বিষয় নং-০৪: লোকটি কেমন ছিল বা মৃত ব্যক্তির প্রশংসা করা।
“হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থের ৬০০ পৃষ্ঠায় লেখক উলেখ করেছেন যে, ‘‘মৃত দেহ সামনে রেখে উপস্থিত মুসল্লিগণকে প্রশ্ন করা হয়, লোকটি কেমন ছিল? সকলেই বলেন ভাল ছিল ... ইত্যাদি। এই কর্মটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।’’
এ মিথ্যাও জঘন্য বক্তব্যের জবাব
দলীলবিহীন লেখকের মূর্খতার পরিচয় খুব ভালভাবেই পাওয়া গেল। তিনি অসংখ্য সহীহ হাদিসকে অস্বীকার ও ইনকার করেছেন। অসংখ্য সহীহ হাদিস অস্বীকার করার পাশাপাশি একটি নেক আমল বা পূণ্যময় কাজকে অস্বীকার করে গোমরাহীর পরিচয় দান করেছেন। একজন মুসলমান বান্দা তার জীবনে অনেক নেক আমল করেছে পাশাপাশি গুনাহও করেছে কম বেশী। এখন মৃত্যুর পর তার কোনটা আলোচনা করা যায়? ভাল দিকটা, না মন্দটা।
❏ প্রিয় নবী করীম (ﷺ) এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে মৃত ব্যক্তির কল্যাণে সুন্দর নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন,
عَنْ عَطَاءٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ ؓ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : اذْكُرُوا مَحَاسِنَ مَوْتَاكُمْ، وَكُفُّوا عَنْ مَسَاوِيهِمْ
-‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে খোদা (ﷺ) ইরশাদ করেন, তোমরা মৃত ব্যক্তির ভাল কাজের আলোচনা কর এবং মন্দ কার্যাদি বা বিষয়াদি আলোচনা করা থেকে বিরত থাক।’’ ৭
➥{১. আবূ দাউদ, আস্-সুনান, ৪/২৭৫ পৃ. হাদিস, ৪৯০০, তিরমিযী, আস্-সুনান, ২/৩৩০ পৃ. হাদিস:১০১৯, বায়হাকী, সুনানিল কোবরা, ৪/৭৫ পৃ. হাকিম নিশাপুরী, মুস্তাদরাক, ১/৫৪২ পৃ. হাদিস, ১৪২১, সুয়ূতি, জামেউস সগীর, ১/৭১ পৃ. হাদিস, ৯০৫, আবি বকর খাল্লাল, আস্-সুন্নাহ, ৩/৫১৩ পৃ. হাদিস:৮২৯, সহীহ ইবনে হিব্বান, ৭/২৯০ পৃ. হা/৩০২০, তাবরানী, মু‘জামুস সগীর, ১/২৮০ পৃ. হাদিস:৪৬১ ও মু‘জামুল কাবীর, ১২/৪৩৮ পৃ. হাদিস, ১৩৫৯৯, ইবনে মুকরী, আল-মু‘জাম, ১/১৪৯পৃ. হাদিস, ৪১৮, বায়হাকী, আল-আদাব, ১/১১৭পৃ. হা/২৮২, এ সনদটি হযরত আয়েশা হতে, সুনানিল কোবরা, ৪/১২৬পৃ. হাদিস, ৭১৮৯, শুয়াবুল ঈমান, ৯/৫৬ পৃ. হা/৬২৫২, বাগভী, শরহে সুন্নাহ, ৫/৩৮৭পৃ. হাদিস, ১৫০৯, তিনি বলেন, সনদটি সহীহ, হাইসামী, মাওয়ারিদুয্-যামান, ১/৪৮৭পৃ. হাদিস, ১৯৮৬, ইবনে আছির, জামিউল আছির, ১০/৭৬৫ পৃ. হাদিস, ৮৪৫০, নববী, খুলাসাতুল আহকাম, ২/৯৪৪পৃ. হাদিস, ৩৩৫৩, মিয্যী, তুহফাতুল আশরাফ, ৬/১১ পৃ. হা/৭৩২৮, সুয়ূতি, আদ্দুরুল মুনতাসিরাহ, ১/৬৮ পৃ. হাদিস:৭১, শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ১/১৫৩পৃ. হাদিস, ১৫৮৩}
هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ، وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ، -
-‘‘ইমাম হাকিম (رحمة الله) বলেন, উক্ত হাদিসটির সনদ বিশুদ্ধ। যদিও ইমাম বুখারী (رحمة الله) ও মুসলিম (رحمة الله) উহা বর্ণনা করেননি।’’ ৮
➥{ক. হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৪২ পৃ. হা/১৪২১
খ. সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, ৬৭ পৃ. হাদিস, ৮৪
গ. আল্লামা জালালুদ্দীন আমজাদী: আনওয়ারুল হাদিস, ২৩৪ পৃ.}
❏ অপরদিকে ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতি (رحمة الله) তার গ্রন্থে বলেন, উক্ত হাদিসটি সহীহ। আলবানী সুনানে তিরমিযীর টিকায় দ্বঈফ বলার কোন ভিত্তি আমাদের কাছে নেই।
তাই উক্ত হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমাণ পাওয়া গেল যে, মৃত ব্যক্তির মন্দ কার্যাদি আলোচনা করা বা প্রকাশ করা নিষেধ। এখন বাকী রইলো মৃত ব্যক্তির প্রশংসা।
❏ এ প্রসঙ্গে রাসূলে খোদা (ﷺ) ইরশাদ ফরমান,
أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، يَقُولُ: مَرُّوا بِجَنَازَةٍ، فَأَثْنَوْا عَلَيْهَا خَيْرًا، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَجَبَتْ ثُمَّ مَرُّوا بِأُخْرَى فَأَثْنَوْا عَلَيْهَا شَرًّا، فَقَالَ: وَجَبَتْ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: مَا وَجَبَتْ؟ قَالَ: هَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ خَيْرًا، فَوَجَبَتْ لَهُ الجَنَّةُ، وَهَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ شَرًّا، فَوَجَبَتْ لَهُ النَّارُ، أَنْتُمْ شُهَدَاءُ اللهِ فِي الأَرْضِ
-‘‘হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিছু সাহাবায়ে কেরাম ও রাসূল (ﷺ) একটি জানাযার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছু সংখ্যক লোক তারা মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির ভাল গুণাবলী আলোচনা করছিলেন, তখন প্রিয় নবী (ﷺ) বললেন, (তোমাদের ভাল প্রশংসার দ্বারা) ওয়াজিব হয়ে গেল। অপর আরেকটি জানাযার পাশ দিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে লোকেরা মৃত ব্যক্তিদের মন্দ বিষয়াদি আলোচনা করছিলেন, তখন প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, (তোমাদের মন্দ আলোচনার দ্বারা) ওয়াজিব হয়ে গেল। হযরত উমর (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! কি চূড়ান্ত বা ওয়াজিব হয়ে গেল? প্রিয় নবী (ﷺ) ইরশাদ করলেন, যে মৃত ব্যক্তিটির তোমরা ভাল গুণাবলী আলোচনা করেছ, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। আর যে মৃত ব্যক্তির মন্দ আলোচনা করেছ তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেল। কেননা তোমরা জমিনে আল্লাহর সাক্ষী স্বরূপ।’’ ৯
➥{ক. ইমাম বুখারী : আস্ সহীহ : কিতাবুয জানাইয : ১/৪৬০ পৃ. হা/১৩৬৭
খ. ইমাম মুসলিম : আস্ সহীহ : ২/৬৫৫ পৃ. : কিতাবুয্ জানাইয : হা/৯৪৯
গ. খতিব তিবরিযী : মিশকাতুল মাসাবীহ : ১/৩১৭ পৃ., হা/১৬৬২
ঘ. ইমাম তিরমিযী, আস্-সুনান, ২/৪৫ পৃ. হা/১০৬০}
❏ এ প্রসঙ্গে আরো সহীহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যেমন বর্ণনায় এসেছে-
عَنْ أَبِي الأَسْوَدِ، قَالَ: قَدِمْتُ المَدِينَةَ وَقَدْ وَقَعَ بِهَا مَرَضٌ، فَجَلَسْتُ إِلَى عُمَرَ بْنِ الخَطَّابِ ؓ، فَمَرَّتْ بِهِمْ جَنَازَةٌ، فَأُثْنِيَ عَلَى صَاحِبِهَا خَيْرًا، فَقَالَ عُمَرُ ؓ: وَجَبَتْ، ثُمَّ مُرَّ بِأُخْرَى فَأُثْنِيَ عَلَى صَاحِبِهَا خَيْرًا، فَقَالَ عُمَرُ ؓ: وَجَبَتْ، ثُمَّ مُرَّ بِالثَّالِثَةِ فَأُثْنِيَ عَلَى صَاحِبِهَا شَرًّا، فَقَالَ: وَجَبَتْ، فَقَالَ أَبُو الأَسْوَدِ: فَقُلْتُ: وَمَا وَجَبَتْ يَا أَمِيرَ المُؤْمِنِينَ؟ قَالَ: قُلْتُ كَمَا قَالَ النَّبِيُّ ﷺ : أَيُّمَا مُسْلِمٍ، شَهِدَ لَهُ أَرْبَعَةٌ بِخَيْرٍ، أَدْخَلَهُ اللَّهُ الجَنَّةَ فَقُلْنَا: وَثَلاَثَةٌ، قَالَ: وَثَلاَثَةٌ فَقُلْنَا: وَاثْنَانِ، قَالَ: وَاثْنَانِ ثُمَّ لَمْ نَسْأَلْهُ عَنِ الوَاحِدِ -
-‘‘হযরত আবুল আসওয়াদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি মদিনায় এসে দেখলাম, সেখানে একটি রোগ বিস্তার লাভ করেছে। আমি ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) এর নিকট বসলাম। তাঁর নিকট দিয়ে একটি জানাযা চলে গেল ও (সেই) মৃত লোকটির প্রশংসা করা হল। তিনি (ওমরرضي الله عنه) বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। তারপর অপর একটি জানাযা চলে গেলে (সেই) মৃত লোকটির মানুষ বদনাম করল। এবারও তিনি বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেল। আবুল আসওয়াদ বলেন, আমি তখন বললাম, হে আমিরুল মু’মিনিন! কি ওয়াজিব হল? হযরত ওমর (رضي الله عنه) বললেন, হুযূর (ﷺ) যা বলেছিলেন আমিও তাই বললাম। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান যে, চার জন ঈমানদার ব্যক্তি যদি একজন মুসলমানকে ভাল ঈমানদার বলে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে আল্লাহ্ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আমি (বর্ণনাকারী) জিজ্ঞাসা করলাম, যদি তিনজন হয়? রাসূল (ﷺ) বললেন, তাহলেও। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, যদি দুই জন সাক্ষ্য দেয়? রাসূল (ﷺ) বললেন, তাহলেও। বর্ণনাকারী (উমর رضي الله عنه) বলেন, তারপর একজনের ব্যাপারে আমি আর প্রশ্ন করিনি।’’ ১০
➥{ক. আল্লামা ইমাম বুখারী : আস সহীহ :১/৩৮০ পৃ. কিতাবুয জানাইয : হা/১০৬১
ঘ. নাসায়ী, আস্-সুনান, ৪/৫০ পৃ. হা/১৯৩৪}
❏ মৃত ব্যক্তির খারাপ দিকগুলো সমালোচনা করার ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান -
عَنْ مُجَاهِدٍ، عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ: لَا تَسُبُّوا الْأَمْوَاتَ، فَإِنَّهُمْ قَدْ أَفْضَوْا إِلَى مَا قَدَّمُوا-
-‘‘হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। আল্লাহর হাবীব (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, তোমরা মৃতদেরকে গালি দিওনা, বদনাম করোনা। কারণ তারা তাদের নিজের কার্যাদির নিকট পৌছে গেছে।’’ ১১
➥{ক. ইমাম বুখারী : আস সহীহ : ১/৩৫০ কিতাবুয জানাইয : হা/১৩৯৩
খ. ইমাম নাসাঈ : আস সুনান : ৪/৫৩ পৃ. হাদিস নং : ১৯৩৬
গ. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল : আল্ মুসনাদ : ৬/১৮০ পৃ.}
এসব আমল সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যা, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মৃত ব্যক্তি সম্পর্কিত ভাল বলতে আদেশ করেছেন এবং মন্দ বলতে নিষেধ করেছেন। নিশ্চয়ই মানুষ মৃত ব্যক্তির মঙ্গল কামনায় দুআ করার জন্যই তাকে ঈমানদার মনে করে তার জানাযায় শরীক হয়ে থাকে। তাই তাকে ভাল বলতে আপত্তি কিসের? সুন্নি ওলামায়ে কেরাম ও পীর মাশায়েখগণ সমাজের মুসলমানদেরকে আল্লাহর রাসূলের নির্দেশনানুসারে চলার জন্য এ ভাল আমলগুলোর শিক্ষা দেন। পক্ষান্তরে যারা এগুলোর বিপরীত ধারণা পোষণ করেন, তারা ঈমানদার কিনা তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ ইহকালে ও পরকালে আমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল ছাড়া কোন উপায় নেই।