সূরা কাউসার সম্পর্কে ইমাম কুরতুবীর পর্যালোচনা
ইমাম কুরতুবি স্বীয় তাফসিরগ্রন্থে ‘কাউছার’ শব্দের ১৬টি অর্থ বর্ণনা করেছেন।
প্রথম: কাউছার হচ্ছে জান্নাতে অবস্থিত একটি নদী বা জান্নাতী প্রস্রবন। এ ব্যাপারে ইমাম বুখারি ও ইমাম তিরমিজি হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া ইমাম তিরমিজি হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন নিম্নরূপ
عن ابن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الكوثر نهر فى الجنة حافتاه من ذهب ومجراه على الدر والياقوت تربته اطيب من المسك وماؤه احلى من العسل وابيض من الثلج-
অর্থ: হযরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কাউছার হচ্ছে জান্নাতে অবস্থিত একটি নদী বা ঝর্ণা। যার উভয় তীর স্বর্ণ নির্মিত। পানি গড়িয়ে পড়ার জাগা হবে মণিমুক্তা ও ইয়াকুত নির্মিত। মাটি হবে মেশক আম্বরের চেয়ে সুগন্ধ। পানি হবে মধুর চেয়ে মিষ্টি ও বরফের চেয়ে শুভ্র। (ইমাম তিরমিজি ইহাকে হাসান ও সহিহ বলেছেন)
দ্বিতীয়: কাউছার হচ্ছে হাশরের ময়দানে অবস্থিত নবীজির হাউজ। আত্বা এই মতকে গ্রহণ করেছেন। যেমন মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদিস-
عن انس قال بينما نحن عند رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا اغفى اغفاءة ثم رفع رأسه متبسما- فقلنا ما اضحكك يا رسول الله- قال نزلت على انفا سورة- فقرأ بسم الله الرحمن الرحيم انا اعطينك الكوثر فصل لربك وانحر ان شانئك هو الابتر- ثم قال اتدرون ما الكوثر- قلنا الله ورسوله اعلم- قال فانه نهر وعدنى ربى عز وجل عليه خير كثير هو حوض ترد عليه امتى يوم القيامة انيته عدد النجوم فيختلج العبد منهم فاقول انه من امتى فيقال انك لا تدرى ما احدث بعدك-
অর্থ: হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমরা রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম এমন সময় তিনি তন্দ্রাবস্থায় ছিলেন। অতঃপর মুসকি হেঁসে মাথা মোবারক উত্তোলন করলেন। আমরা বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার হাসির কারণ কি? তিনি বললেন এইমাত্র আমার কাছে একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। অতঃপর তিনি সূরা কাউছার তিলাওয়াত করলেন। যার অর্থ হচ্ছে- ১. নিশ্চয় আমি আপনাকে কাউছার দান করেছি। ২. অতএব আপনি আপনার প্রভূর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন। ৩. নিশ্চয় আপনার শত্রুই নির্বংশ বা লেজকাঁটা। অতঃপর নবীজি বললেন তোমরা কি জান কাউছার কি? আমরা বললাম এ বিষয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন- কাউছার হচ্ছে একটি ঝর্ণা। যে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আমাকে অঙ্গীকার করেছেন। তা হবে অজস্র কল্যাণ। ইহা হচ্ছে হাউজ। কিয়ামতের দিন আমার উম্মতদেরকে সেখানে প্রেরণ করা হবে। যার পানপাত্র হবে নত্রের সমান। সে দিন কিছু লোককে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, সে তো আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত। তখন বলা হবে আপনি অবগত নন যে, সে আপানার পরিবর্তীতে ধর্মে কি নতুন জিনিস আবিস্কার করেছে।
তৃতীয়: হাউজ অর্থ হল নবুয়ত ও কিতাব। হযরত ইকরামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এ মত পোষণ করেছেন।
চতর্থ: কাউছার অর্থ হচ্ছে আল কুরআনুল কারীম। হযরত হাসান এ মত প্রদান করেছেন।
পঞ্চম: কাউছার অর্থ হল ইসলাম। হযরত মুগীরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এ মত পোষণ করেছেন।
ষষ্ঠ: কাউছার অর্থ হল কুরআনুল কারীমের সহজবোধ্যতা ও শরিয়তের শীথিলতা। হাসান বিন ফদল এ মত পোষণ করেছেন।
সপ্তম: কাউছার হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মতের আধিক্যতা। হযরত আবু বকর বিন আয়াশ এবং ইয়ামান বিন রিআব এ মতটি ব্যক্তি করেছেন।
অষ্টম: কাউছর অর্থ হচ্ছে সম্মান ও মর্যাদা। ইবনে কায়ছান উক্ত মতের অধিকারী।
নবম: কাউছার অর্থ হচ্ছে যিকিরের উচ্চ মর্যাদা। এ মত ব্যক্ত করেছেন আল মাওরিদী।
দশম: কাউছার অর্থ হচ্ছে আপনার (নবীর) কলবের নূর মোবারক। যা আপনাকে আমার দিকে পথপ্রদর্শন করেছে এবং আমি ব্যতিত অন্য সবকিছু থেকে আপনাকে দূরে রেখেছে।
একাদশ: কাউছার অর্থ হচ্ছে শাফায়াত।
দ্বাদশ: কাউছার হচ্ছে আপনার প্রভূর সেই কুদরত, যার মাধ্যমে আহলে ইজাবগণ আপনার দাওয়াতে হিদায়তপ্রাপ্ত হয়েছে। ইমাম ছালাবী এ মতটি গ্রহণ করেছেন।
ত্রয়োদশ: হিলাল বিন ইয়াছাফ বলেছেন কাউছার অর্থ হল কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
চতুর্দশ: কেউ কেউ বলেছেন, কাউছার হল ধর্মীয় ফিকাহশাস্ত্র।
পঞ্চদশ: কারো মতে কাউছার হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
ষোড়শ: ইবনে ইসহাকের মতে কাউছার হচ্ছে সুমহান বা সুউচ্চ বিষয়।
অতঃপর ইমাম কুরতুবি বলেন- উল্লেখিত ব্যাখ্যাসমূহের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থটিই অধিক বিশুদ্ধ। কেননা এগুলোর পে নস বা দলিল রয়েছে।
কাউসার শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা
কাউসার শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা
كوثر
শব্দটি فوعل এর ওজনে مبالغه এর ছিগা। শব্দটি
الكثرة মূল ধাতু থেকে উৎকলিত। এর অর্থ হলো অত্যধিক, অফুরন্ত, অসীম প্রভৃতি। সূরা কাউছারের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কেরাম লিখেছেন- কাউছার অর্থ হল নবীজির উচ্চ মর্যাদা, অগণিত উম্মত, অফুরন্ত নিয়ামত, খতমে নবুয়ত, অসংখ্য কল্যাণ, কোরআনুল কারীম, শাফায়াতে উজমা, আলে আওলাদ, উম্মতের আলেমগণ, পাঁচ ওয়াক্ত নামায, নবীজির শান-মানের অধিক চর্চা ও আবে কাউছার প্রভৃতি। নিম্নে বিস্তারিত বর্ণনা প্রদত্ত হলো-
তাফসিরে জালালাইন শরীফে উল্লেখিত আছে-
الكوثر الخير الكثير من النبوة والقران والشفاعة ونحوها
অর্থ: কাউছার হল অফুরন্ত কল্যাণ। যেমন নবুয়ত, কুরআন এবং শাফায়াত ইত্যাদি।
মিশকত শরীফের ৪৮৭ পৃষ্ঠায় পাশ্বটীকায় বর্ণিত হয়েছে-
ويفسر بالخير الكثير المفرط من العلم والعمل وشرف الدارين والنهر المذكور من جزئياته وفى القاموس الكوثر الكثير من كل شئ-
অর্থ: কাউছার শব্দের অর্থ হচ্ছে অফুরন্ত কল্যাণ, যা ইলিম আমল উভয় জগতের মর্যাদা বা হাদিসে বর্ণিত ঝর্ণা ইত্যাদি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। ‘কামুস’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে- প্রত্যেক বিষয়ে আধিক্যতাই হচ্ছে কাউছার।
যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস-
عن ابن عباس رضى الله تعالى عنه قال الكوثر الخير الكثير الذى اعطاه الله اياه- قال ابو بشر قلت لسعيد ان اناسا يزعمون انه نهر فى الجنة فقال سعيد- النهر الذى فى الجنة من الخير الذى اعطاه الله اياه- (بخارى)
অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- কাউছার হল অফুরন্ত কল্যাণ, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে প্রদান করেছেন। বর্ণনাকারী আবু বিশর বলেন, আমি সাঈদ বিন জুবাইরকে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষতো মনে করেন কাউছার হচ্ছে জান্নাতে অবস্থিত একটি নদী বা ঝর্ণা। তখন সাঈদ বললেন জান্নাতে অবস্থিত ঝর্ণাটি অফুরন্ত কল্যাণসমূহের একটি। যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে প্রদান করেছেন।
যেমন তাফসিরে জালালাইন শরীফে বলা হয়েছে-
الكوثر هو نهر فى الجنة او هو حوضه ترد عليه امته-
অর্থ কাউছার হচ্ছে জান্নাতে অবস্থিত একটি ঝর্ণা বা নদী। অথবা হাউজ হল কাউছার। যার প্রতি উম্মতে মুহাম্মদীদেরকে প্রেরণ করা হবে।৪
মিশকাত শরীফের ৪৮৭ পৃষ্ঠায় পাশ্বটীকায় বর্ণিত হয়েছে-
هو نهر فى الجنة ينفجر منه جميع انهارها- وقيل هو اولاده واتباعه او علماء امته وهو ايضا من افراده-
অর্থ: কাউছার হচ্ছে জান্নাতে অবস্থিত একটি নদী। ইহা হচ্ছে সমস্ত নদী বা ঝর্ণাসমূহের মূল উৎস। কেউ বলেছেন কাউছার হল রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তান এবং অনুসারীগণ। অথবা তাঁর উম্মতের উলামাগণ, অথবা কাউছার দ্বারা উম্মতের সংখ্যা ও বুঝায়।
এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসখানা দেখুন-
عن انس عن النبى صلى الله عليه وسلم قال بينما انا اسير فى الجنة اذا انا بنهر حافتاه قباب الدر المجوف قلت ما هذا يا جبريل- قال هذا الكوثر الذى اعطاك ربك فاذا طينه او طيبه مسك اذفر- (بخارى)
অর্থ: হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি জান্নাতে ভ্রমণ করছিলাম, এমন সময় একটি নদীর তীরে উপস্থিত হলাম। যার উভয় পার্শ্বে মণি-মুক্তা খচিত প্রাসাদসমূহ বিদ্যমান। আমি বললাম হে জিব্রাইল ইহা কী? তিনি বললেন ইহা হচ্ছে কাউছার। যা আল্লাহপাক আপনাকে প্রদান করেছেন। ইহার সুঘ্রাণ মেশ্ক আম্বরের চেয়ে অধিক। (বুখারি)
নবীজীর দুষমনই লেজকাটা নির্বংশ
কুখ্যাত কাফের নবীজির পরম দুশমন আস ইবনে ওয়াইলসহ অন্যরা যখন নবীজিকে আবতার বা নির্বংশ বলে উপহাস করল এবং নবীজির পবিত্র হৃদয়ে ব্যাথা দিল।
তখন মাহবুবের মনের ব্যাথা দূর করার জন্য স্বয়ং রাব্বুল আলামীন উক্ত সূরাটি অবতীর্ণ করে এ শান্ত্বনা প্রদান করলেন- হে বন্ধু আপনি কেন এ দুষ্ট লোকের কথায় চিন্তিত হচ্ছেন। আমি তো আপনাকে কাউছার দান করেছি। যা হচ্ছে উভয়জগতের সমস্ত কল্যাণের চাবিকাঠি। আপনি নির্বংশ নন। বরং সেই নির্বংশ, সেই কুখ্যাত, সেই লেজকাটা। যেমন কবি বলেন-
خالق کل نے آپ کو مالک کل بنادیا
دونوں جہاں ہیں آپ کے قبضہ واختیار میں-
অর্থ: সমগ্র সৃষ্টির স্রষ্টা আপনাকে সমগ্র সৃষ্টির মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। উভয় জাহানই আপনার আয়ত্বাধীন এবং আপনার ইচ্ছাধীন।
সুতরাং হে হাবিব! আপনার প্রভূর উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন ও কুরবানি করুন। অতঃপর এ সূরার সর্বশেষ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাদের কটুক্তির জবাবে বলেন-
ان شانئك هو الابتر
অর্থাৎ হে হাবিব! নিশ্চয় আপনার শত্রুই লেজকাটা বা নির্বংশ।
এ আয়াতে কারীমা দ্বারা নবীজির একটি শান প্রকাশ পেল যে, যদি কেউ নবীজির হৃদয়ে কষ্ট দেয়ার অপপ্রয়াস করে তখন স্বয়ং রাব্বুল আলামীন নবীজির পে জবাব প্রদান করেন।
এ ছাড়া আরো একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে গেল যে, শুধু আস ইবনে ওয়াইল নয় বরং যে ব্যক্তিই নবীজির শানে কটুক্তি, বেআদবি ও শত্রুতা পোষণ করবে সেই হবে নির্বংশ, সেই হবে লেজকাটা, সেই হবে সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে মেয়ে ধন সম্পদ কোন কিছুই কাজে আসবে না। তার নাম স্মরণ করার মত কেউ থাকবে না। তাকে আল্লাহর আযাব-গযব থেকে রা করার জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না। সুতরাং সেই হবে নির্বংশ।
এ প্রসঙ্গে ইমাম তাবারী বলেন-
واولى الاقوال فى ذالك عندى بالصواب ان يقال- ان الله تعالى ذكره اخبر ان مبغض رسول الله صلى الله عليه وسلم هو الاقل الاذل المنقطع عقبه فذلك صفة كل من ابغضه من الناس وان كانت الايه نزلت فى شخص بعينه-
অর্থ: আমার নিকট এ ব্যাপারে সবচেয়ে সঠিক ও উত্তম কথা হল- আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াত দ্বারা এ সংবাদ প্রদান করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শত্রুগণই দুর্বল নির্বংশ ও সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। অতএব ইহা এমন প্রত্যেক লোকের চরিত্র বলে গণ্য হবে যারা রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে শত্রুতা পোষণ করবে। যদিও আয়াতটি নির্দিষ্ট একজন লোকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল।
আস ইবনে ওয়াইল কিভাবে নির্বংশ
============
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন হে হাবিব! আপনার শত্র“ই আবতার বা নির্বংশ। এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, তা হল আয়াতটি নাজিল হয়েছে আস ইবনে ওয়াইলের ব্যাপারে। তার তো পুত্র সন্তান ছিল। তাহলে সে কিভাবে নির্বংশ হল?
এর জবাব হল, এখানে ‘আবতার’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সে সকল সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। অথবা অর্থ এই যে, তার সন্তানদেরকে ইসলামের হেদায়ত প্রদান করা হবে। যা দ্বারা পিতা ও পুত্রের মাঝে দ্বীনি মতানৈক্য সৃষ্টি হবে। আর দ্বীনি মতানৈক্য মূলত: মৃত্যুরই শামিল। এজন্যই মুসলমানদের মিরাস, জানাযা, দাফন-কাপন তার কাফির পিতা অথবা পুত্র করতে পারবে না। বাস্তবিকই আসের পুত্র হযরত আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করে একজন সম্মানিত সাহাবি হয়েছিলেন। অতএব আস বিন ওয়াইল প্রকৃত পক্ষেই নির্বংশ।
শেষ কথা
=====
আল্লাহপাকের দরবারে লক্ষ কোটি শোকরিয়া। তাঁর অশেষ মেহেরবাণীতে ছাক্বিয়ে কাউছার নবী মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে সামান্য কিছু আলোচনা করেছি। শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর পিয়ারা হাবিবের রেজামন্দী হাসিলের জন্য। হে আল্লাহ তুমি আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু কবুল কর। বিনিময়ে কিয়ামতের কঠিন দিনে তোমার হাবিবের হাউজে কাউছার নসিব কর। আমিন।
সুরা কাউছার আমাদের যা শিক্ষা দান করে
নাহমাদুহু নুসাল্লি ওয়া নুসাল্লিম আ'লা রাসুলিহিল কারীম।।আম্মা বা'দঃ-
আমি আপনাকে আল-কাউছার উপহার দিয়ে দিয়েছি, তাই তুমি তোমার প্রভুর প্রতি সালাত আদায় করুন, এবং কুরবানি করেন। আপনার শত্রুরাই তো নির্বংশ। [আল-কাউছার]
একদিন আমাদের বাবা-মাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসতে হবে, এই নিয়তি মেনে নেওয়াটা বড় কষ্টের। প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের জন্য সেদিন এক ভীষণ কষ্টের দিন। কিন্তু নিজের সন্তানকে কোনোদিন নিজের হাতে কাফনে জড়িয়ে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসবো, এই চিন্তা কোনো বাবা-মা’র পক্ষে করা সম্ভব নয়। আদরের ছোট শিশু সন্তানকে কবর দেওয়ার মত কষ্টের অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। রাসুল صلى الله عليه وسلم এর সাতটি সন্তান ছিল। ছয়টি সন্তানই অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল, শুধুই ফাতিমা (রা) বেঁচে ছিলেন। রাসুল صلى الله عليه وسلم নিজের হাতে ছয়-ছয়টি সন্তানকে কবর দিয়েছেন।
আমরা কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবো না সেটা কত কষ্টের অভিজ্ঞতা হতে পারে। একজন বাবা-মার পক্ষে সারাজীবনেও কোনোদিন সেই অভিজ্ঞতা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। একটি সন্তানের মৃত্যু হয়ত সামলানো যায়। দুটো, তিনটে হলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়। আর ছয়-ছয়টা সন্তানের মৃত্যু কী ভয়ংকর কষ্টের ব্যাপার হতে পারে, আমরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবো না। বিশেষ করে তার শিশু সন্তান আব্দাল্লাহ এর মৃত্যুর অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি কষ্টের।
তখন তিনি মক্কায় ছিলেন। ইসলামের প্রচারে বাঁধা দেওয়ার জন্য কাফিররা তার জীবন দুর্বিষহ করে ফেলেছিল। এমনকি তার নিজের প্রতিবেশী চাচা আবু লাহাব যখন জানলো শিশু সন্তানটি মারা গেছে, তখন সে রাস্তায় বের হয়ে রাসুলকে صلى الله عليه وسلم আনন্দ করা শুরু করলো যে, রাসুলেরصلى الله عليه وسلمবংশ শেষ। নিজের আত্মীয়দের কাছ থেকে এত জঘন্য ব্যবহার পেয়ে তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। এই ভয়ংকর কষ্ট থেকে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ تعالى তাকে সূরাহ আল-কাউছার পাঠালেন।
এত বড় একটি কষ্টে কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই অনেক সময় নিয়ে, অনেক কথা বলা দরকার? আল্লাহ تعالى যদি একটি বড় সূরাহ নাজিল করে তাকে অনেক সান্ত্বনা দিতেন তাহলে কী ভালো হতো না? কিন্তু আল্লাহ تعالى কুর‘আনের সবচেয়ে ছোট সূরাহ, মাত্র তিনটি আয়াতে তাকে এমন কী সান্ত্বনা দিলেন যে, শিশু সন্তানকে হারানোর কষ্ট রাসুল صلى الله عليه وسلم সামলে উঠলেন?
এখান থেকে আমরা একটা শিক্ষা পাই যে, কাউকে কষ্টের সময় বেশি কথা বলার দরকার নেই। অল্প কথায় যথাযথ উপদেশ দিয়ে তাকে তার মত থাকতে দিতে হবে। মানুষের কিছু সময় দরকার হয় নিজের মত একাকী থেকে কষ্ট সামলে নেওয়ার। বেশি কথা বললে বরং বেশি সমস্যা তৈরি হয়।
আমরা অনেকেই এই সূরাহ মুখস্ত করি কারণ এটা সবচেয়ে ছোট সূরাহ, তিলাওয়াত করাও অনেক সহজ। আমরা যদি এই সূরাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানি, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো এই ছোট সূরাহতেও কত গুরুত্বপূর্ণ বাণী আছে, যা একজন বাবাকে শিশু সন্তান হারানোর শোক সামাল দিতে পারে।
ধর্ম প্রচারকের জীবন এত কষ্টের হলে সেটা সত্য ধর্ম হয় কীভাবে?
অনেকে বলেন, কীভাবে একজন দয়াময় স্রস্টা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে এত কষ্ট দিতে পারেন? সাতটি সন্তান দিয়ে ছয়টিকেই নিয়ে যাওয়া? ইসলাম কীভাবে সত্য ধর্ম হতে পারে, যার প্রচারকের জীবনই ছিল এমন ভয়াবহ কষ্টের?
এটা একটা কুযুক্তি। অনেকটা ‘ডাক্তারের এত অসুখ হলে সে ভালো ডাক্তার হয় কীভাবে?’ —এধরনের কথা। এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, একজন ধর্ম প্রচারকের দুনিয়ার জীবন হবে আরাম, আয়েসের। কিন্তু এই ধরে নেওয়ার পেছনে কোনো ভিত্তি নেই।
নবী-রাসুলরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মান না। তারা নিজেরা আরাম আয়েসে জীবন পার করে ধর্ম প্রচার করে যান না। বরং আমরা দেখতে পাই, সবচেয়ে ভয়ংকর সব পরীক্ষা, চরম কষ্টের জীবন নবী-রসূলদেরই হয়ে থাকে। কেউ বলতে পারবে না যে, নবী-রসূলরা তো আরামের জীবন পার করে গেছেন। তারা কীভাবে বুঝবেন সাধারণ মানুষের জীবন কত কষ্টের? গরিব মানুষের কষ্ট, সন্তান হারা বাবার কষ্ট, স্ত্রী হারা স্বামীর কষ্ট, শত্রুর শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, যুদ্ধ করার কষ্ট, কারাবন্দী থাকার কষ্ট —এই সব কি আর নবী, রসূলরা বোঝেন নাকি? আরামে থাকলে অনেক নীতি কথা বলা যায়। —কারও সুযোগ নেই এধরনের কথা বলার, কারণ এই মহান মানুষেরা জীবনের কঠিনতম সব কষ্ট এবং ত্যাগ পার করে গেছেন। জীবন যুদ্ধে তাদের মত অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা মানুষের অভাবের কষ্ট বোঝেন, না খেয়ে থাকার জ্বালা জানেন, যুদ্ধের ভয়ংকর মানসিক এবং শারীরিক চাপ বোঝেন, প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করেন।
একইসাথে কেউ আল্লাহর تعالى বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবে না যে, আল্লাহ تعالىপৃথিবীতে কিছু মানুষ পাঠান যারা দুনিয়াতেও আরামের জীবন পার করে যায়, আবার আখিরাতে গিয়েও আরাম করে। কেউ বলতে পারবে না যে, স্রস্টা আমজনতার প্রতি অবিচার করেন: একদিকে তাদের এই জীবনে অনেক কষ্ট দেন, আবার আখিরাতেও কষ্ট দেন। নবী, রসূলরা এই জীবনে কত কষ্ট করেছেন, সেগুলো দেখলে তাদের জান্নাতে যাওয়া নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকবে না। তাদের মত ভয়ংকর কষ্টের জীবন যদি কাউকে সাধা হয় নেওয়ার জন্য, কেউ রাজি হবে না।
নবী, রসূলদের ভীষণ কষ্টের জীবন তাদের প্রস্তুতির অংশ। তারা যেন মানুষের কষ্ট বোঝেন, কষ্টের সময় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন, সঠিক উপদেশ দিতে পারেন, সেই জন্যই হয়ত আল্লাহ تعالى নবী, রসূলদের কঠিন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। তাদের কষ্টের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিঃসন্দেহে তাদের অনুসারীদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে।
আমরা যদি ইতিহাস দেখি, তাহলে দেখবো যে, ফাতিমা (রা) নিয়ে অনেক দলাদলি, অনেক সমস্যা হয়েছে। শিয়া সম্প্রদায় গত হাজার বছরে বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। রাসুলের
صلى الله عليه وسلمনাতি হাসান(রাঃ) এবং হুসাইন(রাঃ) নিয়ে গত হাজার বছরে যা হয়েছে তা বড়ই দুঃখজনক। যদি আরও বেশি সন্তান থাকতো, তাহলে কী ভয়াবহ ব্যাপার হতো আমরা চিন্তাও করতে পারি না। রাসুল صلى الله عليه وسلم এর মত একজন ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর পরিবারকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভক্তি থেকে দলাদলি, মতবিরোধ, বড় ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা হবেই। সেদিক থেকে চিন্তা করলে একজন সন্তান থাকাটাই আল্লাহ تعالى অসীম প্রজ্ঞা থেকে যথার্থ সিদ্ধান্ত। বরং একজন সন্তানও যদি না থাকত,তাহলে হয়ত আজকে শিয়া সম্প্রদায় সৃষ্টিই হতো না। কিন্তু তাহলে আমরা রাসুল صلى الله عليه وسلمজীবনের অনেক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারতাম না। যা হোক, আল্লাহ تعالى তার অসীম প্রজ্ঞায় যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মুসলিমরা সেটাই মেনে নেবে। যারা মুসলিম না, তারা নানা ধরনের সমস্যা খুঁজবে।
তাহলে তাকে এতগুলো সন্তান দেওয়ারই বা কী দরকার ছিল? একজন সন্তান দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখলেই হতো না? —আমরা মৃত্যু ব্যাপারটাকে বিধর্মীদের প্রভাবে পড়ে বেশি কঠিন করে ফেলেছি। মৃত্যু মানে আল্লাহর تعالىসম্পত্তি আল্লাহর تعالى কাছে ফিরে যাওয়া —এর বেশি কিছু নয়। এর থেকে বেশি কিছু বানালেই অশান্তি, হতাশা, বেদনা, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি নানা জটিলতা হয়। বিধর্মীদের মৃত্যু নিয়ে বিকৃত সব ধারণা, নাস্তিকদের জীবনকে আঁকড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা এবং জীবনটাকে খুব বেশি বড় করে দেখা — এগুলোর প্রভাব মুসলিমদের উপর পড়ে আজকে এই সব জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ইসলামের সহজ শিক্ষা, বাস্তবতাকে ভুলে গেছি। নিজেরাই নিজেদের উপরে প্রিয়জনদের মৃত্যু নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সমস্যা তৈরি করেছি।
একজন মুসলিম বিশ্বাস করেন, যদি আল্লাহ تعالى তার শিশু সন্তানকে নিয়ে যান, এবং সে এই পরিস্থিতিতে কদরকে মেনে নিয়ে, সবর করে —এই অবর্ণনীয় শোককে অতিক্রম করে বলে, “ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি র-জি’উন”— আল্লাহ تعالى তখন তাঁর সেই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ী তৈরি করার নির্দেশ দেন। তাছাড়া মৃত শিশু সন্তানটি জান্নাতে গিয়ে বাবা-মায়ের জন্য অপেক্ষা করে। আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা আল্লাহর تعالى কাছ থেকে এসেছি এবং আল্লাহর تعالى কাছেই আমরা ফিরে যাবো। তিনি تعالى তাঁর কিছু বান্দাকে সন্তান হারানোর শোক দিয়ে পরীক্ষা করবেন। কেন করবেন, সেটা শুধু তিনিই জানেন। কিন্তু যার পরীক্ষা যত কঠিন তার উপহারও তত বড় হবে। এবং তিনি কাউকে তাঁর বহনের অতিরিক্ত বোঝা দেন না —এটা তার ওয়াদা।
আমি আপনাকে আল-কাউছার উপহার দিয়ে দিয়েছি
আরবিতে কিছু দেওয়ার জন্য দুটো শব্দ আছে – آتَى আ-তা এবং أعطى আ’ত্বা। প্রথমটা হচ্ছে কাউকে কিছু দেওয়া। যেমন, আমি তোমাকে কলম দিয়েছি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কাউকে সম্মান করে কোনো বিরাট কিছু উপহার হিসেবে দেওয়া। আল্লাহ تعالى দ্বিতীয় শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কারণ রাসুলকে صلى الله عليه وسلمশুধুই তার কাজের প্রাপ্য দেওয়া হচ্ছে না, বরং আল্লাহর تعالى পক্ষ থেকে এটা বিরাট একটা উপহার, অকল্পনীয় সম্মান।
আমরা কেউ নিজেদের যোগ্যতায় জান্নাত অর্জন করি না, বরং আল্লাহ تعالى অনুগ্রহ করে আমাদেরকে দেন। যদি আমাদের সব কাজের হিসেব নিয়ে ন্যায্য বিচার করা হতো, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আমরা কেউ জান্নাতে যেতাম না। আমাদের নামাজগুলো বেশিরভাগই বাতিল হয়ে যেত, কারণ নামাজে এমন কিছু নেই যা আমরা ভাবি না। আমাদের রোজা বাতিল হয়ে যেত, কারণ রোজা রেখে আমরা মিথ্যা বলি, গীবত করি, আজেবাজে জিনিস দেখি। আমাদের ইবাদতগুলো এত ত্রুটিপূর্ণ যে, আল্লাহ تعالى যদি দয়া করে আমাদের ভুলগুলো উপেক্ষা না করেন, তাহলে খুব কম ইবাদতই কবুল হতো। আমরা কেউ আর জান্নাত পেতাম না। একারণে জাহান্নাম হচ্ছে উপযুক্ত শাস্তি, কিন্তু জান্নাত হচ্ছে আল্লার تعالى পক্ষ থেকে উপহার।
কাউছার শব্দ এসেছে কাছুরা থেকে। আরবিতে ‘বেশি’ বোঝানোর জন্য কয়েকটি শব্দ আছে। কাছরহ كَثْرَة অর্থ প্রচুর। কাছি-র كَثِير অর্থ অনেক বেশি। কাছুর كَثُر অর্থ অনেক-অনেক বেশি। আর আল-কাউছার الكوثر হচ্ছে এগুলোর চরম পর্যায়। এর অর্থ অকল্পনীয় বেশি, যার সাথে কিছুর তুলনাই হয় না।।রাসুল صلى الله عليه وسلم আল্লাহ تعالى বলছেন যে, তিনি তাকে ইতিমধ্যেই অকল্পনীয় বেশি কিছু উপহার হিসেবে দিয়েছেন। তার কোনো চিন্তাই করতে হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে অনেক বেশি কী দেওয়া হয়েছে তাকে?
সব কিছু। যা কিছু ভালো পাওয়া সম্ভব, তার সব কিছুই তাকে অকল্পনীয় পরিমাণে দেওয়া হয়েছে। এই আয়াতের তাফসিরে কাওছার বলতে সৃষ্টির সকল কিছু।।
এখন, এত বড় একটা সুখবর পাওয়ার পর তিনি কী করবেন? আনন্দ উৎসব করবেন?না—
তাই আপনি আপনার প্রভুর প্রতি সালাত আদায় করুন, এবং কুরবানি করেন
এত বড় একটা সুসংবাদ পাওয়ার পর নির্দেশ হচ্ছে সালাত আদায় করেন এবং কুরবানি দান করুন। ছোটখাটো দান বা কুরবানি করলেও হবে না। আন্হার এসেছে নাহ্র থেকে, যা গরু, ভেড়ার মত সাধারণ কিছু কুরবানি দেওয়া নয়, বরং উটের মত মূল্যবান কিছু কুরবানি দেওয়া। আগেকার আমলে উট ছিল মূল্যবান সম্পত্তি, যা একাধারে তাদের বাহন, খাবার এবং পানীয় উৎস। উট কুরবানি দেওয়া মানে বহু বছর ধরে কাঠখড় পুড়িয়ে বড় করা একটি মূল্যবান উপকারী সম্পদকে কুরবানি করে দেওয়া।
আজকের যুগে আমরা যদি চিন্তা করি, তাহলে এর তুলনা হবে: আপনি বহু বছর ধরে কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটা দামি মডেলের গাড়ি কিনলেন। সেই গাড়ি আপনি অনেক যত্ন করে নিয়মিত মুছে রাখেন। গাড়ি চড়ে বেড়াতে যান, অনুষ্ঠানে গিয়ে মানুষকে দেখিয়ে গর্ব করেন। এখন আপনাকে সেই দামি গাড়ি বিক্রি করে গরিবদের সব টাকা দান করে দিতে হবে। এরকম বড় ধরনের কুরবানি বা ত্যাগ হচ্ছে আনহার। আল্লাহ تعالى রসূলকে শুধু কুরবানিই করতে বলেননি, বরং তিনি বড় ধরনের কুরবানি করতে বলেছেন।
কাউকে জান্নাত গ্যারান্টি দেওয়ার পর তাকে যদি এই নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে আমরা যারা জান্নাত পাওয়ার জন্য দিনরাত চেষ্টা করছি, আমাদের তাহলে কী পর্যায়ের ইবাদত এবং কুরবানি করতে হবে জান্নাত পাওয়ার আশা করার জন্য, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আল্লাহ تعالى যাদেরকে দুনিয়াতে থাকতেই জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, তাদের কাউকেই তিনি এরপরে দুনিয়াতে যা ইচ্ছা করার লাইসেন্স দেননি। জান্নাতের নিশ্চয়তা উপহার হিসেবে গ্রহণ করতে চাইলে বান্দাকে বাকি জীবন আল্লাহর تعالى প্রতি বড় ধরনের আনুগত্য দেখাতে হবে।
এখানে চিন্তার ব্যাপার হয়েছে, কেন আল্লাহ تعالى শুধুই নামাজ আর কুরবানি করতে বললেন? তাহলে রোজা, হাজ্জ, যাকাত সহ অন্যান্য ইবাদতের কী হবে?
নামাজ হচ্ছে শারীরিক এবং আত্মিক ইবাদত যার মধ্যে কুর‘আন তিলাওয়াত এবং যিকর অন্তর্ভুক্ত। আর আনহার অর্থাৎ বড় কুরবানি হচ্ছে সম্পদের ইবাদত যার মধ্যে যাকাত এবং সাদাকা অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ تعالى রসূলকে এই দুটি ইবাদত করতে বলে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সার্বিক ইবাদত করতে বলেছেন। কারণ আমরা দেখতে পাই যে, কিছু মানুষ আছে যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে, কিন্তু তাদের ঈমানের আসল পরিচয় বের হয়ে যায় যখন তাদেরকে কিছু দান করতে বলা হয়। নিজের পকেট থেকে কিছু বের করে দান করতে তাদের বুক ছিঁড়ে যায়। আবার অনেক দানবীর আছেন যারা নিয়মিত দান করেন। তাদের অঢেল সম্পদ মানুষকে দিতে তাদের খুব একটা কষ্ট হয় না, বরং সেটা করে তারা একধরনের আত্মতৃপ্তি পান। কিন্তু তাদেরকে দিয়ে নামাজ পড়ানো যায় না। হয়ত জুমুআহ’র নামাজ তারা পড়েন। অনেকটা লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। কিন্তু দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়ার চিন্তাই তারা করতে পারেন না। নামাজ এবং কুরবানি এই দুই ইবাদত যিনি করতে পারেন, তিনি অন্তরে এবং বাইরে দুই দিকেই গভীর বিশ্বাস আনতে পেরেছেন। এই দুই ইবাদত প্রমাণ করে দেয় আল্লাহর تعالى অস্তিত্বে, তাঁর বাণীতে, কুর‘আনের সত্যতায়, দুনিয়ার পরীক্ষায় এবং আখিরাতের প্রতিদানে তার বিশ্বাস দৃঢ়। যাদের ভেতরে এই জিনিসগুলো দৃঢ় ভাবে আছে, তাদেরকে আর বাকি ইবাদতগুলো করার জন্য বলতে হয় না, তারা নিজে থেকেই করেন।
আপনার শত্রুরাই তো নির্বংশ
আজকে আমরা কেউ জানি না আবু লাহাবের বংশের কী হয়েছে, আবু জাহল এর নাতি-নাতনিরা কোথায় গেছে। যেই মানুষগুলো একসময় দুর্দান্ত প্রতাপশালী ছিল, তারা সবাই হারিয়ে গেছে।রাসুলের صلى الله عليه وسلم শত্রুরা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কারও কোনো খবর নেই। আল্লাহ تعالى তাদের নির্বংশ করে দেবেন ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, তা-ই সত্যি হয়েছে। আর অন্য দিকে রাসুুল صلى الله عليه وسلمএর মেয়ে ফাতিমা (রা) এর মাধ্যমে রসূলের বংশ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।রাসুল صلى الله عليه وسلم ইতিহাসের পাতায় অন্যতম প্রভাবশালী এবং সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে অমর হয়ে রয়েছেন।
সূত্রসমূহ
---------------------------------------------------------
বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন
মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
তাফসীর উল কু’রআন
কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
তাফসির ইবন আব্বাস।
তাফসির আল কুরতুবি।
তাফসির আল জালালাইন।
লুগাতুল কুরআন
তাফসীর আহসানুল বায়ান
কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ
তাফসির আল-কাবির।
তাফসির আল-কাশ্শাফ
নবীজীর বংশধারা কেয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে
কাফেররা যেই অর্থে নবীজিকে নির্বংশ বলে কটুক্তি করেছিল, সেই অর্থে নবীজি কখনই নির্বংশ নন। বরং সেই অর্থে কাফেররা নিজেরাই নির্বংশ। তাদের ধারনা ছিল নবীজির যেহেতু পুত্র-সন্তান ইন্তেকাল করেছেন। সুতরাং তার শান-মান বর্ণনা করার মত লোক পরবর্তীতে কেউ থাকবে না। এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে কাউছার প্রদানের ঘোষণা দিয়ে শান্ত্বনা দান করলেন- আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- হে নবী নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাউছার দান করেছি।
কাউছারের একটি অর্থ হলো অধিক চর্চা। তখন অর্থ হবে কাফিররা ধারণা করেছিল পরবর্তীতে তাঁর নামের চর্চা বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁকে কেউ চিনবে না। কেউ তাঁকে স্মরণও করবে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিবের নামের চর্চা কিয়ামত পর্যন্ত সবার উপরে জারি রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ورفعنالك ذكرك অর্থ আমি আপনার যিকিরকে বুলন্দ করেছি।
আবার কাউছারের আরেকটি অর্থ হল অধিক সন্তান। এতে দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমটি হল- যদিও রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুত্র সন্তান কেউ জীবিত নেই কিন্তু নবীজির মেয়ে বেহেস্তের মহিলাদের সর্দার মা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মাধ্যমে তাঁর বংশ কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
দ্বিতীয়টি হল নবীগণ হচ্ছেন পিতৃতুল্য আর তাদের উম্মতগণ তাদের সন্তান সমতুল্য। নবীজির উম্মতগণ তাঁর সন্তান স্বরূপ।
যেমন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেন-
النبى اولى بالمؤمنين من انفسهم وازواجه امهاتهم-
অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের প্রাণের চেয়েও অধিক নিকটে এবং তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মা।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে রুহুল বয়ানে বর্ণিত হয়েছে-
وفى قرأة ابن مسعود النبى اولى بالمؤمنين من انفسهم وهو اب لهم-
অর্থ: হযরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর কেরাতে রয়েছে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের প্রাণের চেয়েও অধিক নিকটে এবং তিনি মুমিনগণের পিতা।
এ প্রসঙ্গে মিশকাত শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একখানা হাদিস-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم انما انا لكم مثل الوالد لولده اعلمكم اذا اتيتم الغائط فلاتستقبلوا القبلة ولاتستدبروها- الخ (رواه ابن ماجه والدارمى)
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- পুত্রের নিকট পিতা যেমন, তোমাদের নিকট আমিও তেমন। আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দেই। যখন তোমরা পেশাব-পায়খানা (বাথরুমে) যাবে তখন কিবলার দিকে মুখ করে অথবা পিছন ফিরে বসবে না। (সংক্ষিপ্ত) ইবনে মাজাহ ও দারেমি।