারো সূত্রে জানা যায় না।’’ ৪০
➥৪০. ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, ৪/২০০ পৃঃ হা/২৭০০
তাই বুঝা গেল, ইমাম তিরমিযীর কাছেই এই হাদিসের ভিত্তি নেই। উক্ত হাদিসের প্রধান রাবী ‘উমার ইবনুল হারুন’ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (ওফাত. ১৮১ হি.) বলেন, তিনি একজন মিথ্যাবাদী। ৪১
➥৪১. ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ৭/৪৪১-৪৪২পৃঃ, ইবনে হাজার আসকালানীঃ তাক্বরীবুত তাহযীব, ২/১৪৭ পৃঃ
তাই ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী উক্ত হাদিসকে মওদ্বু বা জাল বলে উল্লেখ করেছেন। ৪২
➥৪২. ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ৭/৪৪১-৪৪২ পৃঃ
আহলে হাদিসদের ইমাম শাওকানী লিখেন-
وَقَالَ فِي التَّقْرِيبِ: إنَّهُ مَتْرُوكٌ
-‘‘ইনে হাজার তার তাক্বরীবুত তাহযিব বলেন, সে মাতরুক।’’ (শাওকানী, নায়লুল আউতার, ১/১৫০ পৃ.)
তাছাড়া উক্ত রাবীকে ইমাম ইবনে মাহদী, ইমাম আহমদ, ইমাম নাসাঈ বলেন, متروك الحديث -‘‘তিনি পরিত্যক্ত হাদিস বর্ণনা করতেন। এছাড়া ইয়াহিয়া ইবনু সাঈদ বলেন- كذاب خبيث -‘‘সে ছিল একজন মিথ্যাবাদী এবং খবীস প্রকৃতির লোক।’ ইমাম আবু দাউদ বলেন- غير ثقة -‘‘তিনি বিশ্বস্ত নন।’ মুহাদ্দিস আলী ইবনে মাদীনী ও ইমাম দারাকুতনী বলেন, ضعيف جدا-‘‘তিনি অত্যন্ত দুর্বল রাবী। মুহাদ্দিস আবু আলী নিশাপুরী বলেন, متروك -‘তিনি পরিত্যক্ত রাবী। ইমাম ইবনে হিব্বান ও অনুরূপ বলেছেন। হযরত আবু আব্বাস তিনি ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তার সম্পর্কে বলেন, ليس بشئ -‘তার হাদিস কিছুই নয়। ইমাম যাহাবী বলেন, তিনি বাতিল রাবী। ৪৩
➥৪৩. ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব, ৭/৪৪২-৪৪৪, ইমাম যাহাবীঃ মিযানুল ই’তিদালঃ ৩/২২২পৃ, হা/৬৬৮০, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত।
তাই সর্বোপরি বলা যায়, হাদিসটি বানোয়াট হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অপরদিকে আহলে হাদিসের শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী তার দুই গ্রন্থে উক্ত হাদিসটিকে জাল বলেছেন। ৪৪
➥৪৪. আহলে হাদিস আলবানী, দ্বঈফু জামেউস সগীর, ৬৫৩ পৃঃ, আহলে হাদিস আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ, ৪/৪৫৬-৪৫৭ পৃঃ হা/৪২৫৭
অপরদিকে আমাদের হানাফি মাযহাবের ইমাম মুহাম্মদ দুইজন সাহাবী হজ্জের সময় মাথা হলকের সময় দাঁড়ির এলোমেলো বাইরের অংশ কেটে ফেলতেন বলে এক মুষ্টির অথিরিক্ত কেটে ফেলার ফাতওয়া দেন। হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) এবং হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه), তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী এর বিষয়েও অনুরূপ বর্ণিত আছে। ৪৫
➥৪৫.
ক. ইমাম বুখারীঃ আস-সহীহঃ ৫/২২০৯ পৃঃ
খ. ইমাম নাসাঈঃ আস-সুনানুল কোবরা, ২/২৫৫ পৃঃ এবং ৬/৮২ পৃঃ
গ. ইমাম বায়হাকী, আস-সুনানুল কোবরা, ৫/১০৪ পৃঃ
ঘ. ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী, ১০/৩৫০পৃঃ
ঙ. ইমাম কাস্তাল্লানী, ইরশাদুস সারী শরহে বুখারীঃ ৮/৪৫০ পৃঃ
ইমাম আবূ দাউদ, বাগভী (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ يَحْيَى أَبُو مُحَمَّدٍ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ الْحَسَنِ، أَخْبَرَنِي الْحُسَيْنُ بْنُ وَاقِدٍ، حَدَّثَنَا مَرْوَانُ يَعْنِي ابْنَ سَالِمٍ الْمُقَفَّعَ، قَالَ: رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ يَقْبِضُ عَلَى لِحْيَتِهِ، فَيَقْطَعُ مَا زَادَ عَلَى الْكَفِّ
-‘‘তাবেয়ী ইবনে সালেম বলেন, আমি ইবনে উমর (رضي الله عنه) কে তাঁর দাঁড়ি ধরে এক মুষ্টির অধিক দাঁড়ি কর্তন করতে দেখেছি।’’
(ইমাম আবূ দাউদ, আস-সুনান, ২/৩০৬ পৃ. হা/২৩৫৭, ইমাম বাগভী, শরহে সুন্নাহ, ১২/১০৮-১০৯ পৃ. হা/৩১৯৪, ইমাম আবূ ইউসুফ, আল-আছার, ১/২৩৪ পৃ. হা/১০৪০, ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৮৪ পৃ. হা/১৫৩৬, বায়হাকী, আস-সুনানুল কোবরা, ৮/৪১১ পৃ. হা/৬০১২, ইমাম দারাকুতনী, আস-সুনান, ২/৯৭ পৃ. হা/৪৯৯) ইমাম হাকেম (رحمة الله) বলেন- هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَلَى شَرْطِ الشَّيْخَيْنِ -‘‘এ হাদিসটি শাইখাইনের (বুখারী মুসলিমের) শর্তানুসারে সহীহ।’’ (ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, হা/১৫৩৬)
হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه)-এর কর্ম বিষয়ক হাদিসটি ইমাম ইবনে আবি শায়বাহ (رحمة الله) সংকলন করেছেন। (ইমাম ইবনে আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ৫/২২৫ পৃ. হা/২৫৪৮১)
তাবেয়ী সিমাক ইবনে ইয়াযিদ (رحمة الله) আমিরুল মু‘মিনীন হযরত আলী (رضي الله عنه)ও এমনটি করতেন বলে উল্লেখ করেছেন। (ইমাম ইবনে আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ৫/২২৫ পৃ. হা/২৫৪৮০)
এই কারণেই একদল ফকীহ এক মুষ্টির বাইরে দাঁড়ি কেটে ফেলাকে মুবাহ বলেছেন এবং তার চেয়ে কম রাখা মাকরুহে তাহরীমী বলেছেন। তবে কোনো কোনো সাহাবী এটির হজ্জের সময়েই সুনির্দিষ্ট বলেও উল্লেখ করেছেন। (ইমাম ইবনে আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ৫/২২৫ পৃ. হা/২৫৪৮৭)