দ্বিতীয় অধ্যায়
কবরের উপর ইমারত তৈরী প্রসংগে উত্থাপিত আপত্তি সমূহের জবাব
এ বিষয়েল উপর কেবল দু’টি আপত্তি রয়েছেঃ
১ নং আপত্তিঃ মিশকাত শরীফের بَاب دفن الْمَيِّت অধ্যায়ে মুসলিম শরীফের বরাত দিয়ে বর্ণিত আছে -
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ.
হুযুর ﷺ কবরের উপর চুনকাম করা, ইমারত তৈরী করা এবং এর উপর বসাটা নিষেধ করেছেন।’’ ১৭৩
{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/পৃষ্ঠা-৫৩৩, হাদিস/১৬৯৭}
❏ অধিকন্তু অধিকাংশ ফকীহগণ-
يَكْرَهُ الْبِنَاءَ عَلَى الْقُبُوْرِ.
-‘‘কবরের উপর ইমারত তৈরী করাকে না পছন্দ করেছেন।’’
উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা তিনটি কাজ হারাম বোঝা গেল-কবর পাকা করা, কবরের উপর ইমারত তৈরী করা এবং কবরের পাশে খাদিম বনে অবস্থান করা।
উত্তরঃ তিন ধরনের কবর পাকা করা নিষেধ।
এক: কবরের অভ্যান্তরিন অংশ যা লাশের সাথে সংযুক্ত। এ জন্য হাদীছ শরীফে أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ বলা হয়েছে, কিন্তু عَلَى الْقُبُوْرِ বলা হয়নি।
দুই: সাধারণ মুসলমাদের কবর পাকা করা। কেননা এতে কোন ফায়দা নেই। তাই নির্বিশেষে প্রত্যেক কবরকে পাকা করতে নিষেধ করেছেন।
তিন: কারুকার্য করার উদ্দেশ্যে, লৌকিকতার কারণে বা গবর্বোধ করার জন্য কবর পাকা করা।
এ তিন ধরনের কবর পাকা করা নিষেধ। কিন্তু স্মৃতি রক্ষার করার জন্য যদি কোন আল্লাহর ওলীর কবর পাকা করা হয়, তাহলে জায়েয। কেননা হুযুর ﷺ হযরত উসমান ইবনে মযউনের কবর পাথর দ্বারা তৈরী করেছিলেন, যেমন প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
❏ প্রখ্যাত ‘আশআতুল লুমআত’ গ্রন্থে أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ এর ব্যাখ্যা প্রসংগে বলা হয়েছে-
لَمَّا فِيْهِ مِنَ الزِّيْنَةِ وِالْتَّكَلْفِ.
-‘‘কেননা এতে কেবল সজ্জিতকরণ ও লৌকিকতা প্রকাশ পায়।’’ তাই বোঝা গেল যদি এজন্য না হয়, তাহলে জায়েয আছে। وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ (কবরের উপর ইমারত তৈরী করা) এরও কয়েকটি অর্থ আছে, এক: কবরের উপর এভাবে ইমারত তৈরী করা যে, কবরটা ওয়ারের অন্তভূর্ক হয়ে যায়। যেমন
❏ ফত্ওয়ায়ে শামীর ‘দাফন’ শীর্ষক অধ্যায়ে আছে -
(قَوْلُهُ: وَتُكْرَهُ الزِّيَادَةُ عَلَيْهِ) لِمَا فِي صَحِيحِ مُسْلِمٍ عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهَى رَسُولُ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ، وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ .
-‘‘কবরকে এক হাত থেকে বেশী উঁচু করা নিষেধ। কেননা মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, হুযুর ﷺ কবরকে পাকা করা এবং এর উপর কিছু তৈরী করা নিষেধ বলেছেন।’’ ১৭৪
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৬।}
❏ একই অধ্যায়ে দুররুল মুখতারে বর্ণিত আছে-
(وَتُكْرَهُ الزِّيَادَةُ عَلَيْهِ) مِنْ التُّرَابِ لِأَنَّهُ بِمَنْزِلَةِ الْبِنَاءِ.
-‘‘কবরের উপর মাটির স্তুপ করা নিষেধ। কেননা এটা ইমারত তৈরী করার পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়।’’ ১৭৫
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৬।}
এর থেকে বোঝা গেল যে, কবরের উপর তৈরী করা মানে কবর দেওয়ালের অভ্যন্তরে পতিত হওয়া। কিন্তু গম্বুজ যা কবরের চারিদিকে পরিবেষ্টিত করে তৈরী করা হয়, নিষেধ নয়। দুই, এ নিষেধাজ্ঞা সাধারণ মুসলমানদের কবরের বেলায় প্রযোজ্য। তিন, এ ইমারত তৈরীর বিশ্লেষণ স্বয়ং অন্য হাদীছে রয়েছে, যেমন
❏ মিশকাত শরীফের المسجد শীর্ষক অধ্যায়ে আছে-
اللَّهُمَّ لَا تجْعَل قَبْرِي وثنا يعبد اشْتَدَّ غَضَبُ اللَّهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائهمْ مَسَاجِد.
-‘‘হে আল্লাহ, আমার কবরকে মূর্তিতে পরিণত কর না, যার পূজা করা হবে। ওই কওমের জন্য খোদার কঠিন গযব আছে, যারা স্বীয় নবীদের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে।’’ ১৭৬
{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/২৩৪ পৃঃ হা/৭৫০, ইমাম মালেক, আল-মুয়াত্তা, হা/৪১৬}
এর থেকে বোঝা গেল, কোন কবরকে মসজিদে পরিণত করা বা এর উপর ইমারত তৈরী করা বা সেদিক হয়ে নামায পড়া হারাম। এটাই হচ্ছে ঐ হাদীছের ভাবার্থ-কবরকে মসজিদে পরিণত করোনা। কবরকে মসজিদ বানানোর অর্থ হচ্ছে এর ইবাদত করা অথবা, একে কিবলা সাব্যস্ত করে সেদিকে সিজ্দা করা।
❏ আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) বুখারী শরীফের ফতহুল বারীতে বর্ণনা করেছেন-
وَقَالَ الْبَيْضَاوِيُّ لَمَّا كَانَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى يَسْجُدُونَ لِقُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ تَعْظِيمًا لِشَأْنِهِمْ وَيَجْعَلُونَهَا قِبْلَةً يَتَوَجَّهُونَ فِي الصَّلَاةِ نَحْوَهَا وَاتَّخَذُوهَا أَوْثَانًا لَعَنَهُمْ وَمَنَعَ الْمُسْلِمِينَ عَنْ مِثْلِ ذَلِكَ.
-‘‘আল্লামা বয়যাবী (رحمة الله) উলেখ করেছেন যে যখন ইহুদী ও নাসারা সম্প্রদায় পয়গাম্বরদের এবং ওনাদের কবরসমূহকে তারা মূর্তি বানিয়ে রেখেছিল, তখন হুযুর ﷺ এর জন্য লানত দিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকে এর থেকে বারণ করেছেন।’’ ১৭৭
{ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, ফতহুল বারী, ১/৫২৫পৃঃ }
এ হাদীছ দ্বারা আপত্তিকারীদের উপস্থাপিত হাদীছের ব্যাখ্যা হয়ে গেল এবং সুষ্পষ্ট বোঝা গেল যে, গম্বুজ তৈরী করা থেকে নিষেধ করেননি বরং কবরকে সিজদাগাহে পরিণত করা থেকে নিষেধ করেছেন। তাঁর এ নিষেধাজ্ঞা শরঈ হুকম নয়; বরং এটা সংযম ও তকওয়ার শিক্ষামাত্র। যেমন আমি প্রথম অধ্যায়ে উলেখ করেছি যে, বাসস্থান সমূহকেও পাকা করা থেকে বারণ করা হয়েছিল বরং পাকা ঘর ভেংগে দেয়া হয়েছিল। যদি ইমারত নির্মাণকারীর এ ধারণা থাকে যে ইমারাতের দ্বারা মৃতব্যক্তির আরাম ও উপকার হয়, তাহলে নাজায়েয, কেননা এটা ভুল ধারণা। কিন্তু যিয়ারতকারীদের আরামের জন্য যদি ইমারত তৈরী করা হয়, তাহলে জায়েয।
আমি এসব বিশ্লেষণ এজন্য করছি যে, অনেক সাহাবায়ে কিরাম বিশেষ বিশেষ কবরের উপর ইমারত তৈরী করেছেন। এটাকে সুন্নাতে সাহাবা বলা যায়। যেমন হযরত ফারুক (رضي الله عنه) হুযুর ﷺ'র পবিত্র কবরের চারপাশে ইমারত তৈরী করিয়েছেন। সৈয়্যদেনা হযরত ইবনে যুবায়ের (رضي الله عنه) একে আরও সুন্দর করেছেন। হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) এর স্ত্রী তাঁর স্বামীর কবরের উপর তাঁবু স্থাপন করেছিলেন যা আমি মিশকাত শরীফের البكاء অধ্যায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছি।
❏ হযরত যায়নুল আবেদীনের স্ত্রীর এ কার্যের প্রেক্ষাপটে মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) তাঁর রচিত মিরকাত শরহে মিশকাতের البكاء অধ্যায়ে উলেখ করেছেন-
الظَّاهِرُ أَنَّهُ لِاجْتِمَاعِ الْأَحْبَابِ لِلذِّكْرِ، وَالْقِرَاءَةِ، وَحُضُورِ الْأَصْحَابِ لِلدُّعَاءِ وَالْمَغْفِرَةِ وَالرَّحْمَةِ، وَأَمَّا جَعْلُ فِعْلِهَا عَلَى الْعَبَثِ الْمَكْرُوهِ كَمَا فَعَلَهُ ابْنُ حَجَرٍ فَغَيْرُ لَائِقٍ بِصَنِيعِ أَهْلِ الْبَيْتِ.
-‘‘এটা সুস্পষ্ট যে, বন্ধুবান্ধব ও সাহাবা কিরামকে জমায়েত করার অভিপ্রায়ে এ ঘরটা তৈরী করা হয়েছিল, যাতে যিকর আযকার, কুরআন তিলাওয়াত ও মাগফিরাতের জন্য প্রার্থনা করা যায়। কিন্তু উক্ত বিবি সাহেবানীর এ কাজকে অনর্থক মাকরূহ সাব্যস্ত করা আহলে বাইতের শানেন পরিপন্থী। ’’ ১৭৮
{মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ৩/১২৪৯ পৃঃ হা/১৭৪৯}
পরিষ্কার বোঝা গেল, অনর্থক ইমারাত তৈরী করা নিষেধ, কিন্তু যিয়ারতকারীদের আরামের জন্য জায়েয। অধিকন্তু হযরত উমর (رضي الله عنه) হযরত যয়নব বিনতে জাহশ (رضي الله عنه) এর কবরের গম্বুজবিশিষ্ট ঘর তৈরী করিয়েছিলেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) নিজের ভাই হযরত আবদুর রহমান ও হযরত মুহাম্মদ ইবনে হানীফা (رضي الله عنه) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করেছিলেন।
❏ ‘মুনতকা শরহে মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক’ গ্রন্থে হযরত আবু ওয়ালীদ সুলায়মান আন্দুলসী (ওফাত. ৪৭৪ হি.) বর্ণনা করেছেন-
وَقَدْ ضَرَبَهُ عُمَرُ عَلَى قَبْرِ زَيْنَبَ بِنْتِ جَحْشٍ وَكَرِهَ ضَرْبَهُ عَلَى قَبْرِ الرَّجُلِ ابْنُ عُمَرَ وَأَبُو هُرَيْرَةَ وَأَبُو سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ وَابْنُ الْمُسَيِّبِ وَضَرَبَتْهُ عَائِشَةُ عَلَى قَبْرِ أَخِيهَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ وَضَرَبَهُ مُحَمَّدُ بْنُ الْحَنَفِيَّةِ عَلَى قَبْرِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ ابْنُ حَبِيبٍ وَأَرَاهُ وَاسِعًا الْيَوْمَ وَالْيَوْمَيْنِ وَالثَّلَاثَةَ وَيُبَاتُ فِيهِ إنْ خِيفَ مِنْ نَبْشٍ أَوْ غَيْرِهِ، وَإِنَّمَا كَرِهَهُ مَنْ كَرِهَهُ لِمَنْ ضَرَبَهُ عَلَى وَجْهِ السُّمْعَةِ وَالْمُبَاهَاةِ.
-‘‘হযরত উমর (رضي الله عنه) যয়নব বিনতে জাহশের কবরের উপর, হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) স্বীয় ভাই আবদুর রহমানের কবরের উপর এবং মুহাম্মদ ইবনে হানীফা (ইবনে হযরত আলী) ইবনে আব্বাসের কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করেছিলেন। যিনি গম্বুজ তৈরী করাকে মাকরুহ বলেছেন, তিনি এ শর্তে বলেছেন যে, যদি গর্ববোধ ও ভন্ডামী করার অভিপ্রায়ে এটা তৈরী করা হয়।’’ ১৭৯
{আন্দুলসী, মুনতাকা শরহে মুয়াত্তায়ে মালেক, ২/২৩ পৃঃ }
❏ প্রসিদ্ধ ‘বদায়েউস সানায়ে’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৩২০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে-
وَرُوِيَ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَبَّاسٍ - رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا - لَمَّا مَاتَ بِالطَّائِفِ صَلَّى عَلَيْهِ مُحَمَّدُ بْنُ الْحَنَفِيَّةِ، وَكَبَّرَ عَلَيْهِ أَرْبَعًا، وَجَعَلَ لَهُ لَحْدًا وَأَدْخَلَهُ الْقَبْرَ مِنْ قِبَلِ الْقِبْلَةِ، وَجَعَلَ قَبْرَهُ مُسَنَّمًا وَضَرَبَ عَلَيْهِ فُسْطَاطًا.
-‘‘যখন তায়িফে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ইন্তিকাল ফরমান, তখন হযরত মুহাম্মদ ইবনে হানীফা তাঁর জানাযার নামায পড়েছেন, কবর প্রস্তুত করেছেন, জানাযার ৪ তাকবীরে আদায় করলেন, লহদ কবরে কিবলামুখি করে প্রবেশ করলেন এবং কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করিয়েছিলেন।’’ ১৮০
{‘বদায়েউস সানায়ে’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৩২০ পৃষ্ঠা}
❏ বুখারী শরীফের শরাহ আইনীতে আছে-
وضربه مُحَمَّد بن الْحَنَفِيَّة على قبر ابْن عَبَّاس.
হযরত মুহাম্মদ ইবনে হানীফা (رضي الله عنه) হযরত ইবনে আব্বাসের কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করিয়েছিলেন।’’ ১৮১
{আল্লামা আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ৮/১৩৪ পৃঃ }
সাহাবায়ে কিরাম এ কাজটি (অর্থাৎ গম্বুজ তৈরী) করলেন এবং সমস্ত উম্মত রসুলে খোদার রওযা মুবারকে যেতে আছে। কোন মুহাদ্দিছ, কোন ফকীহ কোন আলিম এ রওযা পাক পাক নিযে কোন আপত্তি উত্থাপন করেননি। তাই উপরোক্ত হাদীছের সেই বিশ্লেষণই করতে হবে, যা আমি করেছি। আর কবরের উপর বসার অর্থ হচ্ছে, স্বয়ং কবরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন, মাযারের খাদিম হওয়া নিষেধ নয়। খাদিম হচ্ছে, যিনি কবরের রক্ষণাবেক্ষণের করেন, মাযারের দরজার চাবি নিজের কাছে রাখেন ইত্যাদি। এ কাজটা সাহাবায়ে কিরাম থেকে প্রমাণিত আছে। মুসলমানদের মাতা হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) হুযুর ﷺ'র রওযা পাকের পরিচর্যাকারিনী ও চাবি রক্ষয়িত্রী ছিলেন। যখন সাহাবায়ে কিরাম যিয়ারত করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন তাঁর দ্বারা তালা খুলে যিয়ারত করতেন। (মিশকাত শরীফের الدفن অধ্যায়ে দেখুন) এখনও হুযুর (ﷺ) এর রওযা পাকের খাদিম নিয়োজিত আছেন কেউ ওটাকে নাজায়েয বলেননি।
২নং আপত্তি: মিশকাত শরীফের الدفن অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وَعَنْ أَبِي الْهَيَّاجِ الْأَسَدِيِّ قَالَ: قَالَ لِي عَلِيٌّ: أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِن لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مشرفا إِلَّا سويته. رَوَاهُ مُسلم.
-‘‘আবু হায়াজ আসদী থেকে বর্ণিত আছে- হযরত আলী (رضي الله عنه) আমাকে বলেছেন, “আমি কি তোমাকে ওই কাজের জন্য পাঠাবো না, যে কাজের জন্য আমাকে হুযুর ﷺ পাঠাতেন? কাজটি হচ্ছে কোন ফটো বিনষ্ট করা ছাড়া রাখিও না এবং কোন উঁচু কবর রাখিও না, একে সমান করে দাও।’’ ১৮২
{খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৫৩২ পৃঃ হা/১৯৯৬, সহীহ মুসলিম, ২/৬৬৬ পৃঃ হা/৯৬৯}
❏ বুখারী শরীফের প্রথম অধ্যায়ে কিতাবুল জনায়েযের بَابُ الجَرِيدِ عَلَى القَبْرِ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
وَرَأَى ابْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، فُسْطَاطًا عَلَى قَبْرِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، فَقَالَ: انْزِعْهُ يَا غُلاَمُ، فَإِنَّمَا يُظِلُّهُ عَمَلُهُ.
-‘‘হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) হযরত আবদুর রহমানের কবরের উপর তাঁবু দেখে বলেছিলেন, “হে বৎস, একে সরিয়ে ফেল, কেননা ওর আমলই ওর উপর ছায়া দিচ্ছে।’’ ১৮৩
{ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুুুল জানাইয, ২/৯৫ পৃঃ আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ৮/১৮৩ পৃঃ }
এ হাদীছ দু’টি থেকে বোঝা গেল যে, যদি কোন কবরের উপর ইমারত তৈরী করা হয় বা কবরকে উঁচু করা হয়, তাহলে ভেংগে দেয়া দরকার।
বিঃ দ্রঃ- এ হাদীছের আশ্রয় নিয়ে নজদী ওহাবীরা সাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বাইতের মাযারসমূহ ভেংগে ধুলিসাৎ করে দেয়।
উত্তর: যেসব কবরকে ভেংগে ফেলার জন্য হযরত আলী (رضي الله عنه) নির্দেশ দিয়েছিলেন, ওগুলো কাফিরদেরই কবর ছিল, মুসলমানদের নয়। এর কয়েকটি প্রমাণ রয়েছে-প্রথমতঃ হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেছেন- আমি তোমাকে ঐ কাজের জন্য পাঠাচ্ছি, যেটার জন্য আমাকে হুযুর ﷺ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হুযুর ﷺ'র যুগে হযরত আলী (رضي الله عنه) যেসব কবর ধ্বংস করেছিলেন, ওগুলো কিছুতেই মুসলমানদের কবর হতে পারে না। কেননা, সাহাবার দাফন কার্যে হুযুর ﷺ অংশ গ্রহণ করতেন। অধিকন্তু সাহাবায়ে কিরামও হুযুর ﷺ'র সাথে পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করতেন না। সুতরাং ঐ সময় মুসলমানদের যা কবর ছিল, ওগুলো আবার কোন উঁচু করা হতো। যেমন
❏ বুখারী শরীফে মসজিদে নববীর নির্মাণের বর্ণনা প্রসংগে উল্লেখিত আছে-
فَأَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقُبُورِ الْمُشْرِكِينَ فَنُبِشَتْ.
-‘‘হুযুর ﷺ মুশরিকদের কবর সমূহের বেলায় হুকুম দিয়েছিলেন। তখন ওগুলোকে উপড়ে ফেলা হয়েছিল।’’ ১৮৪
{ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুুুল জানাইয, ১/৯৩ পৃঃ , ইমাম নাসাঈ, আস-সুনান, ২/৩৯পৃঃ হা/৭০২, ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, হা/৪৫৩, আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ৪/১৭৫ পৃঃ }
❏ হযরত হাফেজ ইবনে হাজর (رحمة الله) ফতহুল বারী শরহে বুখারীর প্রথম খন্ডের ৫২৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
أَيْ دُونَ غَيْرِهَا مِنْ قُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ وَأَتْبَاعِهِمْ لِمَا فِي ذَلِكَ مِنَ الْإِهَانَةِ لَهُمْ.
-‘‘নবীগণ ও এদের অনুসারীদের কবরসমূহ বাদ দিয়ে, কেননা ওনাদের কবর উপড়ে ফেলাটা ওনাদের প্রতি অবমাননাকর হবে।’’
অন্যত্র আরও উলেখ করেছেন-
وَفِي الْحَدِيثِ جَوَازُ التَّصَرُّفِ فِي الْمَقْبَرَةِ الْمَمْلُوكَةِ بِالْهِبَةِ وَالْبَيْعِ وَجَوَازُ نَبْشِ الْقُبُورِ الدَّارِسَةِ إِذَا لَمْ تَكُنْ مُحْتَرَمَةً.
-‘‘এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়, যে কবরস্থান ইসলামী হুকুমতের অধীনে এসে গেছে, এতে হস্তক্ষেপ করা জায়েয এবং পুরাতন কবরসমূহের উপড়ে ফেলা যাবে। তবে শর্ত হলো, যেগুলো উপড়ে ফেলা হারাম, সেগুলো বাদ দিতে হবে।’’ ১৮৫
{ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, ফতহুল বারী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৫২৬।}
উপরের উল্লেখিত হাদীছ এবং এর ব্যাখ্যা দ্বারা বিরোধিতাকারীদের উত্থাপিত হযরত আলী (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যা হয়ে গেল অর্থাৎ সে হাদীছে মুশরিকদের কবর ভেংগে ফেলার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ উক্ত হাদীছে কবরের সাথে ফটোর কথাও উল্লেখিত আছে। কিন্তু মুসলমানদের কবরেতো ফটো থাকে না। তাই কাফিরদের কবরই বোঝা যায়, কেননা, ওদের কবরসমূহে মৃতব্যক্তির ফটোও থাকে না। তাই কাফিরদের কবরই বোঝা যায়, কেননা ওদের কবরসমূহে মৃতব্যক্তির ফটোও দেয়া হয়। তৃতীয়তাঃ উল্লেখিত হাদীছে বলা হয়েছে, ‘কবরকে যমীনের বরাবর করে দাও, কিন্তু মুসলমানদের কবরের বেলায় যমীন থেকে এত হাত উঁচু রাখা সুন্নাত। এতে যমীনের সাথে মিলিয়ে দেয়া’ সুন্নাতের বরখেলাপ। তাই মানতেই হবে যে, ওই কবরসমূহ কাফিরদেরই ছিল। অন্যথায় আশ্চর্যকর মনে হবে যে, হযরত আলী (رضي الله عنه) উঁচু কবরসমূহ উপড়ে ফেলেছেন আর তাঁরই সন্তান মুহাম্মদ ইবনে হানীফা হযরত ইবনে আব্বাসের কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করলেন। যদি কোন মুসলমানের কবর অতিরিক্ত উঁচুও হয়ে যায়, তবুও একে উপড়ে ফেলা উচিত নয়, কেননা, এতে মুসলমানের অবমাননা হয়। প্রথমেই উঁচু করানো। তবে যদি হয়ে যায়, তাহলে ভেংগে ফেল না। দেখুন, ছোট সাইজের কুরআন ছাপানো নিষেধ (শামী, কিতাবুল, কারাহিয়া দ্রষ্টব্য) কিন্তু যদি ছাপানো হয়ে গেল, তাহলে ফেলে দিও না বা জ্বালিয়ে ফেল না। কেননা উপরে বসা, ওখানে মলমূত্র ত্যাগ করা, জুতা পরে বা এমনি চলাফেরা করা নিষেধ। কিন্তু আফসোস! নজদী সরকার সাহাবায়ে কিরামের মাযার সমূহ ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। অথচ জিদ্দা শহরে খৃষ্টানদের উঁচু উঁচু কবর নিয়মিত হতেই আছে।
❏ হুযুর ﷺ ঠিকই বলেছেন-
يَقْتُلُونَ أَهْلَ الْإِسْلَامِ، وَيَتْرُكُونَ أَهْلَ الْأَوْثَانِ.
-‘‘তারা মুসলমানদেরকেই হত্যা করবে এবং মূর্তি পুজারীদেরকে ছেড়ে দেবে।’’ ১৮৬
{ইমাম ইবনে আবি আসেম, আস-সুন্নাহ, ২/৪৪০ পৃঃ হা/৯১০, পরিচ্ছেদ: بَابُ الْمَارِقَةِ، وَالْحَرُورِيَّةِ، وَالْخَوَارِجِ، السَّابِقِ لَهَا خِذْلَانُ خَالِقِهَا, হাদিসটি হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।}
প্রত্যেকের স্বজাতির প্রতি টান থাকে। হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) এর হাদীছ প্রমাণ হিসেবে পেশ করা নিছক বোকামী বৈ কিছু নয়। তিনি তো স্বয়ং বলেছেন-মৃত ব্যক্তির ছায়ার জন্য তার আমলসমূহই যথেষ্ট। যার ফলে, বোঝা গেল, যে মৃত ব্যক্তির ছায়ার জন্য যদি গম্বুজ বানানো হয়, তাহলে নাজায়েয। তবে যিয়ারতকারীদের আরামের জন্যে বানানো হলে জায়েয।
❏ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “আইনী"তে হযরত ইবনে উমরের এ হাদীছের প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আছে-
وَهِي الْإِشَارَة إِلَى أَن ضرب الْفسْطَاط إِن كَانَ لغَرَض صَحِيح كالتستر من الشَّمْس مثلا للإحياء لَا لإظلال الْمَيِّت فَقَط، جَازَ.
-‘‘এ হাদীছ দ্বারা ওইদিকে ইংগিত করা হয়েছে যে বৈধ উদ্দেশ্যে তাঁবু টাঙানো অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির ছায়ার জন্য নয়, জীবিতদেরকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করার জন্য জায়েয আছে।’’ ১৮৭
{আল্লামা আইনী, উমদাতুল ক্বারী শরহে সহীহুল বুখারী, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-১৮৩।}
এ ব্যাপারে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। একবার দ্বিপ্রহরের সময় হযরত মোল্লা আবদুল হাকীম ফাজিলে শিয়ালকুটি (রঃ) এর মাযার যিয়ারত করার একান্ত বাসনা দিয়ে শিয়ালকোর্ট গিয়েছিলাম। কিন্তু কবরের উপর কোন ছাউনি না থাকায়, তদুপরি মাটির গরম ও প্রখর রৌদ্রের কারণে তাড়াহুড়ো করে কোন মতে দু’এক আয়াত পাঠ করে চলে আসতে বাধ্য হলাম। মনের আবেগ মনেই রয়ে গেল। ওই দিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম মাযারের উপর ইমারত তৈরী করার অনেক ফায়দা রয়েছে।
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানে ২৬ পারা সূরা ফ'তাহের ১৮ আয়াত
إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ.
এর ব্যাখ্যা প্রসংগে বলা হয়েছে যে কতেক অহংকারী লোক বলে যে যেহেতু আজকাল লোকেরা আওলিয়া কিরামের কবরসমূহের তাযীম করে, তাই আমরা ওসব কবরসমূহ ভেংগে ফেলবো, যাতে এসব লোকেরা বুঝতে পারে যে আওলিয়া কিরামের কোন ক্ষমতা নেই। তা না হলে ওনারা নিজেদের কবরসমূহকে উচ্ছেদ করা থেকে রক্ষা করতেন-
فَاَعْلَمُ اَنَّ هَذَا الصَّنِيْع كَفْر صَرَاحَ مَأَخُوْذٌ مِنْ قَوْلِ فِرْعُوْنَ عَلَى مَا حِكَاه الله تَعَالٰى لَنَا فِي كِتَابِهِ القَدِيْم وَقَال فِرْعُوْنَ ذَوُونِى اَقْتُلَ مُوْسٰى وَلَيَدْعُ رَبَّهُ اِنِّى أَخَافُ اِنَّ يُبَدِّلَ دِيْنَكُمْ اَوْ ان يَظْهر فِي الْأَرْض الْفَسَاد.
-‘‘কিন্তু জেনে রাখ যে, এ ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে কুফরী। এটা ফিরাউনের সে উক্তিরই প্রতিধ্বনি। (যেমন সে বলেছিল) “আমাকে ছেড়ে দাও। আমি মূসাকে কতল করব। সে ইচ্ছা করলে তার খোদাকে ডাকুক। আমার ভয় হচ্ছে যে, সে তোমাদের ধর্মকে পালটে দেবে এবং পৃথিবীতে অরাজকতা সৃষ্টি করবে।” ১৮৮
{ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-৩৪।}
কেউ একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, যদি আওলিয়া কিরাম ও সাহাবায়ে কিরামের কোন ক্ষমতা থাকতো, তাহলে নজদী-ওহাবীদের থেকে নিজেদের কবর সমূহকে কেন রক্ষা করতে পারবো না? বোঝা গেল যে এগুলো নি®প্রাণ। তাই ওদের সম্মান-অসম্মান আবার কিসের? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম হুযুর ﷺ'র আগমনের আগে পবিত্র কা’বা শরীফে ৩৬০টি মূর্তি ছিল এবং হাদীছ শরীফে আছে যে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে এক ব্যক্তি কা’বা শরীফকে ভেংগে ফেলবে। বর্তমানে লাহোরের শহীদগঞ্জ মসজিদে শিখদের গুরদুয়ারায় পরিণত হয়ে গেছে এবং হিন্দুস্থানে অনেক মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাহলে হিন্দুরা যদি বলে খোদার যদি শক্তি থাকতো, তাহলে আমাদের হাত থেকে তার ঘরকে কেন রক্ষা করলো না? এর উত্তরে কি বলবেন? আল্লাহর ওলীগণ বা তাঁদের মাযারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তাঁদের খোদা প্রাপ্তির কারণেই করা হয়, কেবল ক্ষমতাবান বলে নয়, যেমন মসজিদসমূহ ও মক্কাশরীফের সম্মান করা হয়। ইবনে সাউদ অনেক মসজিদ ভেংগে ফেলেছে, যেমন সাফা পাহাড়ের উপর স্থাপিত হযরত বিলালের মসজিদ ইত্যাদি ইত্যাদি।