অধ্যায়ঃ কিতাবুল ইলম
আলিম-ই দ্বীন কে ফিক্বহ্ কি (হাদীসঃ ১৯০)
'আল্লাহ্ দান করেন, হুযূর বন্টন করেন'- এর ব্যাখ্যাঃ
ক্বাদেরী, হানাফী, শাফে'ঈ-এর মধ্যে পার্থক্যঃ
ﻭَﻋَﻦْ ﻣُﻌَﺎﻭﻳَﺔ ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ [ﷺ]
হযরত মু'আবিয়া [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ] হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ [ﷺ] এরশাদ করেছেনঃ
ﻣَﻦْ ﻳُﺮِﺩِ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻪ ﺧَﻴْﺮَ ﺍﻳْﻔَﻘﻬﻪُ ﻓﻲ ﺍﻟﺪﻳْﻦ ﻭَﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺍﻧَﺎ ﻗَﺎﺳِﻢ ﻭَﺍﻟﻠﻪ ﻳُﻌﻄﻰ .
❝আল্লাহ্ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের ফক্বীহ্ বানিয়ে দেন। আমি বন্টনকারী, আল্লাহ দান করেন।❞
( ﻣُﺘﻔَﻖ ﻋَﻠَﻴْﻪِ )
【 বােখারী, মুসলিম 】
উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় 'মির'আত শরহে মিশকাত'-এ উল্লেখ হয়েছেঃ
____________________________________
১. 【হযরত মু'আবিয়া [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ]】
টীকা- ১. ৭ . তাঁর নাম শরীফ- মু'আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদুস শামস ইবনে আবদে মানাফ। তাঁর বংশধারা পঞ্চম পুরুষে, অর্থাৎ আবদে মানাফে গিয়ে হুযূরের বংশধারার সাথে মিলে যায়। তাঁর মাতা হিনদ বিনতে ‘উতবা ইবনে রবী'আহ্ ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ। তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির বছর ইসলাম গ্রহণ করেন; কিন্তু মক্কা বিজয়ের দিনই ইসলাম প্রকাশ করেন। তিনি হুযুরের শ্যালক। ওহী লিখক। ফারূক্ব-ই আ’যম’র যুগে সিরিয়ার শাসক হয়েছিলেন । চল্লিশ বছর সেখানকারই শাসক ছিলেন। ইমাম হাসান ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা তাঁর অনুকুলে খিলাফতের পদ ছেড়ে দিয়ে সন্ধি করেছিলেন। তিনি ৭৮ বছর বয়সে ৬০ হিজরীতে ৪ রজব (মুখের) অর্ধাঙ্গ রােগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তিকাল করেন। তাঁর কাছে হুযুরের বরকতময় লুঙ্গী, চাদর শরীফ, কামীজ মুবারক এবং কিছু চুল ও নখ মুবারক ছিলো। তিনি ওসীয়ত করেছিলেন, "আমাকে এ পােষাক শরীফে কাফন দেবে এবং আমার মুখ ও নাকে হুযুরের নখ ও চুল মুবারক রেখে দেবে।" তাঁর পূর্ণাঙ্গ আদর্শ জীবনী আমার কিতাব ‘আমীরে মু'আবিয়া’তে দেখুন।
২. 【আল্লাহ্ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের ফক্বীহ্ বানিয়ে দেন।】
টীকা- ২. অর্থাৎ যাকে দ্বীনী ইলম, দ্বীনী বােধশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা দান করেন, স্মর্তব্য যে, 'ফিক্বহ্-ই যাহেরী' হচ্ছে ‘'শরীয়ত এবং ‘ফিক্বহ্-ই বাত্বেনী’ হচ্ছে তরীক্বত ও হাক্বীক্বত।★
★{শরীয়তের বাহ্যিক বিধিবিধান, ঈমান-আমল ইত্যাদি বুঝার নাম 'যাহেরী ফিক্বহ্'। আর ইলমে বাত্বিন বা ত্বরীক্বত সম্পৃক্ত বিষয়াদিসহ শরীয়ত বুঝা হলাে 'ফিক্বহে্ বাতেনী'।}
আলােচ্য হাদীসে উভয় ধরনের ফিক্হ অন্তর্ভুক্ত। এই হাদীস থেকে দু'টি মাসআলা প্রতীয়মান হয়:
এক. কোরআন ও হাদীসের তরজমা ও শব্দাবলী মুখস্থ করা ‘ইলমে দ্বীন’ নয়; বরং সেগুলাে বুঝাই হচ্ছে 'ইলমে দ্বীন'। এটা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ (যােগ্যতা অর্জনের) কারণেই ফক্বীহ্গণের অনুসরণ (তাক্বলীদ) করা হয়। এর ভিত্তিতে সমস্ত তাফসীর ও হাদীস বিশারদগণ মুজতাহিদ ইমামগণের মুকাল্লিদ (অনুসারী) হয়েছেন। হাদীস সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞানের উপর অহংবােধ করেন নি। ★★
★★{ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযীসহ সিহাহ'র ইমামগণ যেখানে কোন না কোন ইমামের তাক্বলীদ করেছেন, সেখানে ক্বোরআন-হাদীস সম্পর্কে সামান্য লেখাপড়া করে তাক্বলীদ (মুজতাহিদ-ইমামের অনুসরণ) করা (মাযহাবের অনুসরণ করা) কে উপেক্ষা করে আহলে ক্বোরআন বা ‘আহলে হাদীস’ হবার ইসলামী শরীয়তে কোন সুযােগ নেই। শাহ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।}
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেনঃ
ﻳُﺆْﺗِﻲ ﺍﻟْﺤِﻜْﻤَﺔَ ﻣَﻦ ﻳَﺸَﺎﺀُ ۚ ﻭَﻣَﻦ ﻳُﺆْﺕَ ﺍﻟْﺤِﻜْﻤَﺔَ ﻓَﻘَﺪْ ﺃُﻭﺗِﻲَ ﺧَﻴْﺮًﺍ ﻛَﺜِﻴﺮًﺍ
(এবং যাকে 'হিকমত' (প্রজ্ঞা) দান করা হয়, নিশ্চয় তাকে বহু কল্যাণ দেওয়া হয়। ২:২৬৯) এখানে ‘হিকমত’ অর্থ 'ফিক্বহ্'। কোরআন ও হাদীসের অনুবাদ তাে আবূ জাহলও জানতো।
দুই. কোরআন ও হাদীসের নিছক জ্ঞানার্জন পরিপূর্ণতার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং সেগুলাের মর্মার্থ বুঝার মধ্যেই রয়েছে পরিপূর্ণতা। 'আলিম-ই দ্বীন' হচ্ছেন ওই ব্যক্তি, যাঁর মুখে আল্লাহ-রসূলের বাণী থাকে এবং অন্তরে থাকে সেগুলাের ফয়য ও বরকত। ফয়য ও বরকত অর্জনে ব্যর্থ হলে বাণীগুলাে থেকে উপকৃত হতে পারবে না। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সংযােজন ব্যতীত বিদ্যুৎশক্তি কার্যকর হয় না।
৩. 【আমি বন্টনকারী, আল্লাহ দান করেন।】
টীকা- ৩. এ থেকে বুঝা গেলাে যে, দ্বীন ও দুনিয়ার সমস্ত ইলম, ঈমান, সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি দেন আল্লাহ্, বন্টন করেন হুযূর। যে যা পেয়েছে হুযুরের পবিত্র হাতেই পেয়েছে। কেননা, এখানে না আল্লাহর দানের শর্তারােপ করা হয়েছে, না হুযূরের বন্টনের ক্ষেত্রে। সুতরাং এ ধারণা সঠিক নয় যে, তিনি শুধু ইলম বন্টন করেন। নতুবা তখন এটা অনিবার্য হয়ে যাবে যে, আল্লাহও শুধু ইলম দান করেন। স্মর্তব্য যে, হুযুরের দান সমান্তরাল; কিন্তু গ্রহণকারীদের লওয়ার মধ্যে ব্যবধান আছে। বৈদ্যুতিক শক্তি (পাওয়ার) সমান্তরালভাবে আসে; কিন্তু বিভিন্ন পাওয়ারের বাল্ব সেগুলাের শক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ গ্রহণ করে। তারপর বাল্বের কাঁচের রঙ যেমন হয়, বিদ্যুতের আলাের রঙও তেমন হয়। হানাফী, শাফে'ঈ, অনুরূপ ক্বাদেরী, চিশতী হচ্ছে বিভিন্ন রঙের; কিন্তু প্রত্যেকটিতে পাওয়ার একই ধরনের। একই সমুদ্র হতে সমস্ত নদ-নদীর সৃষ্টি; কিন্তু রাস্তার ভিন্নতার কারণে ওইগুলাের নাম ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। অনুরূপ, ক্বাদেরী, চিশতী ইত্যাদি ওই সব বৃক্ষের নাম, যেগুলাে থেকে এ ফয়য ও বরকত আসে।
[মির'আত শরহে মিশকাত; খন্ড: ০১/১৯৪পৃ. হাদীসঃ ১৯০, অধ্যায়ঃ ইলম পর্ব, টীকা-(৭-৯)]